শহরের দক্ষিণে, লোকালয়ের থেকে বেশ কিছুটা দূরে তিরতির করে বয়ে চলা এক ক্ষীনকটি জোড়ের ধারেই ডাকাত কালীর শ্মশান। শ্মশানের স্বকীয় নির্জনতা, লোকমুখে প্রচলিত অতীতকালে ডাকাতদের কল্পকাহিনী আর আধাভৌতিক গল্পগাথা শ্মশানভূমিকে সাধারনত লোকসমাগম থেকে দূরে রাখে। মাঝে মাঝে মৃতদেহ এলে মানুষের পদচারনায়, ধূপ-ধূনো-ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধে সাময়িক ভাবে মুখর হয়ে ওঠে। সৎকার শেষে শ্মশান-বন্ধুরা ফিরতি পথে কুল বা বাবলা কাঁটা ডিঙ্গিয়ে শহরমুখী হলে আবার নির্জনতার গ্রাসে নিমজ্জিত হয় দাহক্ষেত্র।
ডাকাতকালীর শ্মশান – নামটা এখনো বিদ্যমান। যদিও ডাকাতদের অস্তিত্ব এখন আর নেই।ডাকাতদের তৈরী মূল কালীমন্দির বা দেবীর দেউল কালের নিয়মে ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়েছে বহুকাল। কিছু মানুষের উদ্যোগে ভাঙ্গা দেউলের থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পাকা রাস্তার কাছাকাছি একটি ছোটখাটো মন্দিরে দেবীমূর্তিকে পুনরায় স্থাপন করা হলেও, নিত্য পূজার কোন ব্যবস্থা করা যায়নি উপযুক্ত পূজারীর অভাবে। কেবলমাত্র অমাবস্যা আর বিশেষ বিশেষ তিথিতে দেবীমূর্তিতে অর্পিত হয় রক্ত জবার মালা।
এহেন এক শ্মশান ভূমিতে হঠাৎ উদয় ঘটে এক মাঝ বয়সী মানুষের। জাগতিক নামকরণে আমরা তাকে সংসারী নামেই চিনি। সংসারের গোলক ধাঁধায় নাস্তানাবুদ সংসারীর মনভূমি আজ খুবই চঞ্চল। তা না হলে, সাধারনত কেউ শ্মশান ভূমিতে শান্তির খোঁজে হাজির হয় না। দু চার দিন আগে দাহ করা চিতার অবশিষ্ট পোঁড়া কাঠ আর ছাইভস্ম দেখে সংসারীর মনে এখন প্রকৃতই শ্মশান বৈরাগ্য। নতুন মন্দির চাতালে বসে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলেও তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সংসারের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা মানুষের মন কখনো কখনো এতটাই উদাসীন হয়ে যায়, সংসারী তার জীবন্ত প্রতিফলন।
চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় মন্দির চাতালে বসে থাকা সংসারীর চোখ যায় ভগ্নস্তূপ দেউলের দিকে। লোকমুখে সংসারীও শুনেছে দেউলটির অতীত। ডাকাতরা নির্মাণ করেছিল। ডাকাতি করে আনা টাকাকড়ি সোনাদানা রাখতো দেবীমূর্তির পায়ে। জনশ্রুতি অনুযায়ী এখনো অনেক দূর্মূল্য সম্পদ চাপা পড়ে আছে ভগ্নস্তূপের নিচে। মতিভ্রম না অভাবের তাড়না, ঠিক জানি না, সংসারী ঝোঁকের বশে এগিয়ে গেল ভাঙ্গামন্দিরের দিকে। বিবশ মন, কি জানি, কোন আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল হয়ে ওঠে।
ভাঙ্গা দেউলের সিঁড়িতে পা রাখতেই সংসারী মুখোমুখি হয় এক অতিপ্রাকৃতীয় ঘটনার। দুচোখের সামনে দ্রুত পট পরিবর্তীত হয়। একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সংসারী।। কোথায় ইট কাঠ পাথরের ধ্বংস স্তূপ? এতো সেই ডাকাতদের তৈরী করা মন্দির। অক্ষত। চতুর্দশীর চাঁদের আলো খিলানের গায়ে এসে পড়েছে। আলো আধাঁরের নক্সায় রহস্য পুরীর মতো লাগছে নাটমন্দির থেকে গর্ভগৃহ। সামনের বেদীর উপর দাঁড়িয়ে মুণ্ডমালিনী। সংসারীর হাত পা অবশ হয়ে আসে। কিছু বুঝতে পারার আগে সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।
— “প্রাণের ভয় নেই? কি জন্য এখানে এসেছিস ?” বজ্র কঠিন কন্ঠ স্বরে সংসারীর কর্ণমূলে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন।
— “না, মা..নে,….”, কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলার চেষ্টা করে সংসারী।
— “বুঝেছি, টাকাকড়ির লোভে এসেছিস।”
— “আমি খুবই গরীব, সংসারের বোঝা আর টানতে পারছি না।” অস্ফূট স্বরে সংসারী কোনক্রমে বলে তার বর্তমান করুণ ইতিহাস।
একটা অট্টহাসিতে ভরে গেল মন্দির প্রাঙ্গণ। সংসারীর দু-পায়ে যেন মাটিতে প্রথিত বটবৃক্ষের শিকড়। চলচ্ছক্তিহীন। চারপাশের গুপ্তকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো সোনাদানা, বের হয়ে এলো সোনার মোহর। অদৃশ্য কোন এক শক্তির প্রভাবে শূন্যে ভাসছে।
— “নে, যতো পারিস নে,…. প্রাণ ভরে নে,….. মন ভরে নে।……..”, অট্টহাসির সাথে সাথে মোহর, সোনাদানা সংসারীর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। লোভাতুর মন দুহাত বাড়াতে চায়। কিন্তু হায়, সংসারীর হাত দুটোও কে যেন আটকে রেখেছে। শত চেষ্টাতেও হাত বাড়িয়ে একটা মোহরও নিতে পারছে না, সংসারী। দু কানের পর্দায় অট্টহাসির অনুরণন। –” নে… কত নিবি… নে… নিবি… না?… নে…. কত… নিবি…. নিয়ে যা…. নে….. নিবি…. না…….”।
পরদিন সকালে সংসারীর ঘুৃম ভাঙ্গলো ভাঙ্গা দেউলের ভগ্নস্তূপে। কোথায় সেই মন্দির? কোথায় সেই দেবীমূর্তি? বহুচেষ্টাতেও গত সন্ধ্যার কোন ঘটনাই মনে করতে পারছে না সে। চারদিকে ভগ্নাবশেষ। হঠাৎ শুনতে পায়, দূর থেকে হরিধ্বনি ভেসে আসছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রাস্তায় আসে সংসারী। একটা মৃতদেহ নিয়ে শবযাত্রীর দল এগিয়ে আসছে শ্মশানের দিকে।
খইয়ের সাথে ছড়ানো অনেকগুলো খুচরো কয়েন কুড়িয়ে পেল সংসারী। কয়েনগুলো গুনতে গুনতে বাড়ির পথ ধরে।
সমাপ্ত