আগে বোঝা যায় না

আগে বোঝা যায় না

কথাটা শুনে সুনন্দর ভুরু কুঁচকে গেল। চোখ সরু করে তিনি তাকালেন বিপিন চ্যাটার্জির দিকে। অবাক হয়ে তার কথাটাই আবার উচ্চারণ করলেন, “আগে বােঝা যায় না! তার মানে? বিপিন চ্যাটার্জি সিগারেটে টান দিয়ে সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, মানে অতি সহজ। তুমি যে ভূত দেখেছ সেটা তুমি আগে কিছুতেই বুঝতে পারবে না। একটু দম নিয়ে আরও যােগ করলেন, ‘বুঝতে পারবে–তবে অনেক পরে। এটাই সরকারদের ভূতুড়ে বাড়ির স্পেশালিটি।

সুনন্দর স্ত্রী কল্যাণী মিষ্টি করে হেসে ঠাট্টার সুরে বললেন, “তবে তাে দারুণ ভালাে। ভূতের ভয় পাওয়ার কোনও চান্সই নেই। কারণ, ভূত দেখার সময় ভূত বলে বুঝতে পারব না। যেমন, আপনি এখন গল্প করছেন, চা-বিস্কুট খাচ্ছেন—ব্যাপারটা এইরকমই মনে হবে। তারপর…আপনি যেমন বললেন…অনেক পরে—মানে, দু-চারদিন পরেও হতে পারে—বুঝতে পারব যে, সেদিন আসলে ভূতের সঙ্গে কথা বলেছি, গল্প করেছি। তখন ভয় পাওয়ার কোনও মানে হয় না। সুতরাং আপনার ওই ভূত কাউকে ভয় দেখাতে পারবে না। এরকম দয়ালু বিবেচনা-বুদ্ধিওয়ালা ভূত সত্যিই খুব রেয়ার। কল্যাণী বেশ কষ্ট করে হাসি থামিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, তােমার কী ওপিনিয়ান ?

সুনন্দ হাতে হাত ঘষলেন। টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। তারপর বন্ধুর দিকে তাকালেন। হাসি চেপে রাখতে ওঁরও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বিপিন চ্যাটার্জি একটু আহত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে টেবল-ক্লথের নকশাটাকে জরিপ করছিলেন। সুনন্দ ছােট্ট করে কাশির শব্দ করায় ওঁর দিকে চোখ ফেরালেন।  দেখলেন, সুনন্দও রীতিমতাে হাসি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিপিন পাছে রাগ করেন, তাই সুনন্দ হাসির ঝোকটা সামলে নেওয়ার সময় দিলেন। তারপর বেশ সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘দ্যাখাে, বিপিন…কল্যাণী মজা পেয়ে হাসছে বলে তুমি কিছু মাইন্ড কোরাে না। তুমি তাে জানােই, কল্যাণী বা আমি কোনওদিনই ভূতে বিশ্বাস করুন আমাদের যত
লেনদেন শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবে ‘ভূত আছে এই কারণে তােমার ওই ইয়েদের বাড়িটার যদি দাম কম হয়, তা হলে আমাদের তো লাভ বই লােকসান নেই! সুতরাং তুমি এগােতে পারাে…।

বিপিন তক্ষুনি কোনও জবাব দিলেন না। সিগারেটে কয়েক টান দিয়ে তারপর চাপা গম্ভীর গলায় বললেন, তােমরা যে ভূতে বিশ্বাস করে না সে জানি । আর জানি বলেই সরকারদের শােভাবাজারের বাড়িটা ভুতুড়ে জেনেও কথাবার্তা এগিয়েছি ও-বাড়িতে বছর দশেক ধরে কেউ থাকে না। সরকার ফ্যামিলির সবাই আমেরিকায় সেটা শুধু একজন, বামদেব সরকার, হরি ঘােষ স্ট্রিটে থাকেন। ওঁর বয়েস হয়েছে, বিয়ে-থা করেন। বদনামী বাড়িটা কেউ কিনতে চাইলে তিনি রীতিমতাে বর্তে যান। সেইজন্যেই মাত্র সাড়ে তিনলাখ টাকা চেয়েছেন। বাড়ির পেপারস তিনি সব ক্লিয়ার করে রেখেছেন। বাড়ি বিক্রি করার রেজিস্টার্ড পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিও ওঁর কাছে আছে….। বাড়িটা কেনার পর রিপেয়ার খরচ কীরকম পড়বে?

‘তা ধরাে প্রায় লাখখানেক। তবে ফার্নিচারপত্র যা আছে সবই তুমি ফ্রিতে পেয়ে যাচ্ছ। বামদেববাবু ওসব কিছু নেবেন না বলেছেন। ‘কেন, ওগুলাে কি অভিশপ্ত?’ কল্যাণী জানতে চাইলেন। ওঁর কথায় একটু ব্যঙ্গের খোঁচা বিপিন চ্যাটার্জি উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন। ছােট-ছােট টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করলেন। তারপর মুখ তুলে ঘরের খােলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলােয় ওঁর খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি চকচক করছিল। চশমার কাচেও খানিকটা আলাে ছিটকে পড়েছিল।

সবাই চুপচাপ থাকায় কেমন একটা চাপ তৈরি হচ্ছিল ঘরের মধ্যে। ‘কী বললেন? অভিশপ্ত?’ ঠোটের কোণে আচমকাই হাসলেন বিপিন ঃ ‘হয়তাে হবে–আমি ঠিক জানি না। তবে একজনের কাছে যেটা অভিশাপ আর একজনের কাছে সেটা আশীর্বাদও হতে পারে। আমি দুর্বল, ভীতু মানুষ—জমি-বাড়ির দালালি করে পেট চালাই। বামদেব সরকারের বাড়িটা বিক্রি করিয়ে আমি সাতহাজার টাকা পাব ঠিকই, কিন্তু জোর করে কাউকে ওটা গছিয়ে দিতে চাই না

…আপনাদের তাে নয়ই। সুনন্দ আমার ছােটবেলার বন্ধু—একপাড়ায় থাকি। সেইজন্যেই আগে সবকিছু খােলসা করে জানিয়ে দিচ্ছি। সরকারদের বাড়িটার বেশ বদনাম আছে। তবে পিকিউলারিটি ইচ্ছে, ভূতের ব্যাপারটা আগে বােঝা যায় না।’

সুনন্দ মিত্র বামপন্থী মানুষ। যুক্তি দিয়ে সব খতিয়ে দেখেন। আধুনিক খােলা মন নিয়ে প্রগতির কথা ভাবেন। অফিসে ইউনিয়নের একজন হর্তাকর্তা। ওঁর স্ত্রী কল্যাণী হাই স্কুলের শিক্ষিকা। সাহিত্য, সিনেমা, সংস্কৃতি নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামান। বিয়ের আগে নাটকের দল চালাতেন। পরে সময় কমে আসায় সরে এসেছেন।

বিপিন জানতেন, এই বাড়িটা নিতে ওঁরা আপত্তি করবেন না। অন্য দু-একটা বাড়ির খোঁজও বিপিন দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলাে সুন্দর বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর-একটু সময় পেলে বিপিন হয়তাে একটু বেশি খোঁজখবর করতে পারতেন…সুনন্দর বাজেটের মধ্যেই কিছু হয়তাে জুটে যেত, কিন্তু সুনন্দ আর কল্যাণী এমন তাড়াহুড়াে করছেন যে, সে-সময় আর মেলেনি। সুনন্দ বলেছেন, ‘এ-মাসের মধ্যেই আমার বাড়ি চাই…যেভাবে হােক…। ওঁদের তাড়াহুড়োর কারণ বিপিন জানেন না। দু-একবার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু সুনন্দ এড়িয়ে গেছেন। কল্যাণীও কিছু ভাঙেননি। শুধু বলেছেন, ‘ফ্ল্যাট বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।

এখন ওঁরা সি, আই. টি. রােডের যে-ফ্ল্যাট ভাড়া থাকেন সেটা এমনিতে খারাপ নয়। কিন্তু হঠাৎ করে কী যে হল, ফ্ল্যাটে ওঁদের আর মন বসছে না।

আরও কিছুক্ষণ ভূত, ভুতুড়ে বাড়ি, এইসব নিয়ে আলােচনার পর বেশ হালকা মেজাজেই বিপিন চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, বামদেব বাবুর সঙ্গে কথা বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তােমাদের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে রেজিস্ট্রির দিন ঠিক করছি। আর তুমি যখন পাকা কথা দিলে তখন আমার চেনা এক কন্ট্রাকটরকে রিপেয়ারের ব্যাপারটা আগাম জানিয়ে রাখছি…যদি অবশ্য তােমার আপত্তি না থাকে…।

‘আপত্তি। কেউ উপকার করতে চাইলে মানুষ কখনও আপত্তি করে! সুনন্দ বিপিনের হাত চেপে ধরলেন কৃতজ্ঞতায়। মনে মনে ভাবলেন, ‘বিপিন জানে না বিপিন আমাদের কী বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চলেছে।

বিপিন চলে যাওয়ামাত্রই ঘরের আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে গেল। হাসি-খুশির ছবিটাও মুছে গেল। সুনন্দ আর কল্যাণী বুক-চাপা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলেন। চুপচাপ—যেন ট্রেনের কামরায় অচেনা দুই সহযাত্রী। সুনন্দ চোখের চশমাটা অকারণেই ঠিক করলেন। তারপর টেবিলের একপাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে পড়ার ভান করলেন। সেদিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘কী, এবার তুমি খুশি তাে?”

কল্যাণী স্বামীর দিকে তাকালেন ? কেন, তুমি খুশি না ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুনন্দ, বললেন, ‘ই-খুশি। আশা করি এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলে সমস্যাটা মিটে যাবে, কিন্তু তুমি ওকে রাজি করাতে পারবে তাে? করাতেই হবে। ওকে বােঝাতে হবে। মনে হয় ও বুঝতে পারবে। বাইরে সন্ধে গাঢ় হয়েছিল অনেকক্ষণ। কল্যাণী উঠে ভেতরের ঘরে গেলেন। সুনন্দ টিভি অন করে রিমােট হাতে চ্যানেল সার্ফিং করতে লাগলেন। এমন সময় ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল। সুনন্দ চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই কল্যাণী ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকল অনুপম।

রােগাটে ফরসা চেহারা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঘন ভুরুর নীচে সামান্য টানা চোখ। চোয়ালের উঁচু হয়ে থাকা হাড় কুড়ি বছরের নবীন মুখে রুক্ষতার তুলি চালিয়েছে। ‘কী ব্যাপার! এত তাড়াতাড়ি চলে এলি?’ কল্যাণী জিগ্যেস করলেন। কল্যাণীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢােকার সময় অনুপম জবাব দিল, কোচিং ছিল না। স্যারের শরীর খারাপ। নিজের ঘরে ঢুকতে-চুকতে সুনন্দর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল অনুপম। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সুনন্দ কল্যাণীর অসহায় মুখের দিকে তাকাল। তারপর আবার টিভির দিকে। কল্যাণী পায়ে-পায়ে সুনন্দর কাছে এগিয়ে এলেন। সুনন্দ টিভির দিকে চোখ রেখেই চাপা গলায় বললেন, এখন কিছু বােলাে না। আমি যখন বাড়ি থাকব না তখন মুড বুঝে নতুন বাড়ির ব্যাপারটা বােলাে।

কল্যাণী যেন অচেতনভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। টিভির দিকে তাকিয়ে অনুপমের কথা ভাবতে লাগলেন। যখন সন্তান আসবে না এই সত্যিটা একরকম মেনে নিয়েছিলেন তখন চিকিৎসাশাস্ত্রের কী এক কারিকুরিতে অনুপম এসে পড়েছিল। তারপরই জীবনটা কী সুক্ত হয়ে গেল। হাসি, খুশি, আর ফুর্তি ছাড়া কিছু ছিল না সংসারে। কোনওরকম দুঃখ-কষ্ট গোয়ে আঁচড় কাটতে পারত না।

এইভাবে আঠেরােটা বছর কীভাবে গড়িয়ে গেল কে জানে! আঠেরােটা বছরের হিসেব সেইদিন মনে পড়ল যেদিন কল্যাণী ছেলের মুখে মদের গন্ধ পেরেছিলেন। এলাকাটা যে খুব ভালাে নয় এটা ওঁর স্বামী স্ত্রী আঁচ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে ওঁদের জীবনে আঁচ লাগাবে তা বুঝতে পারেননি।  এরপর যতই দিন যেতে লাগল ব্যাপারটা তত খারাপের দিকে গড়াতে শুরু করল।

সুনন্দকে কল্যাণী যখন জানালেন তিনি বললেন, ‘বয়েসের ঝোক—পরে ঠিক সামলে নেবে। মুখে এ-কথা বললেও ভেতরে-ভেতরে সুনন্দ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। একদিন সন্ধেবেলা অনুপমের বই-খাতা হাতড়ে কল্যাণী কতকগুলাে বাজে ছবি পেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর কথাটা মনে পড়েছিল : বয়েসের ঝোঁক। কিন্তু যেদিন ছেলের টেবিলের ড্রয়ার থেকে কল্যাণী সাড়ে দশহাজার টাকা পেলেন সেদিন তিনি কেঁপে গিয়েছিলেন। পাঁচশাে টাকার নােটগুলাে ওঁর হাতে কিলবিল করছিল।

কোথা থেকে এত টাকা পেল অনুপম। সুনন্দ সত্যনিষ্ঠ মানুষ। কল্যাণীও তাই। অনুপমকে সেই মূল্যবােধের ওপরে দাঁড় করিয়ে অত্যন্ত যত্নে ওঁরা মানুষ করতে চেয়েছেন। এত কষ্টের ফল এই! কল্যাণীর চোখে জল এসে গিয়েছিল। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শক্ত করলেন তিনি। তারপর অনেক রাতে ছেলের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। আলাে জ্বেলে ঘুম-চোখে দরজা খুলল অনুপম। গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি, পায়ে পাজামা। কী ব্যাপার? ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল।

‘তোর সঙ্গে কথা আছে। কল্যাণী ঘরে ঢুকে সােজা গিয়ে বসলেন ছেলের বিছানায়। অপলকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কী কেস বলাে তাে?’
‘তাের কথাবার্তাগুলাে বদলে যাচ্ছে। এই কথা বলার জন্যে এত রাতে ঘুম ভাঙালে ? অনুপম হাই তুলল। মুখের সামনে বারকয়েক টুসকি দিল।
‘সাড়ে দশহাজার টাকা তুই কোথায় পেলি?
অনুপম বেশ অবাক এবং বিরক্ত হয়ে তাকাল মায়ের দিকে ? আজকাল লুকিয়ে আমার ঘর সার্চ করছ নাকি?”
‘টাকাটা কোথায় পেয়েছিস? আমার কাছে লুকোবি না।
‘ও বিজনেসের টাকা।
‘বিজনেস! তুই বিজনেস করছিস নাকি?
হ্যাঁ।
কীসের বিজনেস?”
জমি-বাড়ি কেনাবেচার বিজনেস।

