“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ”
পয়লা বৈশাখের সকালটাতে এই একই গানে ঠাকুরের পুজোটুকু সারে তুলি ।প্রতিবছরে একই দৃশ্য । তুলি ওর মা কেও যে এভাবেই দেখে এসেছে ! অন্যদিন যাই হোক বিশেষ কয়েকটা দিনের এই নিয়মটুকু ভাঙেনি তুলি ।এই দিনটা এমনিতেই খুব স্নিগ্ধ একটা দিন , মা সকাল সকাল উঠেই স্নান সেরে পুজোয় বসত তুলিও পাশে গিয়ে বসত মায়ের । তারপর মায়ের হাতের সেই পায়েস আজ ভুলতে পারে না তুলি । আজ বছর শুরুর সাথে সাথে তুলির জন্মদিনও । সেই থেকে ছবিটা একই থাকলেও পায়েস পর্বটা বাদ পড়ে গেছে বহুদিন । এখন সে ছাড়া আর হয়তো কেউ জানেও না যে আজ ওর জন্মদিন । নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । মা বলতো “তুলি মা আমার লক্ষী , নাহলে এমন দিনে জন্মায় !” মিথ্যে বলতো মা ,পাড়ার লোকজনই ঠিক বলে বড্ড অভাগা মেয়েটা । ”
পুজোর ঘরটার পাশেই তুলির বাবা থাকে । তাকে এখন পরিষ্কার করে খাইয়ে দিতে হবে , এরপর আসবে কম্পউণ্ডার কাকা ,খাওয়ার পরে একটা ইঞ্জেকশনটা দিতে হয় । চার মাস ধরে চেঞ্জ করে করে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু ,কোনো ইম্প্রুভ নেই । সকাল বিকেল রমেন দা এসে ফিজিওথেরাপি করে যাচ্ছে । মনে পড়লো তুলির- আজ সোমবার সাপ্তাহিক টাকা দিতে হবে রমেন দাকে, পাঁচশো করে প্রতিদিন আর কম্পউণ্ডার কাকাকে রোজের সাড়ে তিনশো , খালি ইঞ্জেকশনের দাম টুকু নেয় কাকা ।ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। আজ কাজে গিয়ে টাকা পেলে সবাইকে দিতে পারবে , রমেন দাকে একটু অনুরোধ করতে হবে ভাবতে ভাবতে বাবার ঘরে ঢুকলো তুলি ।
পরিষ্কার করে স্যুপ টুকু খাইয়ে দিল ,বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তুলির দিকে ,চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে । মুখের ঈশারায় বুঝিয়ে বললো গানটা খুব সুন্দর । তুলি বললো ” ভাল লেগেছে তোমার? ” এই বাবা ই তুলির গান নিয়ে কত আপত্তি ছিল ।কিন্তু মা ! তুলির মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়ে বড় হয়ে মস্ত গাঁইয়ে হবে । মাত্র সাড়ে তিন বছর থেকেই গান শিখতো তুলি । তুলির মা বলতো ” তুলি গান টাকে পুজো করিস মা , এটা তোর শান্তির জায়গা হোক , কিছুর বিনিময়েই একে বিক্রি করিস না । ” তখন এসবের মানে বুঝতো না তুলি কিন্তু আজ বোঝে , সবটা। বাবার সেরিব্রাল এটাক হয়ে বিছানায় প্যারালাইজড আজ দেড় বছর । রোজকার খরচ ওষুধ নিয়ে প্রায় এগারোশো টাকা । এই গানটাই সম্বল ছিল , এটা বিক্রি করা ছাড়া আর কি বা করতো তুলি ?
কম্পউণ্ডার কাকা এসে বেরিয়ে গেল ,এরপর রমেন দা আসবে ।তারপর মালতি দিদির ওপর বাবার দায়িত্ব টুকু দিয়ে রোজ দুটো তে বের তুলি , ঐসময় পাড়াটা একটু শান্ত থাকে , বেরোতে সুবিধা হয় । কিন্তু আজ পয়লা বৈশাখের বাজারে অত লেট করলে হবে না । মালতি দিদিকেও তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে ।আজ মায়ের সেই সাদা দুধে আলতায় জামদানিটা পড়লো তুলি । সবাই বলে একদম মায়ের মুখটা কেটে বসানো তুলিতে । আয়নায় ভালো করে দেখে নিজেই মনে মনে বললো “উঃ হুম: মায়ের মতো সুন্দরী সে নয় ।
রেডি হয়ে যখন বেরোলো তুলি ,রমেন দা তখনও আসেনি । মনে মনে একটু যেন খুশি হলো বছরের প্রথম দিন কাওর আশা ভাঙতে ইচ্ছে করে না । আজ রাস্তায় বড্ড ভিড়, চেনা পরিচিতরা একটু যেন অবাক হয়েই দেখছে তুলিকে । হরেন কাকা, বাবার বন্ধু তো জিজ্ঞাসা করেই বসলো ” তুলি মা তোর আজ ও ছুটি নেই ?” সবার ওকে নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই । বাবার বন্ধু অথচ এক বছরে বাবাকে কতবার দেখতে গেছে সেটা মনে করেও বলতে পারবে না , পাছে টাকা চেয়ে বসে তুলি ! তাইতো আজ আত্মীয় কমতে কমতে মালতী দিদিতে এসে ঠেকেছে ।
আজ ছুটি হয়নি ভাল, আজ দিনটা কিছু উপরি ইনকামও হতে পারে । ভাবতে ভাবতে ট্রেনে উঠে বসলো তুলি । অন্যদিন গুলো ক্যাব বুক করে যায় একটু গোপনীয়তা রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা ।
ছোটবেলা থেকেই বাবা একটু দূরত্ব রেখে চলতো তুলির সাথে । কাছে খুব একটা ঘেঁষতে দিতো না । ওটা তুলি বুঝতে পারতো না যদি না হঠাৎ বাড়িতে খুশির হাওয়া উঠতো , ঠাম্মা বলেছিল মা নাকি একটা ভাই এনে দেবে ওকে , ও খায়াবে চুল আঁচড়াবে। তুলিও যেন মনে মনে খুব মজা পেত এসব ভেবে , এমনি মেয়েরা বাচ্চাবেলা থেকেই যেন পুতুল আর রান্নাবাটি খেলায় অভ্যস্ত হয়ে যায় ।তখন তুলির বাবা তুলিকে ডেকে খুব আদর করতো এমনকি সাত বছরের জন্মদিনটাও খুব পরিষ্কার মনে পরে তুলির ,ইয়া বড় বড় গলদা চিংড়ি । জন্মদিনের দিন সাতেক পরে , একদিন সকালবেলা মায়ের খুব পেট ব্যথা ,ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসা করতে বললো সেও বুঝতে পারছে না । বাবা তখন অফিসে । সিধু জ্যেঠার গোডাউন থেকে ফোন করেছিল তুলি । বেশ অনেক্ষন মা কষ্ট পেয়েছিলো তারপর বাবা আর ঠাকুমা মাকে নিয়ে চলে গেল ,পাশের বাড়িতে তুলিকে দিয়ে । যাওয়ার আগে বাবা বলেছিলো “সাবধানে থাকিস মা,তোর ভাই আর মা কে নিয়ে আসব তাড়াতাড়ি । ” সারাটাদিন খুব খুশিতে ছিল তুলি ।খালি ভাই আসবে বলে নয়, ভাই আসার খবরে বাবা যে তুলিকে এতো ভালোবাসছে এটা ভেবেই তুলি মনে মনে ভাইকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল সেদিন ।তুলি একদিন নিজের কানে বলতে শুনেছিলো ঠাম্মাকে ” বৌরে এইবারটা ছেলে নাহলে গোপলাকে সামলানো যাবে না ।”
সেদিন আর কেউ ফিরলো না, পরের দিন বাবা আর ঠাম্মা ফিরলো মা কে ছাড়াই । বাবা কোনো কথা বলেনি সেদিন ।ঠাম্মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল তুলি “মা কোথায় ? আর ছোট্ট ভাইটা ?” ঠাম্মা বলেছিলো “ভাইটা খুব দুষ্টু তো ! তোকে যদি মারে, তাই মা ওকে নিয়ে অন্য জায়গাতে আছে একটু বড় হলে নিয়ে আসবে । ” ঠাম্মার চোখের জলটুকু সেদিন দেখেছিল তুলি কিন্তু সরল মন ওটাই বিশ্বাস করেছিল । মা র কাছে যাওয়ার অনেক বায়না করতো তুলি কিন্তু ঠিক পাস্ কাটিয়ে চলে যেত সবাই ।আর বাবাতো তুলির মুখ দেখলেই রেগে যেত । এরপর টানা একমাস ঠাম্মা তুলিকে নিয়ে নিজের বোনের বাড়ির ঘুরতে গেছিলো , সেখানেই তুলি জানতে পেরেছিলো সেদিন ভাই সত্যি হয়েছিলো কিন্তু হতে গিয়ে দুজনেই মারা গেছিলো ।এরপর থেকে তুলির আর গান নিয়ে বসতে ইচ্ছে করতো না কিন্তু ঠাম্মা জোর করতো বলতো “তুলি গান গুলো ভাল করে তুলে নে, হট করে মা একদিন এসে যখন দেখবে পারছিস না খুব বকুনি দেবে “। ঠাম্মা জানতো না যে তুলি সব জানে মা আর কোনোদিন আসবে না । কিন্তু এটা ঠাম্মা জানলে আরো কষ্ট পাবে তাই তুলিও বুঝতে দিতো না ।
শিয়ালদাহ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন নামলো ” ড্রিমল্যান্ড ” কি অপূর্ব সেজে উঠেছে ।আলোঝলমলেতে পুরো স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে আজ বার টাকে । সামনেতে আবার বাংলায় ঝোলানো “শুভ নববর্ষ “। তুলি ঢুকতে ঢুকতে ঠিক করে নিলো আজ ড্রেস চেঞ্জ করবে না , শাড়িতেই পারফরমেন্স করবে মিস প্রিয়া । এই প্রথম আজ নিজের প্রফেশনটাকে একটু যেন ভাল লাগলো তুলির । দরজাটা একটু প্রণাম করে বারের গ্রীন রুমটিতে ঢুকে গেল মিস প্রিয়া হয়ে ।একটু দেরি আছে ঠান্ডায় বসে গলায় একটা লবঙ্গ ফেললো তুলি ।
তুলির মনে পড়লো একবার ঠাকুমা খুব অসুস্থ বাবাও ঠিকঠাক অফিসে যেত না । তুলিকেই যেন সবটা সামলে রাখতে হতো । তুলির সবসময় মনে হতো কেউ ওকে বলে দিচ্ছে ওর কি কি করা উচিত ।আত্মীয় বলতে যেকজন ছিল তারা আসতো এই অবধি ।বাবা চাকরি না যাওয়ায় সংসার টাও যেন থেমে যেতে বসেছিল ।তুলি কিছু বলতেই বাবা যেন আরো হিংস্র হয়ে যেত ।ঠাম্মাই বলে কয়ে বাবাকে সিধু জেঠুর গোডাউনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তখন ।ঠাম্মা যখনি বাবাকে সংসার টানাটানি নিয়ে কিছু বলতো বাবার সব রাগ গিয়ে পড়তো তুলির গানের ওপরে । গানের স্যারকে যে টাকাটা দিতে হয় সেটা বাবা দেবে না জানিয়ে দিয়েছিলো । ঠাম্মাই নিজের সংসারের টাকা থেকে বাঁচিয়ে সেই টাকার যোগান দিতো ।হয়তো বা ঠাম্মা বুঝেছিলো যে ভবিষ্যতে সংসারটা বাঁচাতে গেলে এটা কাজে লাগবে !
মিস প্রিয়া নাম শুনেই উঠে পড়লো তুলি । শুরুতেই গাইলো
” মঙ্গল দীপ জ্বেলে/ অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু ।”
অনেকের এক্সপ্রেশনে তুলি বুঝলো আজ লোকজনের রুচিটুকু হয়তো বদলে গেছে । খুব একটা খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা হচ্ছে না ।আজ কেউ মুখের ওপর টাকাও ছুড়ে মারছে না।এটা খুব অসম্মানিত লাগে তুলির। পয়লা বৈশাখ বলেই হয়তো শ্রোতাদের চরিত্রে আভিজাত্য টুকু ফুটে উঠেছে ।” ড্রিমল্যান্ড ” থেকে বেরিয়ে আরো দুটো বারে গেয়ে গাড়িতে উঠলো তুলি , আজকাল আর তিন ঘন্টা ধরে গান গাইতে হয়না ওকে।সময় মেপে গান গায়। রিনা দি ওকে বুঝিয়েছে এখন আসতে আসতে ও প্রফেশনাল হয়ে যাচ্ছে । আজ ওকে পেমেন্টের জন্য যেতে হবে “নাইটক্লাব সিঙ্গার এসোসিয়েশনে “প্রতি সোমবার এটা করতে হয় ।প্রতিদিন সকালে উঠে টেক্সট করে জেনে নিতে হয় সেদিনকার সিডিউলটুকু, যেদিন যেতে পারে না সেটাও সকাল সকাল ইনফর্ম করতে হয় একাউন্টেন্ট রাজীব দা কে।ভাবতে ভাবতেই ঘড়ি দেখলো তুলি সাড়ে ছয়টা প্রায় বাজতে চলেছে দেখা পেলে হয় রাজীব দার, ড্রাইভার কে একটু তাড়া লাগিয়ে বাইরের দিকে দেখলো তুলি । আকাশটা থম মেরে আছে আজ , এরকম দিন ছিল যেদিন তুলির ঠাম্মা মারা গেল । কলেজ এ পড়ে তখন তুলি, কুড়ি বছর বয়স । কলেজ থেকে ফিরে গান প্রাকটিসে বসেছিল তুলি ঘন্টা তিনেক গান করতে করতে খেয়াল হলো ঠাম্মা তো একবার আসলো না , তার আগের দিন থেকে অবশ্য জ্বর ছিল ঠাম্মার ।কলেজ থেকে যখন ফিরেছিল তখন ঠাম্মা ঘুমাচ্ছিলো বলে আর ডাকেনি । খেয়াল হতে গিয়ে ডাকতেই দেখলো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছিলো ওর ঠাম্মা ।
সেদিন থেকে তুলিও ঠান্ডা হয়ে গেলো ভয়ে । মা র পর যে ওকে আগলে রাখতো সেদিন সেও ওকে একা করে চলে গেলো । রইলো বাকি বাবা সে তো জন্ম থেকেই থেকেও নেই ।তুলি বুঝেছিল এবার পড়াশুনো গান সব বন্ধ হয়ে যাবে
-সেই আশঙ্কাতেই পরপর চার পাঁচটা গানের টিউশন জুটিয়েছিলো তুলি ।
“নাইটক্লাব সিঙ্গার এসোসিয়েশনে ” গেটে ঢুকেই জানতে পারলো একাউন্টেন্ট বেরিয়ে গেছে আর পেমেন্ট হবে না । আজ টাকা না পেলে কাল থেকে রমেন দা হয়তো আর ফিজিওথেরাফি করবেই না , কান্না পেয়ে গেল তুলির । রাজীব দাকে ফোনে অনেক বোঝালো তুলি, শুধু দেখছি বলে ফোন কেটে দিলো । একটু বসে গেল সোফায় । কি করবে ? কাকে ফোন করবে ভাবতেই মনে পড়লো রিনা দিকে, এই রিনা দি ওদের হাবড়াতেই থাকে । দেড় বছর আগে যখন হঠাৎ ওর বাবার এই অবস্থা, সিধু জেঠার পায়ে পড়ে গেছিলো সেদিন তুলি । পাওনাটুকু দূরে থাক, সেই মাসের মাইনা টুকুও দেয়নি । সিধু জেঠার বক্তব্য ওর বাবা নাকি ধার করে মাঝে মাঝেই সব টাকা তুলে নিত । সংসারটা চালাতে একটা স্কুলে গিয়ে গান শেখাতে শুরু করেছিল তুলি । কিন্তু ট্রিটমেন্ট? প্রতিদিন সব নিয়ে হাজার এগারশো টাকা খরচ, তখন এই রিনা দি ওকে এখানে এনেছিল । প্রথম প্রথম খুব কান্না পেত তুলির ।মায়ের মুখটা মনে পড়ত । একদিন যেন স্বপ্নে মা ই বললো “তুই কোনো অন্যায় করছিস না মা , বাবার জন্য করছিস , আমি পাশে আছি তোর ।” সেদিন তুলিও মা কে বলেছিলো “মা ওরা খুব বাজে ভাবে যেন তাকায় আমার দিকে ।” মা হেসে বললো “আমার মেয়ের গায়ে হাত দিক না , হাত কুপিয়ে দেব ।” সেদিন খিলখিল করে হেসেছিলো স্বপ্নে মা আর তুলি । যেমনটি ছোটবেলায় হাসতো ।
আকাশ পাতাল ভাবতে বসলো তুলি ।রিসেপশনে সমীরণ দা বলল ” তুমি আজ চলে যাও , কাল পেমেন্ট পেয়ে যাবে ।এঁরা ভাল , পেমেন্ট কখনও মারবে না ।”আজ আর আশা নেই ভেবে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়া । বাস , ট্রেন ধরে শেয়ালদায় এসে যেন পা আর চলছে না তুলির । কিভাবে কালকের ট্রিটমেন্ট করবে ভেবেই পাচ্ছে না তুলি । ফাঁকা ট্রেনে উঠে একরকম কাঁদতেই লাগলো মনে মনে বলল “মা গো কি করবো বলে দাও ! দিশেহারা লাগছে,ঘরে চালটুকুও নেই যে , ” ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো খেয়াল নেই তুলির ।
ঘুম ভেঙে স্টেশনে নেমে আজ আর রিক্সা নিলো না। ওই টাকায় রাতের চাল টুকু হয়ে যাবে ভেবে হেঁটেই গলির সামনে আসতেই দেখলো গলির মুখে সিঁধু জ্যেঠা ।এঁনাকে দেখে আজকাল মুখ ঘুরিয়েই নেয় তুলি ।
“তুলি মা একটু দাঁড়া , তোর কাছেই গেছিলাম ।”পেছন থেকে ডাকলো সিধু জ্যাঠা।
অসহ্য লাগছে তুলির ,কাওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারেনা এটাই ওর দোষ।
“হুমম ” বলে দাঁড়িয়ে গেল । পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে হাতে দিলো তুলির, বললো ” বয়স হয়েছে রে। ব্যবসাটাও গুটিয়ে নিচ্ছি । সবার সব টাকাও দিয়ে দিয়েছি ।তোর বাবার টাকাটা না দিলে মরেও শান্তি পাবো না মা রে।”
তুলি দেখলো হাজার পাঁচেক টাকা আছে । জেঠুর হাত ধরে কেঁদে দিল তুলি বললো ” জেঠু তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে। আজ অফিস পেমেন্ট দেয়নি । কাল বাবার ট্রিটমেন্ট কিভাবে করবো জানতাম না ।”
সিধু জ্যাঠা : “আর ভালো হবে নারে তোর বাবা , সেও তো তোকে সহ্য করতে পারতো না , তুই আর টাকা নষ্ট করিস না । এবার নিজের কথা ভাব ।”
তুলি : “জেঠু তাও যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষন আঁশ।বাবা আছে বলেই আজ আমার বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে । এসে রান্না করতে ইচ্ছে হয় , বাবার জন্যই আমি নিজের অস্তিত্বটুকু টের পাই ।নাহলে আজ কার জন্য বাড়ি ফিরতাম ?”
জ্যাঠা ও কেঁদে ফেললো বললো: “মা রে আমায় ক্ষমা করিস । তোর ঠাম্মা ঠিক বলতো তুই খুব লক্ষী ।শুধু তোর বাবাই তোকে চিনলো না ।”
সিধু জ্যাঠা চলে গেল ,তুলির খুব মায়া লাগলো পিছন থেকে দেখে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার তুলি ,বললো মনে মনে -“মা তুমি সত্যি আছো ।এভাবেই পাশে থেকো মা ।আমার সোনা মা ,খুব ভালোবাসি তোমায় । তোমার দেখানো পথেই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখবো । জানো মা বারে সবাই আমার দিকে নোংরা দৃষ্টিতে দেখে,ভাবে আমি বাজে মেয়ে।কিন্তু বাবার মুখটা দেখলেই আমার আর কিছু খারাপ লাগে না ।বারে গান নাচ করা মেয়েদের সবাই এঁড়িয়ে চলে ।কিন্ত কেউ জানেনা বারে গান করা মানেই নোংরা না।ওর পিছনে অনেকের অনেক দুঃখ লুকিয়ে থাকতে পারে ।
সবাই বলে বাবা আমায় সহ্য করতে পারে না কিন্ত আমি ? তুমিইতো শিখিয়েছ কাউকে ঘৃণা করতে নেই,জলে ঝাপসা হয়ে গেল তুলির চোখদুটো। কান্নাটাকে আটকালো না তুলি , মনটা খুব ভার সকাল থেকে একটু কান্নার দরকার আছে, থম মারা আকাশটারও হয়তো তাই মনে হয়েছিল , সেও জলটুকু ফেলে হালকা হতে চাইলো । বৃষ্টি ভিজতে বড় ভালোবাসে তুলি , মিস প্রিয়া হওয়ার পর থেকে এসব ইচ্ছে থেকে দূরে রাখে নিজেকে পাছে ঠান্ডা লেগে যায় ! কিন্ত আজ ভিজলো , খুব করে ভিজলো , শরীরের ক্লান্তিটুকু দূর হতেই মনে পড়লো তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবাকে এক্ষুনি না খাইয়ে দিলে রাতের ওষুধ দিতে দেরি হবে ।পা চালাতে থাকলো , শুধু রাতের এই অন্ধকার আর বৃষ্টি টুকুই সাক্ষী থেকে গেলো মায়ের ছোট্ট তুলি থেকে মিস প্রিয়া হওয়ার মুহূর্ত টুকুর ।