আরেকবার হিমু

আরেকবার হিমু

কানা কুদ্দুস একজন ভয়ানক সন্তাসী। ঢাকা শহরের সব ক’টি থানায় কানা কুদ্দুসের নামে মামলা আছে।

কানা কুদ্দুস কিন্তু কানা না।
কুদ্দুসের টাইটেল হচ্ছে- কানা।
কারন সে একবার এক পুলিশ কমিশনারের চোখ উপড়ে ফেলে দিয়েছিল।
এরপর থেকে কুদ্দুসের নাম হয়ে যায়- কানা কুদ্দুস।
আরেক বার কাওরান বাজারের সামনে দিনে দুপুরে কুদ্দুস এক ব্যবসায়ীর চোখ তুলে ফেলেছিল।
ব্যবসায়ীর অপরাধ কুদ্দুস তার কাছে তিন লাখ টাকা চেয়েছিল।
ব্যবসায়ী সেই টাকা না দিয়ে বরং পুলিশকে খবর দিয়েছিল।
মাত্র দুইবার চোখ তুলে ফেলার কারনে কুদ্দুসের নাম হয়ে যায়, কানা কুদ্দুস। বস্তুত, কুদ্দুসের চোখে কোনো সমস্যা নেই।
হিমু বসে আছে কানা কুদ্দুসের আস্তানায়।
হিমুকে ধরে আনা হয়েছে।
তার অপরাধ কিছুই না।

কানা কুদ্দুস হিমুর মাজেদা খালাকে অপহরন করেছে- আজ দুই দিন।
কানা কুদ্দুস হিমুর খালুকে ফোন করে বলেছে বিশ লাখ টাকা দিয়ে মাজেদা কে ছাড়িয়ে নিতে।
হিমুর খালু সাহেব আখলাক সাহেব- কুদ্দুস কে বলেছে, আমি এক পয়সা দিবো না।
যদি মাজেদাকে টুকরো টুকরো করে কেটে তূরাগ নদীতে ভাসিয়ে দাও, তাও না।
এখন কানা কুদ্দুস চায়- হিমু তার খালুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসে- মাজেদা খালাকে মুক্ত করে নিয়ে যাক।
কুদ্দুস এই মহিলাকে অপহরন করার পর অনুভব করছে, বিরাট ভুল হয়েছে।
এই পর্যন্ত দুইবার মাজেদা কানা কুদ্দুসকে জঘন্য বকা দিয়েছে।
কোনো ভদ্র মহিলা যে এই রকম বকা দিতে পারে- তা কুদ্দুস স্বপ্নেও ভাবেনি।
কানা কুদ্দুস একটা সিগারেট ধরিয়ে হিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, তিন দিনের মধ্যে টাকা নিয়ে এসে তোমার খালাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।

অন্যথায় তোমার খালাকে টুকরো টুকরো করে তূরাগ নদীতে ফেলে দিব।
হিমি বলল, আমি কি খালার সাথে দুই মিনিটের জন্য দেখা করতে পারি?
কানা কুদ্দুস একজনকে ইশারা করতেই,
হিমুকে নিয়ে যাওয়া হলো- ছোট একটা ঘরে।
এই ঘরে কোনো জানালা নেই। একশো ওয়াটের একটা লাইট জলছে।
হিমুকে দেখেই মাজেদা খালা বললেন- আমি জানতাম, আর কেউ আসুক
বা না আসুক হিমু তুই ঠিকই আমাকে ছাড়িয়ে নিতে আসবি।
তোর খালু নাকি টাকা দিবে না বলেছে? কত বড় সাহস হারামীর! স্ত্রীর জন্য মায়া মহব্বত নাই।
বাসায় গিয়ে লাত্থি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিব হারামীর বাচ্চাটাকে। …
রাত নয়টায়- কানা কুদ্দুসের আস্তানা থেকে হিমু বের হলো।
ঢাকা শহরে রাত নয়টা তেমন কোনো রাত নয়।
হিমু হাঁটছে পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকায়।

কানা কুদ্দুসের আস্তানা থেকে বের হওয়ার পরই একটা কালো রঙের কুকুর হিমুর পেছনে পেছনে হাঁটছে।
হিমুর ইচ্ছা করছে সদরঘাট গিয়ে কোনো একটা লঞ্চের ছাদে গিয়ে ঘুম দিতে।
মাজেদা খালার ব্যাপারটা নিয়ে সে মোটেই চিন্তিত না।
কানা কুদ্দুস মাজেদা খালাকে যথা সময়ে ছেড়ে দিবে।
কোনো টাকা পয়সা লাগবে না।
রুপার সাথে দেখা করাটা খুব দরকার।
এ পর্যন্ত তের বার রুপা হিমুর খোঁজ করেছে।
ড্রাইভার কে দিয়ে এপর্যন্ত সাতটা চিঠি পাঠিয়েছে।
খুব কাছের প্রিয় মানুষদের অবহেলা করা ঠিক না।
সাতটা চিঠি থেকে হিমু মাত্র একটা চিঠি আজ সকালে পরেছে।
চিঠিতে রুপা লিখেছে, “আমার খুব জ্বর।
আমি কোনো ওষুধ খাইনি।

কারন আমি জানি, তুমি এসে একবার আমার কপালে হাত দিলেই আমার জ্বর ভালো হয়ে যাবে।”
কালো কুকুর টা এখনও হিমুর পেছনে পেছনে আসছে।
হিমুর ইচ্ছা করছে এক পেকেট বিরিয়ানী কিনে কুকুরটাকে খেতে দিবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হিমুর কাছে কোনো টাকা নেই।
আজ তের দিন ধরে হিমুর হাতে কোনো টাকা নেই।
গত তিন মাস মেসের ভাড়ার টাকা দেওয়া হয়নি।
চৌরঙ্গী স্টোরেও বেশ কিছু টাকা বাকি আছে।
জর্জ কোটের সামনে একটা বিরিয়ানীর দোকানের সামনে হিমু থামল।
হিমুর সাথে কালো কুকুরটাও থামল।
অজানা এক আনন্দে কালো কুকুরটার চোখ মুখ জ্বল জ্বল করছে।
বিরানীর দোকানের মালিক জয়নাল হিমুকে দেখে এমন চিৎকার দিল যেন
সারা কলতাবাজারের মানুষ সেই চিৎকার শুনতে পেল।
জয়নাল হিমুকে জড়িয়ে ধরে বলল,কতদিন পরে আপনারে দেখলাম হিমু ভাই।
মনটা জুড়িয়ে গেল।

হিমি বলল,জয়নাল ক্ষুধা লেগেছে বিরিয়ানী খাওয়াও।
আর শোনো আমার সাথে একজন মেহমান আছে তাকেও বিরানী দাও।
আমার কাছে কিন্তু টাকা নেই।
জয়নাল বলল, হিমু ভাই এটা কি বললেন?
আপনি বিরানী খাবেন আর আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নিমু?
হিমু ভাই এই কথা না বলে আমারে দুই
গালে দুইটা জুতা দিয়ে বাড়ি দেন, তাও ভালো।
কুকুরটা আরাম করে বিরানী খেল। হিমু খুব মন দিয়ে কুকুরটার খাওয়া দেখল। মানুষও এত মন দিয়ে আগ্রহ নিয়ে খায় না।
জয়নাল বলল, হিমু ভাই আপনার জন্যই আজ বেঁচে আছি।
সেদিন যদি আপনি আমাকে না বাঁচাতেন…( হিমু সেই দিনের কথা কিছুই মনে করতে পারল না।)
হিমু বলল, জয়নাল থামো। পুরান কথা বাদ দাও।
জয়নাল চোখের পানি মুছে বলল- হিমু ভাই জান, আপনার মত মানুষ হয় না।
হিমু বলল, জয়নাল একটা পান আনিয়ে দাও তো,খাই।
আজ খুব বেশী খেয়ে ফেলেছি।
আর শোনো,আমি যদি কখনও বিয়ে করি, তাহলে আমার বিয়ের রান্না করবে তুমি। তোমার মতন এত মজা করে বিরানী রান্না করতে এই শহরে আর কেউ পারে না।
কোনো দিন পারবেও না।
একদিন রুপাকে নিয়ে আসবো বিরানী খাওয়াতে।
রাত দেড় টায় হিমু হেঁটে হেঁটে তার মেসে ফিরল।
আজও রুপার সাথে দেখা হলো না।
দুপুর দুইটা।
হিমু দাঁড়িয়ে আছে একটা দোতলা বাড়ির সামনে।
এই বাড়িতে থাকেন হিমুর মাজেদা খালা এবং খালু আখলাক সাহেব।
হিমু ঘরে ঢুকে দেখতে পেল খালু সাহেব আজ অফিসে যান নি।
তার সামনে একটা মদের বোতল। বোতলের লেবেলে হিন্দুদের দেব দেবতার ছবি।
এর মধ্যেই বোতল অর্ধেক খালি করে ফেলেছেন খালু সাহেব।
খালু সাহেব হিমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ভেব না তোমার খালার চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে মদ্যপান করছি।
সে আজ তিনদিন ধরে বাড়িতে নেই- আমি ব্যাপক আনন্দে আছি।
মদ্যপান করাটা আমার পুরোনো অভ্যাস। হিমু বলল, খালু সাহেব প্লীজ আর খাবেন না, আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। খালু সাহেব বললেন, চুপ।
হিমু চুপ করলো।
একজন নেশাগস্ত মানুষের কর্মকান্ড দেখার মধ্যে আনন্দ আছে।
খালু সাহেব খুব কায়দা করে সিগারেট ধরালেন।
হিমু বলল, আপনি ভাববেন না, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে আমি খালাকে ছাড়িয়ে আনব।
খালু বললেন- তুমি এত টাকার ব্যবস্থা কি করে করলে ?
এই কথার উত্তরে হিমু একটু হাসলো।
সন্ধ্যা ছয়টায় হিমু গেল মোহাম্মদ পুরের এক বাসায়।
রিয়া নামের চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে একা একা খেলছে।
হিমু খুব মন দিয়ে বাচ্চা মেয়েটার খেলা দেখছে।
বাচ্চাটি কাগজ টুকরো টুকরো করে কেটে পুতুল কে খাওয়াচ্ছে।
আবার অদৃশ্য একটা গ্লাস থেকে পানি খাওয়াচ্ছে।
হঠাত পেছন থেকে একজন ভদ্র মহিলা বললেন- আপনাকে পাঠিয়েছে?
হিমু ভদ্র মহিলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
ভদ্র মহিলা বললেন, আপনার আসার কথা ছিল সকালে- আপনি আসলেন সন্ধ্যায়।
রাতের ট্রেনে আমি চলে যাচ্ছি খুলনা। হিমু রিয়াকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো।
রিয়া হচ্ছে কানা কুদ্দুসের মেয়ে।
রিয়া মা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
টাকার অভাবে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে পারেনি কুদ্দুস।
এরপর রিয়ার খালা রিয়াকে দেখাশোনা করেন।
হিমু এখন রিয়াকে নিয়ে যাবে রুপার বাসায়।
হিমু জানে রিয়াকে খুব সুন্দর ভাবে দেখভাল করবে।
রিয়ার কোনো সমস্যা হতে দিবে না রুপা।
রুপা হিমুকে দেখে বললে- এতদিন পরে এলে?
হিমু বলল, খুব ব্যস্ত ছিলাম।
রুপার ঘরটা খুব সুন্দর।
অসুখ অবস্থায়ও রুপাকে খুব বেশী সুন্দর লাগছে।
নীল একটা সুতী শাড়িতে কত সুন্দর লাগছে।
হয়তো হিমু আসবে জেনেই রুপা জ্বর
নিয়ে চোখে কাজল দিয়েছে, হাতে পরেছে কাঁচের চুড়ি। কপালে টিপ।
হিমু এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে রুপার কপালে হাত রাখল।
সাথে সাথে রুপার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
হিমু বলল- তুমি সুস্থ হয়ে যাও।
কারন, আজ থেকে তোমাকে একটা বাচ্চা মেয়ের দেখাশোনা করতে হবে। তার দায়িত্ব নিতে হবে।
খুব সাবধান থাকবে বাচ্চাটির যেন
কোনো অবহেলা না হয়।
রিয়াকে কোলে তুলে নিল- রুপা।
রুপার জ্বর ভালো হয়ে গেছে।
তার আর কখনও কোনো অসুখ করবে না।
অসুখে পড়লে রিয়াকে দেখবে কে ? রুপার বাসা থেকে বের হওয়ার আগে হিমু রুপাকে তিনটা বেলী ফুলের মালা দিল।
বেলী ফুল হাতে নিয়ে আরেকবার রুপার চোখে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
হিমু রাস্তায় বের হলো।
কালো কুকুরটা হিমুর সাথে আছে।
হিমু কুকুরটার নাম দিয়েছে টাইগার।
টাইগার বললেই কুকুরটা লেজ নেড়ে হিমুর কথার জবাব দেয়।
কুদ্দুস র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে।
র্যাপিড এক্যাশন ব্যাটালিয়ন -৪
কানা কুদ্দুসকে গ্রেফতার করে।
হিমু কুদ্দুসকে বলেছে- তুমি চিন্তা করো না।
তোমার কন্যা রিয়া আমার কাছে আছে। সে ভালো আছে।
খুব ভালো থাকবে।
তুমি তোমার ১৪ বছরের সাজা ভোগ
করে- তোমার মেয়েকে আমার কাছ
থেকে নিয়ে যাবে।
মাজেদা খালা বাসায় ফিরে গেছেন।
মাজেদাকে দেখেই আখলাক সাহেব
অনেক আহ্লাদ করলেন।
মাজেদা বললেন- তুমি আমাকে কোনো দিনও ছাড়িয়ে আনতে পারতে না। হিমুকে দেখেই ভরসা পেলাম।
আখলাক সাহেব বিশ লাখ
টাকা রিয়ার নামে ব্যাংকে রেখে দিয়েছে।
রিয়া রুপার কাছে খুব ভালো আছে।
আকাশের অবস্থা ভালো না।
যে কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে।
টাইগারকে নিয়ে হিমু গেল রাস্তার
পাশের চায়ের দোকানে। হিমু এক কাপ চা নিল।
চা টা ভালো বানিয়েছে।
হিমু টাইগারকে দু’টা বিস্কুট দিল।
টাইগার খুব আনন্দ এবং আগ্রহ নিয়ে বিস্কুট খাচ্ছে।
হিমু চায়ের কাঁপে চুমুক দিতেই ঝুম বৃষ্টি নামল।
সাথে তীব্র বাতাস, মনে হচ্ছে চায়ের দোকান উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
টাইগার দুইবার ঘেউ ঘেউ করে হিমুর পায়ের কাছে গিয়ে বসল।
হিমু টাইগারের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল- কোনো ভয় নেই, আমি আছি।
চায়ের দোকানের মালিক শামছু কি মনে করে হঠাত একটা বেনসন সিগারেট
ধরিয়ে গান ছাড়ল- “একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই/ আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ/ সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই”।
হিমু গানের তালে তালে মাথা দুলিয়ে বলল শামছু চা তো ভালো বানিয়েছো- দেখি, আরেক কাপ দাও তো।
শামছু বলল- হিমি ভাই, রাতে সবজি খিচুরী রান্না করবো।
আপনার দাওয়াত।
হিমু বলল- দাওয়াত কবুল করলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত