(মহান সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার এই ছোট্টো নিবেদন। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো।
জন্ম—দুই মে
মৃত্যু—তেইশ এপ্রিল
@রাণুদির ক্যুইল)
পাঠক আর লেখক সম্পর্কটা অনেকটা চক্রের মতো, সেই ছোটোবেলায় পড়ানো হয় না!! ঋতুচক্র, জলচক্র, খাদ্যচক্র, বায়ুচক্র, শিলাচক্র— ঠিক সেরকমই এই সাহিত্যচক্রে আবর্তিত হন লেখককুল আর পাঠককুল। একজন ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ,
এর একটি নির্ভেজাল উদাহরণ, অরণ্য গুপ্ত। ওর এই নাম ও পদবী একসাথে করে ওকে অনেকেই “গুপ্তারণ্য” বলে ডাকে, তাতে অবশ্য ও রাগটাগ করেনা। ও বরং নামটার মধ্যে বেশ ঐতিহাসিক গন্ধ পায়।
ব্যাঙ্ক ছুটির পর কোলকাতা থেকে রাজচন্দ্রপুরের বাড়িতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় অরণ্যর। বাড়িতে ফিরে একটু বই নিয়ে না বসলে ‘যেন দিনটা ঠিক —শেষ হলোনা’— বলে মনে হয়।
সত্যজিৎ রায়ের খুব ভক্ত ও। প্রতিটি গল্প প্রায় কণ্ঠস্থ। তাই সবকিছুতেই ও মহামান্য রায়বাবুর গল্পের সাথে মিল খোঁজে।
রোজকার মতো আজও সাড়ে আটটার ডানকুনি লোকালে বাড়ি ফিরছিলো। রোজই শ্রীবিষ্ণু মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে মিষ্টি কিনে ফেরে।আর সেখানেই রোজ দেখতে পায় ছেলেটাকে, —কালো কুচকুচে রোগা চেহারা, গোল-গলা গেঞ্জি, পুরোনো জিনস্-এর প্যান্ট, চোখে সস্তার চশমা, কব্জিতে সস্তার ঘড়ি। ও রোজই অরণ্যকে দেখে হাসে, আর তাতেই ওর চোখে পড়ে একটা দাঁতে কালো ছোপ। ছেলেটার নাম আবার রাজা। রোজই ছেলেটা হেসে বলে,
——-একটা মিষ্টি খাওয়ান না কাকু—-
অরণ্য কখনও সখনও কিনে দেয়, কখনও গম্ভীর হয়ে চলে আসে। ছেলেটা নির্লজ্জের মতো হাসে…
কিন্তু আজ দিন তিনেক হলো রাজাকে দেখতে পাচ্ছেনা। তিনদিন আগে অনেক রাতে ওকে ওর বাড়ির আশেপাশে একঝলক দেখেছিলো যেন। আজও দেখতে না পেয়ে দোকানদার দুলালবাবুকে জিগেস করলো,
———রাজাকে দেখছিনা?
উনি হাত উল্টে বললেন,
——–কে জানে!!আপনাকে বড্ডো বিরক্ত করে।
মিষ্টির দোকান থেকে বাঁদিকে বেঁকে পনের/কুড়ি হাত হাঁটলেই অরণ্যর বাড়ি। সামনে একটা বটগাছ আছে, তলায় একটা বেদিও। আজ দেখলো ঐ বেদিতে একটা লোক বসে রয়েছে।না না লোক বলা যাবেনা, জটাজুটধারী সাধু। আর সঙ্গে একটা কালো কুচকুচে বেড়াল।
সাধুর সঙ্গে বেড়ালটা কেমন যেন বেমানান। সে মুখ নিচু করে বসে আছে। ওর মনে হলো বেড়ালটা সো-ও-জা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সবুজ চোখে যতোরাজ্যের রহস্য। মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠলো অরণ্যর।
এরপর থেকে রোজ রাতে দেখতে পায় ঐ সাধু আর তার বেড়ালকে। সকালে ওরা কোথায় থাকে কে জানে, কি যেন একটা রহস্য আছে। ওর বাড়িটা বেশ ফাঁকা অঞ্চলে। ফিরতেও রাত হয় ভালোই। কালো বেড়ালটাকে দেখলে গা কেমন যেন শিরশির করে—–
প্রায় দিনপাঁচেক পরর কথা।
সেদিন ফেরার সময় ওদের দেখতে পেলোনা অরণ্য। অথচ ভেবেছিলো, আজ সাধুবাবার সাথে আলাপ করবে, অফিসের একটা ঘটনায় খুব বিব্রত বোধ করছে, মনটা অশান্ত। মিষ্টি কিনে বাড়ির দিকে এগোলো।
বাগানের গেটে ঢুকতেই গা টা কেমন ছমছম্ করে উঠলো। কে যেন পেয়ারা গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে না !! বাগানের সামনের লাইট পোস্টের আলোটাও আজ জ্বলেনি। একটা মোটোর সাইকেল চলে যেতেই মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে দুটো সবুজ আলো জ্বলে উঠলো যেন। অরণ্য বুঝলো কারা রয়েছে সেখানে। ওর পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেল।
গাছের তলার ছায়ামূর্তিটা এবার নড়েচড়ে উঠলো। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো। আবছা আলোয় বুঝতে পারলো সেই সাধুবাবা। কোলে সেই কালো বেড়ালটা। জটাজুটধারী লম্বা মেদহীন চেহারা, বেড়ালের মতোই যেন ওর চোখদুটোও জ্বলছে। বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
—–ইয়ে আপকা ঘর হ্যায়?
গলাটা কেঁপে গেলো অরণ্যর,
——হ্যাঁ, মানে জী হাঁ কিঁউ ?
—–আকেলে হো?
——হ্যাঁ
—–বিকাশ গুপ্তা সাহিব?
—–আমার বাবা
——উয়ো?
—–নেহি হ্যায়, প্রায় সাত বছর হলো–
——- আভি আপ হি হো?
—–হ্যাঁ ! কিন্তু এসব কিঁউ—-নেহি সমঝা– বাবাকে কিভাবে চিনতা হ্যায়?
——ম্যায়নে ইস মকান পর কাম কিয়েথে
——মানে? –অবাক অরণ্য–
একটু যেন হাসলো সাধুবাবা–
——অন্দর আউঁ?
অরণ্য যেন নিরুপায়—–এমনভাবে বললো,
—— আসুন
ঘরে আলোটা জ্বালামাত্রই চমকে দুইপা পেছিয়ে এলো,—এ কাকে দেখছে ও! ঠিক যেন, —ঠিক যেন ইমলি বাবা!— সেই জ্বলন্ত চোখ, —লম্বাচেহারা —-চুল গুলো উঁচু করে বাঁধা। বুক অবধি নেমে এসেছে দাড়ি, আঙুলে বড়ো বড়ো নখ—বাঁকানো।
বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো সাধুবাবা।
অরণ্যর কেমন অস্বস্তি লাগছে, অন্য ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় পাল্টে একটু চোখেমুখে জল দিয়ে এলো।
এসে দেখলো, সাধুবাবা সোফায় নেই,
—কোথায় গেল রে বাবা !!
অরণ্য সারাবাড়ি ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়ালো, কিন্তু কোথ্থাও চিহ্ন নেই। ও যেন এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো! বাইরের দরজাটা বন্ধকরে দেওয়ার পর যেন আরো নিঃশব্দ হয়ে গেলো বাড়িটা। বাগানের গাছগুলোর স্বাভাবিক নড়াচড়াও ভৌতিক লাগছে—–
অস্বস্তি কাটাতে টিভি চালালো অরণ্য। একটা ইংরেজি সিনেমা হচ্ছে, অতিকায় যন্ত্রদানব, হলুদ-কালো শরীর নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অরণ্যর মন ছিলনা ওতে, ভাবছিলো,
—-সাধুবাবার উদ্দেশ্যটা কি!! ও একা থাকে– সারাদিন অফিসে,—কোনো বদ মতলব-টতলব—
রাতের খওয়া শেষ করে অরণ্য যখন শুতে গেল, তখন রাত এগারটা চল্লিশ। আজ বিছানার চাদর পাল্টে দিয়ে গেছে সাবিত্রীমাসি। খুব আরাম বোধ করলো ও। দেখতে দেখতে ঘুমে জুড়ে আসে চোখ।
স্বপ্নেও সাধুবাবা সঙ্গ দিচ্ছিল ওকে, ও দেখলো, বেড়ালটা সাধুর কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে ওদের বাড়িতে ঢুকে অরণ্যর দিকে তাকিয়ে,—-ম্যাঁ—এ্যাঁ—এ্যাঁ—ওঁ–করে একটা কর্কশ ডাক ছাড়লো।
ঐ ডাকেই বোধহয় ঘুমটা ভেঙে গেল, ডাকটা যেন কানে বাজছে এখনও। “কালো বেড়াল” ব্যাপারটাকে সুনজরে দেখা যায় না ঠিক। অরণ্য উঠে জল খেল, খোলা জানলার কাছ দাঁড়াবে একটু। উঠে জানলার পর্দাটা সরাতেই জলন্ত দুটো সবুজ আলোর বিন্দু চোখে পড়লো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ম্যাঁ–এ্যাঁ-এ্যাঁ–ওঁ শব্দটটাও চমকে দিলো ভীষণভাবে।
রাতের পরিবেশে কালো কুচকুচে বেড়ালটাকে সাক্ষাৎ শয়তানের দূত মনে হচ্ছিল। অরণ্য জানলা থেকে সরে এলো। কেমন ভয়ের ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে । কি উদ্দেশ্য সাধুবাবার? বেড়ালটাকে রেখে গেল কেন? সে রাতে আর ঘুম হলোনা অরণ্যর। সারারাত যেন কার খসখস শব্দ —–
ভোরবেলা যখন বিছানা ছাড়লো, তখন মাথাটা বেশ ভারী। স্নান সেরে একটু সুস্থ হলো।
অফিসে কাজে মন দিতে পারলোনা আজ। কেমন একটা আতঙ্ক যেন ঘিরে আছে মনটা,—-অফিস থেকে ফিরে এলো একটু তাড়াতাড়ি।
সেদিনও গাছের তলার বদলে বাগানে দেখতে পেলো ইমলিবাবাকে। আজ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বললো,
—–কাল হঠাৎ চলে গেলেন কেন?
ইমলিবাবা সেকথার উত্তর না দিয়ে বললো,
——-ম্যাঁয় ভুখা হুঁ—কুছ খানা—
অরণ্য সেদিন যত্ন করেই খাইয়েছিল ওকে। বেড়ালটাকেও। খাওয়ার সময় বেড়ালটা একটা মৃদু —ম্যাও— করতেই, অরণ্যর চোখে পড়লো, একটা দাঁতে কালো ছোপ। কেঁপে উঠলো অরণ্য। বেড়ালের দাঁতে ছোপ? আশ্চর্য্য!! আশ্চর্য্য!!আরোও একবার বাকসিদ্ধঋষির কথা মনে পড়লো,—ইমলিবাবা—-
———ম্যায় কুছ বাতানা চাহতা হুঁ——
ওর কথায় ছেদ পড়লো চিন্তায়।
এরপর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ইমলিবাবা, শোনালো তার কথা—–
ওর নাম রামদীন, ধানবাদ অঞ্চলের মানুষ। অনেক কষ্টে রামদীন এক ইঞ্জিনিয়ারের এসিস্টেন্টের কাজ জুটিয়ে বাংলায় এসেছিল।আর অরণ্যদের বাড়ির কাজের দায়িত্ব ছিল ওই ইঞ্জিনিয়ারের। খুব মন দিয়ে কাজটা শিখছিল সে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী ওর সাথে অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করতো। রামদীনও চেষ্টা করতো কি করে ওদের জব্দ করা যায়, একদিন সে সুযোগ জুটে গেল।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী হীরের লকেটটা খুলে রেখেছিলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর। রামদীন দেখতে পায় ওটা। বেশ বড়ো সাইজ, নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে, ওকে আর চাকরের মতো থাকতে হবে না।
ওটা নিয়ে সোজা চলে আসে অরণ্যদের বাড়িতে, অসম্পূর্ণ বাড়িটার চারিদিকে তখন ইঁট,রড, বস্তা, কোদাল, নানারকম জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অন্ধকারে বাউন্ডারি ওয়ালের এক কোনে পুঁতে ফেলে লকেটটা।
যথারীতি পুলিশ তাকে ধরে এবং বহু অত্যাচারেও স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তখন তার মথায় আঘাতের চোটে স্মৃতিশক্তি বেশ এলোমেলো।
—— এর পরের কথা রামদীন শুনেছিল এক সাধুবাবার কাছে । ওকে রেল লাইনের ধার থেকে উদ্ধার করে এনে সারিয়ে তোলে সে। উড়িষ্যার এক পাহাড়ে। সেখানেই ছিল এতোদিন। অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে তার কৃপায়।
এই বেড়ালটাকে সে অরণ্যর বাড়িতে রেখে গিয়েছিল জিনিসটা খোঁজার জন্য। ও হদিস দিয়েছে, তবে এখনও পায়নি হীরেটা। অরণ্যকে এসব কথা বলছে, কারণ, ওটা খুঁজতে সাহায্য দরকার,
বড়ো বড়ো বাঁকানো নখ ওয়ালা একটা আঙুল তুলে বললো,
—-আগর বিসোয়াসঘাত কিয়া তো—–
সফেদ বিল্লি ভী মুঝে নাপসন্দ নেহি ——-
বলে বীরদর্পে রেরিয়ে গেল।
অরণ্যর বুকটা কেমন খালি হয়ে গেল, বুঝতে পারলোনা কি করা উচিৎ, পুলিশকে বলা কি নিরাপদ? নাকি সাহায্য করবে হীরেটা খুঁজে পেতে? লোকটা পাগল বলে তো মবনে হয়না। কিন্তু কতোদিন এইভাবে চলতে পারে? ভাবতে ভাবতে ও যখন দিশেহারা তখনই খবর পেলো, সাধুবাবাকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এলাকায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল বলে, অনেকেই অভিযোগ করেছিল। যাকবাবা নিশ্চিন্ত।
বেশ কয়েকদিন পর অরণ্য আজ নিশ্চিন্তে খেলো, ঘুমিয়েও পড়লো। খসখসে একটা মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাতে। প্রথমটা কিছু দেখতে পেলনা। মাথার দিকের জানলায় চোখ যেতেই দেখলো, দুটো জ্বলন্ত সবুজ চোখ ওর দিকে একদূষ্টে চেয়ে আছে।
দেখে হাড় হিম হয়ে গেল অরণ্যর। ও বুঝলো, ইমলিবাবা আবার ফিরবে——ওর নিস্তার নেই—-
——নিস্তার নেই—-
সমাপ্ত