কল্যাণী পাথর হয়ে গেলেন। আর সাত-আটমাস পরে যার বি, এসসি. অনার্সের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা সে বিজনেস করছে। জমি-বাড়ির দালালির বিজনেস। ‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! সামনে তাের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা..তুই তুই…। এবার ধৈর্য হারাল অনুপম। বেশ রুক্ষভাবে বলল, ‘বি. এসসি. পাস করার পর কী করব বলতে পারাে? চাকরি-বাকরির ব্যাপক ক্রাইসিস। এখন থেকে টুকটাক বিজনেসের লাইন ধরতে পারলে পরে আর চিন্তা থাকবে না। পাবলােদা বলেছে বিজনেস পার্টনার করে নেবে। পাবলাে।

শিউরে উঠলেন কল্যাণী। এই এলাকার কুখ্যাত মান এবং প্রমােটার পাবলাে শিকদার। পুলিশের খাতায় ওর নাম উঠতে-উঠতে খাতার পাতা ফুরিয়ে গেছে। লােকটাকে সুনন্দ বা কল্যাণী কখনও কোথাও দেখেননি, তবে তার অনেক গল্প শুনেছেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। ওঁদের একমাত্র সন্তান কখন যে বড় হয়ে গেল, কখন যে এরকম হয়ে গেল, ওঁরা টের পাননি। এই তাে সেদিন ও টলােমলাে পায়ে মাম, মাম’ বলতে বলতে কল্যাণীর কোলে ঝাপিয়ে আসত। টেলিফোনে কথা বলার জন্য বায়না করত। হ্যালাে বলতে পারত। আর থ্যাংক যু-কে বলত “খ্যাংকু। হইহই করে গােটা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। সুনন্দ বাজার থেকে মাগুর মাছ নিয়ে এলে ‘জুজুমাছ’ বলে থাবা মারতে চাইত।

সকলের আদরের ‘বুবুসোনা কী তাড়াতাড়ি অনুপম হয়ে গেল। নার্সারি, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, এইচ. এস., তারপর কলেজ। ছুটে যাওয়া ট্রেনের জানলা দিয়ে যেন সিনেমা দেখছিলেন কল্যাণী। ফ্ল্যাশব্যাক! বুবু থেকে অনুপম পর্যন্ত।

তারপর পাবলাে শিকদার ! কল্যাণীর ভেতরটা ভাঙচুর হয়ে গেল। চোখে মেঘ-বৃষ্টি। মুখে হাত চাপা দিয়ে ছেলের কাছ থেকে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। ভেতরে-ভেতরে একটা তরাস কাজ করছিল। যে করে হােক অনুপমকে বাঁচাতে হবে। যে করে হােক।

সে-রাতেই সুনন্দর সঙ্গে কথা বললেন। এতক্ষণ গলা টিপে রাখা কান্নাটা উথলে বেরিয়ে এল বাইরে। স্বামীকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জড়ানাে গলায় কী যে বললেন বােঝা গেল না। মুখের বাক্য না বুঝলেও অন্তরের কথা শুনতে পেয়েছিলেন সুনন্দ। অনুভব করেছিলেন, একজন মা কথা বলছে।

আর তারপর থেকেই সুনন্দ আর কল্যাণী নতুন বাড়ির খোঁজে পাগলের মতাে হয়ে উঠেছেন।  তবে বাড়ি খোঁজার আসল কারণটা কাউকে বলেননি। কখনও বলা যায়। টিভিতে একটা জোরালাে মিউজিক বাজিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হতেই কল্যাণী স্মৃতিপথ থেকে ফিরে এলেন। তখনই দেখলেন, অনুপম জিনসের পাঞ্জাবি আর সরু পাজামা পরে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

পাঞ্জাবির হাতা গােটাতে-গােটাতে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগােল অনুপম। চটি পায়ে গলাতে- গলাতে দেওয়ালকে বলল, “আমি একটু বেরােচ্ছি।’

কল্যাণী বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরিস। কিন্তু ততক্ষণে শব্দ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

বাড়ি বদলের তোড়জোড় চলতে লাগল। বিপিন চ্যাটার্জি সাধ্যমতাে দৌড়ঝাপ করতে লাগলেন। আর কল্যাণী অনুপমকে ব্যাপারটা জানানাের জন্য একটা সুবর্ণ মুহূর্তের খোঁজে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদিন রাতে মরিয়া হয়ে অনুপমের মুখােমুখি হলেন কল্যাণী। ‘বুবু, আমরা এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

অনুপম টেবিলে বসে কীসব হিসেবপত্র করছিল। টেবল-ল্যাম্পের আলো ছিটকে পড়েছে ওর মুখে। কল্যাণী আলাের ছটার বাইরে আঁধারি উপচ্ছায়া অঞ্চলে ছিলেন। মায়ের কথায় অনুপম মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। আলাে পড়ে ও মাথার চুল চকচক করতে লাগল, তবে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। তাই বিরক্তির ছাপটা কল্যাণী দেখতে পেলেন না। ‘এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি মানে!

‘এই ভাড়ার ফ্ল্যাটে আমাদের..খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমাদের বয়েসও বাড়ছে। তা ছাড়া নতুন যে-বাড়িটার খোঁজ পেয়েছি সেটা বেশ খােলা মেলা। সে খানে গেলে আমার অ্যাজমার টানটা কমবে। হাতে ধরা পেনটা টেবিলে ছুড়ে ফেলে দিল অনুপম, চাপা গলায় বলল, “হােপলেস!’ কল্যাণী বেপরােয়া হয়ে ছেলের কাছাকাছি চলে গেলেন। বহু বছর যা করেননি তাই করলেন, সাহস করে ওর মাথায় আদরের হাত রাখলেন। আমাদের ভালাে তুই চাস না?” অনুপম চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকার পর কল্যাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মলিন গলায়  বললেন, ‘আমরা প্রতিমুহূর্তে তাের ভালাে চাই।। অনুপমের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বুবুটা অল্প-অল্প জেগে উঠল। মায়ের দিকে সামান্য চোখ তুলে আলতাে করে জিগ্যেস করল, “বাড়িটা কোথায়?  ‘শােভাবাজারে। ভুতুড়ে বাড়ি বদনাম নিয়ে বাড়িটা বহুবছর পড়ে ছিল। বিপিনকাকা ওটার খবর দিয়েছে। ভূতের ভয় আছে বলে দারুণ সস্তায় পাওয়া গেছে। ভূতের ব্যাপারটা শুনে অনুপম মজা পেল। বলল, ‘ভূত। আজকাল পাওয়া যাচ্ছে না কি? তাও আবার সস্তায়!

কল্যাণী ওর কাছ থেকে সরে এসে বিছানার ওপরে বসলেন। অনুপম বােধহয় একটু-একটু করে সহজ হচ্ছে। যেহেতু ভূতে ওর কোনওকালেই ভয়-ডর নেই, তাই একটা মজা মেশানাে চ্যালেঞ্জ হয়তাে তৈরি হচ্ছে।

‘আমি তাের বাবাকে বলেছি, “ও-বাড়িতে ভূতের ছিটেফোঁটা যদি থাকেও বুবু তাকে উদ্বাস্তু করে ছাড়বে। তােমার কোনও চিন্তা নেই।” তুই একদিন বাড়িটা দেখতে চল।

অনুপম হাসল বাড়িটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে…। তা ছাড়া শােভাবাজার তাে কাছেই। ইচ্ছে করলে তুই রােজই এ-পাড়ায় আসতে পারবি। পাতাল রেলে এসপ্ল্যানেডে নেমে বাসে এইটুকু পথ—কতক্ষণ আর লাগবে! আরও কিছুক্ষণ একথা সে কথা বলার পর ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন কল্যাণী। ওঁর মনে হচ্ছিল, বরফ গলতে শুরু করেছে।

বাড়িটা রেজিষ্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর প্যাচ রিপেয়ারের কাজে হাত দিয়েছিলেন বিপিন। সেটা শেষ হতে প্রায় মাস দেড়েক লাগল। তারপর একটা লাগসই ছুটির দিন খুঁজছিলেন সুনন্দ। অফিসের নানান ঝামেলা। ইউনিয়নের মিটিং, ফ্ল্যাটবাড়ির বাড়িওয়ালার কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত নেওয়া, এইসব মিলিয়ে সময় কাটতে লাগল।

তারই মধ্যে একদিন রাত দশটা নাগাদ অনুপম বাড়ি ফিরল উদভ্রান্তের মতাে। কল্যাণী রান্নাঘরে ছিলেন। অনুপম সেখানে উঁকি মেরে চাপা গলায় বলল, “মা, একবার শুনবে।

ওর গলায় এমন একটা টেনশান ছিল যে, কল্যাণীর খুন্তি ধরা হাত কেঁপে গেল। গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কী হয়েছে রে?

‘কেউ আমাকে ডাকতে এলে বলে দেবে “বাড়ি নেই”। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী ওর ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাইলেন। মনে হল যেন একটা অচেনা ভয় অনুপমের ভেতরে তিরতির করে কাঁপছে, কী ব্যাপার? কোনও গােলমাল হয়েছে না কি?’  কল্যাণীকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল অনুপম। মাথা ঝাকিয়ে বলল, না, কিছু হয়নি। তারপর চটপট চলে গেল নিজের ঘরের কে। কল্যাণী নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এবিষধর সাপ মসৃণ মেঝের ওপর দিয়ে খুব ধীরে-ধীরে যেন ওঁর দিকে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সাপটা ঠিক কোথায় ছােবল মারবে সেটা কল্যাণী আঁচ করতে পারছিলেন না।

পরদিন থেকেই সুনন্দ আর কল্যাণীকে অবাক করে দিয়ে অনুপম নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠল। বাড়িটা একদিন দেখেও এল ও। তারপর বলতে গেলে একরম ওর তাড়াতেই এক রবিবার দুপুরে নতুন বাড়িতে চলে এল ওরা। কৌতুহলের তাড়নায় সুযােগ বুঝে অনুপমকে বারকয়েক বিরক্ত করেছেন কল্যাণী। জানতে চেয়েছেন, অনুপম হঠাৎ ভয় পেয়েছে কেন। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনুপম এইটুকু বলেছে, ‘পাবলােদা খুব ডেঞ্জারাস টাইপের লোেক। ওঁর সঙ্গে আর বিজনেস করব না।

এরপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহু প্রশ্ন করেও অনুপমের কাছ থেকে আর কোনও কথা কল্যাণী
বের করতে পারেননি।
অনুপম শুধু একই কথা বারবার বলেছে, নতুন বাড়ির ঠিকানা এ-পাড়ার কাউকে দেবে
ওখানে ফোন এলে ফোন নাম্বারও কাউকে দেবে না।

কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়লেও কল্যাণী ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলেছেন, না—দেব না।” রবিবার সকালে ওঁরা যখন লরিতে মাল লােভ করে সঙ্গে প্রাইভেট কার নিয়ে রওনা হবেন, ঠিক তখনই শ্রীকান্তকে দেখতে পেলেন কল্যাণী। চোখে চশমা, কদমছাট চুল, পড়ুয়াগােছের দেখতে এই ছেলেটি স্কুলে বুবুর সঙ্গে পড়ত। এখন কলেজেও। মাঝে-মাঝেই বাড়িতে আসে। আজ ওঁরা চলে যাবেন শুনে দেখা করতে এসেছে।

প্রাইভেট কারের জানলা দিয়ে বুবুর সঙ্গে কথা বলার পর সুনন্দ আর কল্যাণীর সঙ্গে সৌজন্যের দু-চারকথা বলে চলে যাচ্ছিল শ্রীকান্ত। কল্যাণী ওকে লরির আড়ালে ডাকলেন। অনুপমের অনেক খবর রাখে শ্রীকান্ত। হয়তাে ওর কাছে অনুপমের আতঙ্কের একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
শ্রীকান্ত, শােনাে–।
‘কী, কাকিমা?’ কল্যাণীর কাছে এগিয়ে এল শ্রীকান্ত।
‘পালাে শিকদারের সঙ্গে বুবুর কি কিছু হয়েছে?’ চাপা গলায় জানতে চাইলেন কল্যাণী।
ওঁর বুকের ভেতরে একটা পাথর এপাশ-ওপাশ গড়াচ্ছিল।
তাে! কেন?’

তখন কল্যাণী অনুপমের ভয় পাওয়ার কথা বললেন। বললেন, বুবু বলেছে, পাবলােদা খুব ডেঞ্জারাস টাইপের লােক। ওঁর সঙ্গে বুবু আর বিজনেস করবে না। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে-কাটতে চারপাশে একবার দেখে নিল শ্রীমন্ত। তারপর নিচু গলায় বলল, “আমি বুবুকে বহুবার বারণ করেছি, কাকিমা। আপনারা এখান থেকে চলে যাচ্ছেন, খুব ভালাে হয়েছে। আসলে লাস্ট উইকে সােমবার রাতে রেললাইনের ধারে শর্মাদের সিমেন্ট গােডাউনের একজন নাইটগার্ড মার্ডার হয়েছে। রিভলভারের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গেছে…।

কল্যাণীর ভয়ে বুক কাঁপছিল। শ্রীকান্তর কথা আর শুনতে চাইছিলেন না তিনি কিন্তু শ্রীকান্তকে বারণ করার শক্তি ছিল না এতটুকু।
..পাড়ার অনেকেই খবরটা জানে। তবে কাগজে কিছু আসেনি। একটু দম নিয়ে শ্রীকান্ত বলল, ‘নাইটগার্ডটাকে পাবলাে শিকদার মার্ডার করেছে। তাতেই বুবু মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা কেমন করছিল। শ্রীকান্তকে কোনও রওকমে “আসি’ বলে প্রায় টলতে-টলতে প্রাইভেট কারের কাছে গেলেন কল্যাণী। ওঁকে দেখে সুনন্দ দুবার জিগ্যেস করলেন, “কী হয়েছে?

কিন্তু দুবারই কল্যাণী মাথা নেড়ে বােঝালেন কিছু হয়নি। অনুপম মাকে দেখছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছিল। দুটো গাড়ি রওনা হতেই স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কল্যাণী। মনে-মনে ভাবলেন, উৎকণ্ঠা আর দুঃস্বপ্ন চিরতরে পিছনে পড়ে থাক।। নতুনের পথ চেয়ে ওঁরা তিনজন অপেক্ষা করতে লাগলেন।

হাজার পােশাক বদল করেও আভিজাত্যকে লুকোনাে যায় না। ঠিক তেমনই রং-চং বা রিপেয়ার করে বাড়িটার প্রাচীন সৌন্দর্য চাপা পড়েনি। এক অদ্ভুত গর্ব এবং দীপ্তি নিয়ে দোতলা বাড়িটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গার ওপরে দুকাঠা জুড়ে বাড়ি । জানলাগুলাের ওপরে ঢালাই লােহার নকশা—তাতে রংবেরঙের কাচ লাগানাে। দোতলার বারান্দার রেলিংও ব্রিটিশ আমলের ঢালাই লােহার জাফরি দিয়ে তৈরি। কার্নিশে সিমেন্টের কারুকাজ। যে-কটা থাম চোখে পড়ে সবই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা। বিশাল লােহার গেট পেরােলেই দু-পাশে ছােট-বড় গাছের দল এলােমেলাে ভাবে দাঁড়িয়ে।

অনেকটা যেন না-আঁচড়ানাে চুলের মতাে। তারই ফাঁকফোকর থেকে পাখির ডাক শােনা যাচ্ছে। গেট থেকেই সাদা রঙের বাড়িটা দেখা যায়। গেট দিয়ে কেউ ঢুকলে দোতলার বারান্দা কিংবা তেতলার ছাদ থেকে তাকে স্পষ্ট চোখে পড়বে। বাড়ি আর গাছপালা মিলে জায়গাটা এমন যে, ভূতের যদি সত্যি-সত্যি কোনও অস্তিত্ব থাকত তা হলে এই আস্তানা তাদের বিলক্ষণ পছন্দ। গােটাপাঁচেক বড়-বড় ঘর। মার্বেল পাথর বসানাে মেঝে, বারান্দা, অলিন্দ। যদিও পাথরে লম্বা-চওড়া ফাটল ধরেছে। ইশ, মেঝেগুলাে কী ঠান্ডা। কল্যাণী খালি পায়ে মেঝেতে পা দিয়েই মন্তব্য করলেন।

‘স্রেফ ভূতের কল্যাণে বাড়িটা এমন সস্তায় পেয়ে গেলাম। সুনন্দ খুশির সুরে বললেন। ‘তাও আবার এমন ভূত যে, আগে বােঝা যায় না।’ মায়ের কথা শুনে অনুপম অবাক হয়ে গেল, বলল, তার মানে? কল্যাণী তখন বিপিন চ্যাটার্জির কথাগুলাে ছেলেকে মজা করে শােনালেন। মনে হল, বহুদিন পর কল্যাণী আর সুনন্দ ছেলেকে কাছে ফিরে পেয়েছেন। কল্যাণীর বুকের পাথরটা কখন যেন অণু- পরমাণু হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

অনুপম বলল, “মা, আমি দোতলার বারান্দাওলা ঘরটায় থাকলে তােমাদের প্রবলেম হবে? ‘প্রবলেম?’ কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন সুনন্দ আমরা তাে মনে-মনে ওই ঘরটাই তাের জন্যে ঠিক করেছি। দু-চারদিনের মধ্যেই নতুন বাড়িতে ওঁরা গুছিয়ে বসলেন।

প্রথম-প্রথম টেলিফোন ছাড়া বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। টেলিফোন ট্রান্সরের অ্যাপ্লিকেশান সুনন্দ অনেক আগেই করে দিয়েছিলেন। ফলে কুড়ি-বাইশ দিনের মাথায় টেলিফোন চলে আসামাত্রই ওঁরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নতুন বাড়িতে আর কোনও অসুবিধে রইলনা। সুনন্দর অফিস, কল্যাণীর স্কুল আর অনুপমের কলেজ নতুন বাড়ির সঙ্গে ছন্দে মানিয়ে গেল। এ ছাড়া পাড়াটাও বেশ নিরিবিলি আর নির্জন। পাবলো শিকদারের মতাে উৎপাত এখানে নেই।

কল্যাণীর মনে হল, এখানকার বাতাসে অক্সিজেন বোধহয় বেশি। অ্যাজমার টানটা কমে গেছে। ভেতরটা সবসময় কেমন চঞ্চল উদ্দাম হয়ে উঠতে চায়। ছাদের খােলা হাওয়ায় বেড়ানাে, বাগানে শুকনাে পাতা মাড়িয়ে পায়চারি, পাখির ডাক.ভাবা যায় না!  সুনন্দ কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বাড়ির আচকানাচে ভুত খুঁজে চলেছেন। তা নিয়ে বউ কিংবা ছেলের সঙ্গে ঠাট্টা-মজাও কম করছেন না রাত দশটার পর বাড়ির অন্ধকার ঘর, বারান্দা, কি অলিন্দে হঠাৎ করে পায়চারি শুরু করে দেন। চেঁচিয়ে কল্যাণীকে বলেন, “শােনাে, আমি এখন চিরুনি তল্লাশি করে ভূত খুঁজছি। আমাকে এখন ডিসটার্ব করবে না।’ তারপর সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি, তার সঙ্গে আবৃত্তি : “পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, / পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে…ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর- গেলা কেঁাকা রে, / অন্ধবনের গন্ধগােকুল, ওরে আমার হোঁৎকারে!” আয়, আয়—দেখা দে বাবা, দেখা দে…।’

জীবনের ছন্দ যখন বেশ সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে এল তখন একদিন কল্যাণী ছেলেকে একা পেয়ে শ্রীকান্তর কথাটা বললেন।

‘পাবলাে শিকদার মার্ডার করেছে শুনে তুই খুব আপসেট হয়ে গেছিস। আসলে ওইসব লোেক তাে এই টাইপেরই হয়। ওখান থেকে সরে এসে কত ভালাে হয়েছে বল তাে। বুবু মায়ের দিকে একবার তাকাল। তারপর দাঁত দিয়ে বাঁ-হাতের নখ কাটতে লাগল। বাইরে বেলা চড়ে এসেছে। গাছগুলাে খসখসে আওয়াজ তুলে হাওয়ায় দুলছে। ঘুঘু পাখির ডাক শােনা যাচ্ছে। বারান্দার মার্বেলের দিকে তাকানাে যাচ্ছে না। রােদ পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

বুবু হঠাৎ এক অদ্ভুত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। কয়েক লহমা চুপ করে থাকার পর বলল, “শ্রীকান্ত পুরােটা জানে না। তােমাকে সত্যি কথাটা বলে দেব? ভয় পাবে না তাে? কল্যাণীর মুখ পলকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চেরা গলা দিয়ে ভালাে করে আওয়াজ বেরােল না। বেশ কষ্ট করে বললেন, ‘না-বল।’

‘পাবলােদা যখন ওই নাইটগার্ডটাকে মার্ডার করে তখন আমি দেখে ফেলেছি। পাবলােদাও আমাকে দেখে ফেলেছিল। পরদিন এ-কথা আমার কাছ থেকে শােনার পর স্যান্টো আর অভিরূপ…ওরা আমার খুব বন্ধু…আমাকে বলেছিল, পাবলােদা মার্ডারের কোনও সাক্ষী রাখে না। আমি যখন বললাম, পাবলােদা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতাে ভালােবাসে, খুব লাইক করে—তখন স্যান্টো বলে, বাইরে থেকে দেখে তুই পাবলােদার ভেতরটা কিছু বুঝতে পারবি না। আর…আর অভিরূপ আমার দিকে আঙুল তুলে হাতটা রিভলভারের মতাে এইরকম করে মুখে ঠুস করে গুলি করায় শব্দ করেছিল…।

কল্যাণী অনুপমের কথাগুলাে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ছেলের মুখটা কী করুণ আর মলিন দেখাচ্ছে! তা হলে সেই সময়ে ও মৃত্যুভয়ে পাগল ছিল! ‘এখানে আর কোনও ভয় নেই, বলাে, মা— কল্যাণীর দিকে চেয়ে হাসল অনুপম ও তা ছাড়া আমি তাে আর পুলিশকে কিছু বলিনি। ধীরে-ধীরে হাত বাড়িয়ে ছেলের ডানহাতটা আলতাে করে চেপে ধরলেন কল্যাণী। অনুপমের হাতটা কেমন ঠান্ডা মনে হচ্ছিল। বিড়বিড় করে কল্যাণী বললেন, ‘তাের কোনও ভয় নেই…আমরা তো আছি…। জানলার বাইরে থেকে বুলবুলি পাখির ডাক শােনা গেল।  ওরাও আমার পাশে আছে। ভাবলেন কল্যাণী ।

“আর-একটা কথা তােমাকে বলব, ?’ আচমকা কথা বলল অনুপম। ‘কী, বল। ‘গতকাল রাতে আমার একটা ফোন এসেছিল। বাবা আমাকে ডেকে দিয়েছিল। আমি যখন ফোনটা ধরে “হ্যালাে বললাম তখন ওপাশ খেকোনও সাড়া পেলাম না। অনেকক্ষণ ধরে “হ্যালাে হ্যালাে” করেও যখন সাড়াশব্দ না হয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছি তখন চাপা গলায় কে যেন বলল, “অনু তাে?” তারপরই লাইন কেটে গেল। অনুপমের মুখে কালাে ছায়া নেমে এল হঠাৎ। নিচু গলায় অস্পষ্টভাবে ও বলল, ‘পাবলেদা আমাকে ‘অনু” বলে ডাকত। আমাদের ফোন নাম্বার পাবলােদা জেনে গেছে, মা। কল্যাণী ভয় পাচ্ছিলেন, তবে প্রাণপণ চেষ্টায় সেটা ছেলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলেন। ওর হাতে চাপ দিয়ে পুরােনাে কথাটাই আবার বললেন, “আমরা তাে আছি…।

বুবু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। কিন্তু সন্ধেবেলাতেই অনুপম সবকিছু ভুলে হুল্লোড়ে মেতে উঠল। ওর কলেজের তিন বন্ধু সুমিত, কিশাের আর সুবর্ণা এল ওদের বাড়িতে। ঘণ্টাখানেক পড়াশােনা চলার পর টেপ রেকর্ডার চালিয়ে গানবাজনা শুরু হল। সঙ্গে কল্যাণীর হাতে তৈরি চিংড়ির পকোড়া, ফিঙ্গার চিপস, আর কফি।

আরও ঘণ্টাখানেক হইহই করে আড্ডা দিয়ে ওরা চলে যাওয়ার পর সুনন্দ বুবুকে বললেন, ‘তাের বন্ধুবান্ধবদের মাঝে-মাঝেই আসতে বলিস। তা হলে অন্তত ভালাে-মন্দ খাবার কিছু কপালে জুটবে। আড়চোখে কল্যাণীর দিকে তাকালেন তিনি।

কল্যাণী রাগ দেখিয়ে বললেন, তুমি ছেলের সামনে মিথ্যে কথা বললে! কেন, তােমাকে প্রন পকোড়া কি ফিঙ্গার চিপস কখনও করে খাওয়াইনি?’ হাসলেন সুনন্দ ঃ খাইয়েছ। তখন বুবু ছােট ছিল—হামাগুড়ি দিত। বুবু মজার চোখে মা-কে দেখছিল। কল্যাণী ওকে জিগ্যেস করলেন, “কী রে, তাের মনে নেই? ‘কী করে মনে থাকবে। আমি তাে তখন হামাগুড়ি দিতাম। বাবা আর ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠল। কল্যাণী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আমিও শােধ নেব। তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

সেদিন রাতে আবার সেই ফোনটা এল। সুনন্দ ফোনটা ধরে বুবুকে দোতলা থেকে ডাকলেন। বুবু ফোন ধরে অনেকবার ‘হ্যালাে’ বলেও ও-প্রান্ত থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেল না। ও বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিল। তারপর যেভাবে সিঁড়ি লাফিয়ে দোতলায় উঠল তাতে মনে হল ভয়টা এবার ওকে কামড় বসাতে পারেনি। পরদিন বুবু কলেজে বেরিয়ে গেল, সুনন্দও অফিসে রওনা হলেন, কিন্তু কল্যাণীর ছুটি থাকায় অলসভাবে একা-একা দিনটা কাটালেন। বিকেলে ছাদে উঠে আনমনাভাবে পায়চারি করতে-করতে নানান পুরােনাে কথা ভাবছিলেন। এইভাবে কখন যেন ছাদের আলসের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

বড়-বড় গাছের পাতার ফাক দিয়ে সদরের লােহার গেটটা দেখা যাচ্ছিল। গেটটা সবসময় ফুটদুয়েক ফাক করে চেন-তালা দিয়ে বাঁধা থাকে। গেট থেকে যে-পথটা বাড়ির দিকে এগিয়ে এসেছে সেটা গাছের সবুজ পাতায় খানিকটা আড়াল হয়ে গেছে। পথের এখানে-ওখানে শুকনাে পাতা ছড়িয়ে আছে। কাল সকালে কাজের মাসি আবার ঝাট দেবে। কখন ফিরবে বুবু? বলেছিল সন্ধের আগেই ফিরবে। হঠাৎই কল্যাণী দেখলেন, একটি ছেলে গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার রােগা চেহারা অনেকটা অনুপমের মতােই। তবে একটু বেশি লম্বা মনে হল। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে থাকায় কল্যাণী মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না। ছেলেটা এগিয়ে আসতে-আসতে দোতলার বারান্দার আড়াল হয়ে গেল। এইবারই বােধহয় কলিংবেল বাজাবে!

তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলেন কল্যাণী। দরজ়ার কাছে যেতে-যেতে কলিংবেলের শব্দ আশা করছিলেন, কিন্তু কোনও শব্দ হল না!  দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন। কেউ নেই!

এলােমেলাে শুকনাে পাতা ছড়ানাে পথটা চুপচাপ একা-একা লােহার গেট পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাড়িয়ে গেছে। আর কেউ নেই।

রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির শব্দ, গাছের মাথায় পাখিদের শেষ বিকেলের কিচিরমিচির, বাতাসে দোল-খাওয়া পাতার খসখসানি শুনতে পাচ্ছিলেন কল্যাণী। কিন্তু কারও পায়ের শব্দ নেই। বাইরে বেরিয়ে বাড়িটার চারপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। না, কেউ নেই। তখন কল্যাণী বাইরের লােহার গেটের কাছে গেলেন। রাস্তায় পা দিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখলেন। নাঃ, ওরকম চেহারার কোনও ছেলেকে চোখে পড়ছে না। গেট থেকে খানিকটা দূরে একটা ঝুপড়ি-দোকান। চা-ঘুগনিরুটি বিক্রি করে। ওই দোকানদারকে কি জিগ্যেস করা যায়? না, জিগ্যেস করলে লােকটা ভাববে কল্যাণী ভূতের ভয় পেয়েছেন।

কল্যাণী বাড়িতে ঢুকে পড়লেন আবার। মনে হয়, তিনি যখন নীচে নামছিলেন, ছেলেটা তখন গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে। বােধহয় ভুল করে এবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। সুনন্দ আর অনুপম বাড়িতে ঢােকামাত্রই ব্যাপারটা ওদের জানালেন। দুজনেই আহ্বাদে একেবারে লাফিয়ে উঠল : ‘এতদিনে তা হলে ভূতের দেখা পাওয়া গেছে।

সুনন্দ ঠাট্টা করে বললেন, ‘বিপিন দেখছি ঠিকই বলেছিল ? আগে বােঝা যায় না। তবে মানতেই হবে, এ নিতান্ত নিরিমিষ ভূত। এল আর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। বুবু চাপা গলায় বলল, “বাবা, মা কিন্তু এবার রেগে যাবে। কল্যাণী গম্ভীরভাবে বললেন, “আমি ভূতের কথা কিছু বলিনি—মানুষের কথাই বলেছি। আমি ভেবেছি তােমাকে বা বুবুকে কেউ খুঁজতে এসেছে। ‘দেখতে কেমন, মা?’ বুবু জিগ্যেস করল। ‘ওপর থেকে মুখটা ভালাে করে দেখা যায়নি। ‘বােধহয় ভুল করে এ-বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।’ সুনন্দ মন্তব্য করলেন, “আমি তােমার সঙ্গে এতক্ষণ মজা করছিলাম। এবার কি একটু চা খাওয়াবে?

কল্যাণী হেসে বললেন, ‘অত তােয়াজের দরকার নেই—এমনিতেই চা খাওয়াতাম।ঠোঁটে একচিলতে হাসি নিয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখল বুবু। সত্যি, এ-বাড়িতে এসে ওদের জীবনটাই যেন বদলে গেছে! চারপাশটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনটাও কেমন সবুজ আর খােলামেলা হয়ে গেছে। সেদিন রাতে ও অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখল।

পরদিন সকালে সুনন্দ একটু বেলা করেই বাজারে বেরােচ্ছিলেন, গেটের সামনে একটি লােকের সঙ্গে ওঁর দেখা হল। বয়েস আঠাশ কি তিরিশ হবে। চোখে সাধারণ ফ্রেমের চশমা। ফরসা সৌম্য মুখে একটা হাসি-হাসি ভাব। নাকের বাঁ-পাশে একটা বড় তিল। চুলগুলাে সামান্য উশকোখুশকো—যেন দু-চারদিন তেল কি চিরুনি পড়েনি। গায়ে রঙিন চেক শার্ট, পায়ে জিনস। ‘কাকু, অনুপম আছে?’ হাসিমুখে জিগ্যেস কর ছেলেটি। মুখটা চেনা-চেনা লাগছে কি? সুনন্দ ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না। ওঁর কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।

‘চিনতে পারছেন না! আমি অভ্র। অনু কি গল্প’ পড়ছে এখন? ‘কী জানি, পড়ছে বােধহয়। তুমি যাও না, ও দোতলার ঘরে আছে। অভ্র হেসে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সুনন্দ চলে এলেন গেটের বাইরে। হঠাৎই ওঁর মনে হল, অভ্রর জামার ফাক দিয়ে তিনি যেন একটু ব্যান্ডেজ মতাে দেখতে পেয়েছেন। কে জানে, ফুটবল খেলতে গিয়ে হয়তাে পাঁজরে চোট পেয়েছে। বাজার করে ফিরতে-ফিরতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। সদরের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কল্যাণীকে দেখতে পেলেন। একটা গাছের আড়াল থেকে এমন উদভ্রান্তের মতাে বেরিয়ে এলেন যেন কাউকে খুঁজছেন।

সুনন্দকে দেখেই কাছে এগিয়ে এলেন কল্যাণী। হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করলেন, ‘বুবুকে বাইরে কোথাও দেখলে ? না তাে! কী হয়েছে? সুনন্দ কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। ‘তুমি বাজারে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ঘরে ব্রেকফাস্ট দিতে গিয়ে দেখি নেই। তারপর এখানে-ওখানে সব জায়গায় খুঁজলাম…’ যন্ত্রের মতাে মাথা নাড়লেন কল্যাণী ও ‘কোথাও নেই….।

‘অভ্র নামে ওর এক বন্ধু যে ওকে খুঁজতে এল…আমি বললাম, তুমি যাও, ও দোতলায় আছে…সেই ছেলেটা কোথায়? ‘অভ্র? দেখা করতে এসেছিল? আমি তাে টের পাইনি! ‘তুমি হয়তাে রান্নাঘরে কি টয়লেটে ছিলে—–টের পাওনি। দ্যাখাে, ওর সঙ্গেই কোথায় বেরিয়েছে। এক্ষুনি চলে আসবে। সুনন্দ কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তাড়াহুড়াে করতে হবে, নইলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে। কল্যাণীর মন মানছিল না। যেতে-যেতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। স্কুলে যাওয়া তখন ওঁর মাথায় উঠেছে।

সুনন্দর কাছে অভ্রর চেহারার বর্ণনা শুনে কল্যাণী বললেন, মনে হচ্ছে, কাল বিকেলে এই ছেলেটাই গেট দিয়ে ঢুকেছিল। পরে কী ভেবে চলে গেছে। সুনন্দ চুপ করে রইলেন। সাড়ে দশটায় তিনি যখন অফিসে বেরােলেন তখনও বুবু ফিরল না। রাস্তায় বেরিয়ে এদিক-ওদিক দোকানদারদের কাছে খোঁজখবর করে জানতে পারলেন, অনুপমকে তারা একটি ছেলের সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখেছে। এর বেশি আর কেউ কিছু জানে না।

সুনন্দর অফিসে বারবার ফোন যেতে লাগল ও বুবু এখনও ফেরেনি। সুনন্দ বাধ্য হয়ে অফিস থেকে বাড়ি চলে এলেন। তারপর শুধু একে-তাকে ফোন করা, বুবুর খোজ করা। বুবুর ঘর সার্চ করে ওর একটা ছােট্ট ডায়েরি পাওয়া গেল। তার মধ্যে কিছু ফোন নম্বর পাওয়া গেল। তারপর আবার ফোন। ফোনের পরে ফোন। কিন্তু কোনও লাভ হল না। বুবু কোথাও নেই। রাত দশটার সময় স্বামী-স্ত্রীতে মিলে এলাকার থানায় মিসিং ডায়েরি করলেন। ছেলের একটা ফটো জমা দিয়ে সব খুলে বললেন। অভ্র’ নামের ছেলেটি চেহারার বর্ণনাও দিলেন।

থানার অফিসার-ইন-চার্জ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো এদের আশ্বাস দিলেন ঃ “আপনারা বাড়ি যান। আমরা কাজ শুরু করে দিচ্ছি। হসপিটালার্মিংহােম সব খোঁজ করে দেখছি কোনও অ্যাক্সিডেন্টের কেস গেছে কি না। আর অভ্র ছেলেটাকেও আমরা ট্রেস করার জন্যে লেভেল বেস্ট চেষ্টা করছি। দরকার হলে আপনাদের পুরােনাে পাড়াতেও এনকোয়ারি করব। ওর যেসব বন্ধুদের নামধাম দিলেন তাদেরও ইন্টারােগেট করে দেখব। মােদ্দা কথা, উই আর পুটিং ইন আওয়ার বেস্ট এফার্টস। কোনও লিডই আমরা বাদ দেব না। রাতের নির্জন পথ ধরে ওঁরা বাড়ি ফিরে এলেন। এতক্ষণ কল্যাণী বারবার চোখ মুছছিলেন। বাড়িতে এসে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে হাউহাউ করে কঁদতে শুরু করলেন। আর সুনন্দর বুকের ভেতরটা থেকে-থেকেই মুচড়ে উঠছিল। ওঁরা দুজনেই বুঝতে পারছিলেন বুবুকে ওঁরা কত ভালােবাসেন।

চুলচেরা তদন্ত করেও পুলিশ অনুপমের কোনও হদিশ পেল না। প্রতিদিন থানায় খবর নিয়ে নিয়ে সুনন্দ আর কল্যাণী ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ওঁদের ওপরে অভিমান করে বুবু কি চিরদিনের জন্য ওঁদের ছেড়ে চলে গেল ? কিন্তু কেন যাবে! আর অভ্রকেই বা কেন সঙ্গে নেবে। দশদিনের দিন ও. সি. একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে সুনন্দদের বাড়িতে এলেন। রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা।

মুখটাকে পাথরের মতাে করে সুনন্দ টিভি দেখছিলেন। কল্যাণী ভেতরের ঘরে গােছগাছের কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখছিলেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে অফিসার-ইন-চার্জকে দেখেই সুন্দর মুখ শুকিয়ে গেল। ও. সি.-কে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কোনও খারাপ খবর নিয়ে এসেছেন। ওঁর মুখ গম্ভীর। হাতে একটা ফাইল। ওঁকে বসতে দিয়ে কল্যাণীকে চেঁচিয়ে ডাকলেন সুনন্দ! টের পেলেন, গলা কেমন যেন চিরে গেল।

ও. সি. বললেন, ‘সরি, মিস্টার চৌধুরী, আপনার ছেলেকে এখনও আমরা ট্রেস করতে পারিনি। আমরা যা-যা করার সব করেছি..বাট য়ু নাে…মানে, এখন লালবাজারের মিসিং পারসন্স স্কোয়াডের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দিতে হবে। কল্যাণী কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিথরভাবে অফিসারের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

সুনন্দ ইতস্তত করে বললেন, ‘এখন….এখন আমাদের কী করার আছে? ‘সেটাই তাে ভাবছি…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোয়ালে হাত বােলালেন অফিসার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎই বললেন, ‘ও হা, যে জন্যে এসেছি। ইনভেস্টিগেট করে একটা ব্যাপার আমরা কনফার্ম করতে পেরেছি। আপনাদের ছেলের কিডন্যাপিং-এর পেছনে–মানে, যদি কেসটাকে আমরা কিডন্যাপিং বলে ভাবি—ওই পাবলাে শিকদারের কোনও হাত নেই। কারণ, অনুপম মিসিং হয় এগারাে তারিখ সকালে আর ওই অ্যান্টিসােশ্যালটা দশ তারিখে দুটো গ্যাং এনকাউন্টারে গুলি খেয়ে সিরিয়াস ইনজুরি নিয়ে হসপিটালাইজ্‌ড হয়। আর তার পরের দিনই মারা যায়…।

‘ও যদি কোনও শাগরেদকে পাঠিয়ে থাকে। মানে, ওই অভ্র নামের আননােন ছেলেটা যদি ওর গ্যাং-এর হয়…।’ সুনন্দ আর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ‘এই দেখুন না, ওখানকার লােকাল থানা থেকে আমরা পাবলাের ফাইলের কপি আনিয়েছি। তাতে ওর দলের লিস্টে “অভ্র” নামটা পাইনি। হাতের ফাইল খুলে ও, সি. পাতা ওলটাচ্ছিলেন। ফাইলের দিকে চোখ পড়তেই সুমন্দ চমকে উঠল্লেন! এ কী! ওই ছবিটা কার? আচমকা ফাইলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে হাতুড়িয়ে একটা পৃষ্ঠা চেপে ধরলেন সুনন্দ। সেই পৃষ্ঠায় আঁটা একটা পাসপাের্ট ফটো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে বললেন, “এই তাে! এই তাে অভ্র! এই…এই ছেলেটাই সেদিন বুবুকে খুঁজতে এসেছিল। কল্যাণী প্রায় ছুটে চলে এলেন সুনন্দর পাশে। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আঁচ করতে চাইলেন, এই ছেলেটিকেই তিনি দশ তারিখে ছাদ থেকে দেখেছিলেন কি না। অফিসার অবাক হয়ে তাকালেন স্বামী-স্ত্রীর দিকে।

‘কী বলছেন আপনি! অভ্র কেন হবে! এটা তাে ওই গ্যাংস্টার পাবলাে শিকদারের ছবি। সঙ্গে-সঙ্গে যেন শীত নেমে এল ঘরের মধ্যে। প্রাচীন বাড়িটা অন্তর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুনন্দ ঘামতে শুরু করলেন। কল্যাণী বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগলেন। অ্যাজমার টানটা ওঁকে কষ্ট দিচ্ছিল।

দশ তারিখে পাবলাে শিকার কখন গুলি খেয়েছে? জানতে চাইলেন কল্যাণী। ওঁর কাপা গলা উত্তেজনায় টান-টান।

সুনন্দর হাতটা সরিয়ে দিয়ে ফাইলের পাতা ওলটালেন ও. সি.। পকেট থেকে রিডিং গ্লাস বের করে মনােযােগ দিয়ে দেখে বললেন, ‘রিপাের্টে আছে সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। সুনন্দ অবাক চোখে কল্যাণীর দিকে তাকালেন। কী বলতে চাইছেন কল্যাণী? ছেলের শােকে ওঁর কি মাথার গােলমাল হয়ে গেল!

‘পরদিন পাবলাে শিকদার ক’টার সময় মারা গেছে?’ ভাঙাচোরা গলায় কল্যাণী আবার প্রশ্ন করলেন। ফাইলের পাতায় তর্জনীর দাগ টানতে-টানতে উত্তরটা খুঁজে পেলেন অফিসার। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ…।

সবাইকে চমকে দিয়ে কান্নায় ভাঙচুর হয়ে গেলেন কল্যাণী। সুনন্দর হাত আঁকড়ে ধরে বুকফাটা গলায় হাহাকার করে উঠলেনঃ ‘বুবু আর কোনওদিন ফিরে আসবে না গাে, আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। ওঃ…মাগাে…মা…। ‘কী হল তােমার! পাগলের মতাে এসব কী বলছ! সুনন্দ কল্যাণীর দুকাঁধ ধরে জোরে ঝাকুনি দিলেন ঃ তুমি শান্ত হও। প্লিজ….।

মুখে আঁচল গুজে কান্না বন্ধ করতে চাইলেন কল্যাণী। জড়ানাে গলায় স্বামীকে বললেন, ‘এখনও তুমি বুঝতে পারােনি! তােমার বন্ধু ঠিকই বলেছিল ? আগে বােঝা যাবে না। পরে, অনেক পরে, যখন বুঝবে…তখন…তখন আর কিছু করার থাকবে না। অনেক দেরি হয়ে যাবে…অনেক দেরি হয়ে যাবে।

সুনন্দ এবার বােধহয় একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন। বিপিন চ্যাটার্জি তা হলে একবর্ণও মিথ্যে বলেননি।

ও. সি. কল্যাণীর কথার কোনও মাথা-মুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি সুনন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন ? কী ব্যাপার?

কল্যাণী তখন জল-ভরা শূন্য দৃষ্টি মেলে ভূতে পাওয়া মানুষের মতাে বিড়বিড় করে বলে চলেছেন …দশ তারিখ বিকেলে পাবলাে শিকদার গুলি খেয়ে মরতে-মরতেও মরেনি। তাই ও আসতে-আসতেও আসেনি। ওর প্রেতাত্মা আমাকে আবছাভাবে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে। পরদিন সকালে পাবলাে শিকদার মারা যেতেই ওর প্রেতাত্মা এসে হাজির হয়েছে। নিশির ডাকে ভুলিয়ে আমার ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বুবু আমাকে বলেছিল, পাবলাে শিকদার মার্ডারের কোনও সাক্ষী রাখে না। ওঃ মাগাে..। সুনন্দ মাথা ঝুঁকিয়ে দু-হাতে কপাল চেপে ধরলেন। চাপা কান্নায় ওঁর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছিল।

ও. সি, কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কল্যাণী ফিসফিস করে নিজের মনেই কীসব বলছিলেন। তবে ওঁরা তিনজনেই বুঝতে পারছিলেন, অনুপম আর কোনওদিনও ফিরে আসবে না।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত