তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে বাজারের থলেটা নামিয়ে রেখে ভাতের জল চড়ায় বিদিশা। যা ভীড় বাজারে, সব জিনিষের যেন আগুন দাম। পুরো বাজার দু চক্কর মেরে তবে বাজার করতে হয় তার।
একটা বেসরকারী হাসপাতালের সাথে অনেকদিন ধরেই যুক্ত বিদিশা। ১৬ নং ঘরের সামনে একটা কাঠের টুলের ওপর বসে থাকে সে। যেদিন যেমন ডাক্তার বসে সেদিন তেমন নাম লিখতে হয় তাকে। তারপর সিরিয়াল দেখে নাম ডেকে পেশেন্টকে ভিতরে পাঠায় সে।
এই কাজটা পেতে তাকে কম হেনস্তা হতে হয়নি, তবু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তো….
সে যাই হোক চাকরীটা পাওয়ার পর যেন বাবা, ভাই,ভাইয়ের বউয়ের সংসারে সে তিষ্ঠোতে পেরেছে।
স্নান সেরে এসে দেখে হাঁড়ির জল টগবগিয়ে ফুটছে, অন্যদিন নমিতা ভেজানো চাল টা আবার একবার ভালো করে ধুয়ে হাঁড়িতে ছেড়ে দেয়। আজ আবার কোথায় গেলো, ভাতের চাল ছেড়ে গ্যাস কমিয়ে কোনমতে পূজোটা সেরে ফেলে।
রান্নাঘরে এসে দেখে নমিতা বাজারের থলে থেকে আনাজ গুলো মেঝেতে ঢেলেছে। তাকে ঢুকতে দেখে বললো- এ কি দিদি মাছ আনো নি?
-না রে কাল তো শনিবার, নিরামিষ খাওয়া, আজ রুই বা কাতলা নিলে বেশী হয়ে যেতো, ছোট মাছ দেখলাম কিন্তু দামে পোষালোনা, তাই আনিনি। ডিম খেলে ডিম রান্না করতে পারি!
-ইসসসস্ এই ডিম খেতে খেতে পুরো জীবনটা হেজে গেলো। সপ্তাহের মধ্যে দু তিন দিন ডিম, প্রতি সপ্তাহে একদিন মাংস জোটেনা। একদিন যদি বড় মাছ আনো তো পরের দিন ঐ কুচো মাছ। বিরক্ত লাগে ভাতের থালা কারো সামনে ধরতে।
-ওভাবে বলছো কেন নমিতা, মাসের শেষের দিকে একটু হাত টান থাকে, তাই….
-ও তো তোমার সারাজীবন থাকে, ও আর নতুন কি? ধুসস্ আমি ভাবছি এরপর থেকে আমি মাছ খাওয়াই ছেড়ে দেবো, তাতে হয়তো তোমার সুরাহা হবে কিছুটা।
নমিতার মুখের দিকে তাকায় বিদিশা, ভাত নামিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বাবার ঘরে যেতে গিয়ে বলে-এ বেলাটা নাহয় একটু চালিয়ে নাও, ওবেলায় রাজুকে দিয়ে একটু চিকেন আনিয়ে নেবো।
-নাহ্ নাহ্ থাক গো তোমার আর কিছু করতে হবে না, আমার ছেলের অতো খাওয়ার বাছ নেই, আমি তোমার ভাইয়ের কথা ভেবেই বললাম। যাও বাবাকে চা দিয়ে এসে বলো কি আনাজ কুটবো?
মিনু বললো -দাও গো বড়দি, আমি জ্যেঠাকে চা খাইয়ে দি, তুমি তোমার কাজ সেরে ফেল। চায়ের কাপ নিয়ে চলে যায় সে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলে, লাউ এনেছি, ওটা একটু কেটে দাও, ততক্ষণে আমি ডালটা করে নি, তারপর কি খাবে বলো, আলুপোস্ত নয় ঢেরস পোস্ত ,বেগুন ভাজা ওটা আমি কুটে নেবো।
লাউটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নমিতা বললো- মাগনা এনেছো নাকি দিদি? যা চেহেরা! নখের দাগে ভরা এক্কেবারে! বেগুন তো তাই, পোকা খাওয়া দেখছি।
সেদিকে তাকিয়ে বিদিশা বললো- কচি না বুড়ো দেখার জন্য সবাই এমন করেই দেখে ,তাই হয়তো…
মনে পড়ে যায় কিছু পুরোনো স্মৃতি, রোমন্থন করতে না চাইলেও মনে চলে আসে অজান্তেই।
কতই বা বয়স তখন বিদিশার, সবে কলেজের প্রথম দিকেই তার পুরো জীবনটাকে এক জায়গায় থামিয়ে দিয়েছিলো।
সরস্বতী পূজার আগের দিন নতুনদের ওপর দায়িত্ব ছিলো সাজসজ্জা করার। রঙ্গোলীটা যখন শেষ হলো তখন প্রায় রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই ঘড়িতে। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে না পেয়ে কিছুটা হাঁটা শুরু করেছে, তেমন সময় হঠাৎ করেই লোডশেডিং হয়ে যায়। মিনিট পাঁচেক দুরেই একটা বাজার, ওখানে রিকশা পেয়ে গেলে বাড়ি যেতে কোনো অসুবিধা হবে না।
অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতে আবার হাঁটতে শুরু করে সে। পাঁচ সাত পা যেতেই তার মুখ চেপে ধরে কয়েকজন টেনে একটা অর্ধ নির্মিত বিল্ডিংএর দিকে নিয়ে যায়। হাজার গায়ের জোর খাটিয়েও নিজেকে বাঁচতে পারেনি বিদিশা।
নখ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খুড়ে আধ মরা করে ফেলে রেখো গেছিলো সে রাতে। সে বাঁচাকে কি বাঁচা বলে? এর চেয়ে মরে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যেতো বিদিশা। চরিত্রহীনা,নষ্টা এসবের তকমা এঁটে তাকে এ সমাজে সবার চোখে ছোটো হতো হতোনা তাকে।
সারারাত ধরে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ভাই ও বাবা খুঁজেও পায়নি সেদিন। কলেজ গিয়ে জানতে পারে সে বেরিয়ে গেছে নয়টার আগেই। সবাই বাড়ির ভেবেছিলো হয়তো কারো সাথে সম্পর্ক ছিল তাই সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেছে।
ভোরের আলো ফুটতেই কোনোমতে ক্ষত বিক্ষত শরীরটাকে টেনে নিয়ে সে গেছিলো থানায়। সেখানে দিয়ে দেখতে পেয়ে ছিলো ভাই সোমু ও বাবাকে। তাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে থেমে গেছিলো বাবা, ভয়ে কুঁকড়ে গেছিলো সোমু।
যন্ত্রণায়,বাবার অবহেলায়, পুলিশের জেরায়, লজ্জা, অপমানে আবার জ্ঞান হারায় বিদিশা।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন মা ছিলো তার পাশে, বলেছিলো- মরে গেলে তো পারতিস, এতো প্রশ্নের জবাব দিতে হতো না। এরপর কি মুখ দেখাতে পারবে কেউ? ছিঃ ছিঃ! বোনের বিয়ে, ভাইয়ের ভবিষ্যত ভেবে মা ভয় পেয়ে বিদিশাকে তিরষ্কার করেছিলো, কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি, মেয়েটার মনের ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
পাথরের মতো বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। বাড়ি ওয়ালা উঠে যেতে বলেছিলো দুর্নামের ভয়ে। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে সরে গেছিলো তার পরিবার অন্য এক শহরে।
নতুন বাড়িতে উঠে আসার দু মাসের মধ্যেই মা মারা গেছিলো বিদিশার। শুনতে হয়েছিলো মানে আজো সুযোগ পেলে সকলেই শোনায় তার মায়ের মৃত্যুর কারণ সে, মা এতো দুর্নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেনি।
সত্যি তো মা মরে গিয়ে বেঁচেছিলো সেদিন, আর সে…
সে আজো বেঁচে আছে একটা ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হয়ে। স্নান ঘরে যখন পোষাকটা খোলে ভয়ে শিউরে ওঠে নিজের শরীর দেখে। অসংখ্য আঘাত, নখ ও দাঁতের চিহ্নের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল।
-কি হলো? পোস্ত কি বেটে দিতে হবে তোমায়? নাকি নিজেই পারবে?
নমিতার কথায় চমক ভাঙ্গে তার, বলে – কিছু বলছো? ঝাঁঝালো ভাবে বলে ওঠে নমিতা, কার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছো শুনি!
সে কি বলবে ভেবে পায়না, তার মতো পোকায় কাটা বা নখের দাগ লাগা মেয়েরা তো সুখের স্বপ্ন দেখতেই পারবে না কোনোদিন।
তাও ভাগ্যিস তার একটা সংসার ছিলো, একটা মাথা গোঁজার আস্তানা ছিলো।
নমিতাকে বললো- তুমি যাও ঘরে, মিনুর হাতে তোমাদের খাবারটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বঁটিটা জায়গা মতো তুলতে তুলতে নমিতা বলে -তোমার ভাই খেতে বসলে ওকে একটা ডিম সেদ্ধ করে দিও।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলে -আচ্ছা ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি রান্না সেরে তাকেও বেরোতে হবে কাজে।
সমাপ্ত