রাই

রাই

আজ ভোর টা অন্যরকম ছিল রাই এর কাছে। ঘুম ভাঙলো অনেক সকালে। জানলা দিয়ে এক স্নিগ্ধ ঠান্ডা হওয়া ছুঁয়ে গেল রাইকে আর এক ঝলকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তার ফেলে আসা সময়ে।

চার বছর আগে-

“রিমি ঠিক বলতো তুই কোথায়। আমি এই নিয়ে পাঁচ বার তোকে ফোন করলাম আর সেই থেকে তুই বলছিস তুই শিয়ালদা তে।”

“রাই এত অধৈর্য হোসনা প্লিজ। আসছি তো দশ মিনিটে। হলদিরাম এসে গেছি।”
রাই রাগে ফোনে রেখে গজগজ করতে করতে চৌধুরী কে বললো – “সবসময় এই মেয়েটা দেরি করে। দ্যাখ ফোন করে নীল কতদুরে। ওর জন্য নাহলে অবার দাঁড়াতে হবে। খিদেও পেয়েগেছে। উঃফ।”

নীল, রিমি, চৌধুরি আর রাই এই চারজনের একটা গ্রুপ ছিল। রাই মর্নিং কলেজে পড়ত। যদিও নীল অন্য কলেজ কিন্তু তাতে এদের আড্ডা ভালোবাসা বা আনন্দের কোনো কমতি হয়নি।

লেক এর ধারে ভোরবেলার চা আর সঙ্গে বন্ধুদের ভালোবাসা, এর থেকে বেশি ভালোভাবে দিন শুরু হতে পারে বলে তাদের জানা ছিলোনা। জন্মদিন পালনের জন্য বড় রেস্তোরাঁ তে পার্টি নয়, লেকের ধার বা রাস্তার বন্ধ চা এর

দোকানের চৌকি তে তাদের হুল্লোরের ঝড় উঠত। মালটিপ্লেক্স এ সিনেমা কিংবা বড় কফিশপ নয়, তাদের আড্ডা জমে উঠত রাস্তার ধারে কিংবা মান্না দেয় এর স্মৃতি জড়ানো পুরোনো কফীহাউসে।

হয়তো তাদের সম্পর্ক টা ছিল বন্ধুত্বের থেকেও অনেকটা বেশি কাছের, অনেকটা অন্যরকম। আজ চার বছর পর রাই কে অশান্ত করে তুললো তার পুরোনো স্মৃতিরা। তার স্বামী আজ অফিসের কাজে শহরের বাইরে তাই ভাবলো একটু স্মৃতিচারণ করে আসা যাক। স্বামীকে জানিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য রাই এর হয়ে ওঠেনি তাই বাধ্য হয়ে খুঁজে নিতে হয় সুযোগ। আসলে চৌধুরীর সাথে দেখা হয়ে রাই জেনেছিল যে প্রেম এর আরেক নাম বন্ধুত্ব যেটা সে তার স্বামীর মধ্যে আজও খোঁজে কিন্তু পায়না। বৈবাহিক সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা আজও করে যাচ্ছে রাই কিন্তু তার বরের কাছে প্রেম মানেটা একদম অন্যরকম—-অনেক নিয়ম আর কিছু সস্তার টানাপোড়েনে কোথায় যেন রাই এর প্রেম করে বিয়ে করার পরেও এই সম্পর্কটা শুধুই একটা বর-বউ এর সামাজিক তকমাতেই আবদ্ধ হয়েছিল। মাঝেমাঝে দম বন্ধ হয়ে যেত কিন্তু ঐযে বিবেক, মনুষ্যত্ব, মায়া, সমাজ এসবকিছু তাকে এই সম্পর্কে বেঁধে থাকতে বাধ্য করেছিল।

রাই আর সৌম্য দুজনের প্রেমটা শুরু যখন রাই স্কুলে পরে, তখন রাই এর কাছে প্রেম মানে একটা গোলাপ, শপিং, সিনেমা, বাইকে ঘোরা, কিছু উপহার আর কারুর কাঁধে মাথা রেখে গল্প। শুরুটা দিব্যি চলছিল কিন্তু রাই এর যত ম্যাচিউরিটি বাড়তে থাকলো ততই সম্পর্কটা জটিল হতে শুরু করলো। অনেক রেস্ট্রিকশন, নিয়ম আর সৌম্যের ওভার পসেসিভনেস এর বেড়াজালে রাই নিজের স্বাধীনতা, নিজের সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলো দিন দিন এবং বড়ই একা হয়ে পড়তে লাগলো।

নিজের শত চেষ্টার পরেও বিনাদোষে বার বার সৌম্যের সন্দেহের স্বীকার হত, ধিৎকার ধরে গেছিলো তার নিজের ওপর—- ঠিক সেই সময় খুব কাছের এক বন্ধু হয়ে চৌধুরী আসে রাই এর জীবনে। বিয়েটা রাই কিন্তু সৌম্যকেই করতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু সে সেই বন্ধুর জায়গা সৌম্যকে দিতে পারেনি কিংবা বলা যেতে পারে সৌম্য সেই জায়গা কোনোদিনও নিতে পারেনি, নিতে চেষ্টাও করেনি।
মামলার মোটা মোটা ফাইলের তলায় বেজে উঠল চৌধুরীর ফোন—

“হেল্লো! চৌধুরী….??”.. বাকিটা বলার আগেই উল্টোদিক থেকে “হ্যা আমি, বল”। এইটুকুর মধ্যে ছিল অনেক উত্তেজনা অনেক না বলা অভিমান অনেক আবদার আর অনেকটা ভালোবাসা।
“ব্যস্ত? একটু দেখা করবো ভাবছি” -রাই
“ধর্মতলায় আস্তে পারবি। বারোটা?” – চৌধুরী।
“হ্যা। নীল কে তুই ডেকে নিস।”

তারপরেই দু প্রান্তেই উঠল অনেক আবেগ উদ্বেগ আর উত্তেজনার ঝড়। সঠিক সময় পৌঁছে গেল রাই। ওদিকে এই পুরো ব্যাপারটাই আকস্মিক ছিল নীল এর কাছে। শুধু চৌধুরীর ফোনেই দৌড়ে এসছে সে। ধর্মতলার মোরে এসে তার চার বছর আগের জীবনটা ভেসে উঠলো নীল এর চোখে। হাত পা ঠান্ডা, গলা কাঁপছে। আর আনন্দে গোটা বিশ্ব আজ তার কাছে রঙিন হয়ে উঠেছে। ঐদিকে চৌধুরীর মুখ তো আনন্দে লাল। তাদের কাছে আজকের দিনটা যে কতটা আনন্দের তা হয়তো শুধুই তারা জানে। জীবনের সব সমস্যা দুঃখ কষ্ট একদিকে আর আজকের খুশি আরেকদিকে। একটা সময় এই চারজনের জীবনে একটা দিন একে অপরকে ছাড়া কাটতো না আর আজ জীবনটা কতো

অন্যরকম। এক একজন জীবনের সুনামি তে ছিটকে গেছে ভিন্ন পাড়ে। তাই রাই আজ আরেকবার একদিনের জন্য হলেও সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিল নিজেকে।

কিন্তু তাও আজও তারা অসম্পূর্ণ। রিমি আজ শহরের বাইরে। চেষ্টা করলেও তাদের ফোনে এক ছুটে ধর্মতলার মোড়ে আস্তে পারবেনা, যে সময় তার জীবনের অমূল্য তিনটি মানুষ একসাথে আজ সেই সময় রিমি শহরের বাইরে অন্য এক অজানা ঠিকানায় নিদ্রায় মগ্ন। সে এসবের কিছুই টের পাচ্ছে না কিন্তু যারা টের পাচ্ছে তাদের ভেতরটা সব থেকে বেশি ছিন্নভিন্ন। রাই এর সখি বলতে তো শুধুই সে, চৌধুরীর একমাত্র গুন্ডা বোন আর নীল এর! নীল এর হয়তো সবটা ঘিরে আজও তার খুব কাছের বন্ধু সেই রিমি। যে তার নিস্তব্ধতাও হয়ত পড়তে পারতো। অসম্পূর্ণ, তাও তারা কিছুটা সম্পূর্ণ। রোজ দেখা বা কথার মধ্যেও অনেক সম্পর্ক হারিয়ে যায় আবার অনেক সম্পর্ক এসবের উর্ধে। সেগুলোর মধ্যে থাকে নির্ভেজাল ভালোবাসা।

রাই আর চৌধুরীর সম্পর্কটা ছিল অন্যরকম। সবাই ভাবতো প্রেম, হয়তো তাই আবার হয়তো তাদের মধ্যে ছিল এমন একটা ভালোবাসা যার মধ্যে কোনো আশা আকাঙ্খা চাওয়া পাওয়া ছিলোনা। ছিল শুধুই বন্ধুত্ব। আজ রাই এর কাছে তাই চৌধুরীর জায়গাটা একদম অন্য, সবার থেকে আলাদা। কারণ রাই কে এই বন্ধুত্ব তার স্বামীও দিতে পারেনি।
নীল এর মনেও রিমি আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে তবে না প্রেম নয়, খুব ভালো বন্ধু হয়ে, তাই এত আনন্দের মাঝেও তার মন এর খানিকটা শূন্য। সেদিনটা তারা কাটাল ঠিক আগের মতো করে—-সেই রাস্তার ধারে চা খাওয়া, লেকে বসে আড্ডা, সেই হাসি, অনেক ফোটো তোলা, একটু শপিং, মান্না দের কফি হাউসের গন্ধ, একসাথে খাওয়া দাওয়া, অনেক হৈচৈ আর কিছু অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি।

দিন শেষ, সময় শেষ তাই ফিরে যাচ্ছে যে যার ঘরে আর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এক মুঠো স্মৃতি। ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে বিদায় জানালো একে অপরকে কিন্তু মনে মনে চাইছিল সময়টাকে আটকে দিতে। পারেনি—-কেউ পারেনা।
হয়তো অনেকের কাছে এটা পরকীয়া প্রেম, কেউ ভাবতে পারে রাই বিশ্বাসঘাতক,কিন্তু না….কিছু সম্পর্কের নাম হয়না বা প্রয়োজনও হয়না, বন্ধুত্ব হয়ে থেকে যায় মনের কোনে। প্রেম মানেই শরীর নয়, প্রেম মানেই কামনা নয়, প্রেম হলো এক পবিত্র বন্ধন যার মধ্যে সবথেকে বেশি থাকে বন্ধুত্বের ছোঁয়া।

একসাথে আর সকাল শুরু হয়না, জন্মদিনেও আর একসাথে থাকা হয়না তবে এই চারজনের মধ্যে কেউ একজন আছে যাকে আজও তার তিন বন্ধুর জন্মদিনে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের কলেজের পাশের পুরোনো পার্ক এ। হয়তো একা বা হয়তো তার সাথে থাকে তার পুরোনো স্মৃতি রা। ঝরে পড়া শুকনো পাতা আর পাখিরা সাক্ষী থাকে তার বন্ধুত্বের, তার ভালোবাসার।

এভাবেই থেকে যায় কিছু সম্পর্ক মনের কোনে একান্ত গোপনে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত