সপ্তম শ্রেণীতে উঠে যাবার পরেও শেফালীর দুরন্তপনা এতটুকুও কমেনি। স্কুলে কিংবা বাড়িতে, গাছে কিংবা পুকুরে, সব জায়গাতে তার ছুটাছুটি আর হৈ হুরুল্লা করা চাই। তার রিক্সা চালক বাবা সব সময় স্বপ্ন দেখেন মেয়েকে স্কুল পাশ করিয়ে ভাল ঘরে বিয়ে দিবেন। আর নিজে কিছু টাকা জমিয়ে একটা রিক্সা কিনবেন। অন্য দিকে শেফালীর স্বপ্ন, সে স্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক হবে। তাকে স্কুলের যে বেয়াদব বড় ভাইগুলো জ্বালাতন করে তাদের ইচ্ছেমত পেটাবে। কিন্তু তাদের বাপ বেটির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। যমুনার নদী তার নিষ্ঠুর গ্রাসে তাদের সর্বস্ব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আর তাতেই তাদের নতুন স্বপ্ন বাধা শুরু হল, কবে আবার আগের মত একটা বাড়ি বানাতে পারবে।
তারা দরিদ্র বলে ধনী আত্মীয় স্বজনেরা কেউ আশ্রয় দিল না। মা মরা মেয়েটিকে নিয়ে শেফালীর বাবা একটুকু মাথা গোজার ঠাই পেলেন সিরাজগঞ্জ রেল স্টেশনের ফুটপাতে। সেখানে সে কুলির কাজ করত আর অপরিপক্ব হাতে কিছু রান্নার চেষ্টা করত। তবু মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করলনা। এখানেই কোন রকম ভাবে তাদের দিনগুলো পার হয়ে যেতে থাকে। বছর ঘুরতেই শেফালী সাফল্যের সাথে পাশ করে নতুন স্বপ্ন নিয়ে অষ্টম শ্রেনীতে উঠে।
স্টেশনে আসার পর শেফালী সেখানকার সবচেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। এখন তার স্বপ্ন, এ স্টেশনের সবাইকে সে লেখাপড়া শেখাবে। সে এক আধটু চেষ্টা শুরু করে। আর তাতেই তার প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ। মেয়ের ব্যপারে সকলের প্রশংসা শুনতে ভালই লাগে শেফালীর বাবার । কিন্তু তার এই ভালোলাগাটা শেফালীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলনা। স্টেশনের কথিত এক সুন্দরী পতিতাও তার মনের আকাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল। পরিবেশ বলে কথা। তাই এখন শেফালীর বাবার স্বপ্ন, সে এই সুন্দরীকে বিয়ে করতে চায় আর স্টেশনের কুলিদের নেতা হতে চায়। কপাল গুণে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। স্টেশনের সবচেয়ে বড় ফেনসিডিল বিক্রেতা কালা নিজামের নজরে শেফালী পরল। সে শেফালীর বাবার স্বপ্নের কথা জানত। তাকে হাত করার জন্য নিজাম শেফালীর বাবাকে তার ব্যবসায়ের প্রধান সহযোগী নিযুক্ত করল। কালা নিজাম অতি শ্রদ্ধা আর ভক্তির সাথে রাতারাতি নিজ ভাই মিজানের কাছ থেকে হবু শশুরের কাছে ব্যবসার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। সাথে নিজের মনের বাসনাটা শেফালীর বাবাকে বলে। কিন্তু শেফালীর বাবা অত সহজে মেয়ে বিয়ে দেবার পাত্র নন। অতঃপর নিজামের হাত ধরে শেফালীর বাবার কুলিদের নেতা হবার স্বপ্ন পূরণ হয়। এখন শুধু সেই পতিতা মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাকি। ব্যাপারটা শেফালী বুঝতে পেরে তার বাবার বিয়ের কাজে পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায়। আর এই পথের কাটা সরাতে শেফালীর হবু মায়ের পরামর্শ মতে শেফালীকে নিজামের সাথে বিয়ে দেবার চেষ্টা করতে থাকে। নিজামও সুযোগ বুঝে শেফালী ও তার বাবাকে নানা প্রকার উপহার দিতে থাকে। এক সময় বাবার জেদের কাছে শেফালী হার মানে ও ঢাকা শহরে থাকার মস্ত বড় স্বপ্ন নিয়ে নিজামকে বিয়ে করে। বিকেলের ট্রেনেই নিজাম শেফালীকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়।
ট্রেনে উঠার পর শেফালী কান্না লুকিয়ে নানা রকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অন্য দিকে মেয়েকে বিদায় দিয়ে কান্নাকাটি শেষ করে শেফালীর বাবা নিজের স্বপ্ন পূরণে উঠে পরে লাগে। কিন্তু বিধিবাম, তার এ স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। নিজামের ভাই মিজান শত্রুতা করে তাকে র্যা বের কাছে ফাঁসিয়ে দেয়। রাত বারোটায় ট্রেনটি যখন মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে কমলাপুর স্টেশনে থামে তখন শেফালীর কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু শেফালী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনা তার বাবার ঘুম আর কখনো ভাঙবে না। র্যা বের গুলিতে সে সন্ধ্যা বেলাতেই মারা পরেছে। রাতের সংবাদে এক টেলিভিশন চ্যানেলে শেফালীর বাবার মৃত্যুর খবরটি প্রচারিত হয়। একটি দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবার সময় নিজাম ব্যাপারটি লক্ষ্য করে। কিন্তু সে খবরটি শেফালীর কাছে লুকিয়ে ফেলে।
নিজামের সাথে সিএনজি দিয়ে গন্তব্যে যাবার পথে শেফালী অবাক চোখে রাতের নিস্তব্ধ ঢাকা দেখে। আর নিজাম লোলুপ দৃষ্টিতে শেফালীকে দেখতে থাকে। শেফালীর এটা ভাল লাগেনা। সে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরে। নিজাম তাকে কোথায় নিয়ে আসে তা সে টেরই পায়না। নিজামের ডাকে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন সে দেখে বিশাল এক বাড়ির সামনে তাদের গাড়িটা দাঁড়ানো। শেফালী ভাবে এটাই বুঝি তাদের বাড়ি। তাই উৎসাহ নিয়ে নিজামকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে। নিজাম সুযোগ পেয়ে তাকে আশাব্যঞ্জক কথা শোনায়। শেফালী তা সরল মনে বিশ্বাস করে। মস্ত বড় এই বাড়িটা যে তাদের নয় তা নিয়ে ভাবার কোন চেষ্টাই করেনা।
বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে শেফালী ভেবেছিল অনেকেই তার জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর ঠিক তার উল্টো হয়। শুধুমাত্র বাড়ির দারোয়ান বিরক্ত মনে দরজা খুলে দেয়। তারপর তারা মস্ত বড় একটা ঘরে প্রবেশ করে। শেফালী ঘরের এক কোনে বসে ভীত মনে পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কারও কোন সারা শব্দ পায়না। কিছুক্ষণ পরেই বাইরে থেকে কে যেন কাকে ধমকাচ্ছে তা সে শুনতে পায়। অগান্তুক লোকটি বলে, “ ভালইত্ পাইছস, দুই দুইটা বিয়া কইরাও পোষায় নাই, চালায় যা আর আমার ব্যবসাটা লাটে উঠা। শশুরের কাছে ব্যবসা দিয়া লাখ দুয়েক টাকা মাইর খাওয়ালি”। তারপরেই নিজাম একটি শুকনো হাসি হেসে ঘরে ঢোকে। রাতে তৃপ্তি মেটানো খাওয়া দাওয়া শেষেই শুরু হয় শেফালীর কাউকে বলতে না পারার কষ্টের সেই রাত।
সকাল হতে না হতেই নিজাম তাকে টেনে তুলে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। গত রাতের সেই মিষ্টভাষী নিজামের মিষ্টি কথা গুলো একেবারেই বেমালুম গায়েব। শেফালী শরীরের অসহ্য ব্যথা নিয়ে নিজামের সাথে একটি লোকাল বাসে করে অজানা গন্তব্যের দিকে রওনা হয়। সে শেফালীর কোন কথারই উত্তর দিতে চায়না। দুপুর পেরোতেই তারা এক বস্তির কাছে হাজির হয়। নিজাম শেফালীকে নিয়ে তার মধ্যেই প্রবেশ করে। তারপর তারা একটি আধপাকা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে নিজামকে অসহায় মনে হয়। কারণ ঘরের দুই পাশের দুই দরজায় দুটি কুৎসিত মোটা মহিলা নিজামের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে। অতঃপর সতীনদের সাথে শেফালীর চিরাচরিত সেই দুর্বিষহ জীবন শুরু হয়।
সংসারে অপেক্ষাকৃত পাকা দুই সতীনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন পরেই লুকিয়ে বাবার মোবাইলে কল দেয়। কিন্তু অপর পাশ থেকে অল্পবয়সী এক ছেলে তা রিসিভ করে। মেয়ে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে সে ছেলেটি শেফালীর প্রতি তার প্রেমের কথা জানায়। শেফালী তাতে রাগে গজরাতে গজরাতে ছেলেটিকে শালার ব্যটা বলে তাকে গালি দিয়ে বলে, “ আমার জামাইরে চিনিস, ভালায় ভালায় মোবাইল আমার বাপেরে দিয়ে আয়”। তারপরেই তার বাবার মোবাইল নম্বরটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। এরপর শেফালী কাঁদতে থাকল কিন্তু কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে আসলনা। এভাবেই স্বপ্নের ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়েই শেফালীর দিন যেতে লাগল।
এত কষ্টের মাঝেও শেফালীর নতুন বছরটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হল। কিন্তু এবার আর নবম শ্রেণীতে উঠার পর স্বপ্নের আঁকিবুঁকি নয়, অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন। যথারীতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেফালী মা হল। কিন্তু নতুন সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য বেশীদিন হলনা নিজামের। মদ্যপ অবস্থায় রোড এক্সিডেন্টে মারা গেল সে। সুতরাং শেফালীর আরও একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু হল। দিন দশেক পরেই শেফালীর কাছে নানা জনের কাছ থেকে কু-প্রস্তাব আসতে লাগল। কিন্তু টাকার কাছে কিছুতেই শেফালী নিজের চরিত্র বিলিয়ে দিতে চায়না। তাই স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বস্তি ত্যাগ করল শেফালী। তারপর একজন বাসা বাড়ির কাজের বুয়ার সাহায্যে একটা কাজ পেল। বাড়ির মালকিন খুব ভালো মানুষ। তাকে খুব স্নেহ করত। তার ছেলেটিকেও ঈদে নতুন জামা কাপড় কিনে দিল। শেফালী তা দেখে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করাতে আর ঘরের ভেতরে থেকে থেকে শেফালীর গায়ের রঙ দিন দিন ফর্সা হতে লাগল। আর সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। বাড়িওয়ালার অবিবাহিত নেশাখোর ছেলের নজরে সে পরে গেল। তার কাছ থেকে নানা কু প্রস্তাব আসতে থাকল। তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার ভয়ও দেখাতে লাগল। একসময় ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নেশাখোর ছেলেটার সব কিছু মেনে নিলো। এবার শেফালী সাবধানে চলল। বছর তিনেকের আগে কোনমতেই সে আর মা হতে রাজি নয়। কিন্তু তাদের এই গোপন প্রণয় বাড়ির আরেক কাজের বুয়ার মাধ্যমে জানাজানি হয়ে গেল। অতঃপর শেফালীকে সে বাড়ি থেকে দোষের সমস্ত দায় চাপিয়ে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হল এবং শুরু হল শেফালীর নতুন স্বপ্ন দেখার অপেক্ষার পালা।
মাথা গোজার ঠাই পেতে শেফালী শেষ পর্যন্ত কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসে থামল। এবার শেফালী আর বস্তির সবাইকে পড়ালেখা করানোর স্বপ্ন দেখেনা। এখন সে তার অপুষ্টিতে ভোগা ছেলেটিকে দেখিয়ে, স্টেশনের যাত্রীদের কাছ থেকে কিভাবে টাকা আদায় করে খাবার জোগাড় করবে তার স্বপ্ন দেখে আর বাবার কাছে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কিছুতেই তার বাবার কোন হদিশ পায়না। অগত্যা এখানেই সে রাত্রিযাপন করতে থাকে।
শেফালীর কাজে বিভিন্ন সময়তেই রূপচান খালার ষোল সতের বছর বয়সী ইঁচড়েপাকা ছেলেটি অযথা সাহায্য করতে থাকে। প্রথমে শেফালী বিরক্তি দেখালেও আয় বেড়ে যাওয়ায় সে তার সাথে খারাপ ব্যবহার বন্ধ করে। অতঃপর তার সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠে। ছেলেটি তার সন্তানকে খুব আদর করে। প্রতিদিনই তারা একে অপরের সাথে হাসি ঠাট্টা বাড়াতে থাকে। শেফালী ছেলেটিকে ইয়ার্কি করে বলে, “অ্যাই তোরা কিভাবে নেশা করিস রে”। ছেলেটি তাতে উৎসাহ পেয়ে কিভাবে নেশা করে তা তাকে দেখায়। কিন্তু শেফালী তা ছুঁয়েও দেখেনা।
শেফালী একদিন তার বাবার সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল যে পতিতার, তার সাথে দেখা হয়। শেফালী প্রবল আগ্রহ নিয়ে মহিলাটির কাছে তার বাবার খবর জানতে চায়। সে তার বাবার খবর তো দেয়ই না উল্টো টিপ্পনী কেটে বলে, “ কি লো, জোয়ান জোয়ান পোলাগো লগে ঘুইরা তো ভালই কামাই করতাছস”। শেফালী তার টিপ্পনীকে পাত্তা দেয়না। সে নাছোড়বান্দা হয়ে তার বাবার খবর জানতে চায়। পতিতাটি তাকে মেকী কান্না কেঁদে তার বাবা যে তার ঢাকা আসার দিনেই মারা গেছে তা জানায়। দিন কয়েক পরে তার অসুস্থ ছেলেটিও মারা যায়। এবার শেফালীর একসাথে সকল স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। অতি কষ্ট চাপা দিতে সেই ইঁচড়েপাকা ছেলেটির কাছ থেকে মাদক নেয়। মাদকে অভ্যাস না থাকায় অসুস্থ হয়ে রেল লাইনের ধারে মাল গাড়ির পাশে সারা রাত পরে থাকে।
শেফালীর ছেলে মারা যাবার কয়েক সপ্তাহ পরেই একদিন বিকেল বেলায় তার প্রচণ্ড বমি ভাব আসে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনা কি হতে চলেছে। দিন দুয়েক পরেই শেফালী বুঝতে পারে তার শরীরের মধ্যে তার একটি মাত্র ডিম্বাণুর পেছনে রূপচান খালার সেই ইঁচড়ে পাকা ছেলেটির লক্ষ কোটি শুক্রাণু ছুটে বেড়াচ্ছে। অতঃপর শেফালী আর স্বপ্ন দেখতে চায়না।
দূর থেকে ট্রেনের হর্ন বাজছে। আর শেফালী ট্রেন লাইনের মাঝে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, সে কি আবারও স্বপ্ন দেখবে!