ব্যান্ড পার্টি সহযোগে আলোর রোশনাই মেখে বোসেদের দুর্গা প্রতিমার ভাসানযাত্রা গঙ্গাভিমুখে।উল্টোদিক থেকে গঙ্গায় স্নান সেরে শ্মশানযাত্রীরা ফিরছে ঘোষালবাড়ির বড়বৌ দুর্গার দাহকার্য সম্পন্ন করে। আত্মঘাতী হয়ে দুর্গা তো ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে, কিন্তু তার অবোধ দুই শিশুপুত্রকে ধরাকাছা নিয়ে দাদুর সাথে রিক্সায় ফিরতে দেখে অতি বড় পাষাণেরও চোখের কোণ ভিজে উঠেছে।
বোসেদের নিরঞ্জন শোভাযাত্রায় ব্যান্ড পার্টির বাজনদাররাও খানিকক্ষণের জন্য থমকে গেল আর তারপরে বোসকর্তাও আর তেমন উৎসাহ বোধ করলেন না জাঁকজমক করে ভাসানপর্ব সমাধা করার।
ক’মাস ধরে গোটা পাড়াটা কেমন যেন থম মেরে আছে। জানা যায় নি দুর্গা কেন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল বা নিতে বাধ্য হয়েছিল। দুর্গার ছেলেদুটোকে দেখলেই দুর্গার হাসিখুশি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মুখখানা পাড়াসুদ্ধু সবার স্মৃতিতে একবার তোলপাড় নাড়া দিয়ে যায়।
সময় গতিশীল, প্রবহমান সময় চক্রে পরিবর্তনশীলতাও অবশ্যম্ভাবী। সেই কালচক্রের নিয়মে ঘোষালবাড়িতেও কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়।দুর্গার স্বামী অর্থাৎ ঘোষালবাড়ির বড়ছেলে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহণ করে আলুথালু সংসার এবং নিজের ছন্নছাড়া জীবন শোধরানোর উদ্যোগ নিল। ঘোষালকর্তা ছেলের এই সিদ্ধান্তে সহমত হলেন না বটে, কিন্তু আর দুই ছেলেই নিজের নিজের সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ায় বাপ বড়ছেলের ওপর নির্ভরশীল, তাই বাপের ওজর আপত্তিও ছেলের কাছে ধোপে টিকল না। দুর্গার গত হওয়ার ছমাসের মাথায় দুর্গার সতীন এল দুর্গার ভরা সংসার তরণীর হাল ধরতে। মা-মরা শিশুদুটি নতুন মায়ের মধ্যে নিজেদের মতো করে মাতৃস্নেহ সন্ধান করতে লাগল।
দুর্গার সতীন ছেলেদের সাথে এবং পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তেমন মানিয়ে চলতে না পারায় অধিকাংশ সময় স্বামীকে নিয়ে বাপেরবাড়িতেই থাকে। দুর্গার যাবার বছর ঘুরতেই দুর্গার স্বামী নয় বছরের বড় ছেলেটিকে নিয়ে গয়ায় গিয়ে অপঘাতে মৃত দুর্গার আত্মার সদ্গতির জন্য পিন্ডদান করে এল।
আরও কয়েকমাস অতিবাহিত, দুর্গার সতীন ইদানিং স্বামীর ঘরেই থাকছে। কানাঘুষোয় শোনা যায় দুর্গার সতীন নাকি কিছুতেই ঘরে কোথাও দুর্গার কোনো ছবি টাঙাতে দেয় না। ছবিতে দুর্গার চোখদুটি দেখলে নাকি তার সতীন ভয় পায়। এ আবার কেমন কথা? পিন্ডদান তো হয়ে গেছে, তবে?
দুর্গার ছেলেরা বড় হয়েছে, দুই ছেলেই ধীরস্থির, স্বল্পবাক। মৃদুভাষী ছেলেদুটি নিজেদের মতো করে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে, এই বিষয়ে দুর্গার স্বামী ও সতীনের উদাসীনতা পাড়া পড়শীর চোখ এড়ায় না।
দিন মাস বছর পেরিয়ে দুর্গার বড় ছেলের চাকরি হোলো, ছোট ছেলেও লেখাপড়া শেষে চাকরির উমেদার, এমতাবস্থায় ছেলেদের দাদু ঠাকুমা একমাসের আড়াআড়িতে গত হলেন। দুর্গার স্বামী বাতবেদনায় কাবু হওয়াতে বাপের নির্দেশে দুর্গার বড় ছেলে চলল গয়ায় দাদু ঠাকুমার পিন্ডদান করতে।
দাদু ঠাকুমার পিন্ডদান হয়ে যেতে কি মনে করে দুর্গার বড় ছেলে পান্ডাকে মনের ইচ্ছা জানিয়ে মায়ের পিন্ডদান করতে বসল। বাবার সাথে যখন এসেছিল তখন সে যথেষ্ট ছোট ছিল, নিজের ছেলের মতামতের কোনো গুরুত্ব বাবার কাছে ছিল না। দুর্গার উপযুক্ত চাকুরে ছেলের ইচ্ছা মায়ের বড় প্রিয় ফলটি আঙুর প্রেতশিলায় দান করে যায়। পান্ডা পুরোহিতের একটানা মন্ত্র পড়ার মাঝে ছেলের চোখের সামনে ভেসে উঠল যেন দুর্গা চিলেকোঠার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে একটা একটা করে আঙুর গোছা থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। পুরোহিতের কথামত দুর্গার ছেলে হাতের অঞ্জলিতে আঙুর নিয়ে মায়ের কথা ভাবতে থাকল, কতক্ষণ পার হয়েছে তার খেয়াল নেই, হাতের অঞ্জলিতে হিমশীতল অঙ্গুলিস্পর্শ। মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে দুর্গার বড় ছেলে রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরল।
দুর্গার ছোট ছেলেও চাকরি পেয়েছে, আর বড় ছেলের বিয়ের ঠিক হয়েছে। এমন সুদিনে দুর্গার সতীন এক দুর্ঘট ব্যামোয় পড়ল, মাঝেমধ্যে থেকে থেকেই ঘনঘন তার যেন শ্বাসবন্ধ হয়ে যেতে চায়, ডাক্তারী চিকিৎসা থেকে টোটকা পর্যন্ত কিছুতেই রোগের উপশম ঘটল না। দুর্গার বড় ছেলের বিয়ের দিন সকাল থেকে দুর্গার সতীনের ওঠবার ক্ষমতা নেই, পাঁচজন কানাকানি করল, নিজের নাড়ীছেঁড়া কেউ নেই তো, তাই সতীনপোয়ের বিয়ের ঘটাপটা সহ্য হচ্ছে না। হিংসের জ্বলনেই অসুখের বাহানা। ছেলে বিয়ে করতে বেরোবে, নতুনমা কোনোরকমে নিয়মকানুন সেরে ছেলেকে বিয়ে করতে পাঠাল।
পরদিন ছেলে বৌ নিয়ে ফিরেছে, নতুনমা হাসিমুখে বরণ করে বৌ ঘরে তুলে সব স্ত্রী আচার অনুষ্ঠান নিয়মবিধি পালন করে নিজের দায়িত্ব পালন করল, কানাকানি করার লোকেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। পরের দিন বৌভাত ফুলশয্যাও নির্বিঘ্নেই মিটল। নতুনবৌয়ের পয়ে নতুনমা তো একেবারে সুস্থ।
দুর্গার স্বামী বাতব্যথা বেদনায় কাহিল অনেকদিন যাবত, তাই নীচের একখানা ঘরেই থাকে আজকাল, ছেলেরাও নীচের ঘরগুলিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কেবল ছেলেদের নতুনমা ঝুটঝামেলা ছেড়ে নিরিবিলিতে থাকতেই পছন্দ করে বলেই চিলেকোঠার লাগোয়া ওপরের হলঘরাকৃতির একমাত্র বিশাল ঘরটিতে একাই থাকে, সংলগ্ন বাথরুম ও বারান্দা থাকায় নতুনমা নীচে খুব বিশেষ নামে না, সংসার কাজের লোকেদের হুকুম করেই চলে। অসুস্থ হলেও দুর্গার স্বামী ছেলের বিয়ে দিয়ে মনে মনে বেশ সুখ অনুভব করল। বৌভাতের পরদিন সকাল থেকেই নতুনমার দেখা নেই। কাজের লোকজন নিয়ে নতুনবৌ রান্নাঘর সুষ্ঠুভাবেই সামলে নিল। সন্ধ্যাবেলায় নতুনমা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল শরীরটা ভালো আছে বলে বুড়ো বাবামাকে একটু মিষ্টি খাওয়াতে গিয়েছিল। আসা-যাওয়াতে ক্লান্ত, ওপরে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকাল থেকেই ওপরের কোথাও থেকে একটা দুর্গন্ধ
বেরোচ্ছে। খোঁজ শুরু হোলো, কোথাও কিছু চোখে পড়ল না, নতুনমা এখনো বাথরুমে, নতুনমার ঘরের পেছনে একফালি বারান্দায় দুনিয়ার হাবিজাবি জিনিসপত্র ডাঁই করা, ওখানটা ভালো করে দেখতে হবে, ওদিক থেকেই পচা গন্ধটা আসছে মনে হয়।
অনেকটা বেলা হয়েছে, নতুনমা বাথরুমে এখনো, কোনো সাড়াশব্দ নেই, অসুস্থ হয়ে পড়েছে আবার নির্ঘাত। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের ডাকা হোলো, তাদের পরামর্শে পুলিশকেও খবর দেওয়া হোলো। এসব করতে করতেই বেশ বেলা হয়েছে, পুলিশ এসে নতুনমার বাথরুমের দরজা ভাঙতেই বীভৎস দৃশ্য, নতুনমার মৃতদেহ বাথরুমের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, পোকামাকড়-পিঁপড়ে থিকথিক করছে, ছূঁচো বা ইঁদুরে নাকচোখ খুবলে খেয়ে ফেলেছে। পুলিশের অভিমত কমপক্ষে দিন চারপাঁচেক আগে মারা গেছে ভদ্রমহিলা। স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকে অসুস্থতার কারণে, স্বামী নীচে, স্ত্রী ওপরে, তাই কেউ আর খেয়াল রাখেনি।
কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকে গেল সবার মনে, পুলিশের আন্দাজে ভুল আছে, কারণ চারদিন আগে বিয়ে- বৌভাত-ফুলশয্যার দিন সারাক্ষণই তো নতুনমা সব কাজকর্ম নিজে হাতে করল! এমনকি বৌভাতের পরদিন নিজের বুড়ো বাপমাকে মিষ্টি পর্যন্ত খাইয়ে এল! সবায়ের মাথায় পুরো বিষয়টি জট পাকিয়ে রইল।
সময় কারুর জন্য থেমে থাকে না, ঘোষালবাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়।
আচম্বিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রমে নতুনমার পারলৌকিক কাজকর্ম মিটে যেতে বড়ছেলে বিয়ের ডিভিডিটা চালাল বাড়ির গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য। ভিডিও চলছে, কিন্তু একী? প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানেই তো নতুনমা উপস্থিত ছিল! কিন্তু একটি ভিডিওতেও নতুনমার কোনো ছবি বা উপস্থিতির কোনো লেশমাত্রও নেই! এও কী সম্ভব? সমস্ত যুক্তিতর্ক সাধারন বুদ্ধি বিবেচনার উর্দ্ধে! কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় জীবনের ভান্ডারে প্রতিপদে প্রতি মোড়ে প্রতিটি স্তরে !