ফুপির বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই বাবার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। এর আগে কখনো বাবার বুকে ব্যাথা হতে দেখিনি। আমি ডাক্তার ডাকতে গেলে বাবা নিষেধ করলেন। বাবার ধারণা তিনি আর বাচবেন না। মৃত্যুর আগে আমার বউ দেখে যেতে চান। অসুস্থ অবস্থায় বাবা পাত্রীও ঠিক করে ফেললেন। ফুপির একমাত্র মেয়ে ফারিয়া। আমি গোলগোল চোখ করে বললাম, “এটা কিভাবে সম্ভব বাবা! মা’তো….”
আমার কথায় বাবার বুকের ব্যাথা আরো বেড়ে গেল মনে হয়। বুকে হাত চেপে সোফায় হেলান দিয়ে বললেন, “তুই চাইলেই সম্ভব!”। আমি চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষন পরে ফারিয়া ঢুকলো বাসায়। চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। বাবাকে সালাম দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–মানুষ এত স্বার্থপর কিভাবে হয় বলো তো?
আমি বললাম,
–কি হয়েছে?
–তিনদিন ধরে নিপার কোন খোজ নাই। আজ কলেজে লজ্জ্বাবতী লতা হয়ে এসে বলে কিনা ওর বিয়ে হয়ে গেছে। হুট করে বিয়ে। তুমিই বলো এটা কোন কথা। বিয়ে জিনিসটা হুট করে কিভাবে হয়?”
ফুপি ওকে থামিয়ে বললেন,
–তুই আমার সাথে আয়। হুট করে কিভাবে বিয়ে হয় বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
ফারিয়ার বিরক্তিমাখা মুখে হাসি ফুটলো। বাধ্য মেয়ের মতো ফুপুর পেছন পেছন গেল “হুট করে কিভাবে বিয়ে হয়” সেটা জানার জন্য। প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে আমার ঠান্ডা লেগে গেল মনে হয়। একসাথে ছয় বার হাচি দিয়ে ফেললাম।
রাত দশটা। আমরা এখনও ফুপির বাড়িতেই আছি। কাল সকালে রওয়ানা হব। মা’কে এখনও কিছুই জানানো হয়নি। আমার বয়স যখন বারো বছর, তখন থেকেই বাবা-মায়ের মধ্যে আমার বিয়ে নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। মা চাইতেন ছোট খালার মেয়ে সাবিহা’র সাথে আমার বিয়ে হোক। আর বাবা চাইতেন ফারিয়ার সাথে। আমি একবার বাবার দিকে তাকালাম। কি হাসিখুশি দেখাচ্ছে! বাবার অভিনয় প্রতিভা দেখে সত্যি আমি মুগ্ধ। চাকরি-বাকরি না করে বাবা যদি নাটক-সিনেমা করতেন তাহলে বেশ হত। তবে আজ মা-বাবা সম্পর্কে নতুন ধারণা হল। মা যতটা বদরাগী, বাবা তারচেয়ে বেশি জেদী। কথায় মায়ের সাথে না পারলেও, কাজে ঠিকই করে দেখিয়েছেন। এদিকে ফারিয়া তখন থেকে কেদে যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। কাদতে কাদতে হেচকি উঠে গেছে ওর। আমি নিশ্চিত ওর কোন বয়ফ্রেন্ড আছে। এর মানে হলো সারাটাজীবন ওর কাছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার হয়ে কাটাতে হবে। নিজেকে কি বলে শান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছিনা। তবে এইমুহূর্তে আমার উচিত ফারিয়াকে শ্বান্তনা দেওয়া। একগ্লাস পানি হাতে ফারিয়ার রুমে গেলাম। আমাকে দেখে ওর কান্না কিছু থামলো। আমি নরম স্বরে বললাম,
–শাড়িতে তোকে ভাল মানিয়েছে।
ফারিয়ার কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। টিশ্যু দিয়ে নাক মুছে বলল,
–থ্যাংকস।
–তোর কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারিস।
–এখন আর বলে কি হবে। যা হওয়ার তাতো হয়ে গেছে।
–তাও তুই বলতে পারিস। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তোকে সাহায্য করার।
ফারিয়া চোখ বড় বড় করে বলল,
–সত্যি সাহায্য করবে আমায়?
–অবশ্যই। তুই শুধু একবার বল কি করতে হবে।
ফারিয়া আমার কাধে ওর কনুই রেখে বলল,
–মামীর কাছে সবসময় শুনতাম তোমার বিয়ে হবে সাবিহার সাথে। নিজেকে সবসময় “চন্দ্রমুখী” আর সাবিহাকে “পার্বতী” ভাবতাম। তাই ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে নিয়ে কখনো স্বপ্ন দেখিনি। আজ হঠাৎ এইভাবে তোমাকে পেয়ে যাব সেটা কল্পনা করিনি। অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে যাওয়ার আনন্দ কান্না হয়ে বের হচ্ছিলো। যাইহোক, মূল কথা হচ্ছে, আমি তোমাকে ভালবাসি। এখন তোমার কাজ হচ্ছে আমাকে আমার চাইতে বেশি ভালবাসা। এইটুকুন সাহায্য আমাকে করতে পারবেন শ্রাবণ সাহেব?”-
ফারিয়ার কথার মাঝখানে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়ে ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল। গরমে আমি আবার ঘামতে শুরু করেছি। অন্ধকারের মধ্যেই ফারিয়া আমার হাত ধরলো। আমার মনে হল এইভাবেই অন্ধকারের মধ্যে হাত ধরাধরি করে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেই!
বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকার পর থেকেই মা ঝিম মেরে বসে আছেন। সব ঘটনা শুনার পর শুধু একটা কথাই বলেছেন, “দূর হ আমার সামনে থেকে, গাধা কোথাকার!”
আমি মায়ের সামনে থেকে দূর হয়ে বাবার সামনে গেলাম। বাবা আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বাবার পাশে বসলাম। বাবা বললেন,
–আমি যা করেছি ভেবেচিন্তেই করেছি। ফারিয়ার জন্মের পর পরই যখন ওর বাবা মারা যায়, তখন আমার একটা কথাই মনে হয়েছে যে এই মেয়েকে কখনো কাদানো যাবেনা। ও শুধু আমার কলিজার টুকরা না, আস্ত কলিজা। আমি জানি সে তোমাকে মনে মনে খুব পছন্দ করে। কিন্তু তুমি হাদারাম এই ব্যাপারটা কোনদিন বুঝবেনা সেটাও জানি। এই মেয়ের মুখেই আমি প্রথম ‘মামা’ ডাক শুনেছি। চাইলে আমি ভাল কোন পরিবার দেখে আমি ওর বিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু নিজের কাছে এনে রাখার সুযোগ থাকতে অন্য ঘরে বিয়ে বিয়ে হোক এটা আমি চাইনি। আমি চাই মেয়েটা সবসময় আমার চোখের সামনেই থাকুক। সাবিহাকে দেখার জন্য ওর পুরো বংশ আছে। কিন্তু ফারিয়ার, আমি আর ওর মা ছাড়া কেউ নেই। অবশ্য নতুন করে তুই ওর জীবনে যুক্ত হয়েছিস। এখন বল, তোর কি কিছু বলার আছে?
আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।
–বল।
–মা আমাকে গাধা বলেছে।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–মায়েরা গাধা বললে কিছু হয়নারে গাধা!
ফারিয়ার উপরে মায়ের কোন রাগ নেই। ফারিয়াকে মা আগে যেমন ভালবাসতেন এখনও তেমনই ভালবাসেন। মায়ের সব রাগ বাবার ওপর। মা বাবার মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন,
“তুমি যে কান্ডটা আজ করলে, এর প্রতিশোধ আমি একদিন ঠিকই নেব৷ যদি না নেই তাহলে…তাহলে..
বাবা বললেন,
“তাহলে কি?”
“তাহলে আমি তোমার বউ না!”
এটাই ছিল বাবা-মায়ের আজপর্যন্ত শেষ কথোপকথন। এরপর থেকে বাবার সাথে মায়ের কথা বন্ধ। তবে বিশেষ প্রয়োজনে তাদের কথার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে আমার ছোট ভাই শাওন আর ফারিয়া। এরা দুজন সমবয়সী। দুজনে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার চেয়ে মজা পাচ্ছে বেশি। মাঝে মধ্যে তারা বাবা-মায়ের কাছে ভুলভাল তথ্য দিয়ে তাদের মধ্যে আরো প্যাচ লাগাচ্ছে। যেমন, দেখা গেল বাবা কোন জরুরি ফাইল খুজে পাচ্ছেনা। তখন শাওনকে দিয়ে মায়ের কাছে খবর পাঠায়। মা ঠিকই বলে দেয় ফাইল কোথায় আছে। কিন্তু ফারিয়া খবর নিয়ে যায় উল্টো। গিয়ে বলে, “মামী বলেছে বলতে পারবেনা, কিছু জানার থাকলে নিজের মুখে এসে বলতে।” বাবা নিজের মুখে কিছুই বলতে যান না। পুরো ঘর এলোমেলো করে নিজেই ফাইল খুজতে থাকেন।
বাবার সাথে মায়ের কথা হয় প্রায় পাচমাস পর। ফারিয়াকে নিয়ে আমরা সবাই তখন হসপিটালে। সিড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। পা ভাঙার বদলে সে বাম হাত ভেঙে ফেলেছে। ডাক্তার বলেছে হাত পুরোপুরি ঠিক হতে কমপক্ষে এক মাস লাগবে। ফারিয়া হসপিটালের বেডে বসে পা ঝুলিয়ে আঙ্গুর খাচ্ছিলো। হঠাৎ মা এসে দুইহাতে জরিয়ে ধরে ওর কপালে চুমু দিলেন। তারপর বাবার পাশে গিয়ে বসে বললেন,
–নাতি হোক বা নাতনী। নাম কিন্তু আমি রাখব।”
আমার বুঝতে একটু সময় লাগলো। ফারিয়ার হাত ভাঙা নিয়ে চিন্তা করছিলাম দেখে ডাক্তার বলেছিল এর সাথে একটা সুসংবাদ ফ্রি আছে হয়তো। কিছু রিপোর্টস আসার অপেক্ষা শুধু।
“বাবা” হওয়ার আনন্দে আমি আমি আমার বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার আনন্দ দেখে বাবা এই প্রথম মায়ের সাথে তর্কে গেলেন না। হাসিমুখে নাম রাখার বলিদান দিয়ে দিলেন।
আমার ছেলের জন্ম হলো প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে। আমি তখন শহরের বাইরে ছিলাম। ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রায় উড়ে বাড়িতে আসলাম। ফারিয়া ছেলে কোলে নিয়ে বসে ছিল। আমাকে দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও হাসে! একদম ফারিয়ার হাসি পেয়েছে ছেলেটা। ফারিয়া শাওনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “মামীকে গিয়ে বল আব্দুল করিমের বাপ চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি যা।”
আমি বুঝলাম ছেলের নাম আব্দুল করিম রাখা হয়েছে। আমার মা শাহ আব্দুল করিমের বিরাট ফ্যান। সেই খুশিতেই এই নাম রাখা হয়েছে। আমি অনেকটা আশা নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
–ডাক নামও কি রাখা হয়ে গেছে?
–না। তবে ডাকনাম কি হবে সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
–ও।
ফারিয়ার আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
–আচ্ছা তোমার নাম কে রেখেছিলেন?
–বাবা।
–ও আচ্ছা।
এমন সময় মা ঘরে ঢুকলেন। আব্দুল করিমকে কোলে নিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,
–অনেক খুজেও মনমতো ডাকনাম খুজে পেলাম নারে। এই দায়িত্ব তোর বাবাকেই দে শ্রাবণ।”
ছেলের ডাকনাম রাখা হলো শুভ্র। তাহলে পুরো নাম দাড়ালো “আব্দুল করিম শুভ্র”। খারাপ না। ডাকনাম রেখেছে ফারিয়া। আকিকার দিন সবাই আসলেও ছোটখালা আসেন নি। আমার বিয়ের পর থেকেই খালা আমাদের ওপর নারাজ। খালা না আসায় মা খুব কষ্ট পেয়েছেন। সারাদিন অপেক্ষা করতে করতে শেষে বিকেলে নিজেই মাংস নিয়ে খালার বাড়ি রওয়ানা হলেন।
সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বাবা আর ফারিয়া কি যেন মিটিং করছিল। আমি যেতেই বাবা মোবাইলে একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে বললেন,
–আমার বন্ধুর মেয়ে। মিষ্টি না?
আমি ছবি দেখে বললাম,
–খুব মিষ্টি। পিপড়া উঠে যাবে এমন মিষ্টি।
কথাটা বলার পর মনে হলো ফারিয়ার দিকে তাকানো উচিত। তাকিয়ে দেখলাম ওর দুই চোখ পানিতে টলমল করছে। ভাল হয়েছে। কাদুক। ছেলের জন্মের পর থেকেই সারাক্ষন কানের কাছে “আব্দুল করিমের বাপ, আব্দুল করিমের বাপ” বলতে থাকে। ওর কাছে আমার এখন একটাই পরিচয়, আব্দুল করিমের বাপ!
আমি গালে হাত রেখে ফারিয়ার কাদো কাদো মুখ দেখছিলাম। বাবার ডাকে সোজা হয়ে বসলাম। বাবা বললেন,
–তোর মাকেও দেখিয়েছি ছবিটা। পছন্দ হয়েছে। ভাবছি এই মেয়ের সাথে শাওনের বিয়ে দিলে কেমন হয়?
–খুব ভাল হয়।
–হ্যা, তোর মাও আমার সাথে একমত।
–মা তোমার সাথে একমত? ব্যাপারটা কেমন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা বাবা।
–ইয়েস মাই সান। বিশ্বাস করতে পারো। আর বন্ধুকে আমি পাকা কথা দিয়ে ফেলেছি।
–তাহলে তো ভালই। কিন্তু মা কোথায়?
মায়ের খোজ করতে গিয়ে জানা গেল তিনি এখনও খালার বাসা থেকে ফেরেন নি। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আটটা বাজে। এতদিন পর খালার সাথে দেখা হয়েছে। বোনে বোনে কত গল্প জমা হয়ে আছে। আজকে মায়ের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে শিওর হওয়ার জন্য একবার ফোন করা দরকার। ফোন হাতে নিতেই শাওনের ফোন এল। ফোনের ওপাশে গলা ফাটিয়ে কান্না করছে,
–ভাইয়াআআ…..!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
–ঘটনা কি? আবার কোন ড্রেনে পড়েছিস?
–ড্রেনে পড়িনি। ঘটনা এরচেয়ে ভয়াবহ।
–কি হয়েছে?
–মায়ের বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে।
–বলিস কি! তুই খালার বাসায় কখন গেলি?
–একঘন্টা আগে। মা বলল একা বাসায় যেতে পারবেনা। তাই আমি যেন গিয়ে নিয়ে আসি। এখানে আসতেই মায়ের বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। মা মনে হয় আর বাচবেনা ভাইয়া। মায়ের শেষ ইচ্ছা কি জানো?
–মনে হয় জানি।
–আমি এখন কি করবো?
–কি আর করবি। শেষ ইচ্ছা পূরন কর।”
আমি ফোন রেখে দিলাম। ফারিয়া এতক্ষন আমার কানের সাথে কান লাগিয়ে কথা শুনছিল। ফোন রাখতেই এমন ভঙ্গি করে চলে গেল যেন আমাকে চেনেই না।
পরেরদিন সকাল এগারোটায় শাওন আর মা বাড়িতে ঢুকলেন। বাবাকে রাতেই আমি সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছি। হঠাৎ করে এমন সংবাদ শুনলে হার্ট এট্যাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরও বাবা সাংঘাতিক রেগে আছেন। শাওন বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগে বাবা ধমক দিয়ে বললেন, “দূর হ আমার সামনে থেকে ছাগল কোথাকার!”
শাওন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
“আমি মোটেও ছাগল নই বাবা। আমি অনেক বুদ্ধিমান!”
বাবা বসা থেকে এক লাফে উঠে পড়লেন। অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয় এটা বুঝতে পেরে বুদ্ধিমান শাওন দৌড়ে আমার আর ফারিয়ার পিছনে চলে এল। ফারিয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
–তুই একা কেন? সাবিহা কই?
শাওন ভ্রু কুচকে তাকাল। সেও ফারিয়ার মত ফিসফিস করে বলল,
–সাবিহা আসবে কেন?
এরা দুজন এত আস্তে আস্তে কথা বলছে যে আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা। তবে যা বুঝলাম তা হলো, বিয়ে-টিয়ে কিছু হয়নি। তাহলে কাল রাতে হয়েছেটা কি? যাইহোক ভালই হয়েছে। আমার এখন উচিত বাবাকে গিয়ে খবরটা দেওয়া।
বাবার ঘরে ঢুকে আমি পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। দেখলাম মা বাবার মাথার চুল টেনে দিতে দিতে খুব শান্ত গলায় কথা বলছেন। শেষ কবে বাবা-মাকে এত শান্তভাবে কথা বলতে দেখেছি মনে পড়ছেনা। তাদের দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। মা বাবাকে বলছেন,
“রাগের মাথায় সেদিন প্রতিশোধ নেব বলেছিলাম। আর তুমি সেটা এখনো মনে নিয়ে বসে আছে? তোমার অনুপস্থিতিতে আমি আমাদের ছেলের বিয়ে দিয়ে দেব এটা ভাবলে কি করে। হাজার হোক তুমি আমার স্বামী। তোমার অনুমতি ছাড়া কোন কাজ আমি করতে পারি? কাল রাতে আমার বুকে ব্যাথা করছিল দেখে সাবিহা আর যেতে দিলনা। তাই থেকে গেছি। আর তুমি কি ভেবেছো? ছেলের বিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি! এতদিনে এই চিনলে আমাকে?
কথা বলতে বলতে মায়ের গলা ধরে এল।
বাবা মিটিমিটি হাসছেন। খুশি খুশি গলায় বললেন,
–আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই করবেনা। জিজ্ঞেস করো কেন।
–কেন?
–কারন তুমিতো আমারই বউ।
মা লজ্জ্বা পেয়ে হাসলেন। বাবা আবার বললেন,
–আচ্ছা, সাবিহার মায়ের রাগ কমেছে?
ছোটখালার নাম নিতেই ছোটখালা হাজির হয়ে গেলেন। বুবু….ও বুবু বলতে বলতে আমাকে ঠেলে রুমে ঢুকে পড়লেন। মা’কে জড়িয়ে ধরে ভ্যা করে কাদতে কাদতে বললেন,
“কাল রাতে একটুর জন্য বিয়েটা হলোনা। বিশ্বাস করো বুবু, আমি যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেতাম হতভাগী পালিয়ে যাবে, তাহলে ওর হাত-পা গরু বাধার দড়ি দিয়ে বেধে রেখে দিতাম। এই মেয়েকে আমি ত্যাজ্যকন্যা করবো বুবু। কিন্তু তুমি আমার ওপর রাগ করে থেকনা। তুমি চলে আসার পর থেকে মনটা খুতখুত করছে৷ এই জীবনে কখনো তুমি আমার ওপর রাগোনি।”
মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঠোঁট ওল্টে কেদে ফেলবেন। আর ওদিকে বাবা চোখ বন্ধ করে এখন নিজের চুল নিজেই টানছেন।
পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি চাইলেও কিছু করতে পারবোনা। তারচেয়ে বরং আমি আমার ফারিয়াকে খুজি। বেচারি কাল রাত থেকে আমার ওপর অভিমান করে শুধু মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছে। আর কিছু খাচ্ছে না। আমি পৃথিবীর সমস্ত মায়া আর ভালবাসা মিশিয়ে কোমল স্বরে ডাক দিলাম, ও আব্দুল করিমের মা!