”দিনে কমপক্ষে আধঘন্টা করে না হাঁটলে আপনার স্বামী দেবব্রতর ব্লাড সুগারের পরিমাণ কিছুতেই কমবে না। সঙ্গে অন্য নানান রোগের উপসর্গও কিন্তু শুরু হয়ে যাবে। ”
ডাক্তার চক্রবর্তীর কাছ থেকে শোনা এই কথাগুলো বারবার ভেবে বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে অদিতির। যা একবগ্গা মানুষ দেবব্রত – বেলা আটটার আগে টেনে-হিঁচড়ে কোনোওদিনই তাকে বিছানা থেকে তুলতেই পারবেনা! আজ দশ বছর হল অদিতি নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে বেরোয়। কিন্তু ,একটা দিনের জন্যও দেবব্রত কে সঙ্গে নিতে পারেনি ও। ভোরে বিছানা ছেড়ে হাঁটতে বেরোনোর কথা ভাবলেই নাকি দেবব্রতর মনে হয় – হার্ট অ্যাটাক করে ও রাস্তায় পড়ে যাবে। ভোর বেলার অপরূপ সুখনিদ্রার মত আনন্দের জিনিস নাকি পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
তাহলে উপায়? মানুষটাকে তো বাঁচাতেই হবে! ভোরে হাঁটার অভ্যেস না করলে তো খুব মুশকিল। ব্যস্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দেবব্রত। রাতেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ন’টা সাড়ে নটা বেজে যায়। সুতরাং রাত্রি বেলাও যে হাঁটতে বেরোবে সে সে উপায়ও তো নেই। ছেলে একবার পরামর্শ দিয়েছিল ট্রেডমিলে হাঁটার কথা। কিন্তু দেবব্রত শুনে অবধি
– “এক চুল এদিক ওদিক হয়ে গেলে এই বয়সে পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যাব ” বলে-টলে এমন যুক্তি দিতে শুরু করলো যে ওই প্রস্তাবটাও সঙ্গে সঙ্গে নাকচ হয়ে গেল। তাহলে উপায়? ডাক্তারের পরামর্শমতো চলতে গেলে তো দেবব্রতকে রোজ সকালে হাঁটতে বেরোতেই হবে। ছেলে মেয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত- ‘ওই জবরদস্ত উপায়টা’ বের করলো অদিতি।
ছেলে দেবর্ষি ফেসবুকে একটা ফেক -প্রোফাইল তৈরি করে তাতে একটি কমবয়সী ছেলের ছবি লাগিয়ে ‘ প্রেমিক পাখি’ নাম নিয়ে অদিতিকে ফ্রেন্ড -রিকোয়েস্ট পাঠায়। প্ল্যান অনুযায়ী – অদিতি রিকোয়েস্টটা একসেপ্ট করে। আর তারপর থেকে দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ভুলে অদিতি চ্যাট করতে শুরু করে ওই ‘প্রেমিক – পাখি’ ওরফে নিজের ছেলে দেবর্ষির সাথে। মেয়ে অনন্যা একটা অচেনা নম্বর থেকে অদিতিকে বারবার ফোন করতে থাকে । যথারীতি অদিতি দেবব্রতকে শুনিয়ে শুনিয়ে অত্যন্ত আবেগঘন রোমান্টিক কণ্ঠস্বরে -‘ প্রেমিক পাখি, প্রেমিক পাখি’ বলে সমানে কথা চালিয়ে যেতে থাকে!
দিন সাতেক পর থেকে ব্যাপারটা দেবব্রত নজর করতে শুরু করে।
প্রথমে জিনিসটাকে গুরুত্বই দেয়নি দেবব্রত। তেইশ বছরের বিবাহিত স্ত্রী – দুই প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের মা নিষ্ঠাবতী, ধার্মিক সংসার অন্তপ্রাণ অদিতির যে এমন পদস্খলন হতে পারে ব্যাপারটা ভাবতেই পারেনি দেবব্রত! কিন্তু ধীরে ধীরে রাত জেগে ফেসবুকে চ্যাট করা আর ফোন এলেই কেমন ব্যস্ত -সমস্ত হয়ে অন্য ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কথা বলার ব্যাপারটা এতটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেল অদিতি যে দেবব্রতর চিন্তায় পাগল পাগল অবস্থা হয়ে গেল।
শেষ অস্ত্রটা কিন্তু সাংঘাতিক ছিল অদিতির! বুদ্ধিটা অবশ্যই ছিল মেয়ে অনন্যার। রাত দুটোর সময় ফোনটা করেছিল অনন্যা অদিতির ফোনে। অদিতি যথারীতি দেবব্রতর পাশে শুয়ে শুয়েই ফিসফিস করে ফোনের ওপ্রান্তকে জানান দিল যে আগে থেকে তৈরি করা প্ল্যান অনুযায়ী ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকে অদিতি দেখা করবে -‘প্রেমিক পাখি’র সাথে। পুরো ব্যাপারটাই ঘুমের ভান করে চুপচাপ শুনে গেল দেবব্রত।
পরেরদিন ভোরে অদিতির সীমাহীন উত্তেজনা! প্ল্যানটা কাজ করবে তো ঠিকঠাক?
অদিতি যথারীতি মর্নিংওয়াকে হাঁটতে বেরিয়ে গেল। আর অদিতিকে অনুসরণ করতে করতে জীবনে প্রথমবার দেবব্রতও বেরোলো ভোর বেলার আয়েশী সুখনিদ্রাকে পরিত্যাগ করে ‘মর্নিং ওয়াকে’ হাঁটতে। অদিতির প্রেমিক ‘ প্রেমিক পাখি’কে হাতেনাতে ধরে ফেলে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য। ঘড়ি ধরে পাক্কা আধঘন্টা হাঁটলো অদিতি। যথারীতি অদিতিকে অনুসরণ করতে করতে দেবব্রতও।
এই ফোন কল আর ফেসবুকের ব্যাপারটা আরো মাস দুয়েক চালালো অদিতি, অনন্যা আর দেবর্ষি মিলে। আর স্ত্রীকে অনুসরণ করতে করতে এই দু মাসে দেবব্রতর কিন্তু ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াকে হাঁটতে যাবার অভ্যাসটা তৈরী হয়ে গেল।
ডাক্তার চক্রবর্তীর কাছে রুটিন চেকআপএ গিয়ে দেখা গেল – দেবব্রতর ওজন এবং ব্লাড সুগার লেভেল অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে আগের চেয়ে।
ডাক্তারবাবু তো অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত। বারবার দেবব্রতকে বললেন যে ওনার পরামর্শ মেনে দেবব্রত যে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছে – সেটা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং কোনোও অবস্থাতেই যেন এটিকে না পরিত্যাগ করে দেবব্রত। ডাক্তারবাবু এও বলেন যে – ওজন কমে গিয়ে দেবব্রতর চোখেমুখে বয়সের ছাপ যেন অনেকটাই কমে গেছে।
দেবর্ষি আর অনন্যার কাজ এখন অনেক কমে গেছে। যখন তখন ফেসবুকে চ্যাট করতে হয় না বা ফোন করে মায়ের সাথে হাবিজাবি বকতেও হয় না। বাবা এখন নিয়ম করে মর্নিং ওয়াকে হাঁটতে বেরোয় যে।
তেইশ বছরের পুরনো স্ত্রীকে নিয়ে ভোরের নির্মল আকাশ -বাতাসের আনন্দ অনুভব করে হাঁটতে হাঁটতে দেবব্রতর বারবার মনে হয় – এই প্রাতঃভ্রমণ ব্যাপারটা আরো আগে যে কেন শুরু করেননি…!
অদিতি এখন খুব খুশি। স্বামীর শরীরচর্চার ব্যাপারটা তো হচ্ছেই – তার সঙ্গে এ কথাটা ভেবেও খুব আনন্দ হয় যে এতদিন যে মানুষটাকে রসকষহীন ভেবে এসেছে আদিতি, সে মানুষটা কিন্তু ওর ব্যাপারে এখনো বিয়ের এতগুলো বছর পরেও অত্যন্ত সচেতন!
ভোরের ‘ভোরাই’ এমন ভাবেই ভ’রে রাখুক এমনই আরো অনেক অনেক অদিতি আর দেবব্রতর জীবন সায়াহ্নের মোহনার দিকে ক্রমশ ধাবমান দাম্পত্যকে…!
সমাপ্ত