প্যাডবার্ড

প্যাডবার্ড

অনেক্ষণ থেকেই ব্যাপারটা লক্ষ করছি, ভদ্রমহিলা একটি ব্যবহৃত ন্যাপকিন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেই চলেছেন৷ বস্তুটি এতক্ষন আমাদের সকলের চোখের আড়ালে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনটায় পড়েছিল! নিজের চোখে দেখলাম, ভদ্রমহিলা রাস্তায় দিব্যি হাঁটছিলেন, তারপর কি মনে হতে হঠাৎ ডাস্টবিনের মাথার উপর চড়ে কিছুক্ষণ বসলেন, এটা ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ ন্যাপকিনটা টেনে নিয়ে এসে ফেললেন রাস্তার একদম ধারে! ডাস্টবিনের নোংরা আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কালচে দাগ গোটা ন্যাপকিন জুড়ে, সেটাকেই কিনা মুখে করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিব্যি!

আমি জানালা থেকে ধমক দিলাম, এইরকম পরিস্থিতিতে ধমক না দিয়ে থাকা যায় বলুন! যতই হোক, লোকে বলে এটা একটা ‘অশুদ্ধ’ জিনিস, মেয়েরা ‘শরীর খারাপ’ না হলে ব্যবহারই করেনা! তাছাড়া দেখেছি, কেনার সময় অনেক দোকানদার কালো পলিথিনে মুড়ে দেয় আর অনেক মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে, অনেক ছেলে তো কিনতেই চায়না! মন্দির টন্দিরেও নাকি এসব পরে ওঠা যায়না! তাহলেই ভাবুন, এইরকম একটা জিনিস যেটা আবার ব্যবহার হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে টানাহ্যাঁচড়া কি ভদ্রসমাজে শোভা পায়! এই ভদ্রমহিলা নির্ঘাত অস্বাভাবিক, বোধবুদ্ধি নেই কিছু, তাই তাড়িয়ে দিতে গেলাম৷ কিন্তু ওমা! আমাকে পাত্তাই দিলনা বরং অবাক হয়ে দেখলাম আরও একজন এসে ঠোঁট লাগালো! শুরু হল খন্ডযুদ্ধ, দুইজন মিলে নোংরা ন্যাপকিনটার দুই প্রান্ত ধরে টানাটানি শুরু করল, অনেকটা সেই দড়ি টানাটানি খেলার মত! জাষ্ট ভাবুন একবার, অবাক হয়ে গেলাম! ইতিহাসে কত যুদ্ধ পড়েছি, চোখের সামনে কত যুদ্ধ দেখলামও! কিন্তু এনারা আর বিষয় পেলেন না, যুদ্ধ হচ্ছে কিনা ন্যাপকিনের অধিকার নিয়ে! তাও আবার নতুন নয়, পুরানো!

কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়, এরপর তো দেখছি এরা আমার ঘরে ঢুকে পড়বে! অনেক্ষন সহ্য করেছি, আর নয়! এতবার মুখে বললাম, শুনলোনা যখন তখন সোজাসুজি মাঠেই নামতে হবে৷ প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর! হাতে একখানা লাঠি নিয়ে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নামলাম, ওদিকে মাঝরাস্তায় প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে! চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়! ডাস্টবিনের পাশে যে কুকুরটা এতক্ষন ডাবের খোলার ভেতরে কালোধন আছে নাকি খোঁজ করছিল, চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে পর্যন্ত বার দুইতিন ঘেউ ঘেউ করে পালিয়ে গেল৷ সদর দরজা থেকে আবারও চেষ্টা করলাম, আসলে কাছে যাবার সাহস হচ্ছিলনা কিনা! হাতের লাঠিখানা ছুঁড়ে দিলাম তাদের দিকে, তৎক্ষনাত কাজ হল৷ অবশ্য ততক্ষনে ন্যাপকিনটা দুই টুকরো হয়ে দুজনের মুখে অর্ধেক হয়ে ঝুলছে, সে বেচারার আর কি দোষ, এতক্ষন টানাটানি সহ্য করে আধাদাদা হওয়া ছাড়া উপায় আছে নাকি!

যাইহোক, আমি লাঠিখানা ছুঁড়ে দিতেই দুইজন দুটুকরো ন্যাপকিন নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া! একজন উঠে বসলেন আমার বাড়ির সামনের চাঁপা গাছটার ডালে, তার পাশের জবা গাছের ডালে আরেকজন!

দিন কয়েক পরের ঘটনা! দিব্যি ঘুমোচ্ছিলাম, আসলে সকালের ঠান্ডা হাওয়াতে ভোরের ঘুমটা আরও গাঢ় হয়ে আসে৷ কিন্তু একটা অদ্ভুত মন ভাল করা গন্ধে ঘুমটা গেল ভেঙে! তখনও সূর্য ওঠেনি! জানালাটা খুলে দেখি আমি যেন স্বর্গোদ্বারে দাঁড়িয়ে আছি! গোটা গাছ ভর্তি সোনালী চাঁপাফুল, গোটা গাছটা যেন হলুদ হয়ে আছে! একদম নীচু ডালটা আমার জানালার পাশে এসে থেমেছে, ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে! সেই চাঁপাফুলের সুমিষ্ট গন্ধই গোটা পরিবেশটাকে মোহিত করে তুলেছে!

একবুক ঠান্ডা বাতাস ভরে নেওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল হল, চাঁপাগাছের পাশেই জবাফুলের গাছটাও আজ কনে’বৌয়ের মত সেজে উঠেছে! ঠিক যেন সলজ্জ নতুন বৌ, লাল-টুকটুকে বেনারসী পরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! এত জবাফুল ফুটেছে দেখে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠলো, আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করলনা৷ বাইরে বেরিয়ে এসে মনপ্রাণ ভরে দেখতে লাগলাম, আমার নিজের লাগানো গাছগুলো আজ গর্ভবতী হয়ে ফুলেফলে ভরে উঠতে চলেছে৷ ভীষণ ইচ্ছে করল হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম গাছগুলোর দিকে! একটা জায়গায় চাঁপাগাছের ডাল আর জবাগাছের ডাল একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, বেশ গভীর একটা ঝোপের সৃষ্টি করেছে! তার ঠিক নীচেই সবচেয়ে বড় চাঁপাফুলটা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আর কিছুক্ষণ পরেই পাপড়িগুলো খসে যাবে! তাই নিজের হাতে তোলার লোভ সামলাতে পারলামনা! সবে ডালটা ধরে একটু নীচে নামিয়েছি, এমন সময় হঠাৎ অতর্কিতে আক্রমন ধেয়ে এল!

স্পষ্ট দেখলাম সেই ভদ্রমহিলা, যিনি দুদিন আগে ন্যাপকিন নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন সেই তিনিই ঠোঁট নখ বাগিয়ে আমাকে আক্রমন করতে উদ্যত হয়েছেন! পিছিয়ে এলাম, কিন্তু তিনি লড়াই জারি রাখলেন! কখনও আমার মাথা লক্ষ করে, কখনও বাড়ানো হাত! চিৎকারে টেকা দায়! কিন্তু ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, একজন নয় অন্তত তিন থেকে চারজন চিৎকার করে চলেছে৷ পিছিয়ে এলাম, ভদ্রমহিলা উড়ে গেলেন খোলা আকাশে! কিছুক্ষণ পর সাহসে ভর করে আবারও সেই জায়গায় হাজির হয়ে দেখি সব চুপচাপ, কৌতুহল বশত গাছের ডালটা একটু নাড়াতেই আবার চিৎকার! কিন্তু এবার আর কেউ যুদ্ধ করতে এলেননা! আরেকটু সাহস করে জবা ডালটা সরিয়ে দিতেই চোখের সামনে স্বর্গ৷

একটা ছোট্ট পাখির বাসা, খড়কুটো থেকে সরু লাইলন, ইলেকট্রিকের তার, শুকনো পাতা দিয়ে তৈরী বুলবুলি পাখিটার নিজের ঘর! আর সেই ঘরের মেঝেতে খুব সুন্দর করে বিছানো সেই ব্যবহৃত রক্তমাখা ন্যাপকিনের অর্ধেকাংশ!

বিশ্বাস হচ্ছিলনা, চোখ কচলে আরেকবার তাকালাম! মনে হল যেন গোটা পাখির বাসাটা আলো করে আছে ন্যাপকিনের টুকরোটা! আর সেই নরম তুলতুলে গদির ওপর দুটো বুলবুলির বাচ্চা, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! মাঝেমধ্যেই অপরিণত ডানাদুটো নিয়ে ওড়বার ব্যর্থ চেষ্টায় চিঁ চিঁ করে উঠছে, যেন নালিশ করছে মা’কে! একটা অনাবিল আনন্দে মন ভরে গেল!

বুঝলাম, একটা ন্যাপকিনের কতটা মূল্য! একটা ন্যাপকিন শুধু একটা মেয়ের জীবনই বাঁচায়না, বাঁচায় আরও একটা গোটা পরিবারকে৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত