বহু বছর পর আবার যেন মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের অনুভূতিটা ঘিরে ধরছে দেবারতি কে । একটা একটা করে দিন এগিয়ে আসছে আর ওর টেনশন বাড়চ্ছে । কিন্তু মুসকিল হল তখন দিনের শেষে মায়ের ডানার তলায় ভয় ভীতি ঢাকা পড়ে যেত। আর এখনতো মা বাবা কেউই নেই। অরিন্দম কে বলতে গেলেই বলবে ওসব মেয়েলি ব্যাপার আমি কি বলবো। মা কে হারিয়ে এই এক মহা বিপদে পড়েছে দেবারতি। মন খুলে সব কথা বলার মতো লোক পায়না। সবাই যে যার মতো মত দেয় কোনটা যে সঠিক বুঝতে পারেনা দেবারতি।
এই যেমন একটু আগে ফোন করে ওর পিসতুতো জা বলল,
 ” শোনো নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ছেলের বউ কে একদম মাথায় উঠতে দেবেনা। বেশি ভালোবাসা দেখানোরও দরকার নেই।জানো তো কথায় আছে এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগেনা। যতই ভালোবাসা দাওনা কেন সেই নিজের মা নিজের বাবা করে হেদিয়ে মরবে। বাপের বাড়ি বলতে অজ্ঞান হবে। তাই বলছি প্রথম থেকে রাশ টেনে রাখবে। মোটে বেশি বাপের বাড়ি যেতে দেবে না।”
দেবারতি একটু হু হাঁ করে ফোন টা ছেড়ে দিল।
আবার যখন কাল সন্ধ্যায় ওর ছোটবেলার বান্ধবী তনয়ার সাথে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হল । ছেলের বিয়ের আয়োজন কেমন হচ্ছে একথা সেকথা জানার পর সে বলল,
 ” শোন তুই চিরকালের ভালোমানুষ। আমি খুব বুঝতে পারছি তোর ছেলের বউ তোকে মোটেও পাত্তা দেবে না। এই যেমন তোকে স্কুলে ছাত্রীরা মোটেই মানেনা। একদম শক্ত হবি। কথায় কথায় বুঝিয়ে দিবি বাড়ি ঘর সংসার সব কিছু তোর। অনন্য কে কত লড়াই করে স্পেশালিস্ট ডাক্তার বানিয়েছিস সে কথাও সবসময় বলবি।”
দেবারতি একটু অবাক হয়ে বলল,
 ” কিন্তু সে তো আমি আমার বাবীনের জন্য করেছি। সেটা আর ওকে বলবো কেন?”
“এই দেখেছিস কেমন বোকা তুই। ছেলেটার জন্য জীবন দিলি কিন্তু ফল টা কে ভোগ করবে? ওর শাড়ি গয়না শখ আহ্লাদ কে মেটাবে সেই তো তোরই ছেলে। যাক্ গে তোকে বলে লাভ নেই।আইবুড়ো ভাতে যাই অরিন্দম দা কে যা বলার বলে আসবো।”
বারে বারে সবার কাছ এই সব শুনতে শুনতে ছেলের বউ নিয়ে দেবারতি যেন আতঙ্কে পড়ে যাচ্ছে। আর চার দিন পর তার একমাত্র ছেলে অনন্যর বিয়ে। আত্মীয়স্বজনরা কাল থেকেই আসা শুরু করবে, কত কাজ, তার মধ্যে এসব শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে দেবারতি। মাত্র দু মাসের কথাবার্তায় বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। মেয়েটাকেও তেমন চিনে উঠতে পারেনি দেবারতি। এর থেকে বাবীন যদি নিজে পছন্দ করে ভালোবেসে বিয়ে করতো তাহলে তবু মেয়েটা কে একটু চেনা জানার সময় পেত। কিন্তু কলেজে থাকতে সেই যে সৃজার সাথে বাবীনের সম্পর্ক টা ভেঙে গেল । তারপর থেকে তার ছেলে আর কোন মেয়ের দিকে ফিরে তাকাল না। শুধু যন্ত্রের মতো পরিশ্রম করে এই বয়সে উৎকর্ষতার চরম শিখরে পৌঁছেছে সে। কত কষ্ট করে যে ছেলেকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে তা শুধু দেবারতিই জানে। মেয়েটি সত্যি সুন্দরী উচ্চশিক্ষিতা এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করে । সব দিক থেকেই তার বাবীনের উপযুক্ত ।প্রথমদিন দেখতে গিয়ে অরিন্দম ও দেবারতি দুজনেরই রাহী কে খুব পছন্দ হয়েছিল। রাহীর বাবা অধ্যাপক মা ও উচ্চশিক্ষিতা।
যাইহোক খুব সুষ্ঠু ভাবে বিয়ে বৌভাত মিটে গেছে।বিয়ে বাড়িতেও অনেকেই দেবারতি কে বুঝিয়ে দিয়েছে কেমন করে ছেলের বউ কে কব্জায় রাখতে হয় ।
বৌভাতের পরদিন সকাল এখনো বাড়িতে ভালোই লোকজন রয়েছে। আজ সকলের ফিরে যাওয়ার পালা। সকাল প্রায় সাড়ে আটটা। নতুন বউ এখনো দরজা খোলেনি। অনেকের মধ্যে চাপা অসন্তোষ। দেবারতির জা দিদিরা বলাবলি শুরু করেছে
“কি বেয়াক্কেলে মেয়েরে বাবা। এখনো দরজা খুলতে পারছেনা। ”
 দেবারতির ও মনে হচ্ছে উঠে পড়লেই তো হয় তাহলে আর এসব শুনতে হয় না।
সুযোগ পেয়ে একবার পাশের ঘরে গিয়ে অরিন্দম কে বলল দেবারতি,
 “কি করি বলোতো বাবীনরা তো দরজা খুলছে না।”
অরিন্দম একদম নির্বিকার ভাবে বলল,
 ” থাক না ঘুমোতে দাও কদিন ধরে কত ধকল গেছে। আজই কি রাহী রান্না ঘরে যাবে?”
“না সেটা না, কিন্তু সকলে যে কতকিছু বলছে।”
অরিন্দম এবার গলা নামিয়ে দেবারতির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল,
 ” যে যা বলছে বলতে দাও। ওরা তো কেউ এ বাড়ি তে থাকবে না। তুমি শুধু আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তোমার জীবনের এই দিনটার কথা ভাবো।”
দেবারতি হঠাৎ এইকথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
 ” যাঃ এখন এইসব ভাবার সময় আছে ?”
 অরিন্দম একই ভাবে ফিসফিস করে বললো,
 ” কটায় উঠেছিলে? মনে আছে?”
 দেবারতি একটু আড়ষ্ট ভাবে বলল
 “সকাল পাঁচটায়। সবাই ওঠার আগে।”
 “কেমন লেগেছিল ? খুব ভালো?”
 “জানি না যাও। ” ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে দেবারতি ।
 তারপর বলল “এলাম একটা বলতে আর তুমি আমার কথা নিয়ে পড়লে?”
 অরিন্দম এবার একটু জোরের সাথে বলল,
“এটাই মেনে চলো দেবী । যখনই ভাববে কি করা উচিত নিজেকে রাহীর জায়গায় বসিয়ে বিচার করবে। দেখবে সব মিটে যাবে। ”
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অরিন্দমের শেষ কথা গুলো যেন দেবারতির অন্তর স্পর্শ করে গেল। এমন সময় কাজের মেয়েটা এসে বলল
 ” মামী , নতুন বৌদি দরজা খুলেছে। তোমায় ডাকছে।”
দেবারতি দ্রুত পায়ে সিঁড়ি তে উঠতে উঠতে বলল “হ্যাঁ যাচ্ছি। ” পাশে পাশে জা ননদরা দেবারতির সঙ্গী হল। একটা বেশ মজা দেখার অভিপ্রায়ে তারাও চলল দোতলায় ।
ঘরে ঢুকে দেবারতি দেখল একরাশ ঘুম চোখে ফুল সাজানো বিছানায় বসে রাহী ঢুলছে আর বাবীন পাশ ফিরে অকাতরে ঘুমচ্ছে। দেবারতি এগিয়ে গিয়ে রাহীর মাথায় হাত রাখে ।
 ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় রাহী। তারপর বলল
 ” খুব দেরি হয়ে গেল। বুঝতে পারিনি ।”
 মৃদু হেসে রাহীর গালে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেবারতি বলল ,
“তাতে কি হয়েছে। এ বাড়ি তে সবাই দেরি করে ওঠে। সবাই এবার রওনা দেবে তাই একটু তাড়া। ফ্রেশ হয়ে নীচে যেতে হবে।”
মুহূর্তে জড়তা কাটিয়ে একরাশ ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে রাহীর চোখেমুখে। রাহী এবার নীচু হয়ে দেবারতি কে প্রণাম করতে যায়। দেবারতি বুকে টেনে নেয় রাহীকে। এই তো কি শান্তি লাগছে তার। ঠিক যেমন বাবীন কে আদর করলে প্রান টা ভরে যায় । চারপাশের অনেক গুলো চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
দেবারতির মনে পড়ছে অনেক বছর আগে মা একবার বলেছিল বউ কে তেমন ভালোবাসা দিলে সত্যিই একটা মেয়ে পাওয়া যায় । মেয়ের শখ যে তার বহুকালের।
 
  
 Loading...
Loading...













