মৌ ডাকে

মৌ ডাকে

দুপুর থেকে রুকুর কোনো সাড়াশব্দ নেই। বোধ করি এখনো ড্রেসিং টেবিলের চেয়ারটায় ঠায় বসে আছে। ব্যালকনি থেকে ওকে দেখার জন্য ঘাড় সামান্য ঘোরাতেই আমার চোখ পড়লো বড় আয়না টার ওপর। হায়, মারুফ হায়দার খান ! কী দোষ করেছিলে তুমি ? না কি পূর্ব-পুরুষদের কারো পাপের ভার তোমাকে বইতে হল এভাবে ? আমার চোখের নিচে কালি । গাল বসে গেছে । চুল ধব ধবে শাদা। কোনো রকম ভয় নয়, একটা অস্ফুট কান্না কেবল গলার কাছে অটকে আসছিলো। পাথর হয়ে বসে আছে রোকেয়া আমার রুকু। এই মুহুর্তে পেছন-ফেরা বলে ওর চোখ-মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে আজ সকালে ওকে দেখে কষ্ট আার ভয়-মেশানো একটা অনুভুতি আমাকে কাবু করে ফেলেছিলো। রুকু একদম অচেনা হয়ে গেছে, যেন ওর সত্তা জেগে আছে দুর কোনো নিঝুম দ্বীপে নিজীব দেহের কাঠামোটা শুধু কলের পুতুলের মতো নড়াচড়া করছে পুরানা পল্টনের এই ফাকা বাড়িটায় ।

রুকু চলে যাবে । খুলনা থেকে ওর চাচাতো ভাই আসছে ওকে নেওয়ার জন্য। হয়তো এ যাওয়া চিরদিনের জন্য। আমার রুকু এক দিন চারটি ফুটফুটে সন্তান ও একজন প্রেমিক স্বামী নিয়ে নিজেকে ভেবেছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী। ও স্বপ্নে-ছিলো পাঁচ বছর আগের সেই দৃশ্যটা । ফাহিম , আর পলির হাত ধরে একটা অদ্ভুত ঢেউ তুলে মেয়েটার দিকে হেঁটে যাচ্ছে রুকু । সেই মেয়েটা। মূর্তির মতো বসে আছে শত বছরের ক্ষয়ে যাওয়া একটা ভাঙা দেয়ালের ওপর। রুকু একবার আমার দিকে তাকালো। এ  কোন্ রুকু ! পুরো ব্যাপারটা এভাবে শুরু হয়েছিলো। খুব সাদা মাঠা ভাবে, আাশ্বিনের এক বিকেলে ।

একটা লম্বা দুঃস্বপ্ন। এর মধ্যে সব ছারখার, তছনছ। সব সব। রুকুর আর হারাবার কিছু নেই। আর আমি ? ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এই কনকনে শীতে তেষ্টায় আমার গলা শুকিয়ে আসে, ঘামতে থাকি । শেষ বিকেলের রোদ হঠাৎ উধাও । একটা পুরু কুয়াশার অপাৰ্থিব চাদর বুলতে থাকে সমস্ত পুরানা পল্টন, বিজয় নগর জুড়ে। কুয়াশার ভেতর একটা আবছায়া সুড়ঙ্গ। তার ভেতর দিয়ে আমার চোখ চলে যায়•••••• ।

১৯ সেপ্টেম্বর । ১৯ ৮০।

এক নাগাড়ে তিনদিন বৃষ্টির পর ঝলমলে রোদ উঠেছে। আকাশে মেঘের কণাটুকু নেই। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ উপুড় হয়ে আছে আমাদের বাড়ির সামনের দীঘিটায়। বছর দুই হলো আমরা এসে উঠেছি সোনার গায়ে আমার পৈতৃক বাড়িতে। আমার কিংবা রুকু কারো ইচ্ছে ছিলো না। বিশেষ ক’রে রুকু জন্ম থেকে ঢাকায়। তার ওপর রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে ওর সবে নাম-টাম হচ্ছে। তাছাড়া একট নামকরা বিজ্ঞাপনী ফার্মের আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে আমারও মন্দ চলছিলো না। ফাকে ফাকে বইয়ের কভার, নিজের আঁকা ছবির একজিৰিশন । কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন।

মা গত হয়েছেন দশ বছর আগে । দুরসম্পর্কের এক চাচা খবর পাঠালেন, বাড়িটার ওপর মতলব বাজ আত্মীয়-স্বজন অনেকের নজর আছে। এক্ষুণি গিয়ে না উঠলে ওটা যে কোনো দিন বেহাত হয়ে যেতে পারে। আমার চার ভাই বোনের মধ্যে বড় ভাই বিদেশে । ছোট বোন চম্পা আত্মহত্যা করে যখন ওর বয়স আঠায়ে কি উনিশ । আরেক বোন বিশ বছর ধরে স্বামী সংসার নিয়ে রংপুরে। ১৯৬০ এ রিটায়ার করে মাকে নিয়ে বাবা চলে আসেন  সোনার গায়ের বিশাল বাড়িটায়। সেই থেকে তিনি এলাকার প্রফেসর সাহেব। অধ্যাপনা করেছেন পচিশ বছর, তাছাড়া আমার পিতামহের সূত্রে পাওয়া প্রচুর বই ছিলো সমস্ত বাড়ি জুড়ে । মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাবা বই পত্র নিয়েই ডুবে ছিলেন।

ঃ আব্বা আজ রোববার, যাবে না ? অনেক লোক আসবে বেড়াতে।

আমার ছোট্ট ছবি আঁকার ঘরটার দরজায় মন্টি দাড়িয়ে। তাই তো, আইডিয়াটা মন্দ নয়। বৃষ্টিতে ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি। আজ চমংকার ওয়েদার । ঢাকা থেকে দলে দলে দেশী বিদেশী লোক জন আসবে। একটা উৎসবের আামেজ ম’ম’ করছে। সোনার গা, পানাম নগর। শুরুর দিকে আমরা সপ্তাহে চার পাচ বার যেতাম। রুকুর আকর্ষণ ছিল ফোক মিউজিয়াম। পরে অবশ্যধীরে ধীরে টান কমে এসেছে। ভাবখানা এমন, ইচ্ছে হলেই তো যেতে পারি, এমন কী আর ।

ঃ কী আব্বা, যাবে না ? তুমি না গেলে আমরা আম্মুর সাথে যাবো ।

ঃ যাবো না কে বললো? তোমার আম্মুকে ডাকে।

দুপুর সামান্য পড়ে আসতে আমর বেরলাম । আমাদের বাড়ি থেকে মূল সোনার গা এক মাইলের মতো পথ । বরাবর হেঁটেই যাই ।  রাস্তার দু’পাশে ঘন ঝোপ-জঙ্গল, লিচু বাগানের ফাকে ফাঁকে একটা দুটো ছোট শনের ঘর । বেশ কিছু দুর যাওয়ার পর আধ-পাকা রাস্তা৷ গিয়ে ঢুকেছে পানাম নগরের ধ্বংসাবশেষের ভেতর। আজ সত্যি, এলাকাটা জুড়ে বেশ বাইরের মানুষ, অধিকাংশই ছোট ছোট পরিবার । এর ভেতর ক্যামের হাতে একজন কি ছজন বিদেশী। ঈশা খা’র প্রাচীন রাজধানী দেখতে এসেছে সবাই ।

আমাদের মধ্যে উৎসাহ বেশি মন্টি আর পলির। মন্টি আমার মেজো ছেলে। বয়স ছয়। মেয়ে পলির চার। ওরা হৈ চৈ করে এগুচ্ছিল। ওদের আম্মুর সঙ্গে। রুকুর কোলে আমাদের ছ’মাসের ছেলে অপু আপন মনে আঙ্গল চুষে  যাচ্ছিলো। অনেকদিন পর সালোয়ার কামিজ পরেছে রুকু। দারুণ লাগছিলো! গত দু’বছরের মধ্যে আমার এই প্রথম মনে হলো, চার সন্তানের জননী হয়েও রুকু দেখতে এখনো একুশ বছরের উচ্ছল তরুণী—ঠিক যখন আমাদের বিয়ে হয়। আমার সঙ্গে নীরবে হেটে আসছিলো বড় ছেলে ফাহিম । ওকে বলা যায় আব্বুর চ্যালা। স্বভাবও পেয়েছে আমার। সারাদিনে চার-পাঁচটার বেশি কথা নেই। হয়তো বই নয়, রং-তুলি নিয়ে বিশাল বাড়ির কোনো এক ঘরে মশগুল । এই মুহুর্তেও ওর হাতে একটা গল্পের বই। আমরা খাটতে হাটতে পানাম নগরের সরু গলি পেরিয়ে এসেছি। এদিকটায় লোকজন কম, কেবল দুরে একটা পুরনো ফাঁকা বাগানবাড়ি। ওখানেও কৌতুহলী টুরিস্টরা যায় মাঝে মাঝে। ফাহিম ?

আমার পাশে নেই ছেলেটা। আশ্চর্য, গেলো কোথায় ? ও ঠিক আমার পিছু পিছু আসছিলো ।

ঃ ফা-হি-ম!

গলা চড়িয়ে এবার ডাকলাম আমি। কোনো শব্দ নেই। রুকুরা কলকল ক’রে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার গল বোধহয় ওরা শুনতে পায়নি। কিন্তু ফাহিম গেলো কোথায় ? আমার অ্যমনস্কতার ফাঁকে রুকুদের সঙ্গে যোগ দেয়নি তো ? ভালে৷ করে লক্ষ্য করলাম আমি। ওরা তখন আরো অনেকখানি এগিয়ে গেছে। হাটছেও দ্রুত। ওদের থেকে সামান্য আগে বাগান বাড়িটার ফটকে একটা ভাঙ্গ দেয়ালের ওপর নিশ্চল বসে আছে এক বিদেশিনী। মেয়েটার চুলের গোছা পিঠ অবধি ছড়ানো। আমার মনে হলো প্রেগনেন্ট। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না। রুকু রা ওর দিকেই যাচ্ছিলো। আমি লক্ষ্য করলাম রুকুর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে শুধু মন্টি এবং পলি । কোলে অপু । ফাহিমকে দেখলাম না । ঝকমকে দিনের আলোয় আমার কেন জানি গা ছম ছম করতে লাগলো।

: রুকু, রুকু !

আমি ডাকলাম। শুনতে পেয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ও আমাকে দেখলে কিন্তু এ কোন্ রুকু ! ওর চোখ নিস্পলক, মুখের আদল কঠিন। ঠোঁটের কোণে একটা অচেনা অদ্ভুত হাসি । আমি আবার ডাকলাম, ‘রুকু, ফাহিম কোথায় ? ‘ওকে পাচ্ছি না ।’ যেন শুনতে পায়নি, এমন একটা ভান করে ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে বিদেশী মেয়েটার দিকে । হঠাৎ আমি ফাহিমের গলার শব্দ পেলাম। পেছন

ফিরে তাকাতেই দেখি পানাম নগরের শেষ বাড়িটার দোতলায় একটা ছোট কুঠুরির জানালায় ফাহিম। আমাকে দেখে প্ৰাণ-পণে হাত নেড়ে ডাকছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেলাম আমি ঘরটার দিকে । সিড়ির মুখে আমাকে দেখে বুকে ঝাপিয়ে পড়লে ও। “আব্বু , একটা কালো কুকুর “তাড়া করেছিলো ।’ কাপতে কাপতে বললো ফাহিম।

: কখন ? কোথায় কুকুর ? তুমি আমার পেছন পেছন আসছিলে না ?

ও যা বললে। তার মানে দাড়ায়, ও আমার ঠিক পেছনেই ছিলো । হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই দেখে একটা বড় কালো কুকুর। ওর দিকে বড় বড় চোখ মেলে দাড়িয়ে আছে। ও আমাকে ডাকার চেষ্ট করলো কিন্তু আওয়াজ বেরুলো না গলা দিয়ে । ততক্ষণে আমি কিছুদূর এগিয়ে গেছি। কুকুরটা এর পর ঘুরতে শুরু করে ওর চারদিকে,
আার ঘেউ ঘেউ শব্দ করতে থাকে। ওর ভালো মনে নেই, এক সময় কী ভাবে চোখ মুখ বুজে ও ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে পুরনো দোতলার এই ঘরটায়। কুকুরটা নাকি সিড়ির কাছে দাড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছিলো।

ওকে সঙ্গে নিয়ে, ফেরার সময় লক্ষ্য করলাম, আশপাশে অনেক মানুষ । এতগুলো লোকের ভেতর একটা বাচ্চা ছেলেকে কুকুরে কী ভাবে তাড়িয়ে নেয় ? একটা চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে লোকদের জিজ্ঞেস করতে বললো, ওরা ফাহিমকে ছুটে যেতে দেখেছে। কিন্তু কুকুর ।

: জ্বি না সাব। এই পানাম নগরে কোনো পাগলা কুত্তা নাই। একজন বললো।

তবে ব্যাপারট কি ? আমার শক্ত মুঠোর ভেতর ধরা থেকেও ফাহিম রীতিমতো কাপছিল।

আমরা রুকু মন্টি পলিদের থেকে কিছুদরে বাগান বাড়ির একটা পাকা বেঞ্চিতে বসলাম । ফাহিমের চোখ মুখ ফ্যাকাশে !!

“আম্মুর কাছে যাবে ?

ও ঘাড় নাড়লো। না ।

রুকুকে মনে হলে বিদেশী মেয়েটার সঙ্গে জমিয়ে নিয়েছে । মহিলা নিশ্চয় বাংলা জানে। কারণ ওটাই রুকুর একমাত্র ভাষা । আমি বুঝাতে পারলাম না, ওই মহিলা ওখানে এক একা কী করছিলো ! অ্যাশপাশে স্বামী বা বয় ফ্রেণ্ড আছে নিশ্চয় । কিন্তু এই অবস্থায়ই বা কি করে বেরুলো । মনে হচ্ছিলো, মহিলা বেশ এ্যাডভান্সড স্টেজে আছে।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো। আমার আর রুকুর মধ্যে চোখাচোখি হলো। আমি ওঠার ইঙ্গিত করলাম । রুকু বাচ্চাদের নিয়ে উঠে দাড়ালো । আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি । কী মনে করে যেন অামি পেছনে তাকালাম। সন্ধ্যার আবছা আলে-ছায়ায় আমি দেখলাম, বিদেশিনী একই ভাবে নিথর বসে অাছে।

ঃ অদ্ভুত কাণ্ড । রুকু ফিস ফিস করে বললো ।

: কী ব্যাপার ? আমি বলি!

“না, ঐ মেয়েটা। নিজের সম্পর্কে কিছুই বললো না। কোথায় যাবে, এখানে কি করে এলো-—কিছু না । আমার মনে হলেও অ্যাংলো ।

; তো, এতক্ষণ কী আলাপ করলে ?

ঃ সব আমাদের খবর । এমন সময় রুকুর কোলে ছ’মাসের অপু, কেঁদে উঠলো । ওর খাবার সময় হয়ে গেছে। আাধো অন্ধকারে আমরা নিঃশব্দে বাড়ির দিকে পা চালালাম । ফাহিমের ঘটনাটা আমি রুকুকে বললাম ন৷। মনে হচ্ছিলো, সে-ও যেন আমার কাছে কিছু চেপে গেলো।

রাত এগারোটা। বাচ্চারা সবাই শুয়ে পড়েছে । সোনার গাঁয়ে এখন নিশুতি রাত। এক বিঘার ওপর আমাদের পুরনো দোতলা বাড়ি। তিনদিকে ধানী জমি। সামনে বাগান, তারপর দিঘি, রাস্তা । ব্যাঙ ডাকছিলো, তার মানে আবার বৃষ্টি হবে। মনে করতে না করতেই “আকাশ ভেঙে জল নামলো ।

ঃ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম আজ। চুল আলগা করে ব্রা খুলতে খুলতে বললো রুকু । বাচ্চাদের সব সময় নিজের দুধ খাওয়ায়, অথচ ত্ৰিশ ছুই ছুই-চার সন্তানের মা হয়েও ওর স্তন দুটি কী সুন্দর গোল আর সুঠাম। এক ধরনের মেয়ের ফিগার বদলায় না।

কী দেখছো ? ফাজিল ।

বাতি নিভিয়ে ডিমলাইটটা জ্বেলে দিলো রুকু । খাটের এক পাশে ফিরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে অপু। রুকু আমার বুকে মাথা গুজে ফিস ফিস করে বললো, ‘জানো, আমার না ভয় করছে।

ঃ বুঝতে পারছি না, খুলে বলে। । ওকে জড়িয়ে ধরে খোলা, মসৃণ পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে আমি বললাম।

: সেই বিদেশী মেয়েটা। ও জানি কেমন ! আশ্চর্য । আমার মনে হলো, বয়সে কম হলেও আগে আরো কয়েক বার মা হয়েছে। মনে হয় কয়েকদিনের মধ্যে আবারও হবে। অথচও আমাদের অপুকে এমন ভাবে ধরলো যে, মাগো।

: মানে ? আমি বললাম।

ঃ হা, এমন ভাবে কোলে নেয়ার চেষ্টা করলো যেন ও জীবনে কোনো বাচ্চাকে ছোয়নি। কেমন যেন একটা আলগা-ছাড়া ভাব ।
: কি আজে বাজে কথা বলছো ? ‘ও তোমার দেখার ভুল । তুমিই বোধ হয় মেয়েটাকে পছন্দ করোনি ।

: কী জানি, হবে হয়তো ।

ফাহিমের ব্যাপারটা আমি ভাবছিলাম । ও ভয় পাওয়ার মত ছেলে নয়। কিন্তু, এটার মানে কী ?

আজ আমার ইচ্ছে নেই। কিন্তু রুকু তেতে আছে মনে হলো। এক পর্যায়ে ও উঠে এলো আমার ওপর। সম্পৰ্ণ নগ্ন । । আর থাকা গেল না। রুকুর শীৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ে সেই সঙ্গে গরম নিশ্বাস। মিনিট দশেক পর, আমি বুঝতে পারছিলাম, ওর চরম মুহৰ্ত। আমারও। বাইরে অঝোর বৃষ্টি । রুকু একটা তীক্ষ্ম শব্দ করলো প্রায় গলা চিরে। আর ঠিক ঐ মুহূর্তেই আকাশ বাতাস কাপিয়ে আরেকটা শব্দ। একটা কুকুর ডাকছে, উল্টো গলায়। মনে হলো, ঠিক আমাদের বারান্দায়। রুকু তখন এলিয়ে পড়েছে, আমি ছিটকে উঠে বসি ।

বোধহয় কয়েক সেকেণ্ড ঝিম মেরে বসেছিলাম। রাতে যে এদিকে কুকুর ডাকে না, তা নয়। কিন্তু আজকের ডাকটা আমার কাছে ভিন্ন মনে হলো। ভিন্ন এবং ভয়ঙ্কর। নিশ্চয় আশপাশের কোনো গ্রাম থেকে সোনার গায়ে একটা পাগল কুকুর ঢুকে পড়েছে। ব্যাপারটা ধোঁয়াটে মনে হলেও ফাহিমের বিকেলের ঘটনাটা আমি এখন উড়িয়ে দিতে পারছি না। ঐ যে আবার । আমি কান খাড়া করলাম। এবার মনে হলো শব্দটা আসছে বাড়ির সামনে দিঘির দিক থেকে। রুকু উঠে বসলো। ভীত বিহবল ওর মুখাবয়ব। নাহু, এবার দেখতে হয় । ভাদ্র আশ্বিন মাসে কোথেকে এ আপদ এলে জুটলো ? বাতি জ্বালিয়ে টর্চ আর একটা চলনসই লাঠি নিয়ে আমি বেরুলাম । বৃষ্টির চাপ কমে এসেছে। তবে খুব জোরে বাতাস বইছিলে। ঘুরঘুটি অন্ধকার বারান্দা থেকে দিঘির চারদিকে আমি টর্চ ঘোরালাম। ব্যাঙ আর পোকা মাকড় ভাকছে। আর কোনো শব্দ নেই।

ঃ আব্বু!

ঘুরে দাড়ালাম আমি । আমাদের শোবার ঘরের দরজায় রুকুর হাত ধরে দড়িয়ে আছে ফাহিম । ভয়ে চোখ মুখ সিটানো।

: আব্বু সেই কুকুরটা। বলতে বলতে ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরলো ফাহিম। আমি কোনো কথা খুজে পাচ্ছিলাম না। অনেক কষ্টে বললাম, ‘কুকুর, কোথায় কুকুর ?’

“আমি দেখলাম আব্বু, । দেখলাম আমাদের জানালায় দু’পা তুলে মুখ বাড়িয়ে আছে। ও বললো প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় !

: কী বলছিস ফাহিম ? ফাহিম এই ফাহিম …..।

রুকু এসে ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো। ফাহিমের সাড়া নেই ? রুকুর কোলে ঘুমে ঢলে পড়েছে।

সে রাতে আমার ঘুম হলো না । অপু আর ফাহিমকে নিয়ে রুকু বাচ্চাদের সঙ্গে শুতে গেল পাশের ঘরে। আমার দূর সম্পর্কের এক ফুপুর সঙ্গে ও ঘরে থাকে পলি, মন্টি আর ফাহিম।

সোনার গাঁও ছাড়ার আগে বিজ্ঞাপনী ফার্মের চাকরিটা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। সেই সুবাদে পাওনা ছুটি ছাটা, প্রভিডেন্ড  ফাণ্ড ইত্যাদি মিশিয়ে একটা মোটা অংকের টাকা হাতে আসে। কিন্তু

যদিও মফস্বল—-একটা ছোট খাটো সংসার সে টাকায় আর কদিন ? অবশ্য চাল বা তরিতরকারি আমাদের কিনে খেতে হয় না। খরচের বেশিরভাগ যায় কাপড় চোপড় খুঁটিনাটি জিনিস, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন ইত্যাদিতে। একটা বাড়তি খরচ তবু ছিল আমার রং-তুলি কাগজের টাকা।

ঐ কারণেই সপ্তাহে একবার আমাকে ঢাকা যেতে হয়। কয়েকজন বড়, মাঝারি পাবলিশারের সঙ্গে জানাশোনা ছিলো। আমি ছিলাম ওদের বাধা আর্টিস্ট। কাজ, বই-এর কাভার। প্রতি শনিবার আমি পাচ ছ টা অর্ডার নিয়ে আসি। পরের সপ্তাহে ওগুলো শেষ করে অ্যাবার ঢাকা। অামার পারিশ্রমিকের টাকাটা হাতে আসতো মাসের শেষে । অবশ্য মাঝে-মধ্যে গণ্ডগোলও হয়।

কিছু কেনাকাটা ছিলো ঐ শনিবার। গুলিস্তান থেকে বাস ছাড়লো রাত আটটায়। নতুন কোস্টার। চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবে।  বড় জোর এক ঘন্টা। কিন্তু কপালে দুঃখ ছিলো। কাচপুর ব্রিজ পেরুতে না পেরুতেই এক্সিডেন্ট। উল্টো দিক থেকে একটা স্কুটার আসছিলো বাতি না জ্বালিয়ে । যাত্রীদের কেউ বোধহয় সিগারেট খাচ্ছিলো । সেটা আন্দাজ করে হঠাৎ পাশ কাটাতে গিয়ে আমাদের কোস্টার জোরে ধাক্কা খায় রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের সঙ্গে। প্যাসেঞ্জারদের কেউ তেমন জখম হয়নি। তবে উইণ্ডস্কিনের ভাঙা কাচে ড্রাইভারের নাক মুখ কেটে গেছে। ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা। এ গাড়ি চলবে না। কিন্তু আমাকে যেতে হবে আরো পাচ মাইলের মতো পথ। ডেরার দিক থেকে আসা একট। ভাঙ্গা স্কুটারে চেপে আমি, দুজন ব্যবসায়ী, একজন স্কুল মাস্টার ও একজন সাই বাবা যখন কোনো রকমে সোনার গাঁ চৌরাস্তায় নামি, রাত তখন সাড়ে ন’টা পেরিয়ে গেছে। গুমোট গরম। ছোট একটা রিক্সা তখনও ছিলো চায়ের দোকানের সামনে। আমকে দেখে অনসার আলী একগাল হেসে ডাকলো।

প্রতি শনিবার ও ই আমাকে বাসায় পৌছে দেয়। একটু খটকা লাগলো আমার । বাসায় বাতি জ্বলছে । সামনের বটগাছ টার মোড় পেরুলেই আমাদের বাড়ি। খোয়া-ওঠা রাস্তায় রিক্সাটা বড় বেশি টাল খাচ্ছে । কী হতে পারে ? সকালে যাওয়ার সময় দেখে গেছি, অপুর জ্বর।

সেদিন বিকেল ওকে নিয়ে বেরুনো ঠিক হয়নি। রুকু নিশ্চয় ওকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। না-কি একবারে ডাক্তার নিয়েই ফিরবো ? আনসার আলীকে বিদায় দিয়ে প্রায় দৌড়ে আমি উঠে আসি বাসার বারান্দায়। ভেতরে রুকুর গলার শব্দ। ঠাণ্ডা এবং স্বাভাবিক। দরজা খুলেই রুকূর প্রশ্ন, ‘এতো দেরি যে ? আমি ভেবেছিলাম আজ ঢাকায় থেকে যাবে।’ আমি মুখ খুলতে ,না খুলতে চোখ পড়লো সোফায় বসে থাকা মেয়েটার ওপর । হাত পা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ব’সে আছে যেন এ বাড়িতে অনেক দিনের আসা যাওয়া । কোথায় দেখেছি যেন ? কোথায় ? হঠাৎ আমার মাথায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেলে। সেই বিদেশিনী ।

আমার হতভম্ব চেহারা দেখে রুকু ঝটপট বললো, ‘চিনতে পারছো তো ? ওই যে পরসু বিকেলে পানাম নগরে দেখা হয়েছিলো।’

কেমন আছেন ? ‘ আমি বললাম।

একটু নড়ে চড়ে ব’সে মহিলা মুচকি হাসলো শুধু । রুকুর ধারনা ভুল। মহিলা অ্যাংলো নয় । মেয়েটিকে দেখে আমার জিপসিদের কথা মনে হলো। অন্তত এর চোখ তাই বলে । অথচ পরনে অছে শাড়ি। অভ্যস্ত নয় বোঝাই যাচ্ছিল ।

” কখন এসেছে ? আমি খেতে খেতে রুকুকে বললাম।

ঃ আর ব’লে না । সেই বিকেল থেকে ঐ সোফায় ব’সে আছে। তেমন কিছুই বললো না।

ঃ কিছু খেতে দিয়েছো ?

: অনেক সেধেছি, খায়নি।

ঃ এখানে কি চায় ?

ঃ তাও তো বুঝতে পারছি না। আমার কিন্তু ভাবসাব ভালো মনে হচ্ছে না।

ঃ কেন ? বেচারী নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো বিপদে পড়ে এসেছে।
ঃ তাহলে, ঐ দিন বিকেলে একা একা বসে কী করছিলো? আমি
কোনো জুতসই উত্তর খুজে পেলাম না। হঠাৎ আমার মনে হলো শীত শীত লাগছে। । অথচ আসার সময় গরমে রীতিমতো ঘামছিলাম। ‘আচ্ছা ঠাণ্ডা লাগছে না ? —আমি বললাম ।

ঃ তাই তো ? ফ্যানটা বন্ধ করে দিই ?

রুকু ফ্যান অফ করে দিতে উঠেছে মাত্র, আমাদের ফুটফুটে অন্ধকারে ডুবিয়ে বিদ্যুৎ চলে গেলো।

অ্যাই! রুকু ফিসফিস করে বললো। গলা শুকনো।

: কী হলো ? ভয় করছে । এমন সময় মোম বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকলো ফুপুমা’। বৈঠক থানায় একজন অচেনা মহিলা একা ব’সে আছে। আমি রুকুকে হ্যারিকেন জ্বালাতে বললাম। আজ বাতি আসার সম্ভাবনা নেই।

ফুপু আম্মা বাচ্চাদের ঘরে চলে গেছে। । রুকুও গেলো পিছু পিছু । অপু কাদছিলো । অামি হ্যারিকেন নিয়ে এলাম বৈঠকখানায় । ঘর ফাকা। মেয়েটা চলে গেল নাকি ? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

চকিতে আমার চোখ পড়লো দেয়ালের পাশে মেঝেতে । আমি চীৎকার করে রুকুকে ডাকতে গেলাম, পারলাম না। ছেলে মেয়েদের নিয়ে

তোলা আমাদের গ্রুপ ছবিটা ভেঙে খান খান হয়ে পড়ে আছে । দেয়াল থেকে কোনো ভাবে খসে পড়ে গেলে ছবিটার কাচ বড় জোর ফেটে যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হলো গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কেউ ওটাকে হাতুড়ি পেটা করেছে। আর মূল ছবিটাও কুচি কুচি করে ছেড়া। আমি মাথা-মুন্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। রুকু এসে ঢুকলো । ওর চোখ প্রথমে গেলে। অামার দিকে । তারপর দেয়ালের পাশে ফ্লোরে চোখ পড়তেই, ‘এ—কি !’ গলা চিরে ও একটা আর্ত চিৎকার করলো ।

আমি এতোক্ষণ খেয়ালই করিনি, লাগোয়া বাথ রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ । খটাস করে ছিটকিনি খোলার শব্দ । মেয়েটা বেরিয়ে এলো ।

” হোয়াট হ্যাপেনড ? এনিথিং রং ?” বলতে বলতে স্থির হেঁটে ও আবার ওর আগের জায়গায় এসে বসলে৷। । চুর্ণ বিচুর্ণ পড়ে থাকা ছবিটার দিকে আলতো ভাবে একবার তাকালে শুধু । চোখে মুখে কোনো বিস্ময় নেই। রুকু আর আমার চোখাচোখি হলো হ্যারিকেনের আলো ছায়ায়। । মেয়েটাকে আামি এবার লক্ষ্য করেছি । বেশ বেঁটে । পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে হাত বাড়ালেও ছবিটার কাছে পৌছাবে না। ও যে সোফায় বসেছে, সেখান থেকে একেবারেই নয় ।

কিন্তু আমি এসব কি ভাবছি ? ছি ঃ ছি ঃ। মেয়েটা আমাদের এখানে বিপদে পড়ে এসেছে। এটা মন্টির কান্ড হতে পারে। তাই বা কী ভাবে হয়। এতোটুকু ছেলে । আর বাগান থেকে ঘরে একটা আস্ত মই নিয়ে এসেছে ওদেরই ছবি ভাঙার জন্য কল্পনা বদ্ধ পাগল হলেই শুধু আমার পক্ষে করা সম্ভব।

: কটা বাজে ? মেয়েটা নিঃস্তব্ধতা ভাঙলো।

: এগারোটা বেজে দশ। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম। এবার হয়তো উঠবে। রুকুর সঙ্গে আবার চোখাচোখি হলো। পরক্ষণেই হতাশ হলাম আমি। এতো রাতে যাবে কোথায় ? আর অবাক ব্যাপার, মেয়েটিও সেই আগের মতোই নির্বিকার, জানালার বাইরে অন্ধকারে চোখ । ওঠার নাম-গন্ধ নেই। রুকু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হাই  তুললো এর পর ।

ও ইচ্ছে করলে আজ রাতে আমাদের এখানে থেকে যেতে পারে। আমাদের ওপর তলায় একটা ঘর সারা বছর খালি পড়ে থাকে। খাট বিছানা সবই পাতা অছে । কালে ভদ্রে কেউ বেড়াতে এলে তালা খোলা হয়। সমস্যা রুকুকে নিয়ে । ও কি ভাবছে, কে জানে ?

ঝড়ের বেগে মেয়েটা উঠে দাড়ালো। রুকু, আমি দুজনেই চমকে উঠলাম

; আপনাদের অনেক অনেক থ্যাংকস। অামি এবার যাবো । হাসলো মেয়েটা। যেন একটা কিশোরীর নির্মল হাসি। দাত কী ধবধবে সাদা।

“বলেন কি, এই সময় । রুকু উঠে দাড়ালো। আমিও ।

ঃ না:না এটা হয় না। আজ আপনি আমাদের মেহমান । চলুন ভেতরে যাই।”

মেয়েটা উঠে দাড়িয়ে ছিলো। সামনের দিকটা অস্বাভাবিক রকম ভারী। পেটে বাচ্চা। রুকু ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো । মেয়েটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। আমি দেখলাম রুকুর চোখ ছলছলে। এতক্ষণ মেয়েটার সঙ্গে যে ঠান্ডা ব্যবহার করেছে, সে জন্য বোধ হয় দুঃখ হচ্ছে, আমারও খারাপ লাগছিলো। না, ওকে এই রাত দুপুরে একা ছেড়ে দেয়া যায় না। ও কারো কাছে থেকে শক টক পেয়ে থাকতে পারে । হয়তো এখনো সামলে উঠতে পারেনি। আর মাথায় গোলমাল, নেই, তাই বা কে জানে ? সে যাই হোক,  আফটার অল শী ইজ এ লোনলি হেলপলেস উয়োমেন ।

: প্লীজ। আমরা রিকোয়েস্ট করছি। আপনি আজ থেকে যান : কোনো অসুবিধা হবে না । তাছাড়া… ইউ অর নট ওয়েল ফিজিক্যালি ।”

আমি হাত জোড় করে বললাম। রুকু কী করবে বুঝতে পারছে না । দরজার কাছে গিয়ে মেয়েটা বিদায় নেয়ার ভঙিতে আমাদের দিকে ঘুরে তা কালো। ঠিক ঐ সময় রুকুর আর্তনাদ। মেয়েটা দুমড়ে মুচড়ে মেঝেতে বসে পড়েছে। মুখ বুকে গোজা, পেট দু হাত দিয়ে চেপে ধরা।

রুকু ঘটনা বুঝতে পেরেছে। ‘জলদি ডাক্তার ডাকো,’ বলেই ও দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে বসে পড়লো।

এখন আমার হাত-ঘড়িতে ঠিক বারোটা। মাথায় কিছু ঢুকছে না । এই দুপুর রাতে ডাক্তার কোথায় পাবো ? জামান সাহেবকে আনতে হলে যেতে হবে সেই মুগরা। তার বাসায় যেতে হবে হেটে । কী বিপদে যে পড়লাম। বৃষ্টি ঝরছে টিপটিপ করে। । একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে দিশেহারার মতো আমি অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম । ডঃ জামান মানুষটি ভালো। আমার চোখ মুখ দেখে বুঝাতে পারলেন, সাংঘাতিক কোনো বিপদে পড়ে এসেছি। পেশায় ডাক্তার হলেও শিল্প-সাহিত্যে উৎসাহী। এ জন্যই বোধহয় আমাকে তিনি আলাদা ভাবে খাতির করেন। অন্ধকারে খানা-খনন্দ টপকাতে টপ- কাতে জাৰ্মান সাহেবকে নিয়ে বাসায় পৌছলাম দেড় ঘণ্টাপর। শূন্য

বৈঠকখানার দরজা খোলা। হ্যারিকেনটা আছে। নবজাতকের চিৎকার শোনা গেলো ওপরের গেস্টরুমে। জামান সাহেবকে বসতে বলে আমি ছুটে গেলাম ওপরে।

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । রুকু একটা তোয়ালে জড়ানো পুটলি কোলে নিয়ে হাসছে। ফুপুমা’ ব্যস্ত হ’য়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার পাইসস। কাম হইয়া গেছে ।’ মেয়েট। বিছানায় মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে । ঘুমুছে বোধ হয় । ঘরময় ডেটলের গন্ধ । বিস্ময়ে হতবাক  আমি কতোক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। রুকু ম্যানেজ করলো কী ভাবে ?

ঃ কী ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে, মা গো ! আমার সংবিত  ফিরলো । রুকু শিশুটাকে নিয়ে এলে আমার কাছে । তোয়ালের ফাক দিয়ে আমার দিকে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে একটা নিস্পাপ মানব-সন্তান, যে পৃথিবীতে এসেছে ঘন্টাখানেক আগে। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম বাচ্চাটার নাক মুখ সুগঠিত। নবজাতকদের এ রকম হয় না সাধারণত ।

এর মায়ের কী অবস্থ৷ ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

: ভালো । আামি ভাবতেই পারিনি যে ব্যপারটা এতো সহজে হয়ে যাবে। রুকু, বললো।

ডাক্তার জামান ওপরে এসে মা ও প্রসূতি পরীক্ষা করে দেখলেন। ওষুধপত্র দিলেন কিছু। চিন্তার কিছু নেই। তবে মহিলাকে রেস্টে থাকতে হবে। । জামান সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম ।

বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে একটা আর্ম চেয়ারে বসে আছে রুকু । মমতা-মেশানো খুশিতে ঝলমল করছে ওর মুখ ।

ঃ কী দারুণ দেখতে হয়েছে। । মায়ের চেয়ে ও সুন্দর। রুকু, সস্নেহে নবজাতককে বুকে চেপে ধরলে। ফুপু ঘুম-চোখে বিছানার এক কোণায় বসে আছে ।

ঃ ফুপু’ মা, তুমি এবার শুতে যাও । আমরা তো আছি । আমার গলা শুনে বিদেশিনী পাশ ফিরে চোখ খুললো । ওর করুণ হাসিতে অপরাধ বোধ ।

: কনগ্রাচুলেশন্স। কিউট একটা মেয়ে হয়েছে আপনার । আমি বললাম ।

মহিলার মুখে ভাবান্তর নেই। রুকু, বোধ করি সেটা লক্ষ্য করলো না। ও নবজাতককে নিয়ে এলো মায়ের কাছে। মহিলা উঠে বসেছে। রুকু বাচ্চাকে বাড়িয়ে দিলে ওর দিকে, নিন, দেখুন। কী সুন্দর মেয়ে হয়েছে আপনার ’

স্ট্রেঞ্জ ! আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। নিজের পেটের মেয়েকে কেউ এমন ভাবে ধরতে পারে, না দেখলে আমার বিশ্বাস হতো না। । কেমন একটা গা ছাড়া আলগা ভাব। যেন মেয়েটা ওর নয়। রুকু বলেছিলো অপুকেও কয়েকদিন আগে মেয়েটা ঠিক একই ভঙ্গিতে ধরেছিল–আমি বলেছিলাম, ওর চোখের ভুল। কিন্তু এখন আমি নিজের চোখে দেখলাম। মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রুকু আরেকটা বের করে পাশে রাখল। বাচ্চাটার ক্ষিদে পেয়েছে, কেঁদে উঠছে থেকে থেকে । মহিলা নির্বিকার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে । চোখ-মুখে বিতৃষ্ণা নিয়ে রুকু দৃশ্যটা দেখছিলে । এক সময় না পেরে ও বাচ্চাটাকে প্রায় ছো মেরে নিজের কোলে নিয়ে এলে । মহিলা মৃদু হাসলো। এ কেমন মা ! আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না ।

আমি দেখলাম রুকু অবলীলায় পট পট করে ব্লাউজের বোতাম খুলে
নবজাতকের মুখে স্তন গুজে দিয়েছে। কান্না থেমে গেছে । ছ’মাস বয়স অপুর । রুকু এখনো ওকে বুকের দুধ খাওয়ায়। আমি নিচে,  শোবার ঘরে নেমে এলাম।

ভোর হতে আর কয় ঘন্টা মতো বাকি। আমার ঘুম পেয়েছে, চোখের পাতা টেনে রাখতে পারছিলাম না। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ে- ছিলাম। রুকুর ধাকায় জেগে উঠি ।

; মা তো না, যেন একটা ডাইনি । তেতো গলায় বললো রুকু।

“ঠিকই বলেছো, স্ট্রেঞ্জ ।” আমি উঠে বসে বললাম। রুকু প্রসূতি ও বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। বিছানার পাশে ফ্লাস্কে রাখা আছে দুধ, গ্লাস, চামচ। মহিলা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবে না, রুকু ধরে নিয়েছে ।

এমন সময় উল্টো গলায় সেই কুকুরের, ডাক। রুকু আমাকে জড়িয়ে ধরলো, ‘শুনছো ? সেই কুকুরটা ডাকছে। ’

ঃ ও কিছু না, পাগলা কুকুর । তুমি ঘুমাও । আমি ওকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম। চারদিক নিঃসাড় । ঝি ঝি ডাকছে। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি । আমার চোখ লেগে এসেছিলো ।

; অ্যাই ! রুকু আমায় ছোট্ট করে কানের কাছে ডাকলো।

ঃ কী হলো !

ঃ বৈঠকখানার ছবিটা ভাঙলো কিভাবে ? দেখেছো কী অবস্থা হয়েছে ওটার ? রুকু উঠে বসলো। খুব রাগ হলো আমার। এমন সুন্দর একটা গ্রুপ ফটো৷

ঃ আমি কী জানি ? নিশ্চয় মন্টির কাজ। ও ভারী দুষ্টু হয়েছে । জানি কথাটা ফালতু, তবু বললাম আমি।

: তোমার মাথা খারাপ। মন্টি কখ লখনো এটা করতে পারে না। অার ঐ মেয়েটি যখন সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে গল্প করছিলো, তখনো আমি দেখেছি ছবিটা আছে। আমি দেখেছি, ছবিটার দিকে ও বার বার তাকাচ্ছে । রুকু আমার কাছে সরে এলো ।

ঃ তার মানে ? এর অর্থ কি ?

আমার গলা দিয়ে ফ্যাশ ফাশে শব্দ বেরুলো। মাথা ঝিম বিম করছে ।

বাচ্চাটা কাদছে । রুকু কান খাড়া করে শুনলো । তাই তো ? একটানা, একঘেয়ে কান্না । নিশ্চয় ক্ষিদে পেয়েছে আবার।

ঃ কেমন মা বলো তে৷? কী করি এখন রুকু উঠে বসলো।

তারপর কী যেন ভেবে পায়ে স্লিপার গলিয়ে বেরিয়ে গেলো। কিছু ক্ষণ পর ওর চিৎকার শুনে ধড়মড় করে ওপরে উঠে এলাম। মোমবাতিটা প্রায় শেষ । যে কোনো মুহুর্তে নিভে যেতে পারে। রুকু মুখে হাত চেপে চোখ কপালে তুলে দাড়িয়ে আছে। বিছানায় বাচ্চাটা কাদছে হাত পা ছুড়ে। জানলার ভাঙা কাচ দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে ওর সারা গায়ে । বিদেশিনী নেই ঘরের কোথাও । রুকু বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো।

পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম বৈঠকখানার দরজা ভেজানো। অর্থাৎ রাতে ওটা খোলা ছিলো। তাড়াহুড়োয় কেউ খেয়াল করিনি। বিদেশিনী ওখান দিয়েই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অন্ধকারে এরকম অসুস্থ শরীরে ও নিচে নামল কীভাবে, আমার মাথায় এলো না।

পুরো আইপি সোনার গা অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খোজা হলো, বিদেশিনীর খোজ পাওয়া গেলো না। যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে। বিকেলে আমাদের দুধ গেলো এক সপ্তাহ আগে লাঙ্গল বন্ধ ঘাটে একজন শাড়ি পরা মেম সাহেবকে একা হাটাহাটি করতে দেখা গেছে। ঐ এলাকার অনেকেই দেখেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না, শেষ রাতে বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে মহিলা কত দুর বা কোথায় যেতে পারে। যা হোক, আমি উপায় না দেখে থানায় একটা ডায়রি করিয়ে রাখলাম।

সমস্য৷ হলো বাচ্চাটা নিয়ে। ওকে নিয়ে আমরা কি করবো ?

এমনিতে আমার নিজের চার সন্তান, রুকু ও ফুপু আমি। সংসার নেহাৎ ছোট নয় । কয়েক মাস যাবৎ একটু টানাটানিও যাচ্ছিলো। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে রোজ । তার ওপর বাচ্চাদের খরচ বেশি। আমার ছবি আঁকার ঘরে বসে এসব নিয়ে আবোল তাবোল ভাব ছিলাম এমন সময় রুকু ঘরে ঢুকলো। আমি ঘুরে তাকালাম। ওকে চোখ মুখে হঠাৎ-পাওয়া মাতৃত্বের আনন্দ উপচে পড়ছে।

; শোনো, তুমি কিচ্ছ, ভেবো না। ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে। ওর পেছনে আর কত যাবে ? রুকু এসে আমার পেছনে দাড়ালে ; আমি কিছু বললাম না।

ঃ পলি-মন্টি তো দারুণ খুশী । ওরা সেই সকাল থেকে বাচ্চা টাকে ঘিরে আছে। আর ওটাও ফিক ফিক করে হাসছে। কি যে সুন্দর হয়েছে না ।

আমি রুকুকে থামিয়ে দিলাম, ‘সব বুঝলাম, কিন্তু ওকে তো ইচ্ছে করলেই রাখা যাবে না। লোকে কী বলবে ?’

ও আমি আশপাশের সবাইকে ঘটনা বলেছি । বিশ্বাস করেছে সবাই। তুমি কি মনে করো, ওরা আমাদের নিয়ে খারাপ কিছু সন্দেহ করবে ? কখখনো নয় । তোমরা কারা, সোনার গায়ের লোকজন জানে। মিসেস ইব্রাহিম তো বাচ্চাটাকে চেয়েই বসলেন।

ঃ কিন্ত ওর মা তো কোনো দিন ফিরে এসে ওকে দাবি করতে পারে। । আমি রুকুকে থামালাম।

অসম্ভব, ওই বেটি কোনোদিনও আসবে না। আমি জানি। জোর দিয়ে বললে রুকু।

ঃ হয়তো একদিন দেখা গেলো ঢাকা থেকে পুলিশ আর ওর  লোকজন নিয়ে এসে বাসায় চড়াও । তখন কী করবে ? আমি রুকুকে খানিকটা ঘাবড়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু ও সহজে হাল ছাড়ার মতো মেয়ে নয় ।  আহ আসলেই হলো দল বল নিয়ে । প্রমাণ কি ?

এ যে ওর পেটের মেয়ে তার প্রুফ কোথায় ? সাক্ষী কারা ‘ রুকু কিছুক্ষণের জন্য দম নিলো। সম্ভাব্য বিপদটা হয়তো উড়িয়ে দিতে পারছে না । তারপর, ‘ও বেটি আসবে না, তুমি দেখো, আমি বলে রাখলাম। ও মানুষ না, অন্য কিছু। এমন একটা চাদের টুকরোকে কোন মা ফেলে যায় ! আর দেখেছে কোলে নেয়ার ভঙ্গিটা ! মাগো মা !

: ঠিক আছে। সব শুনলাম। বাচ্চাট আপাতত আমাদের কাছেই থাকবে। কিন্তু এটাও পাড়া পড়শী, থানা সবাইকে জানিয়ে রাখতে হবে। পরে যেন কোনো ঝামেলা না হয়। আমি রুকুকে বললাম ।

অবশ্যই জানাবো। এতে অসুবিধের কি আছে ? আমরা তো আর দোষী না!

রুকু হঠাৎ গলার স্বর খাটো করে আমার কানের কাছে মুখ রাখলে, ‘জানো, আমি ওর একটা নাম ঠিক করেছি । কি বলো কি, এরি, মধ্যে ? শুনি ?

ঃ মৌ। রুকু কিছুটা লজ্জার ভঙ্গিতে হাসলো।
– ওহ ফাস্ট ক্লাস ।

আমি বললাম। রুকুর টেস্ট আছে। কে জানে এক সময় গানের ফাকে ফাকে কবিতা লিখতে কিনা !

আমাদের সবার চোখের মণি মৌ। বয়স এক মাস । ফাহিম, মন্টি, পলি এবং অপুর মতো সে-ও আমাদের ঘরের মেয়ে। রুকু র ধারণা ঠিক। বাংলায় লক্ষ্মীমন্ত বলে একটা কথা আছে। আমাদের মৌ-এর বেলা এটা পুরোপরি খাটে। খুব হাসে, প্রায় সারাক্ষণই  আর সবচেয়ে ভাল মেজাজে থাকে রুকু – ওকে দেখলে । আজকাল লক্ষ্য করছি, কাজের ফাকে সময় পেলেই ও মৌকে নিয়ে মেতে আছে ।

তবে ক্ষিদে পেলে ও অতিরিক্ত কাদে। কান্নার শব্দটাও তীক্ষ্ম। রুকুর ধারণা, মৌ খালি পেটে থাকতেই পারে না। । ও অবলীলায় বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাইয়ে চলেছে। অপুর অংশে ভাগ বসাচ্ছে ? একদিন আমার মনে হলো। পর ক্ষণেই লজ্জা পেলাম মনে মনে। এক মাসের বাচ্চা, ও আর কতটুকু খাবে।

কেবল দেখলাম, ফুপু-আম্মার মুখ ভার। পুরো ব্যাপারটাকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। মৌকে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ বা আগ্রহ নেই। ফুপু-আম্মাকে অবশ্য আমি এ-নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। সেকেলে মানুষ । বয়স হয়েছে। । বাজে উৎপাত হয়তো “পছন্দ নয়। আমি ভাবলাম ।

এবারের মতো বর্ষা শেষ। গত কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নি। পরিষ্কার আকাশ। আমাদের বাড়ির সামনে বাগানটায় এবং দিঘির চারধারে মাটি শুকিয়ে এসেছে । ঘন সবুজ ঘাসের ওপর বিকেলে হুটোপুটি করে ফাহিম, মন্টি আর পলি । ওর সোনার গা-এর নতুন কিণ্ডার গার্ডেনে পড়ে। শরতের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। তাই শেষ ক’দিন  প্ৰাণ ভারে খেলাধুলা করে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মৌকে আমার কোলে দিয়ে রুকুও বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে । আমি চোখ ভরে দেখি। জীবনে এর বেশি আর কি চাই। এ রকম একটা সুখী, শান্তির সংসার এই আমার স্বপ্ন ছিলো । যদিও আমার ও রুকুর বয়সের তফাৎ বার তেরো বছরের, আমাদের পরস্পরকে বুঝতে কখনো অসুবিধা হয়নি। রুকু আগে থেকেই বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিওর । ও এখনো প্রায়ই বলে, আমার মতো একজন স্বামীর কল্পনা করেছে ও ক্লাস নাইনে পড়া সময় থেকে।

অপুকে কোলে বসিয়ে আমি মৌকে বুকে চেপে ধরি। কে জানে ‘ওর বাবা কে ? কিন্তু এখন ও আমার, শুধুই আমাদের। বাচ্চাটা পিটপিট করে তাকায় অামার দিকে । আপন মনে হাসে।

ঢাকায় সেদিন হরতাল । সকালে কাগজ আসেনি। সোনার গায়ের অনেকেই ব্যাপারটা জানতো না। আমাদের বাস ডেমরায় ঘন্টা তিনেক বসে থাকলো। হরতাল চলবে বারোটা পর্যন্ত। আমার

কাজ ছিলো সকালের দিকে। আরো এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর, কোনো উপায় না দেখে আমি একটা স্কটার নিয়ে ফিরে এলাম সোনার গাঁয়ে।

দুপুর সাড়ে বারোটা। আমাদের বাড়িটা নিঝুম। ছেলে-মেয়েরা সবাই স্কুলে। অপু-মৌও বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। আমার ভালো লাগছিলো না । আজ ঢাকায় গেলে কিছু টাকা পাওয়া যেতো।

ঃ এখন ব’সে থেকে আর কী হবে ? যেতে যখন পারোনি, তাড়াতাড়ি খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও । বিকেলে তো আর হরতাল নাই। রুকু বৈঠক খানার দরজায় দাড়িয়ে বললো।

ঃ নাহ, আজ আর যাবোই না, লাভ নেই । কাপড় চোপড় ছেড়ে আমি ভেতরের বাথরুমে গেলাম হাতমুখ ধুতে। আজ পানি তোলা হয়নি। সবগুলো বালতি আধাআধি । তবু আমার ইচ্ছে হলো, মাথায় পানি ঢালি । মগটা ভরে উঠিয়েছি মাত্র, বাথরুমের দরোজায় দমাদ্দম ধাক্কা । আর রুকুর কলজে-ফাটানো চীৎকার, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। হায় আল্লা, আল্লা একী হলো…জলদি..জলদি বাইরে এসো ।’

আমি দ্রুত দরোজা খুলে বাইরে এলাম। রুকুর কথা আটকে যাচ্ছিলো, চোখ মুখ উদভ্ৰান্ত ।

ঃ কী হয়েছে ?

আমি ওকে ধরে ঝাকুনি দিই। রুকু মুহুর্তে আমাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলো আমাদের শোবার ঘরে। পাকা মেঝেতে নীল হয়ে পড়ে আছে আমার ছ’মাসের অপু। নড়াচড়া নেই । একদম নিশ্চল । নাকের ফুটোয় সামান্য রক্ত। অ৷র খাটের ওপর হঠাৎ ভয় পেয়ে হাত পা ছুড়ে চীৎকার করছে মৌ ।

: কীভাবে হলো । আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম।

ঃ সব দোষ আমার, আমার। ওগো, তুমি আমাকে মাফ ক’রে দিও… আমিই ভুল করে খাটের দু’পাশে কোলবালিশ রেখে যাইনি …..

অপু ঘুমের মধ্যে গড়াতে গড়াতে হায় আল্লা, আমার অপু। রুকু ফুপু আম্মার কোলে ঢলে পড়লো ৷

ঘটনার আকস্মিকতায় আম রা কিছুদিন শুষ্ক হয়ে থাকলাম। অপুর মৃত্যু রুকু ও আমাকে প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়ে গেলো। যেন একটা নিস্তরঙ্গ নদীতে আমাদের নৌকা ভাসছিলো, তারপর হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় সব ওলট-পালট। কে যেন আমাদের বুঝিয়ে দিলো, এক টানা সুখ বলে কিছু নেই—জীবনের কাছে শান্তি দাবি করতে হলে এর কিছু নিষ্ঠুর খামখেয়ালিকেও মেনে নিতে হয়। আমি বাস্তববাদী লোক, ছবি আঁকি যদিও । অনেক পোড় খেয়েছি। জীবনের কালো কদাকার দিকটা আমার চেয়ে কে আর ভালো জানে ? কিন্তু রুকুকে বিয়ে করার পর থেকে আমি এসব ভুলে ছিলাম। ও যেন হাত ধরে অামাকে নিয়ে এলো এক স্বপ্নের জগতে, যেখানে স্নেহ এবং ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো ভাষা নেই। আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। অপুর মৃত্যু আমাকে জাগিয়ে দিয়ে গেলো।

রুকু আমাকে এড়িয়ে চলছে ক’দিন। প্রথম প্রথম খুব কেঁদে- ছিলো। পরে আস্তে আস্তে কমে আসে। কিন্তু ও কিছুতেই আমার

মুখোমুখি হতে চাইছিলো না। ওর ধারণা অপুর মৃত্যুর জন্য আমি ওকে দায়ী করেছি। কিন্তু আমি তো জানি, অপু মারা গেছে নেহাতই  একটা দুর্ঘটনায়। এ রকম মৃত্যুর কথা শোনা যায় হামেশা।

আমাদের সাবধান থাকা উচিত ছিলো। অথচ রুককে দেখে আসছি, একজন আদর্শ মায়ের মতো ও বরাবর বাচ্চাদের ব্যাপারে সতর্ক । ওর যত্ন আর ভালোবাসায় তিল তিল করে ও বড় করেছে ফাহিম, মন্টি ও পলিকে । সেদিন দুপুরে কেন ও কোলবালিশ ছাড়া অপু ও মৌ কে খাটে রেখে গেলো—আমার মাথায় আসছিলো না। যে-সে  ভুল নয় । ভুলটা মারাত্মক।

ফুপু আম্মার কথা মতো বাড়িতে আমরা মিলাদ পড়ালাম । পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব ও তার ছাত্র শিষ্যরা দোয়া-দরূদ পড়লেন প্রায় সারাদিন। পরদিন আমরা সবাই অপুর কবরটা দেখতে গেলাম গোরস্থানে। ছোট্ট একটা কবর। আমার বুকটা হু হু করে উঠলো । রুকু, মৌকে কোলে নিয়ে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। সান্তনা দিতে গিয়ে আচম্বিতে আমার চোখ পড়লে মৌ-এর ওপর। হাসছে। অবুঝ শিশু।

অপুর মৃত্যুতে বেশি কষ্ট পেয়েছে ফাহিম আর মন্টি। পলি স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছিলো না। ওর কাছে পুরো ঘটনাটা ধোয়াটে। ও মৌকে নিয়েই মেতে আছে । ফাহিম চাপা স্বভাবের ছেলে। কোনো কান্না কাটি নেই । কিন্তু মুখ দেখে আমি ওর ভেতরের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলাম। কিছুদিন থেকে ও আরো চুপ হয়ে গেছে। কাদে লুকিয়ে লুকিয়ে। মন্টি চঞ্চল প্রকৃতির । আমার চেয়ে মায়ের ন্যাওটা বেশি। আমি লক্ষ্য করলাম, ওর প্রিয় কবুতরগুলোকে ও বেমালুম ভুলে আছে। সুযোগ পেলেই ঘূর ঘুর করছে রুকু-র আশেপাশে।

দুসপ্তাহ ঢাকা যাওয়া হয়নি। প্রচুর কাজ পড়ে আছে। পাবলিশারদের কাছে কী ভাবে মুখ দেখাবো বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য ছেলের মৃত্যুর কথা শুনলে ওদের অনেকের হয়তে’ মন গলতে পারে। এদিকে টাকারও খুব দরকার। স্থির করলাম, কালই যাবো। রুকু কে বললাম। ওর আপত্তি নেই। সে-ও বুঝতে পেরেছিলো, শোক করলে দুঃখ বেড়েই চলে। জীবন চলে না।

রুকু-র সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় ন’বছর আগে, একাত্তরের জানুয়ারীতে । ঢাকা আর্ট কলেজে আমার একক একজিবিশন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন টগবগ করছে। সবার চোখে মুখে উদ্বেগ । আমার শো হওয়ার কথা ছিলো নভেম্বরে। কিন্তু জলোচ্ছাস ও পরে ইলেকশনের জন্য তিনবার ডেট ঠিক করেও পিছোতে হয়। শিল্প সাহিত্যের জন্য একাত্তরের জানুয়ারী সু-সময় ছিলো না। একট আসন্ন দুর্যোগের মেঘ সারা দেশের ওপর। লোকজন চাপা উত্তেজনায় ছটফট করছে, দিনের বেলা অফিস আদালতে, হোটেল রেস্তোরায় আলাপের একমাত্র বিষয় পালমেন্ট, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব । একটা বাম পন্থী দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো।  পার্টি মারফৎ জানলাম, বিপদ আসছে।

এমনি এক সময়ে, আমার একজিবিশনের চার দিনের মাথায়, দুটে মেয়ে ঢুকলো গ্যালারিতে। আমি কিছু কাটলগ নিয়ে বসে ছিলাম দরজার পাশে একটা চেয়ারে। সাতটা বেজে গেছে । আমার এাসিসটান্ট সবুজ, সে-ও তরুণ শিল্পী হঠাৎ বলে উঠলো, ‘মারুফ ভাই, রোকেয়া মল্লিক!’

ঃ কে ?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম অামি ।

: রোকেয়া মল্লিক। দারুণ রবীন্দ্র সংগীত গায়। দেখেননি টিভিতে ?

সবুজ বলতে বলতে ভেতরে গেলো। হাতে দুটো ক্যাটালগ । আমার টিভি নেই। সুতরাং রোকেয়া মল্লিকের গুরুত্ব না বুঝে বসে থাকলাম। এরা বেরিয়ে গেলেই আজকের মতো ক্লোজ করে দেবো। লোকজন আর আসবে না। আর দুটোদিন কোন রকমে গেলেই হলো। হোপ লেস। মাত্র একটা ছবি বিক্রি হয়েছে ওপেনিং-এর পর। দেশের এ অবস্থায় পেইন্টিং কেনার গরজ কার ।

ঃ মারু ফ ভাই ।

ভেতর থেকে ডাকলো সবুজ। আমি দরজা দিয়ে দেখলাম মেয়ে দুটো আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওদের পাশে গিয়ে দাড়াতে ফর্সা ছিপছিপে মেয়েটা বললো, “এ ছবিটা আমি কিনতে চাই ।’ ও সামনের কাজট৷ আঙুল তুলে দেখাল।

: দেখুন, এ ছবিটা বিক্রির জন্য নয়। নিচে, লেখা আছে। আমি বললাম।

তার মানে আপনি কিছুতেই বেচবেন না ? মেয়েটা আমার চোখে চোখ রাখলে। স্থির, সন্মোহনী দৃষ্টি ।
ঃ আমি দুঃখিত । আপনি অন্য ছবি দেখুন না। আমি গ্যালারির চারপাশে চোখ ঘোরালাম। সবুজ উসখুস করছে।

আর পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আপনি বলুন এ ছবিটায় এমন কী আছে যে আপনি বিক্রি করবেন না। এ মেয়েটি বুঝি আপনার স্ত্রী ? সঙ্গের মেয়েটি হাসতে হাসতে বললে। অপ্রস্তুত হলাম আমি। ভারী ফাজিল দেখছি ।

: জ্বি না, আমি এখনো সিঙ্গেল।

তাহলে বিশেষ কেউ ?

ছিপছিপে মেয়ে টি বললো। দুজনে শব্দ করে হেসে উঠলো।
ঃ তাও না, ওকে আমি কল্পনা থেকে একেছি। অামি অসহায়ের মতো সবুজের দিকে তাকালাম । ও কিছু বলছেনা কেন?

ঃ মারুফ ভাই এতে করে যখন বলছে, দিয়ে দিন না। আপনার মতো ইনিও তো শিল্পী । সবুজের কথায় আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম । ঠিক আছে । কিন্তু কথা হচ্ছে, ছবিটা আমারও অত্যন্ত প্রিয়। মাত্র ছ’মাস আগে একেছি।

ঃ কী, দিচ্ছেন তো?

আমার চোখে চোখ রেখে ছিপছিপে মেয়েটি বললো।

ঃ অলরাইট । তো, এখনই নেবেন ? শো আরো দুদিন চলবে ।

আপনার ঠিকানা দিয়ে যান, আমি পৌছে দেবো। পেমেন্ট তখনি হবে । অনেক ধন্যবাদ । আমার নাম রোকেয়া মল্লিক। এ আমার ক্লাসমেট নাহিদ । আমরা বাংলা সেকেণ্ড ইয়ার অনার্সে পড়ি। ছিপ ছিপে মেয়েটি ক্যাটালগের পেছনে ওর বাসার ঠিকানা লিখে দিলে । গ্রীন রোড, ধানমণ্ডি ।

ঃ তাহলে চলি, দেখা হবে।

রোকেয়া মল্লিক সঙ্গের মেয়েটির হাত ধরে বেরিয়ে গেলো। ছবিটার নাম ‘একা। এক তরুণী দোতলার রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। নিচে পড়ন্ত বিকেলে খেলছে এক দল ছেলেমেয়ে। । তরুণীর মুখে আবছা বিষাদ ।

আমার জীবনে জড়িয়ে গেলো রোকেয়ামানে রুকু। পচিশে  মার্চ থেকে ন’মাস আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমি চলে যাই ওপারে। ফিরে এসে এক নতুন রুকুকে আবিষ্কার করলাম আমি । ন’মাস ওরা অবরুদ্ধ ঢাকাতেই ছিলো । কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি । তবে প্রতি মুহুর্তের প্রাণের ভয় আর দুশ্চিন্তার ফলে অন্যান্য ঢাকা বাসীদের মতো ওদের আচার ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমি লক্ষ্য করলাম রুকু আগের চেয়ে অনেক শাস্ত, স্থির । চোখের দৃষ্টি আরো গভীর। ধীরে ধীরে আমি ওর স্বপ্নে-জাগরণে হয়ে উঠলাম একমাত্র আকাঙ্খিত পুরুষ।

রুকু-র অনার্স পরীক্ষার ক’দিন পরেই ওর আত্মীয় স্বজনদের মতের বিরুদ্ধে আমরা কোট ম্যারেজ করলাম । এর পাচ মাস পর ফাহিমের জন্ম। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে এখনো লজ্জায় আমার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে । রুকুকে আমি বহুবার বলেছি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিছানায় ও মত্ত বাঘিনী বরাবর । পুরুষ মানুষের কনট্রসেপটিভ আর হাতে চুড়ি একই ব্যাপার, রুকু -র এই অকাট্য যুক্তির ওপর কোনো কথা চলতো না।

কোথায় তুমি, শুনছো ? কান্ড দেখে যাও । সকালে নাস্তা খেয়ে একটা বইয়ের কভারে হাত দিয়েছি মাত্র—এমন সময় রুকু-র গলা।

মনে হচ্ছে, কোনো মজার ব্যাপার। আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে  এলাম। রুকু, স্বাভাবিক হয়ে আসছে এখন। ওর মর্জি মেজাজে সারা দেয়া প্রয়োজন।
ঃ কী হলো রুকু ?

হালকা গলায় আমি জিজ্ঞেস করলাম। পানি ভতি একটা প্লাস্টিকের গামলায় বসিয়ে মৌকে গোসল করাচ্ছিলো রুকু।

: আরে অদ্ভুত ব্যাপার । চার মাসের কোনো বাচ্চার কথা ফোটে শুনেছো ? আমি স্পষ্ট শুনলাম, ও যেন আমাকে ডাকলো।
ঃ বলো কী ? আমি অবাক হবার ভান করি।

ঃ হ্যা, পরিস্কার-ডাক- আম্মা।

তোয়ালে দিয়ে মৌ-এর গা মুছতে মুছতে রুকু বললো। খুশীতে কল কল করছে মৌ। রুকুর কোল থেকে আবার পিছলে নেমে যেতে চাইছে পানি ভতি গামলাটায়। আর হাত পা ছুড়ছে খুব। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। খুব ইচ্ছে হলো কোলে তুলে নিয়ে আদর করি। কিন্তু কাজ পড়ে আছে। দিন দিন সুন্দর হচ্ছে, তাই না ?

রুকু মায়া ভরা চোখে আমার দিকে তাকালো। হু, লাভলি, দারুণ কিউট হবে দেখতে। আমি মৃদু হেসে বললাম।

এ বাড়ির সবার চোখের মণি মৌ। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, যেন এক যাদুবলে মেয়েটা আমাদের অপুর অভাব পুরিয়ে দিলে।। অপুর কথা অবশ্য একেকবার আমাদের কথাবাৰ্তায় এসে যায়। ঐ মুহুর্তটায় রুকু অন্যমনস্ক থাকে কিছুক্ষণের জন্য । ওর চোখ ছলছল করে। কিন্তু সে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। হঠাৎ করে মৌ কেঁদে ওঠে । রুকু ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।

কেবলমাত্র আমার বিধবা ফুপু- আমার কোনো উচ্ছাস নেই , ও  ব্যাপারে। কারণ আছে অবশ্য। ফুপু আম্মার কোলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মৌ পেচ্ছাপ করে দেয় । মহিলা পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন সব সময় পাক পবিত্র থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু একেক সময় বাধ্য হয়ে মৌকে কোলে নিতে হয়। আর তখনি বিপত্তি । ফুপু-আম্মা কোনো মাথা ব্যথা নেই মৌকে নিয়ে। দুজনের যেন একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে। আমি এবং রুকু ব্যাপারটা খুব এনজয় করি ।

খুব শীত পড়েছে সেবার। জানুয়ারীর মাঝামাঝি। অন্য বছর এ সময় গরম ভাবট৷ চলে আসে। এবার দুপুর বেলা অনেকক্ষণ রোদে বসে থাকলেও, শীত যেতে চায় না। ঘরের ভেতর কনকনে ঠান্ডা। ইব্রাহিম সাহেবরা ক’দিন আগে আরো কয়েকটা ফ্যামিলি নিয়ে হৈহুল্লোড় করে পিকনিক করে এলেন। আমাদেরও যাবার কথা ছিলো। হঠাৎ আগের দিন রাতে মৌ এর জ্বর। রুকু পড়লে ওকে নিয়ে । সকাল দশটা পর্যন্ত টেম্পারেচার কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেলো না। অগত্যা প্রোগ্রাম বাতিল । মন্টি আর পলি গাল ফুলিয়ে রইলো। ফাহিমের প্রতিক্রিয়া সহজে বোঝা যায় না। সামনের রোববার আমরা পিকনিকে যাবো। শুধু আমাদের পরিবার । মৌ এখন সুস্থ । কিছুদিন হলো টালুর টুলুর হাটতে শিখেছে। দেড় বছর হতে চললো ওর বয়স।

পানাম থেকে মাইল চারেক দূরে একটা ভালো স্পট আছে। গত দু’বছর আমরা ওখানেই গেছি। অন্যরাও যায়। জায়গাটার প্রধান আকষণ একটা দিঘি। আয়তনে আমাদের বাড়িটার প্রায় কয়েক গুণ, টলটলে স্থচ্ছ জল, এখানে ওখানে ফুটে আছে শাপলা, পদ্ম। দীঘির

চারিদিকে অনেকখানি জুড়ে ছাড়া ছাড়া আম-কাঠালের জঙ্গল। লকবসতি নেই।  কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। আরেকটা দল দেখা যাচ্ছে না। -ওই পাড়ে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে স্টিরিও বসানো টু-ইন- স্পিকার। হিন্দি গান এপারে ভেসে আসছে । পিকনিকের আনন্দটাই মাটি । ভেবেছিলাম হৈ চৈ থেকে দূরে একটা দিন নিজেদের মতো করে কাটাবো । কিন্তু রুকু খুশী । অচেনা মানুষের সঙ্গে আলাপ জমাতে ওর জুড়ি নেই।

: কী ব্যাপার, অমন মুখ করে ব’সে আছো যে ? একটু হেলপ করো ।

ঘাসের ওপর একটা বড় শতরঞ্চি বিছিয়ে খাবারের পোটলা পুটলি গুছিয়ে রাখছিলো রুকু। রান্নার ঝামেলার ভয়ে সব ভোর রাত থেকে জেগে তৈরী করে এনেছে। বেশিরভাগই মাংসের আইটেম, ভাজা ভুজি । তামার সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো না। ফাহিম আর পলি সুবোধ বালক বালিকার মতো অন্য কে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। দিঘির মাঝখানে একটা পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে আছে মন্টি। সাঁতার জানে না ।

: পানির কাছে যেতে নেই মন্টি । অামি ডেকে বললাম।

না, আব্বা, । মন্টি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মৌ আমার কোলে, খুশিতে ডগমগ করছে।

ফাহিমের চুলটা কাটা দরকার। ছেলের দিকে সস্নেহে এক- নজর তাকিয়ে রুকু বললে।

: হ্যাঁ । দেখি কাল একবার সময় করে …।

আমি ভালো করে লক্ষ্য করলাম ফাহিমকে। রুকু আর আমার ভালোবাসার প্রথম ফসল। সত্যি, চুল ঘাড় প্রায় ঢেকে ফেলেছে। খেয়ালই করিনি। ওর চুল বাড়েও তাড়াতাড়ি। ছেলেটও বাড়ছে লকলক করে। আমার ফিগার পেয়েছে। মনে হচ্ছে, বছর তিনেক পর রুকু কে ছাড়িয়ে যাবে।

ঃ আব্বু, । ফাহিম তাকালো আমার দিকে ।

ঃ কী বাবা ?

ও এক বার চকিতে ওর আম্মুর র দিকে তাকালো। তারপর হামা গুড়ি দিয়ে সরে এলো আমার কাছে। আমার কানে ওর মুখ । রুকু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললো, ‘শোনো, তুমি ছেলেটাকে নষ্ট করবে। রাজ্যের যতো আজেবাজে বই পড়াও । আর রাতে চোখ বুজতে না বুজতেই সব উদ্ভট স্বপ্ন। আমার তো মনে হয় ও এবার ফেল মারবে। আর তাহলে এবার ওর সব ভূত পেত্বির বই আমি পুকুরে ফেলে দেবো। রুকুর রাগের ভান আমার বেশ লাগে। আমি জানি, কথাগুলো নিছক বলার জন্যই বলা। ছেলেমেয়েদের বোধ করি আমার চেয়ে ওই বেশি লাই দেয় । তবে ফাহিমের গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকাটা আগের চেয়ে বেড়েছে। ওর বয়সী ছেলেরা লাফায়, দাপায়। দু’ একবার হাত-পা ভঙে । ও ওদের থেকে আলাদা। ছোট ভাই মন্টি ছাড়া ওর কোনো বন্ধু নেই । এটা হয়েছে রুকুর জন্য । পাড়ার বেশী কারো ছেলেমেয়ের সঙ্গে ও ফাহিম বা মন্টিকে মিশতে দেবে না।

তুমি শুধু শুধু ছেলেটাকে বকছো। ও আমার কানে কানে বলেছে তুমি কী ভাবে বুঝলে ? আমি ফাহিমকে এক হাতে জড়িয়ে কাছে টেনে বললাম। ও মায়ের দিকে অভিমানীর চোখে তাকালো ।

: আমাকে বলতে হবে না। আমি বুঝি। নিশ্চয় নতুন কিছু বই আনতে বলেছে ?

কোলে বসা পলির চুলে হাত বুলোতে বুলোতে রুকু বললো।
: মোটেই না। আমি বললাম।

তবে কী । এই ছেলে, বাপ বেটায় মিলে তাহলে কী ফন্দি খাটছিস ?

: পলি…এই পলি ।

কাছে কোথাও মন্টির গলা শোনা গেলো। দেখলাম, ছেলেটা দিঘির পাড়ে নেই । বড্ড চঞ্চল । ফাহিমের উল্টোটা। একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ও আবার ডাকলো পলিকে। জানে, ফাহিমকে ডেকে লাভ নেই। ও যাবে না। মজার কিছু দেখতে পেয়েছে। মন্টি !  যাই আম্মা।

পলি ছটফট করে উঠে দাড়ালো। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই এক দৌড়ে মন্টির কাছে। মন্টি ওকে একটা ছোট সাইজের গাছের ডালে কী যেন দেখাচ্ছে। বোধহয় পাখির বাসা।

: হা, ফন্দি আঁটছি। আমরা ঠিক করেছি বাপে বেটায় একদিন তোমাকে ফেলে কোথাও চলে যাবো। আমি হ৷সতে হাসতে বললাম।

; ওমা কী সাংঘাতিক । তাহলে এই কথা ? বলতে বলতে রুকু আমাদের কাছে এগিয়ে আসতেই ফাহিম ওর কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। রুকু চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো ছেলেকে । ওর চোখ ছলছল করছে। এই এক ঝামেলা । ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোনো ঠাট্টা করা যাবে না।

মায়ের কোলে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে ফাহিম । চোখ আধবোজা। সেদিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে মৌ। রুকু ওর দিকে হাত বাড়ালো ।

দিঘির ওপারে হিন্দি গান থেমে গেছে। এখান থেকে আবছা দেখা যায়, ওরা চার জন। দুজোড়া তরুণ তরুণী । খুব সম্ভব ঢাকা থেকে এসেছে। প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা নেই শহরের আশ পাশে । আমাদের দেখে ওরাও বিরক্ত হয়নি, কে জানে । দুটো বেজে দশ। আমি দেখলাম জোড়া জুটি আলদা হয়ে দিঘির কাছে পিঠে ঘোরা ফেরা করছে। ঝোপ খুজছে না-কি ? আমাকে লক্ষ্য করে রুকু , মুখ টিপে হাসলো

: আমরা বোধ হয় ওদের ডিস্টাব করছি।

ঃ কিছু করার নেই। ওরা দুরে গিয়ে বসলেই পারে। রুকু আবার হাসলো । বেতের ঝুড়ি থেকে প্লেট বের করে সাজিয়ে রাখতে রাখতে ও বললো, ‘ফুপু- আম্মা আসলেই পারতো। একা একা সারাদিন । ওর কথা শেষ হয়নি, পলির গগনবিদারী চিৎকারে আমরা ছিটকে উঠে দাড়ালাম। আমার পায়ের ধাক্কা লেগে চায়ের পটটা উল্টে গিয়ে শতরঞ্চির ওপর পাতা সাদা চাদর ভিজে একাকার। সেদিকে চোখ নেই রুকু-র। ও আঁচল সামলা পড়ি মরি ছুটলো । ফাহিম, তুই মৌকে দ্যাখ-বলে আমিও ছুটলাম।

ছোট আম গাছটার নিচে ওরা দুজন ছিলো কিছুক্ষণ আগে। মন্টি  এক জায়গায় থাকার ছেলে নয় । পলির চিৎকার আসছে উত্তর দিক থেকে। ওই তো ! দুরে একটা গাছের নিচে দুই ভাই বোনকে দেখা  যাচ্ছে। আমরা পাগলের মতো ছুটলাম।

পলি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পাশে রক্ত শূন্য মুখে মন্টি দাড়িয়ে। ডুকরে কাদছিলে। । ওর ভীতসন্ত্রস্ত মুখ দেখে মায়া হলো আমার। ঠিক ততক্ষণে পলিকে কোলে তুলে নিয়েছে ‘কিছু হয়নি মা । এই তো আমরা। লক্ষ্মী মেয়ে আমার, সোনা আমার…।”

দেখলাম পলির কপাল আর নাকের ওপর দিক ছড়ে গেছে- দাঁতে বাড়ি লেগে নিচের ঠোট কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। নিশ্চয় পাখির বাসা পারতে গাছে উঠেছিলো দুজন। আমার রুমালটা মুহুর্তে ভিজে গেলে রক্তে । পলির কান্না থামছে না। ‘রুকু, অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালো। আমি পলিকে কোলে তুলে নিলাম।

ঃ আমার কোনো দোষ নেই আম্মা। পলিকে আমি উঠতে না করেছিলাম। ও শোনেনি। কাদতে কাদতে বললো মন্টি। চোপ, পাজি ছেলে কোথাকার । সব নষ্টের গোড়া তুই।

রুকুর ধমকে ভ্যাবা চ্যাকা থেয়ে থেমে গেলে। মন্টি চোরা চোখে ‘তাকালে অামার দিকে। পলি শান্ত হয়ে আসছে।

: কিছু হয় নি মা । এইতো এখুণি সেরে যাবে খুব ব্যথা লাগছে ?

আমার ঘাড়ের পেছন দিক থেকে আঁচলে পলির মুখ মুছে দিতে দিতে রুকু বললো। রক্ত আর পড়ছে না। ভাগ্যি, নিচে ঘাস ছিলো। মন্টির সাহসের কথা ভেবে আমি অবাক হলাম। ফাকা জায়গাটার চারদিকে ঘন জঙ্গল। আমারই গা ছম ছম করছে। আব্বু, আমাকে একটা চাবিঅলা গাড়ি কিনে দেবে ? কান্না থেমেছে পলির । মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছে। ওর, চোখের কোণায় জমে থাকা পানির ধারা মুছে দিয়ে আমি বললাম—‘হ্যা, মামনি, কালই কিনে দেবো। তুমি ঢাকা যাবে আমার সঙ্গে ?’  পলি মাথা নাড়লো। রুকুর মুখে স্বস্তির মৃঢ় হাসি। ও হাত বাড়িয়ে পলিকে অামার কাছ থেকে কোলে তুলে নিলে।

দুর থেকে ফাহিম বা মৌকে দেখা যাচ্ছিলো না। হয়তো বড় লিচু গাছটার গোড়ায় ঠেস দিয়ে ফাহিম বসে আছে। কোলে মৌ । পলি, মন্টিকে নিয়ে আমরা যখন দিঘির পাড়ে আমাদের শতরঞ্চির কাছে পৌছলাম, চারদিক সুনসান। কেবল একটা ঘুঘু ডাকছে। আমি চারদিকে চোখ ঘোরালাম । ফাহিম, মৌ-এর চিহ্নটি নেই। দিঘির পশ্চিম পাড়ের জোড়া জুটিকেও দেখা যাচ্ছে না। আমার অস্থির লাগছিলো, ঘামছিলাম ।

ঃ গেলো কোথায় ফাহিম ?

আমার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কোরাসে বললো রুকু-“তাই তো গেলো কোথায় । ওর চোখ মুখে দুশ্চিন্তা আর ভীতি। পলিকে কোল থেকে নামিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো।

ঃ আমার মনে হয় আশ-পাশেই আছে। মৌ হয়তো কান্নাকাটি করছিলো। ওকে ঠাণ্ডা করতে এদিকেই কোথাও হাটাহাঁটি করছে। রুকুকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না ।

ঃ তবু তুমি একটু ঘুরে এসো না । আমার ভাল্লাগছে না, যা-ও
প্লিজ ।

রুকু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।

আমি প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ডাকলাম, ‘ফা-হি-ম। প্রতিধ্বনি হলো কেবল। কোনো উত্তর নেই। আচ্ছন্ন এর মতো ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে, দৌড়াতে দৌড়াতে আমি ডেকে চললাম, ‘ফাহিম । ফা-হি-ম । আমার গলার স্বর আমাকেই ভেঙাচ্ছে। অনেক দুর চলে এসেছিলাম বোধ হয় । তরুণ-তরুণী জোড়া জুটিকে দেখা যাচ্ছে। আমি হাত তুলে আসতে বললাম। কাছে যেতেই লম্বা-চুল ছেলেটা বললো ‘ কি ব্যাপার ভাই  আমি ঘটনা খুলে বলি।

: না, না, যাবে কোথায়? আমরা আসার সময় ছোট মেয়ে টার সঙ্গে আপনার ছেলেকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছি। খুব চঞ্চল বাচ্চা । আমার চোখে এখনও ভাসছে। খাদির ফুল তোলা কামিজ পরা মেয়েটা বলতে বলতে ওর পাশে দাড়ানো কালো ছেলেটার দিকে তাকালো । ছেলেটা মাথা নাড়লো । সে-ও দেখেছে বোধ হয় ।

চিন্তা করবেন না ভাই সাহেব। গিয়ে দেখেন আপনার ছেলে মার পাশে বইসা আছে। লম্বা চুল ছেলেটার আশ্বাসবানী শুনে আমি ওদের উল্টোদিকে দৌড়ালাম।

ওদের তিন জনকেই শুধু দেখা যাচ্ছে। রুকু আমাকে দেখে চীৎকার করে উঠলো, পেয়েছো ? কোথায় ওরা?’ আমার বিবৰ্ণ মুখ দেখে কথ৷ বন্ধ হয়ে গেল ওর। আমি কী বলবো, বুঝতে পারছি না। রুকু বসে পড়লো মাটিতে। এখন সেন্সলেস না হয়ে যায় ।

এ অবস্থায় অস্বাভাবিক কিছু না। এমন সময় দিঘির পাড় থেকে মন্টির পড়িত্ৰাহি চিৎকার, “আব্বু, এদিকে আসো।’

ছুটে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে রুকুও। পাড়ের ঢালু জমি কিছুদূর নেমে গিয়ে মিশেছে পানিতে । ছপ ছপ শব্দ কানে এলো ‘ পাড় ঘেষে আধডোবা অবস্থায় দাপাদাপি করছে মৌ । একটা হাতে বড় নালি ঘাসের গোছা ধরে আছে। পাগলের মতো আমি পানিতে নেমে গোলাম । পাজাকোলা করে ওকে আমি কোলে তুলে নিয়েছি । রক্ত শূন্য শরীর। দু চোখ বোজা। হাতে পায়ে মুখে আঁচড়ের দাগ । গায়ের জামাটাও ছেড়া।

দাও ওকে আমার কাছে । আমার মা মণিকে একলা ফেলে রেখে কোথায় গেছে…হায় হায়, ফাহিমের আর বুদ্ধি শুদ্ধি হলো না। কপাল চাপড়ে কাদতে কাদতে বললে রুকু । আমি পানিতে দাড়িয়ে অচেতন মৌকে রুকুর হাতে তুলে দিলাম । দু’জন কামলা ধরনের লৈাক হেঁটে যাচ্ছিলো । ওরা বিপদের গন্ধ পেয়ে দৌড়ে এলো।

কিন্তু একি। হঠাৎ আমার মনে হলো পা কাদায় ক্রমশ দেবে যাচ্ছে। কোনো রকমে একটা পা সামনে রাখতেই আরেকটা পা পুতেথকথকে মাটিতে বসে যাচ্ছে। পাড়ে সবাই মৌকে নিয়ে ব্যস্ত। আমার সঙ্গীন অবস্থাটা কেউ লক্ষ্য করলো না। আমি ততক্ষণে পাড় থেকে  দশ বারো হাত দুরে চলে এসেছি। বুক সমান পানি। এখন পা তুলতেও কষ্ট হচ্ছে ! মনে হলো, একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে ঠেলে দিঘির মাঝখানে নিয়ে যেতে চায়। হঠাৎ আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ডান পাটায় একটা মানুষের মাথা ঠেকলে যেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি বাঁ পা টেনে আনলাম অনেক কষ্টে । আমার দু’পায়ের নিচে একটা মানুষ। আমি গলা ফাটিয়ে ডাকলাম, ‘রুকু। রুকু ।

ডুব দিয়ে যে নিথর শরীরটা আমি তুলে আনলাম, ওটা আমার ছেলে ফাহিমের । প্রাণের চিহ্নটুকু নেই। ভয়ে বিস্ফারিত দু’চোখ । এক হাতের শক্ত মুঠোয় কিছু লালচে চুল। নাক দিয়ে চু’ ইয়ে পড়ছে পানসে রক্ত । রুকুর পেটের সন্তান। দুর থেকেই ও চিনতে পেরেছে। আমি দেখলাম ও মাটিতে এলিয়ে পড়ে গেলো। ভেজা সপসপে ছেলের লাশ কাধে নিয়ে আমি দাড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পা কেবলি দেবে যাচ্ছে কাদায়। গ্রামের লোক দুটোর একজন আমার অবস্থা দেখে ঝাপিয়ে পড়লে পানিতে।

অনেক কষ্টে ফাহিমের লাশ নিয়ে আমরা দু’জন পাড়ে উঠে এলাম । মন্টি, পলি গুমরে গুমরে কাঁদছে। রুকু নিথর পড়ে আছে ঘাসের ওপর । পাশে বসা মৌ, এখনো সবাঙ্গ ভেজা, চুল থেকে পানি পড়ছে ।

ঃ মাইয়ার বেশি কিছু অয় নাই । কপাল ভালা আপনে আগে দেখছিলেন। কিন্তু এইডা কেমুন অইলো? এমন একটা পোলা শেষ কালে – কামলা দুজনের একজন বললো। মৌ অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে লম্বালম্বি শোয়ানো ফাহিমের নিথর দেহের দিকে। বাকি সময়টা আমার একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে গেলো। এর মধ্যে রুকুর জ্ঞান ফিরেছে। আশ্চর্য, কাঁদলো না। অভিব্যক্তি হীন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অন্য দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। শেষে পাগল হয়ে না যায় !

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

আমাদের ভালোবাসার প্রথম ফসল, ফাহিমের লাশ কাধে নিয়ে আমরা ফিরলাম বাসায়। পানাম নগর থেকে সঙ্গ নিয়েছে জনাদশেক চেনা অচেনা লোক। অনেকেই প্রফেসর সাহেবের নাতি ফাহিমকে চেনে । দুঃখ করছিলে সবাই । একটা তরতাজা ছেলে, এমন ভাবে পানিতে ডুবে মরলো ! বড় লোকের পোলাপানেরা কেন যে সাঁতার শেখে না। ফাহিম সাতার জানতো। আমি মনে মনে বললাম।

অরেক রুকুকে আবিষ্কার করলাম আমি। ওকে আজকাল আমি যতো দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। আমাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে ওর এই সত্তা আমার কাছে ধরা পড়েনি । ফাহিমের মৃত্যুর পর একেক বার মনে হচ্ছিলো, আমিই বুঝি পাগল হয়ে যাবো। পুরো এক মাস কোনো কাজ করিনি। টেবিলে রং তুলি কলম ছড়ানো, পাশে খসড়া ড্রয়িং-এর স্তুপ। জীবনে যা করিনি, চোখ মুখ বুজে কলেজের অধ্যাপক সুজাউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকাও ধার করে ফেললাম। আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো।

ঠিক ঐ অবস্থায় লক্ষ্য করলাম রুকু শান্ত, স্থিতধী এক মূর্তির মতো নীরবে সাংসারিক কাজ করে যাচ্ছে। কথা বার্তাও বলছে প্রয়োজনে। অামাকে উল্টো সান্তনা দিয়েছে কয়েকবার। ‘ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই। বাচতে হলে অনেক কিছুই সইতে হয়’ ওর এসব কথায় আমার মনে হয়েছে, এতোদিন পর্যন্তও ও স্বভাবে-মেজাজে ছিলো একজন কিশোরীর মতো। দু দুটো সন্তানের অপমৃত্যু ওর সুপ্ত নারী সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে ।

আমি অবশ্য মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ দিয়েছি আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের । এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবী চলছে। ফাহিমের ঘটনার পর ওরা পাশে না এসে দাড়ালে আরো মারাত্মক কিছু হয়তো ঘটে যেতো । পুরো সাতদিন ইব্রাহিম সাহেবের স্ত্রী রুকুকে রান্না ঘরে যেতে দেয়নি। বাচ্চাদের সামলাতে  কষ্ট হচ্ছিলে৷ ফুপু আমার এগিয়ে এসেছে, মিসেস জামান, ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী। আরো যে কতো মানুষ এসেছে আমার মনে নেই। শুধু প্রতিবেশীরা কেন, সোনার গাঁ বাজার থেকেও অনেকে এসেছে খবর পেয়ে । দৈনিক নিজ হাতে বাজার করার সূত্রে, রুকু সবার প্রিয় বেগম সাহেব । তার ওপর, প্রফেসর সাহেবের পুত্রবধূ। রুকু বাজারে গেলে ওর মন রেখে সদাই বেচার জন্য কম্পিটিশন পড়ে যায়। ফাহিমের জানাজায় আমাদের বাগানে এক তিল জায়গা ছিলো না। নামাজ শেষে ওকে গোরস্থানে নিয়ে যাবার আগের মুহুর্তে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ওর স্কুলের ক’জন বন্ধু। হেড মিস্ট্রেসের চোখ ছলছল করছিলো ।

সব নীরবে দেখে গেছে রুকু। আমি আর পারছিলাম না। কিন্তু
রুকু সয়ে যাচ্ছিলো। মেয়েদের ভেতরে এতো শক্তি থাকে, যারা
রাস্তায় পকেট মারকে মারতে দেখে কেদে ফেলে । রুকুকে নিয়েই
এরকম হয়েছিলো একবার ।

বড় মনমরা হয়ে আছে মন্টি । বাচ্চা ছেলে, ভেতরের কষ্টের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। মাঝে মাঝেই আমার দিকে ফ্যাল: ফ্যাল করে তাকায়। আমি কোলে তুলে নিই । তারপরই আমার কাঁধে মুখ গুজে কান্না। ওকে বাড়ির লোক কাদতে দেখেছে কম। আমি মনে প্রাণে চাইছিলাম, ও আবার দুষ্টুমি করুক, সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াক। ওর এই বিষন্ন সুবোধ চেহারা আমার ভালো লাগছে না।

পলি আর মৌ-এর তেমন পরিবর্তন নেই। সমস্ত ব্যাপারটাকে ওরা একটা মজা ধরে নিয়েছে। তাছাড়া বোঝার বয়সই বা ওদের এমন কী? পলির ঠোঁটটা বেশ কেটে গিয়েছিলো। ঘা শুকিয়ে এলেও একটা আড়াআড়ি দাগ রয়ে গেছে। কিছু দিন পর মিলিয়ে যেতে পারে।

আমার ফুপু আম্মার বদ্ধমূল ধারণা মৌ-এর জন্যই ফাহিমকে অকালে মরতে হলো। নচ্ছার মেয়েটা খেলতে খেলতে নিশ্চয় দিঘির পাড়ে চলে গিয়েছিলো । তারপর পা পিছলে পানিতে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে ফাহিমও পড়ে যায় । হঠাৎ দিশেহারা হয়ে ও হয়তো সাঁতার কাটতে ভুলে গিয়েছিলো। তাছাড়া দিঘিটাও খারাপ। মৌ-কে বাচাতে গিয়ে প্রাণ দিলো ফাহিম।

ফুপু আম্মার এসব কথার কোনো জবাব নেই। আমি আর রুকু চুপচাপ শুনে যাই। কিন্তু এটা ঠিক, মৌ-এর কোনো দোষ নেই। ও কিইবা বোঝে। ফাহিমকে সে-ও কম ভালোবাসতো না। অনেক দিন দেখেছি, ও ভাইয়ের গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে।

ফুপু-আম্মাকে বুঝা দেয়া গেলো না। ইদানীং মৌ কোনো ভাবে সামনে পড়লেই হলো, তার চোখ মুখ খি চিয়ে ওঠে। আর, বেচারী মৌ এক দৌড়ে রুকুর কোলে।

ফুপু আম্মা যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে । “তুমি কিছু বলো।” রুকুর কথার উত্তরে আমি মাথা নাড়লাম। বলবো।

: বলে কি !

আমি সোজা হয়ে বসলাম। রুকু মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকালো—‘আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ নিয়ে তিনদিন মন্টি আমাকে কথাটা বললো। আজ বলতে বলতে কাদছিলো।

: কিন্তু ওদের দুজনে খুব ভাব ছিলো না ? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

ছিলো, এখন নেই। মন্টি বলে-বলে যে ..
: কী বলে !

: মৌ নাকি ওকে মারে।

রুকু কথাটা বলে ঢোক গিললো।

ঃ ধুর ! যতোসব আজগুবি কথা । এ নিশ্চয় তোমার ছেলের নতুন কোনো বাদরামি। আরে, মৌ ওকে মারবে কি, দ্যাখো উল্টোটা কী-না ! দাড়াও ওকে আমি জিজ্ঞেস করছি’—বলে আমি উঠে দাড়াতেই দেখলাম দরোজায় মৌ দাড়িয়ে। আমাদের কথাবার্তা সব শুনেছে হয়তো।

‘আব্বা ’—-ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো ।

“মন্টির সঙ্গে তোমার বাগড়া হয়েছে মামনি ? আমি জিজ্ঞেস করলাম। মৌ দু’দিকে মাথা নাড়লো ।

ঃ বলিনি আমি ? যত্তোসব বাজে কথা।  আমি রুকুর দিকে তাকালাম।

: আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি মন্টিকে আজই জিজ্ঞেস করবে।

রুকু বেরিয়ে গেল, আমার কোল থেকে পিছলে নেমে ওর পিছু নিলাে মৌ।

বাথরুম থেকে রুকু প্রায় ছুটতে ছুটতে এলাে।
: এ্যাই শুনছাে।

আজ আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগছিলাে। রাত একটার কম হবে না। চোখ বুজে আসছে। কোনাে রকমে চোখ খুলে বললাম, কী হলাে?

সেই কুকুরটা ডাকছে। রুকু আমার গা ঘেষে বসে পড়লাে। আমি কান খাড়া করলাম। উল্টো গলায় থেমে থেমে একটা কুকুর ডাকছে। রক্ত হিমকরা ডাক। মনে হলো জন্তুটা এক জায়গায় দাড়িয়ে নেই। বাড়ির চারদিকে পাগলের মতাে ঘুরছে।

: ও কিছু না। তুমি ঘুমাও।

আমি রুকুকে অভয় দিলাম। কিন্তু মন্টিরা যদি জেগে ওঠে? ওর গলায় উদ্বেগ।

: কেন ফুপু আম্মা আছে না? তুমি খামােখা ভয় পাচ্ছাে। দাড়াও ওটার ব্যবস্থা কাল করছি। কোত্থেকে যে এই আপদ এসে জুটলাে ! তুমি ঘুমাও।

ডাকটা আধঘণ্টার মধ্যে থেমে গেলো। আমার ঘুম ছুটে গেছে। রুকু ছোট মেয়ের মতাে গুটিসুটি পাকিয়ে আমার বুকের কাছে। ফুপু আম্মা বোধহয় বাথরুমে গেছেন। শব্দ পেলাম।

খানিকটা তন্দ্রা মতো এসেছিলো। মন্টির চীৎকার শুনে ধড়মড়করে জেগে উঠলাম। দরজায় ধাক্কার শব্দ। খুলতেই মন্টি ভেতরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলাে। ঠকঠক করে কঁপছে। পেছনে ফুপু আম্মা। রুকুও জেগে উঠে হতভম্বের মতাে বসে আছে।

: কী হলো?

ঘুমের ঘোরে আমার সব স্পষ্ট লাগছিলাে। মারুফ, এইটা কী ব্যাপার? আজদাহা এক কুত্তা আমাগো জানালার উপরে ঠ্যাং তুইলা খারাইয়া আছে। তুই দেইখা যা’-ফুপু আম্মা আমার হাত ধরলেন। ওদের ঘরে ঢোকা মাত্র আমার শিড়দাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলাে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মৌ দাড়িয়ে। পলি অঘোর ঘোরে ঘুমােচ্ছে বিছানার এক পাশে।

মৌ!

আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার মনে হলাে, মৌ যেন হঠাৎ ভয় পাওয়ার ভান করছে। না-কি আমারই মনের  ভুল । কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমার রাগ গিয়ে পড়লাে ফুপু আম্মার ওপর। আশ্চর্য মানুষ তুমি, একটা দুধের বাচ্চাকে কেউ এভাবে একলা ফেলে যায়! ভাগ্যিস, পলি জাগেনি। দ্যাখ, মারুফ, আমি সব নিজের চোখে দেখেছি। ফুফুর গলায় ঝাঁজ।

: কী দেখেছে? চীৎকার করে বললাম আমি।

: তাের পােলারে জিগাইয়া দ্যাখ। মৌকে কোলে নিয়ে শােবার ঘরে এলাম আমি।

আম্মুর কোলে মুখ গুজে মন্টি ঘুমাচ্ছে। রুকুর চোখে মুখে প্রশ্ন। ‘আজ, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবে—’মৌ কঁদো কাদো গলায় বললাে।

: হঁ্যা, মামনি। আমি মাথা নাড়লাম।

কিছুদিন ধরে মন্টি আমার ও রুকুর একটা মাথা ব্যথা হয়ে দাড়িয়েছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। ওর সেই এক অভিযােগ- মৌ ওকে সুযােগ পেলেই মারে। চুল ধরে টানে। ওর দুষ্ট, চঞ্চল প্রকৃতির কথা কারাে অজানা নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে ও একে- বারে অন্যরকম। ছুটোছুটি করতে গিয়ে এটা সেটা ভেঙে ফেললেও, ও জিনিসপত্র ভাঙচুর করতাে না। নিজের খেলনা, টুকিটাকি বস্তু তাে কদাপি নয়।

আজকাল বাড়ির এখানে ওখানে ওর ভাঙা, দুমড়ানাে-মােচড়ানাে খেলনাগুলো গড়াগড়ি যায়। একদিন দেখি ফুটবলটা দিঘির মাঝখানে ভাসছে, যা কল্পনা করা যায় না। মন্টি বিগড়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। সেদিন ঢাকা থেকে ফিরে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু চোখ বুজেছি। রুকু ঘরে এসে ঢুকলাে—“কী করি মন্টিকে নিয়ে বল তো?

: কেন হলো কি ?
আমি চোখ বুজেই পাশ ফিরে বললাম।

: সেই পুরনাে কমপ্লেন, মৌ ওকে মারে।

. রুকু আমার মাথার কাছে বসলাে।

: তুমি নিজে কিছু দেখেছো ?

: তা দেখিনি। কিন্তু মন্টি তাে ওরকম বানিয়ে কথা বলার ছেলে নয়। ন’বছর বয়সে ও কী মিথ্যা কথা বলবে? অথচ মৌকেও আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। অমন একটা লক্ষ্মী মেয়ে ! রুকুর কপালে ভাঁজ পড়লো।

: আজ কিছু বলেছে?

আমি উঠে বসলাম । হঁ্যা, তবে আর বলছি কি? তুমি ফেরার  কিছুক্ষণ আগেও ও কাদছিলাে। রুকু কপালের রগ টিপে ধরলো দু’হাতে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা ধারণা খেলে গেলাে। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে মন্টি হিংসে করে মৌকে? কারণ, শুরু থেকেই ও আমাদের প্রায় কলজের টুকরাে। ও কিছু চাইবার আগেই পেয়ে যায়। আর ছোট মেয়ে বলে মন্টির চেয়ে ওর আরাম-আয়েশের প্রতি অামাদের খেয়াল বেশি। আমি রুকুকে কথাটা বললাম। ও উত্তর দিলো না।

মন্টিকে আদর করে জিজ্ঞেস করলে হয়। আমি উঠে জানালার পাশে দাড়ালাম। ওই তো, কেমন সুবোধ বালকের মতাে ওর দুটো  পায়রাকে আদর করছে। বেলা পড়ে আসছিলো। বাগানের কামরাঙা গাছের ঘন সবুজ পাতার চিরল ছায়া পড়েছে ওর কোকড়ানাে চুলে, পিঠে। আমার রক্ত মাংসের সন্তান। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি রুকু আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে। চোখ ভরা মমতা নিয়ে সেও তাকিয়ে আছে মন্টির দিকে।

মন্টিকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে হলাে না আমার। ভাবলাম আরেকটু বয়স হলে ওর পাগলামি আপনি কেটে যাবে।

আমাদের বাড়ির পেছন দিকে, যেখান থেকে ধানী জমি শুরু হয়েছে, তার কিছু ভেতরের দিকে এক চিলতে জায়গায় আমি কয়েকটা পটকা মরিচের চারা পুতেছিলাম। অনেকদিন ওগুলাের যত্ন নেয়া হয় না। আছে না মরে গেছে-ভাবতে ভাবতে সেদিন সকালের দিকে আমি গেছি বাড়ির পেছনে। বাহ, তরতাজা চারাগুলােকে দেখে আমার বেশ লাগলো। একটাতে আবার কয়েকটা মরিচের কুড়ি।

নিড়ানী দিয়ে গাছগুলোর গােড়া সাফ করতে করতে আমি চলে এলাম শুকনো ডোবাটার কাছে। ওটা আমাদের বাড়ির ডাস্টবিনের কাজ করে। হঠাৎ একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে আমি উঠে দাড়ালাম। মাত্র একমাস আগে আমার জমানাে টাকা থেকে মন্টিকে আমি বেবি-সাইকেলটা কিনে দিয়েছিলাম। আবর্জনার স্তুপের ভেতর ওটা যে সাইকেল বােঝার উপায় ছিলাে না। রডগুলো ভয়ঙ্করভাবে ব্যাকানো, হ্যাণ্ডেলটা দুভাগ হয়ে দুদিকে। মনে হচ্ছিলাে, কেউ যেন আছড়ে আছড়ে ভেঙেছে।

রাগে আমার হাত পা কাপছিলাে। কোনাে রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এলাম। রান্নাঘরে রুকুকে দেখা যাচ্ছিলো।

: মন্টিকে দেখেছাে রুকু?

আমি দাতে দাত চেপে বললাম। ও মুখ না ঘুরিয়েই বললো, ওপরে গেস্ট রুমে ছিলাে তাে। আমি ওপরে উঠে এলাম। খােলা দরােজার ফাঁক দিয়ে মন্টিকে দেখা যাচ্ছে, মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। গা ঘেঁষে দাড়ানাে মৌ। আমার রাগ পড়ে এলাে। নতুন কোনাে খেলা আবিষ্কার করেছে হয়তাে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ওদের দুজনেরই পেছন ফেরানাে দরজার দিকে।

: না••! মন্টির গলা চিরে একটা চীৎকার। আমি টাল সামলাতে সামলাতে দেখলাম, মন্টি উঠে দাড়িয়েছে। মৌ-এর ওপর ওর চোখ। ডান হাতের মুষ্টি পাকানাে। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ওর একটা ঘুষি গিয়ে পড়লো মৌ-এর মাথায়।

মন্টি ! একটা গর্জন করে আমি ঢুকে গেলাম ঘরের ভেতর। মন্টি আমাকে দেখে বিহ্বল হয়ে আছে। নড়ছে না। মৌ গঁাট হয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখে পানি বা ব্যথা পাওয়ার কোনাে চিহ্ন নেই চেহারায়।

ঃ পাজি ছেলে কোথাকার! মৌ তােকে মারে? এ বয়সেই মিথ্যা কথা? আমি নিজের চোখে দেখলাম তুই…’ বলতে বলতে আমি মন্টির গালে জোরে চড় কষিয়ে দিলাম। হাউমাউ করে ও কেঁদে উঠলােনা, আব্বু, আমি না। ও আমাকে আগে মেরেছে। চোপ! মৌ মেরেছে । ধাড়ী ছেলে কোথাকার। এটুকুন মেয়ে কাউকে মারতে পারে ? থাপড়ে সব দাত ফেলে দেবাে। আমার গলার স্বর ক্রমশ বাড়ছিলাে।

: আব্ব, তুমি বিশ্বাস করে। আমি মিথ্যা বলছি না। মৌ আমাকে আগে মেরেছে। আমার চুল ছিড়ে ফেলেছে। কান্না থামিয়ে মন্টি ফোপাতে লাগলো। আমি লক্ষ্য করলাম, ওর দু’চোখে মিনতি। এ সবই অভিনয়। বদমাশ হচ্ছে দিন দিন।

: সাইকেল কে ভেঙেছে ?

আমার গলায় এমন কিছু ছিলাে যে মন্টি ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলাে। কী যেন বলতে গিয়েও বলছে না। ঠোট জোড়া কঁপছে।

: বল, তুই ভাঙিস নি ?

আমি তেড়ে গেলাম। মন্টি চকিতে একবার তাকালাে মৌ-এর দিকে। তারপর বললো, মৌ ভেঙেছে।’

জলজ্যান্ত মিথ্যা। কিন্তু মন্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় বালকের কাতর দৃষ্টি নিয়ে। চোখের কোণ বেয়ে পানির স্রোত দু’হাতে মুখ ঢেকে ও দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

মৌ এতােক্ষণ টু শব্দটি করেনি। স্থির, নিস্পলক দাড়িয়ে আছে। কপালের কাছটায় সামান্য ফোলা। ধাড়ী ছেলেটা মেরেছেও গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। হঠাৎ ওর চোখ ছল ছল করে উঠলাে। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। মাত্র তিন বছর বয়স। ও নাকি মন্টিকে মারে।

: দেখি দেখি মা, তােমার হাতে কী? কী লুকাচ্ছাে? ওর ডান হাতের মুঠ্যে লক্ষ্য করে আমি বললাম। ও কী যেন আমার চোখ থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে। মৌ মিষ্টি করে হাসলাে। হাতটা ও পেছন দিকে। টুকিটাকি কিছু হবে হয়তাে।

: ঠিক আছে। তােমার গোপন জিনিস। আমি দেখছি না। বলে আমি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। ও সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাে নিচে।

মিনিট পাঁচেক আমি পুরো ব্যাপারটা ভাবলাম। ধোঁয়াটে লাগছে সব। শেষ পর্যন্ত মণ্টির গায়ে হাত তুলতে হলে আমার ? ছেলে মেয়েদের আমি কোনােদিন মারিনি। কিন্তু উপায় ছিলাে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ও মৌকে মেরেছে। অথচ মন্টির এমন হবার কথা নয়।

নিড়ানীটা তাড়াহুড়াে করে বাড়ির পেছনে ফেলে এসেছিলাম। মনটা বিষিয়ে গেছে। আজ আর কাজ হবে না। ওটা এনে সিড়ি নিচে খুন্তি কোদালের মাঝখানে ছুড়ে দিতে দিতে একটা জিনিস আমার চোখে পড়লাে৷ তুলে দেখলাম কয়েক গাছি কোঁকড়ানো চুল। চুলের গােড়ায় রক্ত-মেশা কঁাচা মাংস। মন্টির চুল।

: এ কি, সিড়ির নিচে দাড়িয়ে কী করছে? কিছু হারিয়েছে?”  রুকু পেছনে।

: না, কিছু না। চকিতে হাত বন্ধ করলাম আমি।

: তাহলে গােসল করে নাও, বাচ্চাদের ক্ষিদে পেয়েছে। টেবিলে খাবার দিয়েছি। রুকু চলে গেলাে। কিছু বুঝতে পারেনি। চুলের গাছি কটা সিড়ির ভেতরকার অন্ধকারে ছুড়ে দিয়ে আমি চলে এলাম। মাথা ঝিমঝিম করছে।

খাবার টেবিলে ফুপুআম্মা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলাে। মন্টিকে মেরেছি আমি। যাক, পরে সব খুলে বলা যাবে। পলি আমার পাশের চেয়ারে। উল্টো দিকে মৌ। পাশে মন্টির চেয়ার খালি। তার পরেরটায় রুকু। ও মৌ আর পলিকে ভাত বেড়ে দিচ্ছিলো। আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলাে। মন্টি। আমি উঠে দাড়ালাম। কোথায় যাচ্ছাে ? মন্টি খাবে না। মৌ-এর পাশে বসে খাবে না। আমি অনেক সেধেছি। থাকুক না খেয়ে। একটা শিক্ষা হওয়ার দরকার। এ ছেলে আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।

রুকুর কথার পর আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। ক্ষিদে উবে গেছে। মুখ বিস্বাদ। মৌ অনেক কষ্টে ওর ছােট্ট হাত বাড়িয়ে পাত থেকে একটা মাছের টুকরাে রাখলাে আমার প্লেটে।

আব্বু, এটা তোমার জন্য । খাও। ও মিষ্টি করে হাসলো। দেখলে, কী লক্ষ্মী মেয়ে আমাদের ? রুকুর কথার উত্তরে আমি যন্ত্রের মতাে বললাম, ‘হুঁ, খুব লক্ষ্মী মেয়ে।

লালচে চুল আর ফরসা রঙ ছাড়া ওকে অন্যান্য বাঙালি বাচ্চাদের থেকে আলাদা করা যাবে না। তবে, এরকম ফুটফুটে, আহলাদী মুখ কম দেখা যায়। খেতে খেতে আমি ওকে লক্ষ্য করলাম।

ঢাকা না গেলে খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে ঘুমানাে আমার অভ্যাস। বিকেলে শরীরটা ঝরঝরে লাগে। আজ বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। মন্টিটা না খেয়ে আছে। পলি আর মৌকে নিয়ে রুকু ইব্রাহিম সাহেবদের বাসায় গেছে কিছুক্ষণ আগে। সমস্ত বাড়ি নিঝুম। আমি উঠে পড়লাম। মন্টিদের ঘরে ফুপু আম্মা একা বসে আছে জায়নামাজে। আমাকে দেখে আবারাে মুখ ফিরিয়ে নিলাে। দারুণ রেগে গেছে। এ ঘর ও ঘর খুজে মন্টিকে আমার স্টুডিওতে
পাওয়া গেলো। কোণায় রাখা ক্যাম্প খাটটায় নিঃসাড় ঘুমিয়ে আছে। দেখেই আমার অন্তর কেঁপে উঠলাে। শেষ পর্যন্ত ওকে আমি মেরেছি। অপু আর ফাহিমের মৃত্যুর পর ও-ই আমাদের এক মাত্র পুত্র সন্তান, আমাদের বংশের শিখা।

আমি কাছে গিয়ে ঝুঁকে ওর দিকে প্রাণভরে তাকিয়ে থাকলাম। মায়ের চেহারা পেয়েছে। একহারা শরীরে মুখটা ভীষণ কোমল। রুকুর সেই টিকলাে নাক, মাঝখান থেকে দুদিকে বাঁকানাে ঠোট, সেই তেকোণা চিবুক। শুধু চুলটা আমার। ঘন কালাে এবং কেঁকড়ানাে। কী যেন বিড় বিড় করে ও পাশ ফিরে শুলল। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পড়লাে, ওর বাঁ কানের ওপর দিকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মনে হচ্ছিলো, অমানুষিক শক্তি দিয়ে কেউ এখান থেকে চামড়া সহ কয়েক গাছি চুল ছিড়ে নিয়েছে। তক্ষুণি দেখলাম ওর গালে কালচে হয়ে আছে আমার পাঁচ আঙ্গুলের দাগ। আমি কান্না চাপতে পারছিলাম না, শব্দ পেয়ে মন্টি চোখ খুলে আমাকে দেখে হতচকিত হয়ে গেলাে । আব্বু, তুমি আবার মারবে?

মন্টি ভয় পেয়ে বললো। আমি আর পারলাম না। কোলে তুলে নিলাম আমার সােনা মনিকে।

মৌ-এর জন্মদিন গত দু’বছর ধরে আমরা নিজেরা ঘটা করে পালন করি। সামনে শনিবার ও পুরো তিন বছরে পড়বে। এবার আমি কেন জানি মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। কিন্তু রুকু জিদ ধরে আছে হবেই। ওর যুক্তি, মন্টি, পলির হলে ও কী দোষ করলাে ?

মৌ-এর জন্য আগের দিন ঢাকা থেকে কিছু কাপড় চোপড়, গিফট কিনে আনতে হলাে। রুকু ওকে দিয়েছে একটা ছােট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ। আজকাল বাচ্চা মেয়েরা কঁাধে ঝােলায়। আর একটা দামী তুলোর পুতুল। মৌ খুব পছন্দ করবে ।

শনিবার দিন ঘুম থেকে উঠেই রুকু পলি আর মৌ কে মনের মতাে করে সাজালাে। বাইরে বৃষ্টি। ফুপু আম্মা শুয়ে আছে, কদিন থেকে জ্বর। নাশতার টেবিলে ঘটলাে বিপত্তি। উৎসবের আমেজটা মাটি করে দিলাে মন্টি।

সেই ভাঙা সাইকেল নিয়ে ঘটনার দিন থেকে ও মৌকে এড়িয়ে চলেছে। খাবার টেবিলে জায়গা বদল করে ও পলিকে দিয়েছে মৌ- এর পাশে। রুকু দাতে দাত চেপে ওর কাণ্ড-কারখানা দেখে ম্যাচ্ছিলাে।

মৌ-এর জন্ম দিনের দিন সকালে রুকু নিজেকে সামলে রাখতে পারলাে না। অন্যান্য দিনের মতাে মন্টি আমার পাশে এসে বসেছে মাত্র, রুকু বলে উঠলাে—“মন্টি, মৌ-এর পাশে গিয়ে বসো।  আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।

যাও, মন্টি। আজ ওর জন্মদিন। একটা বাচ্চা মেয়ে, ওর সঙ্গে ঝগড়া করতে নাই। যাও, লক্ষ্মী, রুকু আদুরে গলায় বলতে থাকলাে। মন্টি নড়লাে না। একবার তাকালাে আমার দিকে, তার- পর মৌ-এর পাশে খালি চেয়ারটার দিকে। পলি বিপদ আন্দাজ করে আগেই ফুপুআম্মার খালি চেয়ারে বসে পড়েছে।

: মন্টি, কথা কানে যাচ্ছে না? যা বলছি করো। রুকুর গলার স্বর বাড়ছিলো। ছেলেটা ঠায় বসে আছে।

: থাক না আজকের মতাে। সাত সকালে কী শুরু করলে ? আমি আমতা আমতা করে বললাম।

: তুমি চুপ করাে। তুমিই ছেলেটাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। রুকু আমার দিকে আগুন-চোখে তাকিয়ে বললাে। আমি দেখলাম ওর মুখ ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। তারপর ও হঠাৎ উঠে গিয়ে মন্টির হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলাে-এ্যাই বাঁদর ছেলে। আমার কথাগুলো ভাল্লাগছে না? ওঠ, মন্টি তাকালো আমার দিকে। চোখে মুখে একটা অস্ফুট আতঙ্ক। আমি বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মাথা নিচু করে ও মৌ-এর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলাে।

: এই তাে ভালাে ছেলে। মৌ তােমার বােন না? আজ ওর জন্মদিন । দ্যাখো তাে, কী সুন্দর লাগছে ওকে।

রুকু খুশী গলায় বললো। আমি মন্টিকে লক্ষ্য করছিলাম। খালি প্লেটের সামনে মাথা নামিয়ে বসে আছে। হঠাৎ মৌ ওর ডান হাতটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগলো। দেখলে কেমন লক্ষ্মী মেয়ে। ওর সঙ্গে ঝগড়া করতে আছে ?—রুকুর কথা শেষ হলাে না। মন্টি এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাঁ হাত নিয়ে ঘষতে লাগলাে মৌ-এর চুমু খাওয়া জায়গাটা।

: তবে রে শয়তান ! এ্যাতদুর বেড়েছিস? ওঠ, তুই। তাের টেবিলে জায়গা নেই। তুই রান্না ঘরে খাবি। রুকু দুমদাম করে মন্টির প্লেট চামচ রান্নাঘরে একটা জল চৌকির সামনে রেখে এলাে।
: সর এখান থেকে। যা বলছি !

দেখলাম একইভাবে মাথা নিচু করে মন্টি রান্না ঘরে গিয়ে বসেছে। রুকু তখনাে ফুসছিলাে। জানি না চোখের ভুল কি-না, আমি যেন দেখলাম, মৌ এর ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি খেলে গেলো। ভয় না গোঁয়াতুমি থেকে মন্টি ও রকম করছে, বুঝতে পারছিলাম। দুপুরেও আমরা সবাই খেতে বসেছি—ও ছাড়া।

হাজার হলেও মা। রুকু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিলাে। আমি দেখলাম, ওর প্লেটে মাখা-ভাত পড়ে আছে। রান্না ঘরের দরজা দিয়ে মন্টিকে দেখা যায় ভেতরে । সে-ও ভাত নিয়ে নাড়া-চাড়া করছে। এক সময় উসখুস করে রুকু উঠে গিয়ে বসলে মন্টির পাশে। মন্টি বাবা, তুমি বড় হয়েছে। না ? তোমার মতাে ছেলেরা এ রকম জেদ করে ? তুমি কতাে ভালাে। সবাই তােমাকে কতাে আদর করে ।

আমার মনে হলো, অনেক হয়েছে। মন্টির চোখ পানিতে টই- টুম্বর। আর কয়েকটা কথার পরই ফেটে পড়বে। হলােও তাই। রুকুকে জড়িয়ে ধরে মন্টি কান্নায় ভেঙে পড়লাে।

: কাদে না সােনা। এসো আমি তােমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। রুকু
ওকে টেবিলে নিয়ে এলাে। ছেলেটা বডড জেদী, এই যা। আমি ভাবলাম।

: তুমি কতাে বড় ছেলে। মৌ-এর সঙ্গে তোমার কেন ঝগড়া হয়? ও একটা বাচ্চা মেয়ে। বলাে, আর ঝগড়া করবে না।

রুকু ওর মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললাে। মন্টি মাথা নাড়লাে। আর ঝগড়া করবে না।

: এই তাে ভালাে ছেলে। আজ বিকেলে আমরা সবাই বাগানে খেলবাে। তারপর সন্ধ্যাবেলা মৌ-এর বার্থডে পাটি। তুমি মন খারাপ করে থাকলে সবার মন খারাপ থাকবে।

মা হিসেবে রুকুর তুলনা হয় না। শুধু আদর করে আর কয়েকটা কথা বলে ছেলেটাকে কেমন ঠাণ্ডা করে আনলাে।

আম্মুর হাতে প্রাণভরে খেয়ে মন্টি লাফাতে লাফাতে বাগানের দিকে চলে গেলাে। আজ ওর কবুতরগুলাের খোঁজ নেয়া হয়নি। কামরাঙা গাছের একটা চ্যাপটা ডালে ওগুলাের কাঠের খুপরি। এক বছর আগে আমি নিজের হাতে ওটা বানিয়ে ডালের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছি। সেই থেকে সময় পেলেই মন্টি তরতর করে এ ডাল ও ডাল বেয়ে খুপরিটার কাছে গিয়ে বসে থাকে। ওর খুব প্রিয় জায়গা। সমস্যা হলাে, ওর দেখাদেখি পলিও গাছে ওঠা শিখে গেছে। রুকুর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

আমাদের, বিশেষ করে মৌ-এর ভাগ্য ভালো যে আজ বিকেলে বৃষ্টি হলাে না। কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করা যাবে। বার্থডে’র খাবার দাবার গুছিয়ে রেখে বাগানে এলে রুকু। ওকে ঝলমলে লাগছিলাে। চোখে মুখে খুশীর আভা। আমি ঘাসের ওপর বসে মৌ আর পলির খেলা দেখছিলাম। আজকাল গলাগলি ভাব হয়েছে দুটিতে।

: মন্টিকে দেখছি না যে?

রুকু আমার পাশে দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাে।

: ওই তাে। আমি বললাম।

গাছে বাঁধা কবুতরের খুপরির মাথায় একটা ডালে পা দিয়ে অন্য আরেকটা ডাল ধরার চেষ্টা করছে মন্টি। ওপরে লটপট করছে একটা কাটা ঘুড়ি। সর্বনাশ, পড়ে না যায়। আমি ডাক দেয়ার আগেই রুকু ওর নাম ধরে ডেকে উঠলাে। উচু থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলে মন্টি। তারপর চোখের পলকে বানরের মতাে এ ডালে হাত, ও ডালে পা দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নেমে এলাে।

: তুমি কবুতরের খোপটা এখান থেকে সরাও। আমার ভয় করে। কখন কী এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। আমার হাত ধরে রুকু বললাে। ওর গলায় উদ্বেগ। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই মন্টি লাফাতে লাফাতে আমাদের সামনে এসে দাড়ালাে। ওকে দেখে ছুটে এসেছে পলি আর মৌ।

রুকু ছেলেকে চেপে ধরে ওর ঝাকড়া চুলে হাত বুলাতে বুলােতে তাকালো মেয়েদের দিকে। ছুটোছুটির ফলে মৌ ঘামছিলাে, ওর ফরসা গাল দুটোয় লালচে ছােপ। মাথার মাঝখানে বাধা নীল ফিতাটা আলগা হয়ে গেছে। মন্টিকে ছেড়ে দিয়ে রুকু ওটা শক্ত করে বেঁধে দিলাে। বােধ হয় দুজন ঘাসে গড়াগড়ি করছে। ছেড়া ঘাস, কুটো- কাটা লেগে আছে জামায়। এখন বিনা কারণে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।

: তারপর মন্টি, আজ মৌ-এর বার্থডে। বলতে কী খেলা যায় ?

: আমি তােমার সঙ্গে থাকবো আব্বু।

কাতর দৃষ্টি নিয়ে মন্টি আমার দিকে তাকালাে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ কঠিন হয়ে গেলে রুকুর।

: মন্টি, দুপুরে কী প্রমিজ করেছিলে ?

কিছু না বলে মন্টি মাথা নিচু করে থাকলাে। রুকু আবার না একটা কাণ্ড বাঁধায়। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার জন্য আমি তাকালাম মৌ- এর দিকে—‘মামনি, বলাে তাে কী খেলবে ?

: লুকোচুরি।

মৌ বললাে। সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে পলি লাফিয়ে উঠলাে— হ্যাঁ, হ্যাঁ লুকোচুরি। আব্বু, আম্মু, তোমাদেরও খেলতে হবে। আমি হেসে তাকালাম রুকুর দিকে।

মন্টি আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। মৌ এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলল, ‘মন্টি ভাইয়া, খেলবে না?

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ও শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলাে’ কিছুক্ষণ। তারপর এক দৌড়। দেখলাম, ও ছুটে যাচ্ছে কামরাঙা গাছটার দিকে। হতাশায় ছাই বর্ণ হয়ে এলাে রুকুর মুখ। এই মুহূর্তে মন্টির ওপর রাগ হচ্ছিলাে আমারাে। এমন একটা বিকেল ওর জন্যই বােধহয় মাটি হয়ে গেলো।

: ঠিক আছে, লুকোচুরি।

রুকু হঠাৎ বলে উঠলাে। আমি বুঝতে পারলাম ও খুশী থাকার চেষ্টা করছে—“পলি, তুমিই শুরু করবে। রাজী?

: হ্যাঁ আম্মি। আমি চোখ বন্ধ করে এক থেকে বিশ পর্যন্ত গুনতে থাকবে। তােমরা ততক্ষণে লুকাবে। তারপর তােমাদের একজন একজন করে খুজে বের করব। সবাই রেডি?

: রেডি। আমি বললাম।

: শুরু করলাম কিন্তু।

পলি চোখ বন্ধ করে গুনতে লাগলাে, এক•• দুই-তিন:চার।

লুকোনোর ব্যাপারে মনে হলাে মৌ ওস্তাদ। আমাদের বাগানটার বয়স পঁচিশ-ত্রিশ বছর হবে। এককালে মালী টালী ছিলো। আজকাল যত্ন নেওয়া হয় না। পুরো বাগান জুড়ে তাই জানা-অজানা ফুলের ঝাড়-জঙ্গল। রুকু বারান্দার পাশে একটা মােরগ ঝুটি ফুলের ঝোপের পেছনে চলে গেলাে। আর মৌ অদৃশ্য হয়ে গেলাে চোখের পলকে। আমার পেছনেই ছিলাে মেয়েটা। আমি কোথায় যাই ? ভাবতে ভাবতে চলে এলাম কামরাঙা গাছটার নিচে।

পাতার আড়ালে মন্টিকে দেখা যাচ্ছে। ভাবলেশহীন মুখ। এই ছেলে, নেমে আয়। খুব মজার খেলা হচ্ছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় ডাকলাম। ও মাথা নাড়লাে দুদিকে। তবে থাক ওখানে বসে একা একা। মনে মনে বললাম আমি। মন্টিকে আর দেখা যাচ্ছিলাে না। একটা বড় ডালের আড়ালে চলে গেছে। কী হলো? ছেলেটার ?

: এই যে আব্ব, তুমি এখানে? তুমি মােটেও লুকাওনি। এ রকম হলে খেলবাে না কিন্তু। পলি আমার হাত ধরে ঝাকাতে ঝকাতে বললো।

: বাহ, লুকিয়েছি তো। তুমি খুব চালাক মেয়ে। তাই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বের করে ফেলেছো। চলাে তােমার আম্মুকে খুঁজি। রুকুকে খুজতে হলাে না। পলির হাত ধরে আমাদের আগের জায়গায় আসতে না আসতে ও নিজেই বেরিয়ে এলাে

—“উহ, রাজ্যের পিপড়া। দু’হাতে ও পা থেকে পিপড় সরাচ্ছিলাে।

: দুর, এভাবে খেলা হয় ?

পলি ম্লান মুখে আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে মৌকে খুজতে গেলাে।

: মন্টিকে দেখছে ?

শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে রুকু বললাে।
: হঁ্যা মগডালে বসে আসে।

: তুমি নামতে বললে না?

: বলেছি। ও নামবে না।

: ঠিক আছে, তাহলে আমি যাই। দেখি ও কেমন করে গাছে বসে থাকে।

রুকু পা বাড়াচ্ছিলাে। আমি বাধা দিলাম। তােমার যাওয়ার দরকার নাই। আপনি নেমে আসবে। আমাদের খেলা নষ্ট করতে চাই না।’

পলি আর মৌ ছুটতে ছুটতে এলো আমাদের দিকে।
: আব্বু, এবার তুমি। আমরা লুকাবাে।

মৌ বললল । উত্তেজনায় লাফাচ্ছিলাে পলি। আমি রুকুর দিকে তাকালাম-“আচ্ছা, আমি চোখ বন্ধ করছি। এবার এ•••ক, দুই, তিন, চা••••••মেয়ে দুটো হাসতে হাসতে ছুটে গেলো দুদিকে। রুকুর শব্দ নেই।

চোখ খুললাম। বাগানে আমি একা। গেলাে কোথায় সব ? রুকুকে পাওয়া কঠিন হবে না। যা ভেবেছিলাম তাই। শিউলি গাছ- টার পেছন থেকে ওর ডোরাকাটা শাড়ির পাড় দেখা যাচ্ছিলাে। আমি পা টিপে টিপে গিয়ে পেছন থেকে এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরলাম। ও ছিটকে সামনে চলে এলাে।

: নাহ,, তােমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এটা একটা লুকাবার জায়গা হলাে?

আমি এক টানে ওকে বুকে টেনে নিলাম।

: ঠিকই বলেছে। লুকোচুরির ব্যাপারটা আমার ধাতে নেই। রুকু চাপা গলায় বললাে।

পুরু নরম দুটো স্তন আমার বুকে লেপ্টে আছে। নিঃশ্বাস গরম হয়ে উঠছে।

: আহ, কী করছে। বাচ্চারা আছে না? তােমার কোনাে কাণ্ডজ্ঞান নাই।

নিজেকে অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে নিয়ে রাঙা মুখ করে ও আমার দিকে তাকালাে।

: তুমি খুব সুন্দর, রুকু।

: এখনাে ?

ও হ্যা, সব সময়।

এক পা এগিয়ে ওকে আমি আবার জড়িয়ে ধরলাম। কয়েক সেকেণ্ড মিশে থাকলে আমাদের দু’জোড়া ঠোঁট।

: আব্বু, তুমি আমাকে পাবে না। হঠাৎ পলির গলা শােনা গেলো কোথাও।

ঃ ছাড়াে, এবার যাই। খাবারগুলো আরেকবার দেখতে হবে। সময় হয়ে আসছে।

: সে-কি, এবার তােমার পালা। এটা কিন্তু ঠিক হলাে না। মেয়েরা মাইণ্ড করবে। আমি বললাম।

: তুমি একটু ম্যানেজ কোরো। খাবারের কথা বললে ওরা মাইন্ড করবে না।

রুকু এক দৌড়ে উঠে গেলাে বারান্দায়। মেয়ে দুটোকে বের করা কঠিন হবে।

বােকার মতাে তন্ন তন্ন করে পুরাে বাগানটা আমি খুজলাম। ওরা কোথাও নেই। ঝােপগুলোর কাছে গিয়ে আমি কান খাড়া করি এই বুঝি ভেতর থেকে ভেসে এলাে চাপা হাসির কোনাে শব্দ ? নাহ। আজকাল কার মেয়ে। ওদের সঙ্গে পারা মুশকিল। তাছাড়া এ বাগানে ওরা প্রায় সমস্ত দিন থাকে। এর সবগুলাে কোনা-কানা ওদের চেনা।

মেয়ে দুটোকে খুঁজতে খুঁজতে অজান্তে আমি কামরাঙা গাছটার নিচে এসে দাড়ালাম। কবুতরের খােপের আশপাশে কোনাে ডালে মন্টি নেই। উঁচু ডালগুলোতেও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আমার মনে হলে, গাছের গােড়ার ডান দিকে ঝােপের ভেতর কেউ যেন হাঁপাচ্ছে। নিশ্চয় পলি বা মৌ।

: পেয়েছি। পেয়েছি। এবার যাবে কোথায়? বলতে বলতে আমি ঝোপের ফাঁক ফোকড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। মৌ একা বসে আছে। আমাকে দেখে হাসলাে। কিন্তু ওর মুখ ফ্যাকাশে, চোখে একটা সন্ত্রস্ত ভাব। বেচারী লুকোবার জায়গা খোঁজার জন্য খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে বােধহয়। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম– “কি, আমার চাখকে ফাঁকি দেবে? অতাে সােজা না।

মৌ ঘামছে মনে হলাে। মেয়েটার এনার্জি আছে। হঠাৎ বলে উঠল-পলিকে তুমি পাবে না আব্বু। আমি বের করি ? ও পিছলে কোল থেকে নেমে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালাে।

ও সে তুমিই ভালাে পারবে। দুজনে ফন্দি করেছে। যাও, ওকে খুঁজে নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি আসবে। আমার টায়ার্ড লাগছিলাে ।

প•••লি প….লি.।

দিঘির পার দিয়ে মৌ মালীর ছোট চালা ঘরটার দিকে ছুটে গেলো। বাতাসে ওর চুল উড়ছে। মাথার ফিতাটা নেই।

কামরাঙ গাছটার চারদিকে চোখ বুলাতে বুলােতে আমি এগুচ্ছিলাম। পায়ের হাঁটু পর্যন্ত বাসে ডুবে যাচ্ছে। কতো বছর যে কাটা হয় না, কে জানে। মন্টিকে আর খুজতে হলাে না। গাছের গােড়া থেকে সাত ফুট দুরে, ওর কবুতরের খোপের ঠিক নিচে লম্বা ঘাসের ভেতরে ওকে আমি দেখলাম। শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। আমার সঙ্গে চাতুরি করছে, কাছে গিয়ে আমি ওকে ডাকলাম । উত্তর নেই। জোর করে উল্টে দিতেই মন্টি বিস্ফারিত ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলাে। এ দৃষ্টি জীবিতের নয়। ওর নাকের নিচে কয়েক  ফোটা গরম রক্ত।

আমি চীৎকার করে কাউকে ডাকতে চাইলাম। গলা দিয়ে শব্দ বেরুলাে না। আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসছিলাে।

: মারুফ সাহেব, আমরা এটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছি না। পর পর তিনটা দুর্ঘটনা হয়ে গেলাে আপনার ফ্যামিলিতে। তিনটা আনন্যাচারাল ডেথ। আপনার এই বাড়ি নিয়ে গোলমাল আছে, আমার মনে হয় বাড়ি এবং জমিজমার সঙ্গে এ সবের একটা লিংক আছে। কথাগুলাে বলে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন তরুণ, স্মাট ওসি সাহেব। দুঃসাহসী বলে এলাকায় দারুণ সুনাম আছে।

: বিশ্বাস করুন, ওসব কিছুই না। দুর্ভোগ আমার ভাগ্যে লেখা ছিলাে। তাই হয়েছে।” আমি অনেক চেষ্টা করে বললাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

: টক সেন্স, মিস্টার মারুফ। আপনি শিক্ষিত লােক। নিজের ভালাে মন্দ অন্যদের চেয়ে ভালাে বুঝবেন। আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু কাইণ্ডলি বলেন, কাদের আপনি সন্দেহ করেন। ওসি সাহেব গলায় জোর দিলেন।

: প্লীজ, আমি বল্লাম তাে। সব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমার কপাল। আর আমার কোনাে শত্রুও এভাবে আমার কোনাে ক্ষতি করতে আসবে না।

: আপনি গ্রামের লােকদের চিনেন না মারুফ সাহেব। ভিলেজ পলিটিক্স বােঝেন? অপিনি তার ভিক্টিম। এনিওয়ে, আপনার মানসিক অবস্থা এখন ভালো না। বাসায় গিয়া রেস্ট নেন। তবে পুলিশ প্রটেকশন লাগলে আমাকে জানাবেন।

: থ্যাঙ্কস।

আমি থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিলাে। বাড়িটা আশ্চর্য রকম নির্জন।

মন্টির মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর, বারান্দায় একটা চেয়ারে রুকু বসে আছে। আমার দিকে তাকালাে, চোখের পাতা নড়ল না। মরা মাছের দৃষ্টি। ওর পায়ের কাছে বু’সে খেলছে পলি-মৌ।

: ফুপু আম্মা!

আমি ভাঙা গলায় ডাকলাম। সাড়া নেই। চলে গেল নাকি? যাক। স্টুডিওতে আমার টেবিলে একটা কবুতর বসে আছে। আমাকে চেনে। তাই উড়লো না। ওটাকে ধরে আদর করি, নাম জিজ্ঞেস করি। পাগল হয়ে যাচ্ছি বােধ হয়। আমি মারুফ হায়দার খান, রুকু এবং সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে খেয়ে-পরে বাঁচতে চেয়েছিলাম। সবই কপাল। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ? ঐ তাে মন্টি। কামরাঙা গাছটার ডাল বেয়ে তরতর করে কবুতরের খুপরির কাছে উঠে যাচ্ছে।

আমার চীৎকার শুনে সেদিন বদ্ধ উন্মাদিনীর মতাে ছুটে এসে ছিলাে রুকু, পেছনে ফুপুআম্মা। আমাকে মন্টির পাশে হতবাক বসে থাকতে দেখে ও ঘটনা বুঝে যায়। পরের দৃশ্য আমরা কেবল সিনেমাতেই দেখি। নিষ্প্রাণ মন্টিকে আঁকড়ে ধরে ক্রমাগত ওর বুকে মাথা কুটে যাচ্ছে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক, খিচুনিতে শাড়ি আলগা হয়ে গেছে। এর পরে কী হয়েছে, আমি ঠিক গুছিয়ে মনে করতে পারি না। আমি কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। না, তাহলে কিছুই মনে থাকতাে না। আধাে অন্ধকারের ভেতর আমি দেখতে পাই বারান্দায় এনে শােয়ানাে হয়েছে মন্টির লাশ! প্রচুর চেনা অচেনা মানুষ । রুকু মাত্রাতিরিক্ত আদর করছে পলি ও মৌকে। মেয়ে দুটোর গালে চোখের পানি শুকিয়ে আছে। রুকু কী যেন বিড়বিড় করে বারবার ওদের কাছে টেনে নিয়ে চুমু খাচ্ছিলাে। মৌ-এর হাতে ধরা ওর মাথার ফিতাটা। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতাে রুকুর আচরণ।

মারুফ সাহেব, আপনি শিল্পী মানুষ। তাই বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই আপ- নার চোখে পড়ে না। আপনার তিন তিনটি সন্তান খুন হইয়া গেল, আপনি ইহার অর্থ বুঝিতে পারিতেছেন না ? খুণী আপনার ঘরেই আছে। আপনার স্ত্রী যে পরমা সুন্দরী ইহা কি আপনি জানেন না? আপনি ঢাকায় চলিয়া গেলে আপনার স্ত্রী কি করে, কোথায় যায়, খোঁজ নিয়াছেন কি? আমরা সব জানি। শীঘ্রই মুখ খুলিব।

আপনার কয়েকজন শুভাকাক্ষী”

ভাগ্যিস পিওন চিঠিটা আমার হাতে দিয়েছিলাে। চোখের কাছে নিয়ে দেখলাম, পােস্ট করা হয়েছে ডেমরা থেকে। স্রেফ বুজরুকি। পত্র লেখক সােনার গাঁ বাজারের আশপাশে থাকে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কে হতে পারে। আমার মাথায় বিজলী খেলে যায়। আমরা সােনার গাঁয়ের বাড়িতে ওঠার ক’দিনের মাথায় রুকু টের পেয়েছিলাে স্থানীয় কিছু বাজে লােক ওর পিছু নিয়েছে। একদিন বাজারে রুকুর সঙ্গে ওদের একজনের কথা কাটাকাটিও হয়। রুকু বেপরােয়া মেয়ে এক পর্যায়ে ও হাতে নাকি স্যাণ্ডেলও তুলে নিয়েছিলাে। পরে অবশ্য ঘটনা মিটে যায়। কারণ, রুকু নিজে থানায় গিয়ে ডায়রি করিয়ে আসে।

চিঠিটা ছিড়ে কুটিকুটি করে আমি বাইরে ফেলে দিলাম। সবাই এখন আমাদের এ অবস্থার সুযােগ নেবে। ওসি সাহেব ভুল বলেননি। গ্রামের লােকদের চিনতে আমার বাকি ছিলো।

: ফুপুআম্মা ধামগড় চলে গেলাে।” আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে রুকু বললো। শুয়ে আছে।

: কখন ?

: তুমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পর। ওর দেওর মুন্সি সাহেব এসে নিয়ে গেছে।

আমি কোনাে জবাব খুঁজে পেলাম না। আমাদের এখানে আরাম আয়েশে ছিলাে ফুপুআম্মা। তঁার ভাইপাের বাড়ি। নিজের বাড়ি মনে করেই আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। আমার ছেলেমেয়েরা তাে দাদী বলতে অজ্ঞান। তার প্রাণের টুকরাে ছিলাে ফাহিম, মন্টি। গােলমাল শুরু হয়ে গেলো মৌকে নিয়ে। মেয়েটা তার দু’চোখের বিষ। শেষ দিকে মৌ সম্পর্কে এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলতে শুরু করেন যে, আমার একবার ইচ্ছে হয়েছিলাে তাকে চলে যেতে বলি। তিনি নাকি প্রায়ই দেখেন মৌ মাঝরাতে বিছানায় নেই। ফুপুআম্মা ভুইয়া বাড়ির মেয়ে। ভয়ডর কম।

“হ, তরে কী কইতাছি। আমি নিজের চক্ষে দেখলাম, মাইয়াডা পুস্কুনির ধারে খারাইয়া আছে। ফুট- ফুইট্টা জোছনা। হের পাও-এর কাছে একটা কালা কুত্তা। হ,কুত্তার মতই একটা জন্তু। আমারে বিশ্বাস না করলে মন্টিরে জিগাইয়া দ্যাখ। হে-ও দ্যাখছে।’ কথাগুলাে ফুপুআম্মা বলেছিলাে মৌ-এর বার্থডের আগের দিন দুপুরে। আমি তখনি স্থির করে ফেলেছিলাম, তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

কয়েকটা কাভারের খসড়া করেছি। কী-ড্রইং এর কালার চার্ট-এর ওগুলাে কালই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে বাংলাবাজারে। পনেরাে দিন ধরে ওগুলাে পড়ে আছে।

হুড়মুড় করে স্টুডিওতে ঢুকে রুকু কান্নায় ভেঙে পড়লাে। আমি উঠে ওকে জড়িয়ে ধরি—“কী হয়েছে রুকু ? আবার কী হলাে? এখানে আর আমাদের থাকা হবে না। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে রুকু বললাে।

: থাকা হবে না মানে ?

: লােকজন আমাদের নিয়ে ফিসফাস করছে।

: তুমি কী ভাবে বুঝলে ?

ঃ আমি বাজারে গিয়েছিলাম। তখন আমার মনে হলাে, বাজারে সবাই আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। চারদিকে কেমন একটা গুঞ্জন। ফেরার সময় রাস্তায় দেখা হলাে মিসেস সুজাউদ্দিনের সঙ্গে। মহিলা আমার দিকে এমন চোখ করে তাকালেন যে••মাগাে মা••• রুকু গুমরে গুমরে কাঁদছে। ওকে ক্যাম্প-খাটটায় বসিয়ে দিয়ে আমি বললাম- “রুকু, এসব তোমার মনের ভুল। তোমার মানসিক অবস্থা এখন খারাপ। তাই এরকম মনে হচ্ছে।

: গত দুদিন দুধঅলা আসেনি। ওর ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, আমাদের ও আর দুধ দিতে পারবে না।

: হতে পারে। ওর কোনাে অসুবিধা আছে হয়তাে।

: তুমি কিছু বুঝতে পারছে না গাে। কোনাে অসুবিধা নাই। এরা আমাদের একঘরে করেছে।

: রুকু তোমার মাথার ঠিক নাই। ক’দিন রেস্ট নাও। তুমি নিজের চোখে দেখনি, এলাকার মানুষ আমাদের কেমন সমীহ করে চলে?

: সে আগের ব্যাপার। এখন সবাই আমাদের ঘৃণা করে, ভয় “পায়। ভয় পায়।

রুকু অবার কঁদতে শুরু করলাে। এমন সময় ঝড়ের বেগে ঢুকলে “পলি আর মৌ। দুজনেরই চোখ মুখ বিবর্ণ, ঠোট কঁপছে।

: কী হলাে তােমাদের, মামনিরা? আমি বললাম।

: আমি আর মৌ আন্টিদের বাসায় গিয়েছিলাম। আন্টি আমাদের বকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে আর যেন ওদের বাসায় না যাই।

পলি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলাে বলে রুকুর দিকে অসহায়ের মতাে তাকালাে। রুকুর জ্বলন্ত দৃষ্টি আমার দিকে। আমি সেই মুহুর্তে ঠিক করলাম, কপালে যা থাকুক সোনার গাঁ ছাড়তে হবে। এ সপ্তাহেই।

সােমবার। আমাদের বাধা ছাদা শেষ। রুকু ভোররাত থেকে সব নিজের হাতে করেছে। দেখতে দেখতে এতাে মালপত্র কীভাবে হলাে, ভাবতে অবাক লাগছিলাে। আমার ছবি আঁকার সরঞ্জামও নেহাৎ কম না। একটা বাক্স ভরে গেলাে। শেষ মুহূর্তে আর কিছু রয়ে গেলো কিনা দেখার জন্য খালি বাড়ির সবগুলাে ঘরে উকি দিয়ে দেখলাম। বৈঠকখানার লাগােয়া বাথরুমটায় আমরা কেউ যাই না। কী মনে করে যেন আমি ওটার দরোজা খুললাম। ভ্যাপসা পুতি- গন্ধের একটা ধাক্কা এলাে নাকে। সারা দেয়ালে মাকড়সার জাল, শ্যাওলার ছােপ। আমার চোখ পড়লাে কোনায় । একটা কালচে বস্তু পড়ে আছে। কাছে গিয়ে ঝুঁকে লক্ষ্য করলাম। একটা রুমাল। এক কালে রং বােধহয় শাদা ছিলাে। শরীরের কোনো জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে আসা রক্ত মােছার ফলে প্রায় সবটা ভিজে গেছে। এখন শক্ত, কালাে একটা পুটলি। ফাঁকে ফাঁকে চিকচিক করছে অসংখ্য কঁচের গুড়ো।

: কই তুমি, গাড়ি এসে গেছে।

রুকু খুজতে খুজতে বাথরুমের দরোজায় এসে দাড়ালাে।
: ওখানে কি ?

: না, দেখলাম কিছু রয়ে গেলে কি-না। চলো। একটা মিনি ট্রাকে মালপত্র যাবে। ঠিকানা বলা আছে। পুরানা পল্টন। আমি, রুকু, পলি, মৌ কোস্টারে।

বাড়িটার দিকে আমি বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম। খুব খারাপ লাগছিলো। রুকু মেয়েদের নিয়ে আগে হেঁটে যাচ্ছে। ও একবারও পেছন ফিরলাে না। যেন একটা বদ্ধ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে, এখন এর ত্রিসীমানা থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। কোস্টারে উঠে আমি আরেকবার পেছন ফিরলাম। কিছু পরিচিত লােক জড় হয়ে আমাদের দেখছে। ভিড়ের ভেতর আনসার আলী আমাকে দেখে হাত নাড়লাে। আমি আস্তে করে ডাকলাম, কোলের ওপর মাথা রেখে ও কাঁদছে।

পুরানা পল্টন এলাকার মাঝখানে আমাদের নতুন বাসা। চারতলা বাড়ির টপফ্লোরে আমরা। বাড়িঅলা রিটায়ার্ড পােস্ট মাস্টার। পঁচিশ বছর আগে জায়গাটুকু কিনে রেখেছিলেন। সরকারী লোন নিয়ে বাড়ি করেছেন তিন বছর হলাে। ছেলে-মেয়েরা প্রায় সবাই দেশের বাইরে। তিনি অবশ্য থাকেন শান্তি নগরে ভাড়া বাসায়। মাসে একবার ভাড়া নেয়ার জন্য আসেন। প্রথম দেখাতেই আমার ভদ্রলোককে ভালাে লেগে গিয়েছিলাে।

আমাদের চার সদস্যের তুলনায় ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। দুটো বড় বেড, আলাদা ড্রইং, কিচেনের পাশে ডাইনিং স্পেস, একটা গেস্ট রুম। বাথরুম দুটো। সােনার গায়ে নিজেদের বাড়ির মতাে খােলা মেলা জায়গা না পেলেও, পলি এবং মৌ মােটামুটি এখানে খেলে বেড়াতে পারবে। সামনে পেছনে দুটো বারান্দা।

অনেকদিন পর তার প্রিয় ঢাকায় ফিরে আসতে পেরে রুকু বেজায় মুডে আছে। আমি দেখলাম তার মুখের ওপর থেকে বিষাদের কালাে ছায়াটা কেটে যাচ্ছে, কপালের তিক্ত-বিরক্ত ভাঁজগুলোও নেই। আমারও নিজেকে হালকা লাগছিলাে। পলি এবং মৌ রুকুর চেয়ে খুশী। মৌকে দেখে মনে হচ্ছিলাে এ বাড়িতে ও যেন কতদিন আছে।

প্রথম দিন বিকেলেই আমার আগের অফিসে দেখা করে এলাম। এমডি সাহেব আমাকে দেখে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন।

ঃ মারুফ সাহেব, আপনি আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে গেছেন। আপনিও গেলেন, আমাদের ব্যবসাও শেষ। পাচটা বড় ক্লায়েন্টের জায়গায় এখন একটাকে কোনাে মতে হাতে পায়ে ধরে রেখেছি। কম্পিটিশনের যুগ। আমাদের এই বিলডিং-এই আরো দুটো ফার্ম বসেছে, গত এক বছরে। বলেন কোথায় যাই। তবে আপনাকে পেয়েছি, আমার আর চিন্তা নাই। সব ক্লায়েন্ট শুধু আপনার খোঁজ করে। আপনার ভিস্যুয়ালের ফর্মই নাকি আলাদা। তো, কাল থেকে আসছেন তাে?

আমি মাথা নাড়লাম। আমাকে আসতেই হবে। মতিঝিল থেকে ফেরার পথে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এলাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কৃবি শফিক ইমতিয়াজ তাে আমাকে দেখে আঁৎকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাে—একি চেহারা হয়েছে ? অসুখ করেছিলাে?

আমি সব চেপে গেলাম। দৈনিক কাগজের এসিসটেন্ট এডিটর। কাজ শেষ । ও বাসায় আসতে চাইলাে। ওর খুব ভক্ত ছিলো ফাহিম।

: দোস্ত, আজ থাক। আরেকদিন। বাসাটা গুছিয়ে নিয়ে এক- দিন সবাইকে ডাকবো।

ফিরতে ফিরতে রাত আটটা হয়ে গেলো। অাজ বাসায় রান্না হবে। হােটেল থেকে কিছু খাবার কিনে নিয়েছি। কলিং বেল টিপতে রুকু দরজা খুললাে। ওকে চেনাই যায় না। খুশিতে ঝলমল করছে।

: শােনাে, ঢাকায় কিন্তু আমি টিভি ছাড়া থাকতে পারবাে না। মাস দুয়েকের ভেতর যে করে হােক একটা টিভি কিনতে হবে। এখানে সবার টিভি আছে।

: অবশ্যই। আগামী মাসেই পাবে। অফিস থেকে লােন নেবাে প্রয়োজন হলে। আমি বললাম। রুকু আলতাে করে আমার কানে একটা চুমু খেলাে।

ওর হাতে খাবারের প্যাকেট গুলো দিয়ে আমি ডাকলাম—পলি: মৌ— ।

দু’জন ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আমার দু’হাত ধরে ঝুলে পড়লাে। সারাদিন বেশ ধকল গেছে। আমার ঘুম পাচ্ছিলো। খেয়ে দেয়ে বাচ্চারা শুয়ে পড়েছে এক ঘণ্টা হলো। নতুন বেডরুমে শুয়ে ঘুম-চোখে আমি রুকুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ও এলেই বাতি নিভিয়ে দেবাে। ও আসছে না। অগত্যা শােয়া থেকে উঠে আমি রুকুর নিপুণ হাতে সাজানাে ঘরটা দেখতে থাকি।

রুকু ঘরে ঢুকলাে।
: কী হলাে, এতােক্ষণ কী করছে?

আমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ও সেটা লক্ষ্য না করে বললো—‘বাহ, নতুন বাসা। মাল পত্র সব এলােমেলাে হয়ে  পড়ে আছে। গােছাতে হবে না ?

: তাই বলে রাত বারোটার সময়? সমস্ত দিন পড়ে আছে। এসাে, আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না। রুকু দরােজার কাছে দাড়িয়ে উসখুস করছে।

: ব্যাপার কি রুকু ? শােবে না? আমি বললাম।

: দ্যাখো, নতুন বাসায় বাচ্চারা একা একটা ঘরে কী ভাবে থাকবে। আমি ভাবছিলাম, আজকের রাতটা আমি ওদের সঙ্গে থাকি। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মন খারাপ করােনা, প্লীজ! মাত্র একটা রাত।

: ঠিক আছে যাও…

আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলাে না। ধ্যাৎ! ঘুমের চৌদ্দটা বেজে গেছে।

মাত্র একটা রাত। সেই একটা রাত আর শেষ হলো না। মাসের পর মাস আমি বিশাল খাটের এক কোণায় ঘুমােতে থাকলাম, একা। পলি এবং মৌকে নিয়ে রুকু অন্য বেডরুমে। আজ এ নিয়ে ও কিছু বলেও না। যেন এটাই নিয়ম, স্বাভাবিক। প্রায় রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় একা একা পায়চারি করি। ইচ্ছে করে রুকুকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসি আমার ঘরে। এভাবে আর কতদিন? সকালে নাশতার টেবিলে আমার মুখ ভার দেখে রুকু এটা সেটা মজার কথা বলে পরিবেশ সহজ করার চেষ্টা করে। এক সময় হার মানি আমিও। ঠিক আছে আর কটা দিন। কিন্তু রাতে শোবার সময় খালি বিছানাটা দেখা মাত্র আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। মনে মনে ভাবি, অনেক হয়েছে। কালই একটা দফারফা করতে হবে।

নতুন বাসাটা পলি এবং মৌ পছন্দ করেছে। ওদের নিয়ে আশঙ্কা ছিলাে। হয়তাে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে সহজে। আমার ধারণা ভুল। মৌ এমনিতে চটপটে, মানুষের সঙ্গে রাতারাতি আলাপ জমাতে ওর জুড়ি নেই। এরি মধ্যে তিন- তলায় ওর যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। রুকুর মুখে শুনেছি ও বাসার কর্তা সিনেমা পরিচালক। নাম অজয় সেন। এখানে আসার পর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তাঁর স্ত্রী শুক্লা নাকি এসেছিলো কয়েক বার আমাদের বাসায়। মৌকে তার খুব পছন্দ হয়েছে—মহিলার তিনটে ছেলে, বড়টার বয়স ছয়।

পলি কিছুটা ঘর কুনাে স্বভাবের মেয়ে। সেগুন বাগিচায় এক কিণ্ডার গার্টেনে ভর্তি হয়েছে। অফিসে যাওয়ার সময় আমি ওকে স্কুলে রেখে যাই, দুপুরে রুকু নিয়ে আসে। আজকাল ওকে ছবি আঁকা পেয়ে বসেছে। স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে রং তুলি নিয়ে বসে যায়। খেয়াল করে দেখলাম, আঁকার হাত চমৎকার। গত কয়েক মাসে গােটা বিশেক ছবি ওর আঁকা হয়ে গেছে। ওদের শােবার ঘরের দেয়ালগুলােতে আঠা দিয়ে ওগুলাে সেটে দেয়ার ফলে ঘরটাকে একটা ছােট খাটো গ্যালারী মনে হয়। ফাঁকে ফাঁকে মৌ-এর ছবিও আছে। দেখলাম এই মেয়েটার লাল এবং কালো রং-এর প্রতি খুব আগ্রহ আর রেখাগুলােও জটিল; পলির সহজ খােলামেলা ব্যাপারটা নেই। বাচ্চাদের মন!

ঢাকায় বহুদিন পর আমাদের প্রথম ঈদ। সারাটা দিন হৈ চৈ করে গেলাে। রুকুর সঙ্গে ওর শহরের বাসার যােগাযােগ নেই সেই বিয়ের পর থেকে। ও সেখানে যায় না। ওরাও খোজ খবর নেয় না। আমি অবশ্য জানতাম, ওর বাবা মা কেউ  ঢাকায় নেই। গ্রীনরােডের বাসাটা বেচে দিয়ে বুড়ােবুড়ি চলে গেছে খুলনা-রুকুদের পৈতৃক বাড়ি। দুইভাইয়ের একজন চাটগাঁয়ে, একজন লিবিয়ায়। আমার আত্মীয়-স্বজন  তেমন কেউ নেই ঢাকায়। ঈদের আনন্দ আমাদের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রলো। রুকুর পরনে একটা নতুন জামদানী, অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলাে। মেয়ে দুটো যা চেয়েছে, তাই দিয়েছি। সেজেগুজে ওরা প্রায় সমস্ত দিন ওপর নিচ করেছে। মাঝখানে এসেছিলেন শুক্লা বৌদি তার ছেলেদের নিয়ে। উচ্চশিক্ষিত মহিলা, কোনাে গোঁড়ামী নেই। কথায় কথায় দুঃখ করে বললেন ; স্বামীর পেশা তার একদম ভালাে
লাগে না। ঈদের ছুটিতেও নাকি তাকে শুটিং করতে হচ্ছে সাভারে। আমার ফিরতে ফিরতে রাত বারােটা বেজে গেলাে। অনেকদিন পর আজ সন্ধ্যায় শফিকের পীড়াপীড়িতে গিয়েছিলাম একটা পুরনাে বারে কয়েক বছর একটানা গ্যাপ দিয়ে খাওয়ার ফলে, তিনটা রামেই ধরে গিয়েছিলো। জিন, হুইস্কি নেই। ঈদের দিন, থাকার কথাও নয়। শফিক অারেকটা রামে’র অর্ডার দিয়েছিলো। আমি মানা করি। হ্যাঙওভারকে আমার দারুণ ভয়। তাছাড়া কালও ছুটি আছে। দুটো কভারের কাজ সারতে হবে।

দরােজা খুলে রুকু নাক কুচকালাে, কীসের গন্ধ পাচ্ছি যেন? ও একটা আকাশী-নীল শাড়ি পরে আছে।

: এক যুগ পর খেলাম। তা-ও কয়েক ঢােক মাত্র।

: না, বাবা তােমাকে বিশ্বাস নাই। কয়েক ঢােক খেতে খেতে শেষে ঘরে বােতল আনা শুরু করবে। আমার এসব ভাল্লাগে না। কী যে মজা আছে এর মধ্যে তুমিই জানাে•••রুকু চলে যাচ্ছিলাে ডাইনিং স্পেসের দিকে। থাক, বাঁচা গেলাে। মুডেই আছে। আমি প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছিলাে। পলি, মৌ-এর কোনাে সাড়াশব্দ নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তাে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরেই সােফার কাছে নিয়ে এলাম। রুকু গরম হয়ে উঠেছিলাে, উত্তেজনায় কাঁপছে আমার শরীরের নিচে।

আহ, কততদিন পর! চুমু খেতে খেতে রুকু আমার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলাে জোরে। আমি আর পারলাম না, ব্লাউজের বোতাম- গুলো পটপট খুলে ফেলে ব্রা-এ হাত দিলাম।

: আরে, পাগল হয়ে গেলে নাকি ?

ফিসফিস করে বললো রুকু। তারপর জোরে আমাকে দুহাতে সরিয়ে সােফা থেকে ছিটকে উঠে দাড়ালাে। আমি শুয়ে হাপাতে লাগলাম। ব্লাউজের বোতাম লাগিয়ে শাড়িটা টেনেটুনে ঠিক করতে করতে আমার দিকে ও একটা অর্থপুর্ণ লুক দিলো।

: আজ হবে তাে ? আমি বললাম।

রুকু ভেতরে যেতে যেতে আমার দিকে আরেকবার তাকালাে। শুয়ে ছটফট করছিলাম। দুটো বেজে গেছে অনেকক্ষণ হলো। রুকু অন্যান্যদিনের মতাে বাচ্চাদের ঘরে শুতে গেছে। কিন্তু আজ আসবে। ওকে অাসতেই হবে।

দরােজা ভেজিয়ে রেখেছিলাম। শব্দ হলাে। ডিম লাইটের আলোতে দেখি রুকু পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকছে। ওর হাতে ধরা একটা বালিশ। আমার সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছে। আজ অনেকদিন পর রুকু আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লাে। কেউ কথা বললাম না। ওর মুখ খানি দু’হাতের তালুর মাঝখানে ধরে আমি ঠোট চেপে ধরি ওর উত্তপ্ত, ভেজা ঠোঁটের সঙ্গে। রুকুর নিঃশ্বাস ভারি, ঘন ঘন পড়ছে।

এমন সময় সমস্ত বাড়ি কাপিয়ে মৌ-এর গলা ফাটানাে চীৎকার। রুকু আমাকে আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে কান খাড়া করে রইলাে। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে।

রুকু উঠে বসে চুল বাঁধতে বঁধতে বললে, ‘আজ থাক। মেয়েটা বোধহয় খারাপ কোনাে স্বপ্ন দেখেছে। আমি জবাব দিলাম না। দুঃখে-হতাশায় শরীর কামড়াচ্ছিলো। দেখলাম, রুকু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাে।

পরের রাতে সেই একই কাণ্ড। পরদিনও। এর পরদিনও। আমরা শুরু করার ঠিক ঐ মুহুর্তে মৌ-এর চীৎকার। আর রুকু ওর কাছে যাওয়া মাত্র কান্না শেষ। টু শব্দটি নেই এরকম চললো দিনের পর দিন।

অফিসে আমার মন বসছে না। অথচ টেবিলে কাজের স্তুপ। একটা নতুন সিগারেট বেরুচ্ছে, তার নিউজ পেপার ডিসপ্লে, টিভিতে হিমানী ফ্যানের বিজ্ঞাপনের টেলপ, সাপ্লিমেন্টের মাস্টহেড-••আরাে অজস্র টুকিটাকি কাজ। সিগারেটের কাজটা দুদিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। চমৎকার মডেল পাওয়া গেছে। ক্লায়েন্ট খুব খুশি। এমডি সাহেব দিনে কমপক্ষে পাঁচবার আমাকে দেখে যাচ্ছেন। তার কপালে ভাঁজ।

: মারুফ সাহেব, আপনার ওপর খুব চাপ যাচ্ছে, বুঝতে পারছি। কোনাে রকমে সিগারেটের লে-আউটটা বের করে দেন। বাকিগুলি দেখা যাবে।

তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারেন না। এসব ক্লায়েন্ট আমার নাম শুনে এসেছে। আমি জানি, কাজের চাপ কথাটা বোগাস। এর চেয়ে অনেক বেশি কাজ আমি করেছি, একা। আমাকে ভেতর থেকে কুরে খাচ্ছে মৌ। বুঝতে পারছিলাম না, এভাবে কতােদিন চলবে। আমার চোখের নিচে কালি, কপালের শিরা দুটো ফুলে আছে। আজকাল মৌ এর কান্না শােনার ভয়ে রুকু আর আমার ঘরে আসে না। সেদিন ইচ্ছে করেই বেশ রাতে ফিরলাম বাসায়। গােল্ডেন গেটে গিয়েছিলাম। সঙ্গে টাকা ছিলাে অনেক। হুইস্কির ওপর বড় কয়েকটা নােট বেরিয়ে গেলাে। শফিক আমার একটার পর একটা অডার দেয়া দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাে। ও জানতো আমি সাধারণত চারটার বেশি খাই না।

: আমি বড় কষ্টে আছি, শফিক। আমার কথা করুণ শােনাচ্ছিলাে নিজের কানেই। টেবিলে খাবার রাখা ছিলো। খেয়েদেয়ে শুতে গেলাম। বেশ ধরেছে। এ সময় রুকু পাশে নেই। আমি একটা দুর্ভাগা। অফিসের রিসিপশনিস্ট মেয়েটা তুখোড়। শুনেছি, ও খুব লিবারাল। আমার ওপর অনেক দিন থেকে ওর চোখ । আমি একবার মুখ খুললেই হলাে।

রুকুকে বিয়ে করার পর থেকে অন্য কোনো মেয়ের দিকে ভিন্ন চোখে আমি তাকাইনি পর্যন্ত। কিন্তু ও-ই আমাকে বাধ্য করছে। অনীতা গােমেজকে কালই বলতে হবে।

দরােজায় শব্দ হলো। আমি তড়াক করে উঠে বসলাম। রুকু ভেতরে ঢুকলো, কোলে মৌ। ওর কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। রাগে আমার হাত পা নিশপিশ করে উঠলাে।

: তুমি কিছু মনে কোর না। ও আমাদের সঙ্গে থাক। কাল পলির পরীক্ষা। ওর ভালাে ঘুম দরকার। রুকু ফিসফিস করে বললাে।

: তাহলে তুমি ওদের সঙ্গে ঘুমাও। এলে কেন? আমি চিবিয়ে চবিয়ে বলি। রুকু চুপ করে থাকলে। এ আবার কোন খেলা। মৌকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ঘুমের ঘােরেই গড়াতে গড়াতে চলে এলাে আমার পাশে। আমি খাটের এক ধারে শুয়েছিলাম। ধারণা ছিলাে মেয়েটা খাটের আরেক পাশে শােবে, রুকু, আমার সঙ্গে। সব ভেস্তে গেলাে। এখন আমার আর রুকুর মাঝ খানে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মৌ।

আধ ঘণ্টা কেটে গেলো। রুকুর চুড়ির আওয়াজ, এ পাশ ও পাশ করার শব্দ পাচ্ছি।

: রুকু, ঘুমিয়ে পড়েছাে?

আমি গলা খাটো করে ডাকলাম। রুকু উত্তর না দিয়ে চুড়ির শব্দ করলাে। আমি খাট থেকে নেমে মাথার কাছ দিয়ে ঘুরে চলে এলাম রুকুর পাশে।

পনেরাে মিনিট পর। রুকু আগুন হয়ে উঠেছে। আমি দর দর করে ঘামছিলাম –রুকু-রুকু••রুকু:”রুকু। আমার তখন হিতা- হিত জ্ঞান নেই। রুকু এক হাতে খামচে ধরেছে আমার খোলা পিঠ। অস্ফুট বিলাপের শব্দ করছে মুখ দিয়ে। আমার মাথার ভেতর ঘন ঘন বিজলী চমকাচ্ছিলো। এমন সময় ।

‘আব্বু, আম্মু ! তােমরা কী করছে।

বিছানায় দাড়িয়ে মৌ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমার দু’হাতের ভেতর কেঁপে উঠলাে রুকু। একদম শক্ত হয়ে গেছে।

: কিছু না মা।

ও কাপড় ঠিক করে উঠে বসলো—তুমি ঘুমাও। আমি চোরের মতো ঢুকে গেলাম বাথরুমে। ফিরে এসে দেখি মৌ অঘােরে ঘুমাচ্ছে। একটু আগে জেগে ওঠার লেশ মাত্র নেই মুখে। এটা কী হলো? আমি মনে মনে বললাম। মাথা ঝিম ঝিম করছে।

: ও কিছু বুঝতে পারেনি। বাচ্চা মেয়ে। তুমি রাগ করেছে ? রুকু চাপা গলায় খাটের ওপাশ থেকে বললো।

: প্রথম প্রথম বাহানা ছিলো তোমার। বাচ্চারা একলা শুতে ভয় পাবে। আর এখন এ মেয়েটার ঝামেলা। বলি, এসব কী আরম্ভ হয়েছে, রুকু । গলা যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রেখে আমি উত্তর দিলাম।

: প্লীজ তুমি রাগ কো’রনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ক’টা
দিন।

: হঁ্যা, আর ক’টা দিন। আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম।

সকালে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। উঠি উঠি করে সাড়ে নটা বেজে গেলাে আজ নটার মধ্যে অফিসে যাওয়ার কথা। একজন বিদেশী ক্লায়েন্ট আসবে। ভাগ্যিস, পলির স্কুল আজ বন্ধ।

তাড়াহুড়াে করে রেডি হয়ে সিড়ির মুখে এসেছি, ফোনের শব্দ পেলাম। বাসায় ফোন লেগেছে দিন দশেক হলাে।
: আব্বু, তােমার ফোন।

ছুটতে ছুটতে দরাজার কাছে এসে দাড়ালাে পলি।
: হ্যালাে !

: হ্যালাে, আমার নাম ইমাজ উদ্দিন পাটোয়ারি। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার সামনের বাড়িতে চার তলায় থাকি। কিন্তু আপনাকে আমি চিনি।

: ও আচ্ছ। খুব ভালাে কথা। বলেন, কী ব্যাপার ?

সাত সকালে অফিস যাওয়ার সময় খেজুরে আলাপ ভালাে লাগছিলাে না।

‘: ইয়ে মারুফ সাহেব, আমার একটা মাদী কুকুর আছে। দেশী, কিন্তু খুব তেজী।

কুকুর আছে ? আমাকে কেন বলছেন?

: বলছি মানে, এই জন্য যে আপনার এলিসিসিয়ানটা দারুণ।

: কী মাথা খারাপের কথা বলেন ভাই! আমার এ্যালসিসিয়ান?

আমি জীবনে কুকুর বিড়াল পালি নাই। মনে হচ্ছিলাে ফোন রেখে “দিই। কোথাকার পাগল।

: আরে ভাই, এ্যাভয়েড করতেছেন কেন? আপনার কালো ‘কুকুরটাকে আমি, কালকেও অাপনাদের ছাদে দেখেছি। এই ধরেন সন্ধ্যার আগে অাগে।

: হ্যালাে, আপনি কে আমি জানি না। তবে বিশ্বাস করেন আমার বাসায় কোনো কুকুর নাই। আপনি ভুল দেখেছেন। অামার গলার স্বর অজান্তে চড়ে যাচ্ছিলাে।

: ভুল দেখি নাই। হলুদ ফ্রক পরা মেয়েটা আপনার ?

কুকুরটার সঙ্গে কয়েকদিন থেকে ওকেই তাে দেখি। নাহ, আমার বয়স হলেও চোখ ঠিক আছে।

ওপাশের গলা ধীর স্থির। আমার বুকের একদিক চিন চিন করে উঠলাে। হলুদ ফ্রক, তার মানে মৌ। গত ঈদে আমি নিজের হাতে  কিনেছি।

: তাে, আমি কি করতে পারি ?

যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। দেখি ভদ্রলােকের মতলবটা কী।

: আপনার এ্যালসিসিয়ানটাকে আমি একটু ধার চাই। আমার মাদীটার সঙ্গে মেটিং করবাে। কী, দিবেন তাে?

: আচ্ছা ভাই, পরে কথা হবে। আমার অফিস আছে।

আমি রিসিভার রেখে দিলাম। রুকু ফোনে আমাকে কথা বলতে দেখে পেছনে এসে দাড়িয়েছিলো

: রুকু, তুমি এ বাড়ির ছাদে ওঠো নাকি?

: ছাদে? হ্যাঁ, অনেকদিন আগে একবার। তাও বহু কষ্টে। সিড়ি নাই। কাঠের মই বেয়ে উঠতে হয়। আমি কাপড় চোপড় বারান্দায় শুকাই। সবাই তাই করে। কী হয়েছে ?

: চলাে তাে, মইটা দেখি।

রুকু অবাক চোখে আমার দিকে তাকালাে।

আমাদের সিড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, তার ডান দিকে একটা বাঁক নিয়ে সামান্য একটু জায়গা। মাথায় দুই বর্গফুটের মতাে চৌকোনা স্পেস থেকে নেমে এসেছে একটা অসম্ভব খাড়া মই। বেশ

চওড়া, আর ধাপগুলাের মাঝখানে বড় বড় ফাঁক। আমি ঢোক গিললাম।

: পলি বা মৌ ছাদে ওঠে ?

তােমার মাথা খারাপ হয়েছে। এই মই বেয়ে ওরা উঠতে পারবে? রুকু চোখ বড় বড় করে বললাে।

আমার বমি বমি লাগছে। কুকুর! ছাদ ! মৌ! সবকিছু গুলিয়ে উঠছে।

অফিসে পৌছতে পৌছতে পৌনে এগারােটা বেজে গেলো আমাকে দেখে এমডি সাহেব ছুটে এলেন তার রুমের দরোজা থেকে

: এনিথিং রং, মারুফ সাহেব ?

আমি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললাম, না লেট হয়ে গেলো, সরি। সবাই এসে গেছে ?

: আরে, চলেন, চলেন ভিতরে। সাহেবের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে আমার জান খারাপ হয়ে গেছে।

ঢাকায় আসার পর রুকুর পরিবর্তনের কথা ভেবে আজকাল আমি অবাক হই। আর দশটা মায়ের মতাে ওর স্বাভাবিক আচরণ। শুধু মাত্র রাতের বেলা মৌ-এর কেঁদে ওঠার ঘটনা ছাড়া, আমাদের জীবন সহজ নিস্তরঙ্গভাবে চলে যাচ্ছিলাে। রুকুর চোখে মুখে গভীর শান্তি আর পরিতৃপ্তির ছাপ। পেটের সন্তান ফাহিম, মন্টি, অপুর কথা কি ও ভুলে গেছে এই দু’বছরে ? কই, আমি তাে পারিনি।

হয়তো রুকুকে আমার এখনাে চিনতে বাকি আছে। ওর এই স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক ভঙ্গী একটা মুখোশও হতে পারে। ভেতরে ভেতরে হয়তাে ও কঁাদে, কষ্ট পায়। অতীতের প্রসঙ্গ টেনে এনে ও বােধহয় আমাদের বর্তমান জীবনে ছন্দপতন ঘটাতে চায় না। ওর সমস্ত স্বপ্ন এখন পলি এবং মৌকে ঘিরে। মাঝে মধ্যে মন্টি বা ফাহিমের নাম “আমার মুখে চলে আসে, আমি অনেক কষ্টে চেপে যাই। রুকুর চেনা এক টিভি-প্রডিউসার এসে গেছে ক’দিন আগে।

ভদ্রলােকের সনির্বন্ধ রিকোয়েস্ট, রুকুকে আবার টিভিতে গাইতে হবে। ও প্রথম প্রথম এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাে, পরে রাজী হয়েছে আমার কথায়। আমি ভাবলাম-ভালােই হলাে, ঘর-সংসারের ফাঁকে বাকি অবসরটায় রুকু এখন গান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারবে। হারমােনিয়াম- ‘টার ওপর ধুলো পড়েছিলাে। আমি এক ছুটির দিন ওটা সাফসুতরাে করে দিলাম।

রুকু আজকাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিয়মিত রেওয়াজ করে।কী একটা পর্বে যেন অফিস বন্ধ ছিলাে সেদিন। আমি সকালে  কোথাও যাইনি। অনেকগুলাে দেশী বিদেশী পত্রিকা জমে আছে। সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে একটা বেজে গেলো। রুকু খেতে ডাকছে। কাগজগুলাে শেলফে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ আমার চোখ পড়লাে আমাদের ফ্যামিলি এ্যালবামটার ওপর। অনেক দিন  আমরা ওটায় হাত দিইনি। এক পাশে অযত্নে পড়ে ছিলাে। আমি পাতা উল্টাতে লাগলাম। ফহিম, মন্টি বা অপুর কোনাে ছবিই নেই। মাঝে মাঝে পাতা ছেড়া। মনে হচ্ছিলো কেউ পাতাগুলাে আস্ত টেনে তুলে নিয়েছে। এমন কি গ্রুপ ছবিগুলোতেও ফাহিম, মন্টি এবং অপর জায়গাগুলাে: তেল পোকায় খাওয়া। আমার সন্দেহ হলাে। চোখের কাছে নিয়ে দেখলাম, তিনজনের ছবি নখ দিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। পুরাে এ্যালবামে এদের কোনাে চিহ্ন নেই।

: আব্বু, জলদি এসাে। সবাই তোমার জন্য বসে আছে। দরোজায় দাড়িয়ে মৌ ডাকছে আমাকে। আমি চমকে ওর দিকে ঘুরে তাকালাম। হুঁ, মামনি আসছি।

চোখের ভুল কি-না জানি না; মনে হলাে আমার হাতে এ্যালবামটার ওপর চোখ পড়া মাত্র এক পলকের জন্য শক্ত হয়ে গেলাে মেয়েটার মুখ। পরক্ষণেই স্বাভাবিক। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এ্যালবামটা বই পত্রের নিচে সযত্নে রেখে আমি বেরিয়ে এলাম। পা টলছিলাে। রুকুকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। পরে এর একটা রফা করতে হবে।

: কী হলো, আজ এতো জলদি যে ?

রুকু কার্পেটের ওপর হারমােনিয়াম নিয়ে বসে ছিলাে। সামনে খােলা গীতবিতান। এ সময়ে আমি সাধারণত বাড়ি ফিরি না।

: সন্ধ্যার পর একটু বেরুতে হবে। অফিসের একটা পার্টি অাছে। মেয়েরা কোথায়? আমি সােফায় গা এলিয়ে দিলাম।

: পলি ঘরেই আছে। মৌ শুক্লা বৌদি’দের বাসায়। রুকু হাত বােলাতে লাগলাে রীডে। এখন কথা বলতে চায় না হয়তাে। কিন্তু একটু পর ও নিজেই বললাে, ‘মৌ বড় দুষ্টমি করে রেওয়াজের সময়। কদিন থেকে দুপুরের পর বৌদি’ই এসে ওকে নিয়ে যায়। রুকু চুপ করে রইলাে কিছুক্ষণ। আনমনে গীতবিতানের পাতা উল্টাচ্ছে। ওর ব্যবহার আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।

: রুকু, ব্যাপার কী বলাে তাে?

আমি উঠে বসলাম। ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাে।

: মৌ-এর মামস হয়েছে।

: মামস! সর্বনাশ! কখন থেকে?

আমি সােফা থেকে নিচে নেমে এলাম রুকুর পাশে।

: ওর কোনো দোষ নেই। শুক্লা বৌদির বড় ছেলেটার আগে হয়েছিলাে। খুব সম্ভব ওই ছড়িয়েছে।

: তাহলে এখন কী হবে? রুকু তুমি জান না, মামস সাংঘাতিক ইনফেকশাস অসুখ ?

: জানি। বৌদিও ফোনে মাফ চেয়েছেন। বলছেন, সব তার দোষ। সেরে না ওঠা পর্যন্ত মৌকে উনি তার কাছেই রাখবেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবু একটা অদৃশ্য কাঁটা খচখচ করতে লাগলাে মনে। এ অসুখ হঠাৎ করে একদিন বােঝা যায়, তার আগে ভেতরে চাপা থাকে অনেক দিন। মৌ  রোগটা বাঁধিয়েছে কদিন আগে কে জানে? সে রাতের বিশ্রী ঘটনার পর থেকে মৌকে আমাদের বিছানায় আর আনি নি। মাঝ রাতে কান্নার শব্দ পেলে রুকুই উঠে
যায়।

আমার খুব চিন্তা হচ্ছিলাে পলিকে নিয়ে। এটা বাচ্চাদের রােগ। বয়স্কদের হয় না সাধারণত। হলে ভুগতে হয়।

: কোথায় যাচ্ছে? রুকু, উঠে দরােজার দিকে যাচ্ছিলাে।

: যাই, মৌকে দেখে আসি । মেয়েটায় জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।

যেন হঠাৎ করে ওর মৌ-এর কথা মনে হলাে। সিড়ির কাছে চলে গেছে, আমি পেছন থেকে বললাম, ওর খুব কাছে যেওনা রুকু। অসুখটা কিন্তু ভালাে নয়।

সন্ধ্যার আগে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হওয়া যাবে। একটা বড় হােটেলে পার্টি। তার আগে পলিকে একবার দেখা দরকার। ওদের শােবার ঘরে মেয়েটা ফ্লোরে দু’হাটু মুড়ে বসে আপন মনে একটা ছবি আঁকছিলাে। আমি নিঃশব্দে ঢুকে দাড়িয়ে থাকি।

আমার এ মেয়েটা একেবারে অন্য রকম। কম কথা বলে, হৈ-হল্লায় বড় একটা নেই। স্বভাব পেয়েছে কিছুটা ফাহিমের। ছবি আঁকার সময় খাওয়া দাওয়া ভুলে যায়। লেগে থাকলে ওকে আমি আর্ট কলেজে পড়াবাে। এখন ওর বয়স ন’বছর।

পলির শ্যামপু করা কোঁকড়ানো, ফাঁপা চুল দু’কঁাধে ছড়িয়ে থাকে। এই মুহূর্তে কাৎ হয়ে বসার ফলে চুলের গােছা সব মুখের এক পাশে চলে এসেছে। ও বারবার হাত দিয়ে সামনের চুল সরিয়ে দিচ্ছিলো। আমি ওর পেছন থেকে উবু হয়ে দেখলাম, কঁাচা হাতে আঁকা এক মহিলার ছবি। মুখের ফ্রেম দেখে মনে হলো রুকুকে আঁকার চেষ্টা করছে। আমার নিশ্বাসের শব্দ শুনে পলি পেছন ফিরে তাকালাে।

: ওহ,, আব্বু!

আমার গালে ও ছােট করে একটু চুমু খেলাে। আমি পাশে বসে পড়লাম।

: কার ছবি আঁকছে, মা!

: আম্মুর ! তােমারও আকবাে।

: বিউটি ফুল।

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপর, মৌ-এর কী হয়েছে জাননা?

: হুঁ। আব্বু, মামস। মাথা না তুলেই পলি বললাে।

: খুব খারাপ অসুখ। এখন ওর কাছে যাবে না। আজ থেকে ও শুক্লা খালা’দের বাসায় থাকবে আমি গম্ভীর হবার চেষ্টা করলাম।

: আমি যাবাে। আমিও শুক্লা খালাদের বাসায় থাকবো। পলি যেন জেদ ধরেছে। এমন সময় রুকু ঘরে ঢুকলাে।

: কেমন দেখলে ।

: ভালো না। ডাক্তার বললাে, ভালাে হতে হতে কম পক্ষে সাতদিন লাগবে। মৌ বারবার তােমার কথা জিজ্ঞেস করছিলাে। রুকুর মুখে বিষন্ন।

: আম্মু, আমি মৌ-এর কাছে যাবাে। আদুরে গলায় বললাে পলি।

: না, মা। ওর খারাপ অসুখ হয়েছে। তুমি কাছে গেলে তোমারও হবে। আমি বললাম।

: বাহ, চমৎকার ছবি হয়েছে। কিন্তু মামনি, আমার নাকটা কি এরকম বোঁচা ? পলির ছবির প্রসঙ্গে চলে গেলাে রুকু। দু’বছর পর সেরাতে আমরা প্রথম বারের মতো পরস্পরকে পেলাম। মৌ-এর কান্না নেই, উটকো ঝামেলা নেই। কিছুক্ষণ জেগে, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত চরম আনন্দের সরোবরে অবগাহন করলাম। এক সময় সম্পূর্ণ বিবস্ত্র রুকু, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাে আমার বুকে। আহ, তৃপ্তি! ঘুমিয়ে তলিয়ে যাবার আগে পরম শক্তিতে উচ্চারণ করলাম আমি।

ঘুম আলগা হতে দেখি রুকু, আমাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। বাইরে আলো ফুটছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। আজ অফিসে যাব না। আমি টের পেলাম রুকু আমাকে আলতাে চুম, খাচ্ছে কপালে, গালে, গলায় । আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলাে। কিন্তু চোখ খুললাম না। মধুর অবসাদে শরীর ভেঙে আসছে। লেপটা মাথা অবধি টেনে দিলাম, রুকু এখনাে আমার পাশে। ওর ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম আমার গালে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু পরের মুহূর্তে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা প্রচণ্ড ঝাকুনি খেলাম। আমি যাকে জড়িয়ে ধরেছি, সে রুকু নয় মৌ !

: রুকু, রুকু।

আমার ভয়ার্ত চীৎকার শুনে ও ছুটে এলাে। গােসল করেছে। বিছানায় চোখ পড়া মাত্র ওর গলা দিয়ে একটা অস্ফুট আর্তনাদ বেরুলল, ‘একি । মৌ’! আমি তখন বিছানায় বসে কঁপছি। মৌ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

: তুমি রাগ কোর না প্লীজ। তােমার টানে থাকতে না পেরে চলে এসেছে। সব দোষ আমারই। হকারকে কাগজের বিল দিয়ে দরােজা খােলা রেখে চলে এসেছিলাম। আর সেই সুযোগে”রুকু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।

: কিন্তু ও এ ঘরে কী ভাবে এলো ? বলেই আমি বুঝতে পারলাম, রুকু তখন ছিলো বাথরুমে। পলি ওর ঘরে, হয়তাে জাগেনি। সেই ফাঁকে।

: দ্যাখে, ও ভয় পেয়ে গেছে। তুমি ওরকম কোরো না। তোমাকে ভালােবাসে বলেই না। আয় মা। রুকু মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো দ্রুত। ঘরটা মনে হলাে, অল্প অল্প দুলছে।

রুকু, মৌকে আবার তিনতলায় দিয়ে এসেছে। নাশতার টেবিলে ও আমাকে বললাে, শুক্লা বৌদি তখন রান্না ঘরে। অজয় বাবু বেরিয়ে গেছেন খুব সকালে। দরজা খােলা ছিলো। মে হয়তাে সেটা লক্ষ্য করেছে।

কিন্তু ওতো বেলা করে ওঠে। আজ এতাে সকালে ওর ঘুম কী ভাবে ভাঙলে? বিরক্তি না রাগ থেকে কথাগুলাে আমি বললাম, জানি না।

বেচারা হয়তাে কষ্ট পাচ্ছিলাে। তাই জেগে গেছে। ও যে তােমাকে কী ভালােবাসে, তুমি যদি বুঝতে ! রুকু, আর কিছু না বলে চায়ে চিনি মেশাতে থাকে।

তিন দিন যেতে না যেতে আমি টের পেলাম, মৌ আমাকে কী ভালোবাসে।

একশ’ তিন জ্বর নিয়ে ফিরেছি অফিস থেকে। বামদিকে গলার ওপর দিকে কনকনে ব্যথা। রুকু ডাক্তার নিয়ে এলাে। যা আশঙ্কা করছিলাম, তাই হলাে। আমার মামস হয়েছে।

: দিন পনেরাে লাগবে সারতে। তবে ভাববেন না। ঠিক হয়ে যাবে। প্রেসক্রিপশানটা রুকুর হাতে দিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি রুকুর দিকে তাকালাম, আবছা লাগছে।

দশদিনের মাথায়। জ্বর আসে, যায়। মুখের বাম দিকে ব্যথায় টনটন করছে। চোয়ালের কাছে হাত দেয়া যায় না। জ্বর বেড়ে গেলে রুকু আমার মাথায় পানি ঢালছে। সাবধানে মুখ মুছে দিচ্ছে। পলি মাঝে মাঝে বাইরে থেকে দাড়িয়ে ডাকে—“আব্বু আববু। আমি ক্ষীণ গলায় উত্তর দিই। ভালাে হয়ে মৌ ফিরে এসেছে। সে-ও ডাকে উত্তর আটকে থাকে আমার গলায়। ভীষণ অস্থির লাগে আর গলা শুকিয়ে আসে। ও আমার ধারে কাছে আছে, এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।

জ্বরের ঘােরে মানুষের মাথা বিগড়ে যায়, শুনেছি। উদ্ভট, আজ-গুবি সব চিন্তা মাথায় আসে। আমি এসব কী ভাবছি ? রুকুকে কিছু বলা যাবেনা। ও উড়িয়ে দিয়ে বলবে, জ্বরে তােমার মাথার ঠিক নেই।”

কিন্তু আমি উড়িয়ে দিই কী ভাবে? আধো নিদ্রা আধাে জাগ- রণের ভেতর আমি মন্টিকে দেখি বারবার। শূন্য ভাবলেশহীন চোখ। মণি দুটো বেরিয়ে এসেছে। নাকের নিচে তাজা রক্ত। এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা মৌ-এর চুলের ফিতাটার কিছু ছেড়া অংশ। লুকোচুরি খেলার আগে রুকু ওটা ওর মাথায় আঁটোসাঁটো করে বেধে দিয়েছিলাে। ঝোপের ভেতর বসে মৌ হাঁপাচ্ছিলাে কেন? ওর সন্ত্রস্ত চোখ দুটো আমি এখনাে দেখতে পাই।

আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। না, অসম্ভব। এসব ঘটনা বই-এ থাকে, সিনেমাতে দেখানাে হয়। বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। আমি সাধারণ একজন শিল্পী। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে একটা নিঝঞ্চাট, শান্তির জীবন চেয়েছিলাম। আমার বাড়ি গাড়ি কোনাে কিছুর দরকার নেই। পরপর তিনটি সন্তানের অপমৃত্যু ছাড়া আমাদের চমৎকার কাটছিলো। অপমৃত্যু! পর পর তিন সন্তানের। নিছক দুর্ঘটনা- আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিই। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। পুরােপুরি ঘুম হয় না এখন। ছটফট করে জেগে উঠি। আর সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভট চিন্তাগুলাে—যা বই-এ থাকে, বাস্তবে নেই। কিন্তু আমার লোম দাড়িয়ে যায়।

জ্বর এবং ব্যথা দুটোই কমেছে। সকালে চোখ খুললাম। আজ নিয়ে বারােদিন হলাে আমি বিছানায়। জানালা দিয়ে শেষ শীতের রােদ এসে পড়েছে বিছানার এক কোণায়। আমি গায়ের লেপ সরিয়ে ওখানে পা দুটো ছড়িয়ে দিলাম। ভালাে লাগছে ।

বিকেলের দিকে মনে হলো আমি এখন হাঁটতে পারবে। ঝর ঝরে মনে হলাে। বায়তুল মােকাররম পর্যন্ত রিক্সায় যেতে পারবাে। দেখি, ডাক্তার কী বলে। রুকু অবশ্য আরেকটা দিন অপেক্ষা করতে বলেছিলাে। কিন্তু আমি শুয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বেরিয়ে সিড়ির কাছে এসেছি, দেখলাম মৌ একা দাড়িয়ে আছে। আমি তাকালাম ওর দিকে। ছলছলে দু’চোখ, ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। মনে হলাে কী যেন বলতে চায়।

: কিছু বলবে?

কর্কশ শোনালাে আমার গলা। নিজেরই খারাপ লাগছিলো। মৌ সেই একই ভাবে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে। যে কোনাে মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমার মায়া হলাে।
: কী হয়েছে মা ?

আমার কথা শেষ হতে দিলাে না, মৌ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলাে। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম।

: কী হয়েছে মামনি? কেউ বকেছে ?

: আব্বু, আব্বু, তুমি আমাকে আর আদর করাে না। আমি কিছু করেছি আব্বু, পলি বলে, আমার জন্য তোমার অসুখ হয়েছে। মৌ আমার কাঁধে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলাে।

: না, মামনি। আমার অসুখ হয়েছিলো তো, তাই মন ভালাে ছিলো না। কে বলে তোমাকে আদর করি না?

আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে কয়েকটা চুমু খেলাম। মেয়েটার প্রতি সত্যি দারুণ অবিচার করেছি গত কয়েকদিন। আমার অনুশোচনা হলাে। এটুকুন মেয়ে ! মৌকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। দেখি, দরােজায় রুকু দাড়িয়ে। ও সব লক্ষ্য করেছে।

বায়তুল মােকাররমে ডাক্তারের চেম্বার থেকে আমি ফিরলাম তিন ঘণ্টা পর। রুকু জানতে চাইলো, সব কিছু ভালো কি-না। আমি মাথা নাড়লাম। ভাল লা। দুঃসংবাদটা গােপন রাখলাম। বেশি না, মাত্র দুটি বাক্যে ডাক্তার সাহেব দুঃসংবাদটা আমাকে শুনিয়েছিলেন-‘মারুফ সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, কিন্তু মামস আপনার সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে।

অফিসে জয়েন করলাম পনের দিন পর। শরীর এখনাে দুর্বল। এমডি সাহেব আরাে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে বলেছিলেন। আমি বললাম দরকার নেই। বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তবে লাঞ্চের পর উনি অমােকে অফিসে থাকতে দেন না। জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেন রেস্ট নেয়ার জন্য।

পুরো বিকেল আমি চেয়ার নিয়ে সামনের বারান্দায় বসে থাকি। আমাদের বাসার সামনের রাস্তাটা সরু। অতি কষ্টে ট্রাক ঢোকে। কিন্তু যানবাহনের বিরাম নেই। সকাল থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত রিক্সার অন্তহীন মিছিল, এর ভেতর পাশের কোনাে লেন থেকে গাড়ি এসে পড়লে সে এক দুর্বিষহ ব্যাপার।

রিক্সায় স্বামী-স্ত্রী আর একটা ছােট ছেলে যাচ্ছে। কী যেন বায়না ধরেছে ছেলেটা। ওর মা হাতে টফি জাতীয় কিছু গুজে দিতে চাইছে, দুদিকে মাথা নাড়ছে ও। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলাে আমার ভেতর থেকে। রুক, আমার অসুখের ক’দিন আগে বলছিলাে, ও একটা ছেলে চায়। আমি সায় দিয়েছিলাম। আমরা দুজনই বুঝতে পারছিলাম, ছেলে সন্তানের অভাব কী সাংঘাতিক। আমার অনেক স্বপ্ন ছিলাে ফাহিম, মন্টি, অপুকে ঘিরে। সব ছারখার হয়ে গেলাে।
রুকু, আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে এ জীবনে আমি আর কোনাে সন্তান দিতে পারবো না। আমি এখন অক্ষম, অভিশপ্ত এক মানুষ। আমি বিড় বিড় করে বললাম।

রাতে রুকু আমাকে উত্তেজিত করতে চায়। অনেক আর্ট ও জানে। কিন্তু কাজ হয় না। আমি কাঠের মতাে পড়ে থাকি। বলি, ‘আজ থাক রুকু। আমার ব্যবহারে অবাক হয়ে যায় ও। মনে কষ্ট পাবে ভেবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে আদর করি। ঠাণ্ডা, নিষ্পণ ঠোটে চুমু খাই। হতাশ হয়ে এক সময় ও ঘুমিয়ে পড়ে।

আজ কাল মৌ আর মাঝ রাতে কেঁদে ওঠে না।

শীত চলে গেলে হঠাৎ। দিনের বেলা এখন ফ্যান চালাতে হয়। বিকেলে উদাস করা বাতাস বইতে থাকে। ঢাকায় বসন্তকাল। আমি জানি এটা তিন চার দিন চলবে। তারপর ভ্যাপসা গরম। অন্যান্য দিনের মতাে আমি বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে যাচ্ছি, রুকু, পেছন থেকে ডাকলো—“এখানে এক জায়গায় বসে থাকতে তােমার এতাে ভালাে লাগে। পলি-মৌ ক’দিন শিশু পার্কের কথা বলছে। ওদের নিয়ে একটু ঘরে এসে না। তােমরাও ভালাে লাগবে।

মন্দ বলেনি রুকু। আমি ওর দিকে তাকালাম ‘তুমিও চলো। তুমি একলা বাসায় কী করবে?” বলেই আমার মনে পড়লো আজ মঙ্গলবার। ওর গানের মাস্টার আসবে।

মেয়ে দুটো বোধহয় তৈরি হয়েই ছিলাে। ওরা ছুটতে ছুটতে এলো।

: হ্যা, আব্বু, শিশু পার্ক চলো। তুমি আমাদের কোথাও নিয়ে যাও না। মৌ আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লগলো।
: ঠিক আছে। শিশু পার্ক। তােমরা সঙ্গে খেলনা টেলনা কিছু নেবে না? আমি বললাম। সঙ্গে সঙ্গে মৌ ভেতরে চলে গেলাে। পলি দাড়িয়ে রইলাে। ও এখন আগের মতো শিশু নেই। ন’বছর চলছে। ও এমন ভাব দেখালাে যে খেলনা টেলনা এখন মৌ-এর ব্যাপার। ওকে বলা কেন? আমি হাসলাম।

: কী খুজছাে মা।

মৌ ওদের শােবার ঘরে আঁতি পাতি করে কিছু খুঁজছে। বের বার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে পলি।

: আব্বু, আম্মার বলটা। খাটের নিচ থেকে মাথা বের করে মৌ বললো।

: কেন, বল কেন? ওই তাে পুতুলটা। ওটা নাও। আমি বলতে বলত লক্ষ করলাম, সােনার গাঁয়ে ওর জন্মদিনে আমার দেয়া পুতুলটা ঘরের এক কোণায় অযত্নে পড়ে আছে। মৌ ওটা কোন দিন ভালো করে হাতে নিয়ে দেখেছে বলে মনে হলাে না। এখনো নতুন, ওপরে ধুলাের পাতলা স্তর। পাঁচ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু পুতুলটা হাতে তুলে দেয়ার সময় মৌ-এর মুখের ভাবান্তর এখনাে আমার চোখে ভাসে। পুতল ও পছন্দ করে না। রুকু, পরে এক দিন বলেছিলাে।

: পেয়েছি আব্বু! চলো।

আয়রন সেফের পেছন থেকে লাল বলটা দু হাতে ধরে মৌ পলিকে নিয়ে নেমে গেল।

: রু কু, আমরা গেলাম।

: বেশি দেরি করবে না। আর পলি, মৌকে দুরে যেতে দিও না । রান্না ঘর থেকে রুকু চেচিয়ে বললাে। শহরে বাস স্ট্রাইক ছিলো। অন্যান্য দিনের তুলনার পার্কে ভিড় কম। বাচ্চাদের নিয়ে যারা এসেছে তাদের অধিকাংশ আশপাশে থাকে, নয়তো গাড়িঅলা। পার্কের গেটের সামনে মানুষের জটলা  নেই, অন্যদিন ভিড়ে রাস্তা উপচে পড়ে। আমাদের ভাগ্য ভালাে বলতে হবে। কোনাে রকম ধাক্কা ধাক্কি না করে পলি এবং মৌকে নিয়ে আমি ভেতরে গেলাম। রোদ পড়ে এসেছে।

শিশু পার্কে আমি আগে আসি নি। খেলাধুলার অনেক ব্যবস্থা আছে। কোনােটাতেই জায়গা খালি নেই। পলি বললো, আগে ট্রেনে উঠবে। কিছুক্ষণ রেল ভ্রমণ করা গেলো। তারপর নাগর দোলা, চরকি, মেরি-গো-রাউণ্ড, ঘােড় দৌড়। দুজনই ঘামছিলো। ওদের নিয়ে আইসক্রিম খেলাম। আমি মাত্র ক’দিন আগে অসুখ থেকে উঠেছি। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির ফলে দুর্বল লাগছিলাে।

: পলি, মৌ, তােমরা খেলো। আমি একটু বসি। খবরদার দুরে যাবে না। পার্কের দক্ষিণ দিকে লোকজন কম। আমি ঘাসের ওপর আয়েশ করে বসলাম। পলি, মৌ একটা দোলনার কাছে। এ পার্কে সবাই আসতে পারে না। টিকিট লাগে। অনেকে টিকিট নিয়ে ঢুকতেও ভয় পায়। চারদিকে চেহারা এবং পােষাকের চাকচিক্যের ভেতর বেমানান লাগে। বহু লােক তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে ভেতরের তামাশা দেখে ।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। পার্কের ভেতরটা দিনের মতাে পরিষ্কার। হাজার ওয়াটের বাতি বসানো আছে জায়গায়  জায়গায়। আর ঘণ্টা খানেক পর পার্ক বন্ধ হয়ে যাবে। লােকজন কমে এসেছে। দুরে দুরে কয়েকটা ফ্যামিলি হাঁটাহাঁটি করছে। যা সামান্য ভিড়তা কেবল নাগরদোলা আর রেল গাড়ির ওখানে। এবার উঠতে হয়।

মাত্র এক সেকেণ্ডের ব্যাপার। মনে হলাে, হৃৎপিণ্ডটা আমার গলায় এসে ঠেকে গেছে, রক্ত চলাচল বন্ধ। গলার সমস্ত জোর দিয়ে আমি ডাকলাম-প••লি । মেয়েটা ঘুরে দাড়ালো আমার দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথা থেকে কয়েক আঙুল দুর দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলে দোলনার কাঠের তক্তাটা। হাবা’র মতাে কিছু না বুঝে পলি দাড়িয়ে আছে। আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার সর্বাঙ্গ কঁপছে।

দোলনার ওপাশে শুধু মৌ। স্পষ্ট দেখলাম, ওর চোখ দুটো এক- বার ধক করে জ্বলে উঠলো, মুখ কঠিন। কয়েক সেকেণ্ড। আমার কাছে সে-ও ছুটে এলাে। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

: কী হয়েছে আব্বু?

পলি তখনাে কিছু বুঝতে পারেনি। মৌ ওর হাত ধরেছে।
: কিছু না, । সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চলাে এবার যাই। আতকে আমার গলা শুকিয়ে আসছিলাে।

: আব্বু, তােমার ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে। আমার ফ্যাকাশে মুখ পলির চোখ এড়ায়নি।

: ও কিছু না, মামনি।

গেটের কাছে যেতে দোলনাটার দিকে আমার আবার চোখ পড়লাে। ওটা এখনাে দুলছে, আশ-পাশে কেউ নেই। কী ভয়ঙ্কর অমানুষিক শক্তি ওটা ঠেলে দিয়েছিলাে। মাথাটা চকিতে আমার দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার ফলে একটু কাৎ হয়ে গিয়েছিলাে পলি। নইলে এতোক্ষণে । রিক্সায় পলিকে আমি বুকে চেপে ধরি। ঝাঁকুনিতে মৌ একা বসে থাকতে পাচ্ছিলাে না। আমি দেখেও দেখলাম না। ও কোমর জড়িয়ে ধরতে আমার গায়ের লোম দাড়িয়ে গেলাে ফের। অসুখের সময় আমার যে চিন্তাগুলোকে জ্বরের বিকার বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, তার প্রতিটা বাস্তব। নির্মম রিয়্যালিটি । মৌ কে আমি চিনে ফেলেছি। এটা বুঝতে পেরেছে সে-ও। রুকুকে সব খুলে বলতে হবে আজই। নইলে মৌ-এর হাত থেকে রক্ষা নেই । এখন উপায় একটা। ওকে যে করে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে।

রুকু টিভি দেখছিলাে। আজ সাড়ে সাতটায় ওর প্রােগ্রাম আছে। আমরা নিঃশব্দে ঢুকলাম ড্রইংরুমে।

: কেমন কাটলো?

রুকু তাকালে আমার দিকে। আমি উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। পার্কের ঘটনাটা ভুলতে পারছি না। সামনে একটা পুরো রাত, এর মধ্যে যদি পলির কিছু হয়ে যায়। তিনটা অপমৃত্যু হয়ে গেছে আমার পরিবারে, এবার বােধ হয় পলির ডাক এলাে। আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছিলাে অপু, ফাহিম ও মন্টির মুখ।

: আব্বু, জলদি এসাে। টেলিভিশনে আম্মুকে দেখাচ্ছে। আমি কাপড় ছাড়ছিলাম। দেখি, মৌ দাড়িয়ে আছে দরজায়। আমার গা ছম ছম করে উঠলাে। কিন্তু এখন ওর মুখ কী সরল আর নিস্পাপ।

: যাও, অাসছি।

মৌ চলে গেলো।

টিভির পর্দায় রুকুকে দেখে আমি কোনাে উচ্ছ্বাস দেখলাম না। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিলাে। আসলে টিভিতে চোখ থাকলেও, আমার মন জুড়ে ছিলো গত পাঁচ বছরের অসংখ্য টুকরাে টুকরাে ঘটনা। এতোদিন এগুলাের কোনো যােগ খুজে পাইনি। আজ সব পরিষ্কার হয়ে আসছে।

অসম্ভব। কী যা-তা বলছে তুমি । চুপ করে। রুকু চেঁচিয়ে উঠলো ।

: বিশ্বাস করাে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। ‘

: কী দেখেছে।

: আমি স্পষ্ট দেখেছি, মৌ খালি দোলনাটা ধরে যতদূর সম্ভব টেনে নিয়ে পেছনে গেলাে। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা ঠেলে দিলাে সামনে।

আমি গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না।
: তারপর কী হলাে শুনি?

: পলি দাড়িয়েছিলাে দোলনার স্ট্যাণ্ডের পাশে। আমি দেখলম বিদ্যুৎ বেগে কাঠের তক্তাটা ছুটে আসছে ওর মাথার দিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে ডাকতেই ও ঘাড় ফেরালো। মাত্র এক বিঘৎ- এর দুরত্ব। তক্তাটা সাই করে ওর ঘাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাে।

: উহ,, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। তুমি বিশ্বাস করতে পারলে, পাঁচ বছরের একটা মেয়ের গায়ে এমন জোর আছে ? মৌ আমাদের টু-ইন-ওয়ানটা ঠিক মতাে আলগাতে পারে না। রুকুর গলা তেতো হয়ে উঠছে।

: রুকু, আমি তােমার সঙ্গে তামাশা করছি না। আমি দেখেছি ও পলির দিকে তাকিয়ে দোলনাটা এইম করলাে, তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে•••অবিশ্বাস। এ শক্তি নর্মাল বাচ্চার নয়।

: থামো, থামো। মৌকে তুমি আজকাল সহ্য কতে পারছ না। এটা আমি কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি। এখন বুঝলাম, সব তােমার মনগড়া, বানানাে গল্প ।

: না, রুকু না। মৌ ঠাণ্ডা মাথায় আমার গায়ে মামসের জার্ম ছড়িয়েছে। জানাে ও আমার কী সর্বনাশ করেছে ? বলে আমি হঠাৎ চেপে গেলাম। রুকুকে বলে লাভ নেই। কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।

: কী, থামলে কেন, বলাে? গুলের স্টক শেষ। রুকু হিস হিস করছে রাগে।

: রুকু, আজ ও পলিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাে। আর সত্যি সত্যি পলির কিছু হয়ে গেলে, সবার সঙ্গে আমরাও বলতাম—এটা এ্যাক্সিডেন্ট। মৌ-এর কী দোষ! ওতাে অবুঝ বাচ্চা। এরকম ঘটনা ছেলে মেয়েদের খেলার সময় প্রায়ই হচ্ছে।

এ্যাসিডেন্ট। আমার তিনটা ছেলে বেঘােরে মরলাে। আমরা বললাম এ্যাসিডেন্ট। আমি ওকে ডেকে না উঠলে আজ এতোক্ষণে তুমি পলির লাশ দেখতে রুকু। মৌকে কোলে নিয়ে কেঁদে কেটে বলতে—‘মৌ-এর কোনাে দোষ নাই। এ্যাকসিডেন্ট!

আমার গলা চড়ে গেলো। রুকু আগের মতাে চোখ ভরা অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ফের বললাম,– ‘বিশ্বাস করো রুকু, নিজের চোখে দেখেছি। ও পলিকে মেরে ফেলতে চায়।

: শোনাে, তুমি তাে সারাদিন বাইরে থাকো। ঘরে থাকি আমি। আমি মা, আমি বুঝি। মৌ পলি বলতে অজ্ঞান। পলিকে ও মন দিয়ে ভালােবাসে।

: হ্যা, যে ভাবে জান দিয়ে ও ভালােবাসত অপু, ফাহিম ও মন্টিকে। রুকু হঠাৎ আমার চোখে চোখ রাখলাে। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর-মানে, কী বলতে চাও তুমি?

: যা সত্য, তাই বলছি।

: আস্তে আস্তে। বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যাবে। বলল, কী সত্য?

: মৌ নিজের হাতে মেরেছে তােমার তিন ছেলেকে। তিন বছরে একটা ফ্যামিলিতে তিনটা এ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে না, রুকু। কোনাে রকম যুক্তি তর্ক এখানে খাটে না। ঘটনাগুলাে কাকতালীয় ব্যাপারও নয়। একটা কিংবা দুটো হলে তবু মানা যেতাে, কিন্তু পর পর তিনটা আনন্যাচারাল ডেথ? আর, আরেকটা হতে যাচ্ছিলাে, আজকে আমার চোখের সামনে! কী ব্যাখা করবে তুমি ?

রুকু উরুতে ভর দিয়ে একহাতে মাথা চেপে ধরে আছে। মন্টি এবং ফাহিমের মৃত্যু নিয়ে আমার ভেতরে যে কথাগুলো এতােদিন জমা হয়েছিলাে, সব আমি বললাম একে একে।

: পানি থেকে তোলার পর মৌ-এর গায়ে কিছু আঁচড় ছিলাে, মনে আছে ? তুমি বলেছিলে, ওগুলাে ফাহিমের নখের দাগ। আমিও তা স্বীকার করি। কিন্তু ফাহিম ওকে খামচে ধরেছিলো, ওকে বাঁচাবার সময় নয়-মৌ যখন ছেলেটাকে দিঘির কাছে ফুসলে নিয়ে পানিতে ঠেলে দিচ্ছিলাে, তখন । ধস্তাধস্তিতে দুজনই পানিতে পড়ে যায়। কিন্তু মৌ-এর শক্তির কাছে ফাহিম হেরে যায়। মেয়েটা ওকে চুবিয়ে মারে, হ্যা, চুবিয়ে মারে।

: না! রুকু চীৎকার করে উঠলাে।

আমার ভেতরে তখন বাধ ভেঙে গেছে। আজ ওকে সব বলতে হবে। সব।

: মন্টি, মন্টির কী হয়েছিলাে? যে গাছে দিনের পর দিন বানরের মতাে ও উঠে যেতে পারতাে, সেখান থেকে ও পড়ে মরেছে ? কখনাে নয়। আর, ওর কবুতরের খুপরিটা ছিলাে নিচের দিকের একটা ডালে। ওখান থেকে পড়ে গেলেও ওর কিছু হতাে না। মৌ ওকে মেরেছে। ও গাছে উঠে মন্টিকে খুন করে নিচে ঠেলে ফেলে দিয়েছে । আমরা তখন লুকোচুরি খেলছিলাম। সেবার আমার সবাইকে খোজার পালা হিলো, মনে আছে ? আমার গলা আটকে আসছে কান্না এবং ভয়ে।

: মৌ-এর এখন মাত্র তিন বছর বয়স। ও গাছে উঠবে কী ভাবে ? এটা তুমি কী বলে।

: শােনাে রুকু, মৌ সব পারে। ওপারে না এমন কাজ নেই। তুমি জানাে, ও প্রায়ই কাঠের মইটা বেয়ে অমদের এ বাসার ছাদে ওঠে। একটা বিশাল কালাে কুকুরের সঙ্গে খেলে ?

: থামাে, থামাে! আমি এ প্রলাপ আর শুনতে চাই না। রুকু দু’হাতে কান চেপে ধরলাে। ওর চোখ গোল হয়ে উঠছে। আমি থামলাম না।

: মন্টির মুঠোয় মৌ-এর মাথার ফিতা থেকে কিছু, অংশ ছিড়ে চলে এসেছিলো। খুব সম্ভব মন্টি নিজেকে বাঁচার জন্য প্রাণ পণ চেষ্টা করেছিলাে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, এক ফাঁকে লােকজনের ভিড়ে মৌ ফিতাটা মন্টির মুঠো খুলে নিয়েও যায়। আমি কিছুক্ষণ দম নিলাম।

: আমরা বলতাম মৌ-এর সঙ্গে মন্টির ঝগড়া হয়েছে। মন্টি বিগড়ে যাচ্ছে। তা যাচ্ছিলো। সেটা শুধু মাত্র মৌ-এর ভয়ে। মৌকে ও ভয় পেতে।

সোনারগাঁয়ের বাসার গেস্ট রুমে মৌকে মন্টির ঘুষি মারার দৃশ্যটার কথা আমি বললাম। হ্যাঁ, মেয়েটার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ও শেষ পর্যন্ত হাত তুলতে বাধ্য হয়েছিলো। সিড়ির নিচে রক্ত-মাংস সমেত মন্টির চুলের গাছি পাওয়ার ঘটনাটাও বললাম। মেয়েটার এমন প্রচণ্ড শক্তি। মন্টি যখন বলেছিলো, ওর সাইকেলটা মৌ ভেঙেছে আমি বিশ্বাস করিনি। আসলে ভেঙেছে মেয়েটাই। তুমি বলবে, এটা অসম্ভব। কিন্তু তার প্রমাণ তাে আমি পেলাম আজকে বিকেলে। ও, সব পারে। ছ’মাসের অপুকে যখন ও খাট থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, তখন ওর বয়স বড় জোর দু’মাস। ফুপুআম্মা মৌকে চিনে ফেলেছিলাে। উনি ওর অনেক কাণ্ড কারখানা দেখেছেন । তুমি রেগে যাবে বলে তোমাকে বলতো না। কিন্তু উনি আমাকে বলেছেন। প্রথম প্রথম বিশ্বাস আমিও করিনি। কিন্তু এখন সব পরিষ্কার।

: আহ্, থামো। আমার কেমন জানি লাগছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুকু বললাে,-“ফাহিম, মন্টি অপুর কথা বলে আর কী লাভ? ওরা চলে গেছে। আমি হতভাগী। এখন আমার আছে পলি, আর মৌ। এ দু’জনই আমার বেঁচে থাকার সম্বল। আর তুমি এদের একজনের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। তুমি কি মানুষ ।

: রুকু, আমি রক্তমাংসের একজন মানুষ। এবং মেন্টালি সুস্থ। শোনাে, তােমার জীবনে শুধু ওরা দু’জন বেঁচে আছে, এর মানে কি জানো? কারণ মৌ তােমার তিন সন্তানকে খুন করেছে। তক্কে তক্কে আছে শেষজনকে মারার জন্য।

: তােমার কোনাে কথা আমি বিশ্বাস করি না। তুমি উন্মাদ। রুকু বলতে বলতে চলে গেলাে শােবার ঘরের দিকে। কিন্তু আমার তখন আরাে কথা বাকি। ওকে যে করে হােক আসন্ন বিপদের কথাটা বােঝাতে হবে। আমি ওর পিছু ছাড়লাম না।

জানালার শিক ধরে রুকু দাড়িয়ে আছে। বাইরে জোছনা। ফুর- ফুরে বাতাস আসছে। আমার পায়ের শব্দ শুনে রুকু ফিরে তাকালাে। লক্ষ্য করলাম, ওর মুখের উজ্জ্বল আভাটা নেই, দৃষ্টি বিহ্বল-চোখের কোনায় পানি চিক চিক করছে।

: মৌ তােমার কী এমন ক্ষতি করেছে যে••• রুকু ভাঙা গলায় বলতে চাইলাে।

: ক্ষতি। ও আমার, ও আমার••• আমি আবারাে চেপে গেলাম।

: এমন একটা ফুটফুটে বাচ্চা।

: হ্যাঁ, ফুটফুটে নিস্পাপ, ফুলের মতো পবিত্র। আর কিছু বলা যায় না? কোকিলের বাচ্চা কী করে জানো? রুকু চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো।

: ওর মা বাসা বাঁধতে জানে না। লুকিয়ে ডিম পেড়ে আসে কাকের বাসায়! কাক নিজের ডিম মনে করে তা দেয়। একদিন বাচ্চাও ফোটে। সরল কাক মনে করে সবগুলাে তার বাচ্চা। কিন্তু কোকিলের বাচ্চাটা চায়, শুধুমাত্র ও থাকবে। আর একটাও না। কাক খাবার আনতে গেলে ও অন্য বাচ্চাগুলােকে ঠোট দিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে। না ফোটা ডিম থাকলে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয় নিচে। কাক বেচারী কিছুই বােঝে না। ভাবে এটাই নিয়ম। তার সমস্ত স্নেহমমতা গিয়ে পড়ে ওই কোকিলের বাচ্চার ওপর। তােমার মৌ হলাে সেই কোকিলের বাচ্চা।

: চুপ করে, চুপ করে। এসব উদ্ভট কাহিনী ভূতের গল্পে থাকে। ভয়ের সিনেমাতে থাকে। এ সব বাস্তবে ঘটে না। আমরা সাধারণ মানুষ। বলে, আমাদের জীবনে কেন এগুলাে হবে? বলাে।

: আমি এর কারণ জানি না রুকু। কিন্তু এটা সত্য যে এগুলাে ঘটেছে, এবং আরাে ঘটতে যাচ্ছে।

রুকু ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাে। কাঁদছে।
: মাথা ঠাণ্ডা রাখো, রুকু। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

: কী ভাবে ? তােমার মুখ থেকে এসব শােনার পরেও? রুকু আমার ঘাড়ে মাথা গুজে বললাে।

: হঁ্যা। আমি বলছি ঠিক হয়ে যাবে। তার আগে মৌ কে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে।

: কী..! তুমি কী বললে! কোনােদিনও না।

রুকু আমার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার গিয়ে দাড়ালো জানালার কাছে। এমন ভাবে কাপছে যেন পড়ে যাবে।
: রুকু, ওকে যে করে হোক বাড়ি থেকে সরাও। ও মানুষ না, পিশাচ। ও পলিকে মেরে ফেলবে। আমি অজান্তে কেঁদে ফেললাম।
: মৌ আমাদের মেয়ে।

মৌ আমাদের মেয়ে না। জানি না কে বা কী ওর বাবা। কিন্তু ও আমাদের মেয়ে নয়।

: হুঁ, আমাদের।

: না। যা বাস্তব তাকে স্বীকার করো রুকু। ও তােমার পেটের সন্তান না।

: কিন্তু ওকে আমি নিজের বুকের দুধ খাইয়েছি। অন্যান্য ছেলে- মেয়েদের মতাে নিজের হাতে বড় করেছি। ও জানে আমিই ওর মা। আর তুমি ওকে তাড়িয়ে দিতে বলছে? কোনােদিন তা হবে না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে নয়।

: মৌ’কে এ বাড়ি থেকে আমি তাড়াবো। এবং খুব শিগগীরই। দাতে দাত চেপে আমি বললাম।

হিস্টিরিয়া রােগীর মতাে শব্দ করে রুকু ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। পারলো না। দেয়ালের পাশ থেকে নিঃশব্দে ওর সামনে এসে দাড়ালাে মৌ। আমার আবার গা কাটা দিলাে। কতাক্ষন এখানে ঘাপটি মেরে দাড়িয়েছিলাে কে জানে? ও সব কথা শুনেছে। রুকু ওকে কোলে তুলে নিয়ে চেপে ধরেছে।

: আম্মু, আব্বু, এ রকম করছে কেন? আমাকে তাড়িয়ে দেবে ? কেন আম্মু। আমি কী করেছি ? মৌ কাদছিলাে ফুপিয়ে।

: না, মা। কেউ তােমাকে কিছু করতে পারবে না। কে তাড়াবে আমার মামণিকে? মৌ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে। আমি দেখলাম, রুকু মেয়েটাকে পাগলের মতাে চুমু খাচ্ছে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই। ভয়ঙ্কর একটা শব্দ শুনে জেগে উঠলাম। মনে হলাে, ছাদে একটা কুকুর ডাকছে। উল্টো গলায়। ওটার ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এলােপাতাড়ি দৌড়াচ্ছে। পাশে মুখ ঘুরিয়ে গুটিসুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে রুকু। আমি ওর গায়ে হাত দিতেই শক্ত হয়ে গেলো। তার মানে, সে-ও জেগে উঠেছে।

: শুনছো ?

আমি ডাকলাম। উত্তর নেই।

রুকু, ছাদের ওপর একটা কুকুর। শুনতে পাচ্ছো? ও ছোট্ট করে বললো, ‘না’! শুয়ে আছে ঠিক আগের ভঙিতে।

ও ঘরে পলি একা। পাশে মৌ! ছটফট করে আমি উঠে পড়লাম রুকুকে ডেকে লাভ নেই ৷ চেচামেচি শুরু করবে। আমি এমনভাবে দরজা খুললাম, যাতে শব্দ না হয়।

পলিদের ঘরে ঢুকেই আমি বাতি জ্বালাম। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে পলি। পাশে মৌ। বােধহয় ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ একটা বােটকা গন্ধ। বিছানার দিক থেকে আসছে। আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। গন্ধটা আসছে মৌ-এর গা থেকে।

মেয়েটর চুল এলােমেলো। গায়ে ঘাম। বালিশে মুখ গুজে হাঁপাচ্ছে। এমন সময় আযান পড়লাে। খসখস শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি, রুকু।

পরদিন। আমি কোনো কিছুতে স্থির হতে পারছিলাম না। রুকু আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সামনা সামনি হওয়া মাত্র। কিছু আসে যায় না। আমার এখন যে করে তােক পলিকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু মৌ-এর ব্যাপারে রুকু অনড়। কী করি! এমন এক সমস্যা যে, বন্ধুবান্ধব কাউকে বলাও যায় না। হেসে উড়িয়ে দেবে।

রাতে খাওয়ার পর রুকু ড্রয়িং রুমে এলো না। আমি একা টিভি দেখলাম। মাঝখানে একবার এসেছিলাে পলি। এরমধ্যে ফোন বাজলো। শোবার ঘরে গিয়ে দুবার ফোনে কথা বলার সময় দেখি, রুকু একইভাবে মৌকে কোলে নিয়ে ভেতরের বারান্দায় বসে আছে। টিভি শেষ হলাে সাড়ে এগারোটায়। আমি তবু বসে রইলাম। রুকুর সঙ্গে মৌ-এর ব্যাপার টা আজই পাকাপাকি করতে হবে।

ঘড়িতে দেখলাম, রাত দেড়টা। রুকু সারারাত বারান্দায় বসে থাকবে না কি ? উঠে গিয়ে দেখি ওখানে কেউ নেই। আমাদের শােবার ঘরটাও ফাকা। তার মানে, রুকু আজ মেয়েদের ঘরে শুয়েছে। ওদের ঘরে বাতি জ্বলছে। দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে রুকু। আমি ফাঁক দিয়ে দেখলাম, রুকু মৌকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। পাশে পলি।

রুকু নাছােড়বান্দা। মৌ কে ছাড়বে না। বিকেলে যে প্ল্যানটা মাথায় এসেছিলাে, এখন সেটাই একমাত্র রাস্তা। পলিকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে মেয়েটাকে বাঁচানাে যাবে না। চুলােয় যাক চাকরি, সংসার। এখন পলিই আমার সব কিছু।

আর এক ঘণ্টা পর ভাের হবে। এই সুযােগ। পলিকে তুলে নিয়ে সােজা কমলাপুর স্টেশন। তারপর সকালের ট্রেনে চিটাগাং। পলিদের ঘরে লাইট নেভানাে। বােধ হয়, রুকু এক সময় উঠে নিভিয়েছে। তবে প্যাসেজের বাতি থেকে জানালা দিয়ে ভেতরে আলাে আসছে। দরাজা খুললাম সাবধানে। বুক টিপ টিপ করছিলাে। রুকু পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। তার গা ঘেষে মৌ, আর খাটের

এ পাশে পলি। আমি ঘুমে অচেতন পলিকে আস্তে আস্তে করে কোলে তুলে নিলাম। মেয়েটা আমার কোলে এলিয়ে পড়েছে; পিছলে যাওয়ার জন্য ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো। দরজা দিয়ে বেরুবার সময় মাথায় বাড়ি খেলাম। সর্বনাশ, এই বুঝি রুকু জেগে গেলো। আমি অনেক কষ্টে মুখ ফেরালাম। রুকু নিঃসাড়।

চোখ দুটো মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মৌ। আমি জানি ও চীৎকার করবে না। ওর শেষ আশা পূরণ হতে চললো। এ বাড়িতে এখন ওর একচ্ছত্র অধিকার।

সিড়িতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলির ঘুম আলগা হয়ে গেলাে।
: আব্বু, সকাল হয়ে গেছে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ও আধাে জাগা অবস্থায় বললাে।

: চুপ মামণি ! আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।

: আম্মু, মৌ ওরা আসবে না?

: আসবে। আমরা আগে স্টেশনে যাবাে। টিকিট করতে হবে। তেতলার সিড়িতে বাতি নেই। আবছা অন্ধকার। মনে হলাে কে যেন উপরে উঠে আসছে। পলি জোরে ডেকে উঠলাে, আব্বু ! ওকে থামাতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই দোতলার সিড়ির মাঝামাঝি জায়গায় আমি অজয় বাবুর ভারী গলা শুনতে পেলাম, কে••কে ওখানে ? ভদ্রলোক সারারাত শুটিং করে ফিরছেন।

ঃ অজয় বাবু, আমি।

আমার গলা বােধ হয় উনি চিনতে পারেন নি।
: আমিটা কে ?

উত্তরটা এ্যাগ্রেসিভ। চোরটোর মনে করে ঝাঁপিয়ে না পড়লেই হয়। আমি উল্টো উঠে গিয়ে আমাদের সিড়ির আলােতে দাড়ালাম। মারুফ সাহেব অপনি! মেয়েকে নিয়ে এই সময় কোথায় যাচ্ছেন ?

অজয় বাবু বুঝে ফেলেছেন। গোলমেলে ব্যাপার।
: অজয় বাবু, আপনার পায়ে পড়ি। চেচাবেন না। আমাকে এখন যেতে দিন। পরে সব বলবো। আমার মিনতিতে কাজ হলো। ভদ্রলােক দুদিকে হাত মেলে সিড়ির মাঝখানে দাড়িয়ে অাছেন। অন্য সময় হলে আমি তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন কোলে পলি।

: আগে সত্যি করে বলুন কী হয়েছে।

আপনাদের ব্যাপার আমি কিছু কিছু শুনেছি। সে আপনাদের পার্সোনাল এ্যাফেয়ার। কিন্তু, এতাে রাতে নিজের একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কী অর্থ ?

অজয় বাবু লােকটি ভালো এবং নীতিবান। বুঝলাম এর হাত  থেকে আজ নিস্তার নেই।

: প্লীজ, আপনাকে বল্লাম তাে পরে বলবাে। এখন আমাকে যেতে দিন।

আমি এগিয়ে ওর সামনে দাড়াতে ভদ্রলােক দু’হাতে ঠেলে আমাকে সিড়ির এক ধাপ ওপরে পাঠিয়ে দিলেন। হঠাৎ ভয় পেয়ে পলি চীৎকার করে উঠলাে– আম্মু।

চুড়ির শব্দ পেয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখি, সিড়ির মুখে রুকু আর শুক্লা বৌদি। ভয়ে-বিস্ময়ে দুজনের মুখ সাদা। আমার কোল থেকে নেমে ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লে পলি। তারপর কান্না।

: মারুফ সাহেব, আই এ্যাম সরি। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন।

অজয় বাবু আমার হাত চেপে কথাগুলো বলে দ্রুত ওপরে উঠে গেলেন। দুঃখে-হতাশায় আর গলার কাছটায় ব্যথা করছিলাে। দরাজায় মৌ দাড়িয়ে। আমার দিকে কট কট করে তাকালাে। দৃষ্টিতে প্রতিহিংসা ঝিকিয়ে উঠছে। ওর আশা পূরণ হলো না।

: রেডি হয়েছে মা?

আমি পলিকে তাড়া দিলাম। অফিসের সময় হয়ে গেছে। তার আগে ওকে স্কুলে ছেড়ে যেতে হবে।

পলি ব্যাগে বই পত্র ঢোকাচ্ছিলো। উত্তর দিলাে না। রাতের ঘটনায় দারুণ ভয় পেয়েছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত।

: পলি, মা রেডি?

: আমি তোমার সঙ্গে যাবাে না। আম্মু, নিয়ে যাবে।

কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ও ভেতরে চলে গেলো। আমি ড্রয়িং রুমে বােকার মতাে বসে রইলাম।

শাড়ি বদলে, হালকা মেকআপ নিয়ে রুকু এলাে। সঙ্গে পলি । পেছনে মৌ। ওকে একা বাসায় ছেড়ে যাবে না।

: আমি পলিকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। চাবি বৌদির কাছে রেখে যাবে।

কাটাকাটা ভাবে কথাগুলো বলে রুকু মেয়ে দুটোকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

কোনাে বুদ্ধি করতে পারছি না আমি। প্রতি মুহুর্তে অপেক্ষা থাকি, এই বুঝি পলির কিছু হয়ে গেলো। রুকু ক’দিন থেকে পলি এবং মৌকে বুক আগলে রাখছে। রাতে ঘরের দরজা আটকে শোয়। একের পর এক নিদ্রাহীন রাত কেটে যাচ্ছে আমার। সেদিন সকালে রুকু পলি এবং মৌকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। আমিও বেরুবাে। হঠাৎ চট করে প্ল্যানটা আমার মাথায় এলাে। পলিকে স্কুল থেকে নিয়ে পালাতে হবে এ ছাড়া পথ নেই।

দিনটা ছিলো বুধবার। ওরা সকালে বেরিয়ে গেলে একটা বড় ব্যাগে আমি নিজের ও পলির কাপড় চোপড় ভরে নিলাম। সাত দিনের ছুটি নিয়েছি। এর মধ্যে রুকু যদি মৌ কে সরাতে রাজী হয় ভালাে, নইলে আমি এবং পলি ফিরছি না। তালা লাগিয়ে ব্যাগটা সিড়িতে রেখে আমি বৌদিকে চাবি দিয়ে এলাম। আমার ভেতরে ঝড় বইছিলাে, কিন্তু মহিলা বুঝতে পারেন নি।

বায়তুল মােকাররমের সব দোকান এখনো খােলেনি। পত্রিকা স্ট্যাণ্ডে কাজগপত্র ঘাটলাম কিছুক্ষণ। চা খেলাম দু’বার। আবার হাটাহাটি। লক্ষ্যহীন।

ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে দশটা। ইলেকট্রনিক্সের ছােট একটা দোকান খুলেছে মাত্র। তরুণ একজন সেলসম্যান বসে আছে। দেখে মনে হয় এইমাত্র গোসল করে ভাত খেয়ে এসেছে। আমাকে দেখে উঠে দাড়ালাে। ঘন নীল রঙের একটা পকেট ট্রানজিস্টারের দাম ঠিক করলাম। একশাে ত্রিশ টাকা। অনেক বেশি চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। পাশের দোকাগুলো খোলেনি।

এক বছর ধরে পলি এটার কথা বলছিলাে। স্কুলে ওর এক বন্ধুর কাছে দেখেছে। আমি সাবধানে ট্রানজিস্টারটা ব্যাগে ভরে রিক্সা নিলাম—-“সেগুন বাগিচা।

পলিকে ভােলাতে বেশি সময় লাগবে না। বস্তুটা ওর অনেক দিনে স্বপ্ন। ওর হাতে ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো।

: ও মেয়েকে আপনি নিয়ে যেতে চান ? হেডমিস্ট্রেস আমার চেনা আমার মুখে উদ্বেগের ছায়া দেখে তাকে চিন্তিত মনে হলাে।

: জ্বী ম্যাডাম।

: কিন্তু ওকে ওর মা দুই ঘণ্টা আগে স্কুলে দিয়ে গেলাে।

: হ্যা, স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রেস ক্লাবের সামনে…

: কী সাংঘাতিক ব্যাপার। রিক্সায় আজকাল জান হাতে নিয়ে উঠতে হয়। ভাগ্যিস; ফুটপাথের দিকটায় পড়েছিলো। মহিলা আয়াকে দিয়ে পলিকে ক্লাস থেকে ডেকে আনালেন। আমার দিকে অবাক চোখে তাকলো পলি- আব্বু!

: তােমার আব্বু, তােমাকে নিতে এসেছেন। আজ তোমার ছুটি।

হেডমিস্ট্রেসের কথা শুনে পলির মুখটা খুশিতে এক মুহূর্তের জন্য ঝলমল করে উঠলাে।

ট্রানজিসটারটা স্কুলে ঢােকার আগে আমি পকেটে ভরে নিয়ে- ছিলাম। স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে কোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বস্তুটা দিলাম ওর হাতে।

: এটা তােমার।

: সত্যি ..!

পলি লাফিয়ে উঠলাে। কাজ হয়েছে। আমার সম্পর্কে এখন আর কোনাে অভিযােগ নেই। রিক্সায় বসে ও ট্রানজিস্টার অন করে দিলাে। ঢাকা রেডিওতে নজরুল গীতি হচ্ছে। বিচিত্র শখ মেয়েটার। রিক্সা গুলিস্তানের মােড়ে এসে পৌছলে পলি অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করলো—“আব্বু, আমরা কোথায় যাচ্ছি।’

: নারায়ণগঞ্জ । ওখান থেকে জাহাজে করে আমরা চাঁদপুর যাবাে। চাঁদপুরের কথাটা না ভেবেই বললাম।

: আম্মু, মৌ ওরা যাবে না?

পলি কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেলাে। সে রাতের ঘটনা মনে পড়েছে হয়তো।

: হা, সবাই যাবে। তােমার আম্মুর আজ টেলিভিশনে রেকডিং আছে তো? তাই একদিন পরে আসবে মৌ কে নিয়ে। তার পর দেখবে কী মজা হয়।

: দারুণ মজা হবে।

পলি আমার কথা বিশ্বাস করেছে।

একঘণ্টা পর কোস্টার আমাদের নারায়ণগঞ্জের মাঝখানে নামিয়ে দিলাে।

দু এক বন্ধু বান্ধব, পরিচিত লােক আছে শহরে। তাদের ওখানে ইচ্ছে করলে ওঠা যায়। কিন্তু পলির ব্যাপারে, জবাবদিহি কী করবো? তাছাড়া অচেনা বাসায় ও সহজে খাপ খাওয়াতে পারবে না।

রিক্সা নিয়ে এলাম টার্মিনালে। একটা চলনসই হোটেল বের করতে হবে। বাইরের চেহারা আর নামের বাহার দেখে মন টানছে না। শেষ পর্যন্ত টার্মিনাল থেকে বেশ দুরে শীতলক্ষ্যার ধার ঘেষে একটা নতুন হােটেল পাওয়া গেলাে। নাম এবং বহিরঙ্গে রুচির ছাপ। সৈকত হােটেলে তিনদিনের জন্য একটা ডবল সীটের রুম বুক করলাম। দুটো বিছান’ দেখে পলির আর সন্দেহ রইলো না যে, আম্মারা আসছে। আমার অবশ্য অন্যান্য বোর্ডার ও হোটেলের কর্ম- ‘চারীদের সন্দেহভরা চোখ দেখে অস্বস্তি লাগছিলাে। কী ভাবছে কে জানে ?

রুমের সামনে ব্যালকনি থেকে নদী চোখে পড়ে। জীবনে এই প্রথম পলি জাহাজ দেখছে। একসঙ্গে এতো রং বেরং এর পাল তােলা নৌকা ও আগে দেখেনি। ওগুলো দেখতে দেখতে অাপাততঃ ও আম্মু দের ভুলে আছে।

: আব্বু, কোন্ জাহাজে করে আমরা চঁদিপুর যাবে? ঐ টা ? একটা অতিকায় তিনতলা কার্গোশিপের দিকে পলি আঙুল তুললাে।

: না, মা। এটা সমুদ্রের জাহাজ। খুলনা যাবে। আমাদেরটা এর চেয়ে ছােট। এখন ঘাটে আছে।

রাতে ট্রানজিস্টারটা বুকে চেপে অন করেই পলি ঘুমিয়ে পড়লাে। রেডিও পিকিং ধরা ছিলো। আমি বন্ধ করে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। হু হু বাতাস। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। বৃষ্টি হতে পারে। মানুষে বােঝাই একটা দোতলা লঞ্চ চলে গেলো। চাঁদপুর, না হয় বরিশাল যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জে আমাদের তিনদিন কেটে গেলাে। এর মধ্যে আমি পলিকে নিয়ে মুনশীগঞ্জ ঘুরে এসেছি। একদিন ডিঙি ভাড়া করে চলে গেলাম দুরে অচেনা এক গ্রামে। মেলা হচ্ছিলাে। যা চাইলো পলিকে আমি তাই কিনে দিলাম। তবু যদি শান্ত থাকে।

সন্ধ্যায় ওর পেট ব্যথা শুরু হলো। বাইরে মশলা দেয়া খাবার পেটে সহ্য হয়নি। চিন্তা হতে লাগলাে আমার। এদিকটা আমি ভেবে দেখিনি। বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ হল রুকু সামলায়। এ ব্যাপারে আমি অনভিজ্ঞ। ঢাকায় চেনা ডাক্তার আছে। এখানে কার কাছে যাবো ?

রাত নটার দিকে পেট চেপে কাদতে শুরু করলে পলিকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পলাম। কলেজের পুরনো বন্ধু মফিজ থাকে নোয়া মাটিতে। এখন ও একমাত্র ভরসা।

মফিজ ওর বউকে নিয়ে গিয়েছিলো সিনেমায়। বাচ্চা কাচ্চা নেই। নিঝঞ্চাট সংসার। ওরা বোধহয় কাপড় ছাড়ছিলাে। দরজায় আমাকে আর পলিকে দেখে দুজন হতভম্ব।

: আগে একজন ডাক্তার ডাক। মেয়েটার পেট ব্যথা। পরে কথা হবে। মফিজ লুঙি গেঞ্জি পরে ছুটে গেলো।

ডাক্তার অষুধ দিয়ে সাবধান করে গেলেন, হােটেলের খাবার মেয়ের জন্য বিষ। ফুড পয়জনিং হতে পারে যে কোনাে সময়।

ভাবলাম, পলিকে নিয়ে দুটো দিন এখানে থেকে যাই। আদর যত্নের অভাব হবে না। মফিজের বউ পলির ভেতর যেন নিজের মেয়েকে পেয়েছে।

এদের নিজেদের বাড়ি। একটা ঘর ছেড়ে দেয়া হলো আমাদের । সূত্র যাবার আগে মফিজের বৌ বারবার জিজ্ঞেস করছিলাে- কি ব্যাপার’ । আমার গড়িমসি দেখে নিজেই ধরে নিয়েছে, রুকুর সঙ্গে ঝগড়ার পর আমি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

: আব্বু, আম্মুরা আসছে না কেন?

শুয়ে শুয়ে পলি জিজ্ঞেস করলাে। ট্রানজিস্টারটায় বিদঘুটে ভাষায় গান বাজছে।

: এই এসে যাবে মামণি। আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। মিথ্যেটা বলে আমি ওর দিকে তাকালাম।

: কখন ফোন করেছে আব্বু? আমাকে বললে না কেন?

: ও, আজ সকালে। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে।

: আবার করলে আমাকে বলবে।

: হঁ্যা মা বলবো। এখন ব্যথা লাগছে ? পলি দু’দিকে মাথা নাড়লো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। রুকুকে কালই ফোন করতে হবে।

হােটলের ম্যানেজার আমাকে দেখে সীট থেকে উঠে এলাে— আরে ভাই আপনে তাে সাংঘাতিক মানুষ। এমন একটা অসুইখা মেয়েরে নিয়া রাত দশটার সময় সেই যে বার হইলেন, আর ফিরার নাম নাই। আমি এখন থানায় যাইতে লইছিলাম। আপনের মেয়েটা কই।’

আমি সব বললাম। হোটেল ছেড়ে দেবাে শুনে কালাে হয়ে এলো তার মুখ—‘কোনাে অসুবিধা হইছিল ? তাইলে বলেন আরো ভালাে রুম দেই।

আমি বানিয়ে বললাম, আমার স্ত্রী এবং আরেক মেয়ে নয়া মাটিতে এক বন্ধুর বাসায় এসে উঠেছে। আমরা এখানেই থাকবাে দু’দিন।

রুমের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমি ফোনটা ব্যবহার করতে চাইলাম।

: কোনো অসুবিধা নাই । করেন। ম্যানেজার সাহেব আমাকে একটা চেয়ার ছেড়ে দিলাে।

: ওগো, আমি তােমার পায়ে পড়ি, তুমি পলিকে নিয়ে এসাে। তুমি মানুষ না আর কিছু? আমাকে এ ভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছে? ওপাশে রুকুর কান্না ভেজা গলা শােনা গেলো। ‘ তাহলে আমার শর্ত মানতে হবে। মৌ কে এখনি সরাও।

: না না। ও কথা আর না। ও আমাদের মেয়ে। ওকে নিয়ে অনেক হয়েছে। আর না।

: ঠিক আছে। পলিকে তুমি আর দেখতে পাবে না। রুকুর বিলাপের শব্দ শুনতে পাচ্ছি ফোনে। তারপর —-

: আমাকে না হয় তুমি কষ্ট দিয়ে মজা পাচ্ছে। কিন্তু পলি কী দোষ করলাে। তুমি যে ওকেও কষ্ট দিচ্ছে।

: পলি আমার কাছে ভালো আছে। অর্থাৎ নিরাপদ। তােমার মৌ-এর সঙ্গে থাকলে ও মারা পড়বে যে কোনাে সময়। রুকু, এখন সময় আছে মৌ কে তাড়াও। ও পিশাচ।

: তুমি পাগল হয়ে গেছে। বদ্ধ পাগল। এতােদিন বুকে নিয়ে মানুষ করার পর এখন আমি মা হয়ে,  হঠাৎ রুকুর কথা থেমে গেলাে। রিসিভার চেপে ধরে নিচু স্বরে কী যেন বললো। নিশ্চয় মৌ এসে দাড়িয়েছে পাশে। আমি বললাম ‘কে, ওটা?

: মৌ। আমি এখন কথা বলতে পারছি না।

: না, রুকু। একটা রফা করতেই হবে। এখনি। পলি অথবা মৌ—দুজনের একজনকে তােমার বেছে নিতে হবে। হ্যালাে, শুনতে পাচ্ছো ?

: শুনছি। আমি ফোনে বলতে পারছি না। তােমার সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলতে হবে। তুমি কোথায় আছে বলো, আমি আসছি।

: তোমার আসার দরকার নাই। আমি নিজেই আসবাে।
: আজ ক’টার সময় ?

: আজ না, কালও নয়। আমি পরশু দুপুরে আসবাে।

তােমাকে চিন্তা করার দু দিন সময় দিলাম। এটা আমার ফাইনাল কথা।

: কিন্তু পলি ? কঁদছে না ও আমার জন্য?

: সে আমি ম্যানেজ করবাে। রুকু মনে রেখাে পলি অথবা মৌ। যে কোনাে একজন।

রুকু কান্না চাপার চেষ্টা করছে। আমি ফোন রেখে দিলাম। ম্যানেজার বােকার মতাে হাসলাে। কিন্তু চোখে হাজারটা প্রশ্ন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি রিক্সায়।

মফিজের বাসায় পলি মনমরা হয়ে আছে। এভাবে বাড়ির বাইরে আম্মুকে ছেড়ে ও কোনােদিন থাকে নি। সবার অগােচরে ও কঁাদো- কাঁদো গলায় আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে—আম্মুরা আসছে না কেন। এটা সেটা বানিয়ে বলতে আমার আর ইচ্ছে হচ্ছিলাে না। কিন্তু উপায় নেই।

একটা দিন কোনাে রকম পার হয়ে গেলাে। রাতে পলি কাঁদতে শুরু করলে আমি বললাম, কাল ওদের আনতে আমি ঢাকা যাচ্ছি।

: তুমি একা থাকতে পারবে না। মফিজ কাকু আর আন্টি তোমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে। টারজান। পলি মাথা নাড়লাে। পারবে। মফিজ আর ওর বৌকে আমি সকালেই বলে রেখেছিলাম।

: সে কি কথা? এটা আবার এমন বিনয় করে বলতে হবে ? পলির জন্য কোনাে চিন্তা করবেন না। আপনি নিশ্চিন্তে ঢাকা গিয়ে ভাবীকে নিয়ে আসতে পারেন। তবে ভাইজান, চাঁদপুর যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় দু’দিন থেকে যেতে হবে।

মফিজের বৌ আমাকে আশ্বস্ত করেছিলাে। চাঁদপুরের ব্যাপারটা বিশ্বাস করে নি মফিজ। কিন্তু ও এ নিয়ে আমাকে কোনাে চাপা- চাপিও করে নি। দু’দিন সময় পেয়েছে রুকু। একটা সিদ্ধান্তে এতােক্ষণে আসতে পারার কথা। হয় পলি, নয় মৌ।

আমার ভাগ্য ভালাে, বাসায় ঢোকার সময় অন্যান্য ফ্ল্যাটের কারো সঙ্গে মুখােমুখি হতে হয় নি। নিশ্চয় প্রচুর জল্পনা কল্পনা হচ্ছে আমাকে নিয়ে । তেতলায় বৌদিদের সামনের দরজায় তালা । আমি চার তলায় উঠে বাসার বেল টিপলাম। ভেতরে শব্দ নেই। আরাে তিনবার টেপার পর আমি বেলে আঙুল চেপে রাখলাম। কয়েক সেকেণ্ড। তখনাে কোনাে শব্দ নেই। আমার আসতে এক ঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। অপেক্ষা করতে করতে রুকু ঘুমিয়ে পড়ে নি তো ! কিন্তু যে ভাবে বেলের শব্দ হয়েছে, তাতে মরা মানুষ জেগে ওঠার কথা।

হঠাৎ আমার চোখ গেলাে দরোজার হাতলে। চকচকে স্টিলের ওপর জমাট বাঁধা রক্ত। ছােট দুটো আঙুলের ছাপ পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে। হাত ঘােরাতেই দরজা খুলে গেলো। আমার বুক টিপ টিপ করছে। বাসায় তাহলে কেউ নেই। চোখ বুজে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

ড্রয়িং রুমের ফ্যান ঘুরছে। অনেক কষ্টে আমি রুকুর নাম ধরে ডাকলাম। সাড়া নেই। শােবার ঘর, কিচেন, বাথরুম কোথাও রুকু বা মৌ এর চিহ্ন নেই। পলিদের ঘরে ঢুকতেই আমার কান ঝাঁঝা করে উঠলো। চারদিকের দেয়ালে পলির আঁকা ছবিগুলো টেনে খুলে ফেলা হয়েছে। সে জায়গায় অগােছালাে ভাবে সাটা মৌ-এর কিছু উদ্ভট ড্রয়িং। শো কেসে পলির খেলনা গুলােও নেই । ওর সমস্ত চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চকিতে আমার এ্যালবামটার কথা মনে হলাে। যেটা কিছুকাল আগে ওল্টাতে ওল্টাতে আমি দেখেছিলাম, ফাহিম, মন্টিদের ছবিঅলা পাতাগুলো ছেড়া। এসব মৌ-এর কাণ্ড। কিন্তু মেয়েটার এই সাহস কীভাবে হলাে? রুকু কিছুই বললাে না। আর, পুরাে বাসা এভাবে খোলা রেখে চলে যাবার মেয়ে রুকু নয়। আমার গা গুলিয়ে আসছিলাে। নিচে নেমে এলাম। বৌদিদের বাসায় তালা। দোতালার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলাে না। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। দরােজার অটোমেটিক হাতলটা ভেতরের বাটন টিপে লাগিয়ে এসেছি।

হাঁটতে গিয়ে টলে যাচ্ছিলাম। দরজার হাতলে রক্ত, দরজা খােলা। রুকুর কিছু হয়েছে ? দুপুরে ওর বাসায় থাকার কথা। আমি আসবে কথা দিয়েছিলাম। বৌদি’দের বাসায় তালার ব্যাপারটাও রহস্যময় লাগছিলাে। বায়তুল মােকাররমে অন্যমনস্ক ভাবে সেদিনের পত্রিকাটার পাতা উল্টাচ্ছিলাম। টেনশনে সকালে ভালাে করে কাগজ পড়া হয়নি। সিনেমার পাতায় ছােট্ট একটা খবরে আমার চোখ আটকে গেলাে।

তিন লাইনের একটা খবর। মাথায় বারাে পয়েন্ট বােল্ড টাইপের হেডিং—‘দুর্ঘটনায় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী আহত। গত পরশু সন্ধ্যায় সিড়িতে পা পিছলে পড়ে রুকু গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এখন আছে মেডিক্যাল কলেজে। কাগজটা কিনে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। হাসপাতালে একা, না পলিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে তুলে এক সঙ্গে যাবে, বুঝতে পারছি না। রুকু কী অবস্থায় আছে, কে জানে। আমাকে একা দেখে অবস্থা যদি খারাপ হয়ে যায়। দু’ঘণ্টার মধ্যে পলিকে নিয়ে আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে।

ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকে মাথা ঘুরে উঠলাে। পলি শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছে। বিশাল হল ঘরটা জুড়ে কেবল গােঙানি আর কাতরানির শব্দ। সবাই মহিলা। একেকটা বেড় ঘিরে রয়েছে রুগীদের আত্মীয়স্বজন। কিন্তু রুকুকে এখন খুজে বের করি কীভাবে? দু’জন নার্স যাচ্ছিলাে ওষুধের ট্রে হাতে নিয়ে। আমি রুকুর পুরো নাম বলাম।

: আপনি !

: আমি ওর হাজব্যান্ড। কোথায় আছে ও?

: ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডে যান । উনি ভালাে আছেন। আমি দ্রুত পলির হাত ধরে বেরিয়ে এলাম। শুনলাম নার্স মেয়েটি পাশের নার্সকে ফিস ফিস করে বলছে—‘রোকেয়া মল্লিক, ভালাে রবীন্দ্র সংগীত গায়—হাজব্যাণ্ড।

রুকু আর ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ড, দুটো আমি মেলাতে পারছিলাম না। বেডের অভাবে ওখানে অবশ্য নিয়ে যেতে পারে। সেই পরিচিত দৃশ্য। প্রতিটা বেডের সামনে জটলা।

: আব্বু, আব্বু, ওই যে!

লােকজনের ভেতর একে বেঁকে পলি ছুটলো। আমি দেখলাম, ওয়ার্ডের শেষ মাথায় দেয়াল-ঘেষা একটা বেড থেকে রুকু আমাকে হাত নাড়ছে।

অনেকক্ষণ কথা হলাে না। রুকু পলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে। এক সময় চোখের পানি মুছে তাকালে আমার দিকে।

: কী হয়েছিলাে?

: সিড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকার ছিলাে।

: এখন কেমন লাগছে?

: ভালাে। তবে ব্লিডিং হয়েছে।

রুকুর একটা পা ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বাঁধা। বেচারী পলির জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাে, এর মধ্যে এমন একটা দুর্ঘটনা। টুকিটাকি কথার পর আর বলার কিছু থাকে না। আমি চুপচাপ বসে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। পলি আম্মুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গত কয়েক দিনে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছে। মৌ কে না দেখে প্রথমেই আমার খটকা লেগেছিলো। প্রসঙ্গটা তুলতে ইচ্ছে হলো না।

: আচ্ছ, শুক্লা বৌদিরা কোথায় ? ওদের ঘরে তালা দেখে আসলাম।

সিলেট গেছে সবাই। অজয়দা’র শুটিং হচ্ছে। পনেরো দিন থাকবে। মৌ ও গেছে।

: আশ্চর্য, আমি ভেবেছিলাম শহরে কোথাও বেড়াতে গেছে। আমাদের বাসায় দরজাটা এ রকম খােলা।

: তুমি রাগ কোরো না। ভুলটা আমারই। কিন্তু কী করবাে বলাে? হসপিটালে আনার সময় আমি সেন্সলেস ছিলাম। আর এ্যাক্সিডেন্টটা হলোও এমন সময় । অজয়দা’রা যাবার জন্য মাত্র রেডি হয়েছে। যাই বলো, ওরা না থাকলে আমি বােধহয় মরেই যেতাম। অজয়দা নিজে দৌড়াদৌড়ি করে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। স্বামী স্ত্রী দু’জন সারারাত ছিলাে হাসপাতালে। সিলেট যাওয়াও ক্যানসেল করতে চেয়েছিলাে। কিন্তু আমি তখন মােটামুটি ভালাে। ব্যথা কমে এসেছে। ব্লিডিং নেই। আমার কথায় আশ্বস্ত হবার পর ওরা গেল গতকাল সকালে।

রুকুর ব্লিডিং এর ব্যপারটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। পা পিছলে পড়লে হাত পা ছড়ে গিয়ে সামান্য রক্ত পড়ার কথা। কিন্তু প্রফিউজ ব্লিডিং !

: তােমার ডাক্তার কে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

: ওই যে, আসছে।

মধ্যবয়স্ক, সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে এদিকে আসছেন।

: স্লামালেকুম।

: ওয়ালাইকুম। আপনি বােধহয় এর স্বামী।

আমি উঠে দাড়িয়েছি। ভদ্রলােক আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমরা বারান্দায় এসে দাড়ালাম।

: আপনার লাক ভালাে যে, মহিলাকে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে আনা হয়েছিলাে। সামান্য দেরি হলে তাকে বাঁচানাে যেতাে না। আর পড়াটা এমন মারাত্মক ছিলাে•••।

: কিন্তু ডাক্তার সাহেব, ব্লিডিং-এর ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না।

: স্টেঞ্জ, আপনি জানেন না! শী ওয়াজ প্রেগনেন্ট। জোরে পড়ার জন্য মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। আমার মুখ হাঁ হয়ে গেলো।  পরক্ষণে সেটা বুঝতে পেরে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। আমি দুঃখিত। বাচ্চাটা মরে গেল। তবে আপনার স্ত্রী এখন সেফ। পাঁচ-ছ’ দিন পর রিলিজ করে দেবে। ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। আমি ফিরে এলাম রুকুর কাছে।

: রুকু, তুমি আমাকে এটা আগে বলেনি কেন?

: পরশু সকালে যখন তুমি ফোন করলে, তখনই বলতে চেয়ে- ছিলাম। কিন্তু এমন নাটক আরম্ভ করলে যে••• থেমে গেলাে রুকু। হঠাৎ আমার মাথায় চিন্তাটা এলাে।

: আচ্ছা, তুমি কি মৌ কে বলেছিলে ? কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুকু বললাে, : সেদিনই বিকেলে। আমি নিজ থেকেই বলেছিলাম।

: তারপর ?

তারপর আর কি। তােমার সঙ্গে কথার পর আমার মন ভালাে ছিলাে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত শুয়ে ছিলাম। মৌ নিচে, বৌদির বাসায়। সাতটার দিকে ও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললাে, বৌদি আমাকে ডাকছে। আমি উঠে বেরিয়ে গেলাম। সিড়ির চারটা কি পাঁচটা স্টেপ পেরিয়েছি, আর তখনি’। আর কিছু মনে নেই। ও সিড়িতে লাইট ছিলাে না?

: না, পরশু ছিলাে না। কিন্তু আগের দিনও ছিলাে। রুকু পলিকে চুমু খেলাে। ঘটনা আমার কাছে তখনাে ধোঁয়াটে। অজয় বাবু অথবা বৌদিকে পেলে সব জানা যেতাে।

পলিকে রুকু রেখে দিলাে। আমি আপত্তি করলাম না। ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। রুকুর কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।

রিক্সায় বাসার দিকে যেতে যেতে আমি ঠিক করে ফেলি, আগামী পনেরাে দিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করতে হবে । মৌ এ বাড়িতে আর ঢুকতে পারবে না। কাল সকালেই যাবো ধানমণ্ডিতে। এখানে বিদেশীদের একটা এতিমখানা আছে, চিলড্রেনস ভিলেজ। সিড়ির মুখে দারোয়ান আমাকে দেখে সালাম দিলাে। বয়স্ক হলেও এখনাে পেটা শরীর। কোনো কালে হয়তাে পুলিশে ছিলাে। আমার সঙ্গে ওর কদাচিৎ দেখা হয়।

: স্যার, একটু খারান।

বলে ও চলে গেলো একতলা সিড়ির নিচে। ফিরে এসে একটা কাগছে জড়ানাে বস্তু আমার হাতে দিয়ে বললো, এইটা আপনেদের সিড়িতে পাইছি। খুব সম্ভাব, আপা না দেইখা এইটার ওপর পারা দিছিলাে। কাগজের মোড় খুলে দেখি, বস্তুটা। আমার অতি চেনা। একটা তুলোর পুতুল। মৌ-এর তৃতীয় জন্মদিনে আমি প্রেজেন্ট করেছিলাম। কিন্তু ও ভালো করে ছুয়েও দেখেনি। যত্নে ওটা এতােদিন পড়ে ছিলাে পলিদের শোবার ঘরে আয়রন -সফের কোণায়। রুকু বলতো’, মৌ পুতুল পছন্দ করে না।

: বাচ্চাতাে। বােঝে নাই। খেলতে খেলতে সিড়িতে ফালাইয়া গেছে।

দারােয়ানের কথায় আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম।
: হ, বাচ্চা মেয়ে। বােঝে নি।

রক্তের ছোপ লাগা পুতুলটা হাতে নিয়ে আমি ওপরে উঠে এলাম। আমাদের সিড়িতে লাইট জ্বলছে।

সারারাত সব কটা ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখলাম। ঘুম এলাে না। মৌ-এর কথা মনে হতেই আমার রক্ত হিম হয়ে আসছে। হায়, রুকু! তুমি এই এক্সিডেন্টের পরও কেন বুঝতে পারছে না, ও তােমার কোনো সন্তানকে বাঁচতে দেবে না। শেষ পর্যন্ত, ও তোমার পেটের বাচ্চাকেও খুন করলো। এখন পলিকে শেষ করতে পারলে ওর শান্তি। আমি আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবাে না। ও আমরি পুরুষত্ব নষ্ট করে দিয়েছে।

চিলড্রেনস হােমের পরিচালককে রাজী করানাে গেলো না। এ ধরনের শিশু তারা নেন না। এটা কেবলমাত্র অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য। যাদের বাবা মা কেউ নেই।

: দেখুন, এ মেয়েটাও অনাথ। একে আমরা পালক নিয়েছিলাম

: কিন্তু জন্ম থেকে আপনাদের সঙ্গে ছিলাে। আপনাদের ফ্যামি- লির একজন হয়ে গেছে।

: আমরা ওকে আর রাখতে চাই না। আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, ওকে আমরা সামলাতে পারি না। আমি মরীয়া হয়ে বললাম।

: আই এ্যাম নট কনভিনসড। ঠিক আছে, ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঠিকানা রেখে যান।

আমার কার্ড দিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। কোনাে সম্ভাবনা নেই। অন্যপথ দেখতে হবে।

রুকু সুস্থ হয়ে উঠেছে। যে কোনাে দিন ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। আমি রােজ গিয়ে ওকে দেখে আসি। পলির সামান্য অসুবিধা হচ্ছিলাে। কিন্তু আম্মুকে না নিয়ে ও আসবে না।

অফিসে জয়েন করেছি। এম-ডি সাহেবের মুড খারাপ। দুটো বড়ো ক্লায়েন্ট ছুটে গেছে। আমার কাজে মন নেই। একটা উপায় বের না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলাম না । অজয় বাবুদের ফিরে আসার সময় হয়ে আসছে। যে কোনাে দিন মৌ এসে উঠবে বাসায়। এর পর। না, পলিকে যে করে হােক বাঁচাতে হবে। প্রয়ােজনে আমি মৌ কে খুন করবো। হ্যাঁ, খুন করবাে।

সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে ফেললাম। সিলেটের জাফলং-এ অজয় বাবুর শুটিং হচ্ছে। রুকু বাসায় ফিরে এলেই আমি চলে যাবাে ওখানে। শুক্লা বৌদির নিশ্চয় অবাক হবে না। ভাববে মেয়ের টানে চলে এসেছি। সেদিনই মৌ কে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে একটা টিলার মাথায়। তারপর সেখান থেকে…। যাবজ্জীবন জেল, ফাঁসি যাই হােক, এখন এটাই একমাত্র রাস্তা। আমার সান্ত্বনা থেকে যাবে, সন্তানদের অন্ততঃ একজনকে আমি বাঁচাতে পেরেছি।

রুকু ভালাে হয়ে ফিরে এলাে। ঘরদোর এলােমেলো হয়ে পড়ে আছে। পলিকে নিয়ে ও জিনিসপত্র গােছগাছ করে রাখে। আমি দেখি। আমার কিছু ভাল্লাগছে না। মৌ কে নিয়ে যাবে। একটা উচু টিলার ওপর। তারপর সেখান থেকে। আমার মাথায় এখন এক- ‘টাই চিন্তা।

দু দিন থেকে কালবােশেখী শুরু হয়েছে। বিকেল না হতেই পশ্চিম আকাশে ঘন কালো মেঘ। তারপর ঝড় বৃষ্টি। সেদিন দুপুর থেকে আকাশ ভারি হয়ে আছে। আমি ঠিক করেছি, কাল সকালের ফ্লাইটে সিলেট যাব, সেখান থেকে জাফলং। হাতে একদম সময় নেই।

একটা ডিসপ্লে বিজ্ঞাপনে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছিলাম। এমন সময় রিসিপশনিস্ট ফোনে বললো, স্যার, আপনার স্ত্রী এসেছেন। পাঠিয়ে দেবো?’

: আমার স্ত্রী? কী বলছেন?

: ইয়েস স্যার ।

: কী নাম বলেছে?

: রােকেয়া মল্লিক।

রিসিপশনিস্টের কথা শেষ হলাে না, রুকু হুড়মুড় করে আমার রুমে ঢুকে পড়লো। চুল এলােমেলো, পরনে একটা সাধারণ শাড়ি। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

: রুকু! তুমি।

: হ্যাঁ, আমি।

ও আমার দিকে আগুনদৃষ্টি নিয়ে তাকালাে।
: কী হয়েছে ?

: কী হয়নি, বলাে। আচ্ছা, তুমি আমাকে পাগল না বানিয়ে ছাড়বে না।

: আরে, কী হয়েছে বলে না?

: তুমি এতিম খানায় গিয়েছিলে কেন ? ভেবেছাে মৌকে তুমি ইচ্ছে করলেই তাড়াতে পারবে?

: কিসের এতিমখানা ? আবােল-তাবোল বোকো না। আমি না বােঝার ভান করলাম।

: আবার এ্যাক্টিং করছো? ধানমণ্ডির এক চিলড্রেন্স হােম থেকে মৌ কে নেয়ার জন্য লােক এসেছিলো। ওরা মৌ-এর কথা কী “ভাবে জানলে ?

: আস্তে রুকু। এটা অফিস। মাথা ঠাণ্ডা রাখাে। আমিই ঠিকানা দিয়ে এসেছি। মৌ কে ওরা নিয়ে যাবে। আমাদের বাসায় ও আর ঢুকতে পারবে না।

: না। কিছুতেই না। মৌ আমাদের মেয়ে।

: ও আমাদের মেয়ে না রুকু। ও একটা পিশাচ। ও আমার তিন ছেলেকে মেরেছে। এখন পলিকে মারতে চায়। তোমার পেটের বাচ্চাকে ও নিজের হাতে খুন করেছে। তুমি সিড়িতে পিছলে পড়ে গিয়েছিলে কেন? ওর পুতুলটায় পা পড়েছিলাে, এই তাে ?

: হ্যাঁ, কী বলতে চাও তুমি? একটা বাচ্চা মেয়ে পুতুল ভুলে সিড়িতে রেখে আসতে পারে না?

: ভুলে নয় রুকু। ও ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে ওটা রেখে এসে ছিলো। কারণ সেদিন বিকেলে তুমি ওকে বলেছিলে, তােমার পেটে বাচ্চা। আর, তুমি নিজেই তাে বলতে, মৌ পুতুল পছন্দ করে না। সেদিন হঠাৎ ও পুতুলের মধ্যে কী পেলো?

রুকু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলে তারপর।

: আমি বিশ্বাস করি না। এ সব তােমার কল্পনা। মেন্টালি অসুস্থ একজন মানুষের কল্পনা। তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছে। উন্মাদ না হলে নিজের মেয়েকে নিয়ে এসব কেউ ভাবতে পারে না।

: ও আমাদের মেয়ে না।

: হ্যাঁ, আমাদের। আমাদের।

রুকু গলা চড়িয়ে বললাে। ওকে বােঝানাে যাবে না। ঠিক করলাম, রুকু বেরিয়ে গেলেই আমি সােজা কমলাপুর স্টেশন। সিলেট যাব আজকের ট্রেনেই।

: তােমার কি চোখ বলে কিছু নেই। তুমি কি দেখোনি পলি আর মৌ-এর মধ্যে কী ভাব! কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। আমি এই তো দেখে এলাম•••

: দেখে এসেছে? কী দেখে এসেছে?

আমি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে রুকুর কাধ ধরে ঝাকাতে লাগলাম।

: পলি আর মৌ আপন মনে খেলছে। রুকু স্বাভাবিক গলায়
বললো।

: তার মানে মৌ ফিরে এসেছে। ওদের সামনে শনিবার আসার কথা ছিলাে না?

: সিলেটে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। অজয়’দা শুটিং প্যাক আপ করে চলে এসেছে।

: রুকু, তার মানে এই মুহূর্তে পলি আর মৌ বাসায় একা।

: হ্যাঁ, কী হয়েছে তাতে? ওরা খেলছে।

: একি সর্বনাশ করলে তুমি।

আমি ঘামতে শুরু করেছি। রিসিপশনিস্টকে বাসার নাম্বারে লাগাতে বললাম। একেকটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে একেকটা মিনিট।

: স্যার রিঙ হচ্ছে।

রুকু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

ও হ্যালাে ।

পলির চিকন গলা শুনতে পেলাম ওপাশে।

: হ্যালাে, পলি মা, আমি আব্বু, বলছি।

: ওহ, আব্বু!

: হ্যা, মা মনি। সব ঠিক আছে ?

: হ্যা, আব্বু। কিন্তু•••

: কিন্তু, কিন্তু কী ?

: না, ইয়ে মানে মৌ•••।

আমার শরীর কাপতে শুরু করেছে।

হাতুড়ি পেটার শব্দ পাচ্ছিলাম বুকের ভেতর। পলির গলায় আতঙ্ক।

: মৌ•••মৌ কী হয়েছে ?

: ও জানি কেমন করছে আব্বু।

: কেমন করছে মানে?

: আমি যেখানে যাই, আমার পেছন পেছন আসছে। কোনাে কথা বলছে না।

: তােমার সঙ্গে খেলতে চায়, মা।

: না, আব্বু। খেলা না। ও আগে কখনাে এরকম করে নি। আমার দিকে কেমন করে জানি তাকাচ্ছে। এখনাে তাকিয়ে আছে। ভয়ে কথা আটকে আসছে পলির। রুকু উঠে এলো আমার কাছে—কী আরম্ভ করেছে? দেখি ফোনটা …..

ও রিসিভার কানে লাগাতে আমি সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিলাম। আমার নখের আঁচড় লেগে ওর কজির কাছটায় কেটে গেলাে। শােন পলি। মা মনি, শুনতে পাছাে ?

: হ্যা, আব্বু!

: শােনো আমি যা বলছি। তুমি ফোন রেখে শুক্লা খালার বাসায় চলে যাও। আমি এবং আম্মু, না আসা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকবে। বুঝতে পারছো মা?

: আব্বু, দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে লাগানাে। পলি কাদো কঁদো হয়ে বললাে।

: সেকি! তুমি ওদের বাইরে থেকে আটকে এসেছো? আমি রুকুর দিকে তাকালাম।

: না তো।

: সত্যি করে বলো, তুমি ওদের আটকে এসেছ কি-না। বলাে ? রাগে-ভয়ে আমার তখন জ্ঞান নেই। কোনােমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ও বললো-“আমার কথা তােমার বিশ্বাস হচ্ছে না?

: পলি বলছে দরােজা বাইরে থেকে লাগানাে। চাবি কোথায় থাকে ?

: যেখানে থাকার সেখানে আছে। ড্রেসিং টেবিলের ডান দিকের ডুয়ারে। কিন্তু তুমি ভালো করে জানো, মেয়েদের ঘরে আটকে রেখে আমি কোনােদিন বের হই না।

: পলি, মা, শোনাে।

: হ্যাঁ, আব্বু।

: ড্রেসিং টেবিলের ডান দিকের ড্রয়ারে চাবি আছে। আমি ফোন ধরে রাখছি। তুমি লাইন কেটো না। জলদি গিয়ে চাবিটা নিয়ে এসে। তারপর বলছি কী করতে হবে।

পলি রিসিভার টেবিলে নামিয়ে রাখলাে, শুনতে পেলাম। এক সেকেণ্ড। দুই সেকেন্ড। তিন সেকেণ্ড।

: কী হয়েছে ? আমি কি শুনতে পারি না?

রুকুর প্রশ্নের আমি উত্তর দিলাম না। শ্বাস বন্ধ করে আছি, কখন, পলি আবার মােন তুলে নেয়।

: আব্বু।

: হ্যা, মা। বলো।

: চাবিটা ড্রয়ারে নাই।

আমার মনে হলাে, মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যাবে।

: ভালাে করে খুঁজে দেখছাে ?

: হা ।

: ঠিক আছে, ভয় নাই।

আর কী বলবাে আমি? মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু পলিকে বাঁচাতেই হবে।

: হ্যালাে, পলি কোনাে ভয় নাই। আমি আর আম্মু, এক্ষুনি চলে আসছি। এর মধ্যে তুমি মৌ থেকে দূরে থাকবে।

: হ্যাঁ, মৌ-এর কাছে•••

লাইন কেটে গেলাে। ফোন রেখে আমি রুকুকে বললাম-“পলিকে জীবিত দেখতে চাইলে জলদি চলো, এক দম সময় নাই।

: কী হয়েছে বলবে তাে?

রুকু বসে থেকেই গা-ছাড়াভাবে বললাে।

: তুমি, যাবে কিনা!

রুকু তখন একইভাবে বসে আছে। আমি হঁ্যাচকা টানে ওকে উঠিয়ে রুমের বাইরে নিয়ে এলাম। অফিসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। এম ডি সাহেব ছুটে এলেন— মারুফ সাহেব, মারুফ সাহেব।

: ও পরে কথা হবে স্যার।

রুকুকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসেছি মাত্র, চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলাে। সঙ্গে তুমুল ঝড়।

: ভাই, একটু জলদি চালান। ডবল ভাড়া পাবেন। উল্টো বাতাসে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডেলে চাপ ছিল রিকসাঅলা।

পুরানা পল্টনে আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় যখন আমরা এসে নামলাম, শোঁ শোঁ বাতাস বইছে। সেই সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। বাতি না চলে যায়। দুজন ভিজে একাকার।

ওই তো পলি। জানালায় মুখ রেখে দাড়িয়ে আছে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম। ও নীচে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পেলাে।

ঃ কী হয়েছে ?

রুকু আমার হাত ঝাকাতে ঝাকাতে বললাে,
: দেখতে পাচ্ছেনা ?

পলির মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য। বার বার চমকে পেছনে তাকাচ্ছে। চারতলায় আমাদের ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ঝড়বৃষ্টি । চীৎকার করে ও কী বলছে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলামনা। ঠোঁট নাড়া দেখে মনে হলাে, ও মৌ শব্দটা উচ্চারণ করছে। কী করি। আশেপাশে কোনাে মানুষ নেই। পলিকে ওখানে রেখে নড়তেও পারছিনা।

: রুকু তুমি জলদি ওপরে উঠে যাও।

শুক্লা বৌদিকে ডাকো।

আমি চীৎকার করে বললাম। রুকু বাতাসের তােড় ঠেলে দৌড় দিলাে। জানালায় তাকিয়ে দেখি, পলি নেই। চকিতে আমার মনে হলে ভেতরের দরজা খোলা। ও নিশ্চয় পেছন দিকের বারান্দায় গেছে। জলকাদা, ড্রেন ভেঙ্গে আমি এসে দাড়ালাম বাড়ির পেছন দিকে। একতলার জানালা দিয়ে এক মহিলা অবাক হয়ে আমাকে দেখলাে। বারান্দা অন্ধকার। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালাে। ওই তো পলি। আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম।

: না, মা, না,••।

রেলিং ধরে পলি ঝুকে আছে। আবার বিদ্যুৎ চমকালাে। দেখলাম, ও আরাে ঝুকে পড়লো। ক্রমশ ঝুকছে। ঝুকছে। আকাশ চিরে গেলাে সবুজ তীব্র আলােয়। আমি দেখলাম, পলির পা দুটো হঠাৎ শূন্যে উঠে গেলো ও পড়ে যাচ্ছে চার তলা থেকে। পাঁচ মিনিট পর। পলির রক্তাক্ত, থাৎলানাে শরীরটা নিস্তেজ পড়ে আছে। চোখ দুটো খােলা। মনি ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পাশে দাঁতকপাটি লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রুকু। শুক্লা বৌদি মুখে কাপড় দিয়ে কাদছে। অজয় বাবু হতবুদ্ধির মতাে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছুটে এসেছে একতলা, দোতলা ফ্লাটের সবাই।

সেই ফাঁকে আমি ছুটলাম চারতলায়। আজ দরজা আটকানাে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাতল ঘােরাতেই দরজা খুলে গেলাে। মৌ আমাদের বেডরুমের দরজায় আমার চোখে চোখ রেখে দাড়িয়ে আছে। আমি এগিয়ে যেতেই ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করলো। তখন ভয়-ডর চলে গেছে আমার। ছুটে গিয়ে গলা চেপে ধরলাম। ঘড় ঘড় অমানুষিক শব্দ হচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর শক্তি। মনে হলাে আমার থেকে দশ গুণ শক্তিশালী একটা মানুষের সাথে লড়ছি। হাতের ঝাপটায় আমি ছিটকে পড়লাম দেয়ালে। কাছে যেতে পারছি না।

কিন্তু আজ ওকে শেষ করতেই হবে। আমি গায়ের সমস্ত শক্তি নিয়ে ‘ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ধারালো নখ দিয়ে আমার পিঠ ফালা ফালা করে দিচ্ছে। একট। থাবা এসে পড়লাে আমার মুখে। নােনতা রক্ত মুখের ভেতর চলে আসছে। ড্রেসিং টেবিলে রুকুর চুল কাটার কাঁচি পড়ে ছিলো। আমি ওটা তুলে নিলাম। কিন্তু বুকে বসাতে পারছি না। হাতে লেগে ফিরে আসছে। দুজনের শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছে। আমি আরেকবার ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সুবিধা করতে পারলো না এবার। মেঝেতে পড়ে গেলো। আমি সেই সুযােগে ওর গলা চেপে ধরলাম। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এমন সময়ে হৈ চৈ করে ঘরে ঢুকলো একদল লোক। সবার সামনে অজয় বাবু। এরপর আমার কিছু মনে নেই। পরে শুনেছি, মৌ কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার চিকিৎসা হয়েছে বাসায়।

এ যাত্রা রুকুকে ঠেকানো যাবে না। ওর আচরণে মানসিক রােগের উপসর্গ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আমার তা-ই মনে হলাে। প্রথম কদিন আমাকে দেখলে তেড়ে আসততা, অশ্রাব্য গালাগাল করতো। সব ছুির জন্য নাকি আমিই দায়ী। পুলিশের কাছেও ওর সেই অভিযোগ। আমি ঠাণ্ডা মাথায় সব সহ্য করেছি। আমি বােধ- হয় পাগল হবো না। হতে পারলে বেঁচে যেতাম।

কিন্তু আমার সান্ত্বনা একটা, মৌ’র ঘটনা ও বুঝতে পেরেছে। জানালায় পলির ভয়ার্ত, রক্তশুন্য মুখ—এ দৃশ্য তো কল্পনা নয়। নিজের চোখে দেখেছে ও। আর ওর রাগ সেখানে। ওকে কেন আমি ওই রূঢ়-ভয়াল সত্যের সামনে হাজির করালাম। হায়, নারী ।

সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। রুকু চলে যাবে। খুলনা থেকে ওর এক চাচাতাে ভাই আসছে ওকে নেয়ার জন্য । তৈরী হয়ে বসে

আছে ও দুপুর থেকে একই জায়গায়, নিশ্চল মূর্তির মতাে। বারান্দায় বসে আমি কিছুক্ষণ পরপর বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাচ্ছিলাম।

মাঝে মাঝে বিড় বিড় শব্দ। আমাকে বকছে হয়তাে। ওর জন্য আমার মায়া হলো। সুখ সবার জন্য নয়। নিয়তির ছকের মধ্যে ও, আমি সবাই ঝরা পাতার মতো। কেউ জানেনা, উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে পড়বে।

কলিং বেলের শব্দ। থেমে থেমে। রুকুর চাচাতো ভাইটা এলাে। মফস্বলের ছেলে। বেল টেপার অভ্যাস নেই হয়তাে। রুকু উঠে যাচ্ছিলাে।

: আমি যাই, রুকু। তােমার জন্য অন্তত এটুকু করতে দাও। ও দাড়িয়ে রইলো, হাতে ধরা একটা সুটকেস। আমি দরজা খুললাম।

পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাড়িয়ে বেলটা টেপার চেষ্টা করছে মৌ। আমাকে দেখে দাড়িয়ে পড়লাে। চলে এলাে দরজার সামনে।

: মৌ•••

ওকে দেখতে পেয়েছে রুকু। আমি দুজনের মাঝখানে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শিরদাড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা তরল ভয় বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার চোখ একবার আমার ওপর একবার রুকুর ওপর।

: আম্মু ।

মৌ-এর চোখ ছলছল করছে। চোখ ভরা নিস্পাপ শিশুর মিনতি। ঠোঁট কাপছে। গলায় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পাঁচ আঙুলের দাগ। কালাে হয়ে আছে। মেয়েটা কোখেকে, কার সঙ্গে এলাে। এলােই বা কিভাবে ?

রুকু বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাতের স্যুট- কেসটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলাে। চোখ ফেটে পানি নামছে, কান্না

চেপে রাখতে পারছে না। ও দু’হাত বাড়িয়ে দিলাে। মেয়েটার দিকে-মৌ•••আমার মৌ। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতাে ওর গলা।

: আম্মু।

মৌ এমন ভাবে ডাকলাে যেনাে ও এখানে নেই। দুর কোনাে গ্রহ থেকে ভেসে আসছে ওর কণ্ঠ। ওর রুকুর দিকে এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর এক দৌড়ে রুকুর কোলে। রুকু ওকে চেপে ধরলো।

মৌ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে আমার দিকে। বড় বড় চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য ধক করে জ্বলে উঠলাে। তারপর ফের স্বাভাবিক। আমার মাথার পেছনে সবগুলাে চুল দাড়িয়ে গেলাে।

মৌ আমার ওপর চোখ রেখে হাসছে। এ হাসি বিজয়ের না পরিতৃপ্তির বুঝতে পারলাম না। হয়তাে দুটোরই।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলাে। ঘরের বাল্বগুলো তির তির করে কাপছে। কাল এই সময় বাতি চলে গিয়েছিলাে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত