তার নাম মতিয়ার মিয়া। ডাক নাম মতি। মেহেন্দিগঞ্জ এলাকার নাম করা চোর মতিকে সবাই একনামে চেনে।
বিষন্ন মনে উঠোনে বসে আছে। স্ত্রী ফুলবানুকে দেখে দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বলে, দেখ বউ দিনকাল বদলে গেছে।মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনা উঠে যাচ্ছে। আমি বয়সে গ্রামের অনেকের বড়। অথচ গ্রামের মানুষ আমারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ছোটখাট চুরির বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে।
সেদিন পুকুর পাড়ে বসে আছি। রশিদ মেম্বারের কলেজ পড়া ছেলেটা একটা মোটরসাইকেলে ভোঁ ভোঁ হর্ন বাজিয়ে হাওয়াই সার্টের বোতাম খুলে এসে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? কি করিসরে তুই ওখানে? আমি ভাঙা গলায় জবাব দিলাম, কোন লাট সাহেবের বেটা রে তুই যে বাপের বয়সি একজনের সাথে এভাবে কথা বলিস? মেম্বারের ছেলে একটু লজ্জাও পেলনা। বলল তোর মত চোর মানুষকে আপনি করে বলতে হবে কেন?
বল ফুলবানু আমি কি গ্রামের কারো চুরি করি? তা ছাড়া আমি মাদ্রাসা, মক্তব, এতিমখানা সবখানে দান খয়রাত করি। সেই জন্যতো আজও আমি একজন সফল চোর হতে পারলামনা, সয় সম্পত্তি কিছু করতে পারলামনা। ওর বাপ রশিদ মেম্বার, সামাদ চেয়ারম্যান ওরা যে গরিবের রিলিফের বস্তা বস্তা চাল, গম, টিন চুরি করে খাচ্ছে, সেকথা কি আমরা ওদের সামনে বলতে পারি, তুই তুকারি তো দূরের কথা।
বুঝছো ফুলবানু, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এলাকা ছেড়ে চলে যাই। নেহাত বাপদাদার কবর এখানে, তাই এ অঞ্চলে পড়ে থাকা, নইলে ঝাটা মেরে কবে ছেড়ে চলে যেতাম।
এসব কথা বলতে আপনের শরম লাগেনা। চুরিও করবেন, আবার মানুষের প্রশংসা পাওয়ার লোভ করবেন, এটা কেমন কথা?
তুই এটা কেমন কথা বলস ফুলবানু। চুরি করি বলে আমার মান সন্মান কিছুই নাই।
আচ্ছা এতই যদি মান সন্মানে লাগে, তবে এই পাশা ছেড়ে আর কিছু করেন না কেন?
চুরিচামারির কাম ছাড়া অন্য কিছু করতে পারিনা, করতে ভাল লাগেনা, গলার স্বর নিচু করে মতি বলল।
কেন?
একসাথে অনেক কাজ করলে কোনটাই ই ভাল হয়না।
আল্লাতা’লা আমাকে একটা বিদ্যাই দিছে। চুরির বিদ্যা। অন্য কোন বিদ্যা দেয় নাই। তাছাড়া তুমিতো জান আমরা কয়েক পুরুষ ধরে চোর। আমার দাদা চান্দু চোর এই জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চোর ছিল। তার নাম শোনা মাত্র এ এলাকার গৃহস্তরা আঁতকে উঠতো। বৃদ্ব বয়সে যখন সে চলাচল করতে পারতনা, তখন দূর দুরান্ত থেকে লোকজন তাকে একনজর দেখতে আসতো। চুরি পেশা আমার শিরায় শিরায়, রক্তে রক্তে, বুঝলে ফুলবানু।
কবে যে চুরিবিদ্যা ছেড়ে দিয়ে ভাল হয়ে যান ঠিক নাই। তার আগে আমার জন্য পাঁচ ভরি সোনা চুরি করেন। আমার অনেক দিনের শখ। যে কয়টা দিন বাঁচি আরাম কইরা বাঁচি। ভালমন্দ কিছু খাবার খাই। দুই হাতে চার গাছি সোনার চুরির আমার বড় শখ। আর গলার একটা হার।
চিন্তা করনা বউ। শীত আসুক। মান্নান ব্যাপারীর বাড়িতে অনেক সোনাদানা আছে। খবর পাইছি। শীতের সময় রাতে লোক চলাচল কমে যাবে। তবে জান কি বউ দিনকাল বদলে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন হল গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। সবার হাতে এখন হাই ভোল্টেজের চারজার লাইট, মোবাইল ফোন। এখন চুরি করা আর আগের মত সোজা নয়। মনে হয় শেষমেশ পৈত্রিক এই পেশাটি ছেড়েই দিতে হবে। এসব চিন্তাভাবনা করতে করতে তার প্রচন্ড মাথা ধরে গেল। ফুলবানুকে তার মাথা ধরার ব্যাপারটা জানতে দিলনা।
তবে বউ আমি ভেঙ্গে পড়ি নাই। আমার মত ঝানু চোরের ভেঙ্গে পড়া মানায়ওনা। এই তল্লাটে চুরির লাইনে আমার ধারে কাছেও কেউ নেই। গত ত্রিশ বছরে একবার মাত্র ধরা পড়েছি।কাজেই দশদিন চোরের একদিন গেরস্থের কথাটা আমার জন্য খাটেনা।
সেবার ছাতার দিঘির কাশেম মাষ্টারের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ভাগ্য দোষে ধরা পড়েছিলাম।তখন সবে চুরি করা শুরু করেছি। আগেই পাকা খবর ছিল ওখানে সোনাদানা আছে। আলমারির দরজা ভেঙ্গে একটা বড় গলার হার ও বেশ কয়েকটা হাতের চুড়ি নিয়ে বের হব এমন সময় মাস্টারের বউ আমাকে হঠাৎ দেখে ফেলে এমন জোরে একটা চিক্কর মারল সারা মাস্টার পাড়ার লোকজন জেগে উঠল। জান বাঁচাতে আমি বাড়ির পিছনের ডোবায় লাফ দেই। কিন্তু ততক্ষনে আট দশজন ঘিরে ফেলেছে আমাকে। আমারে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে একটা কাঠাল গাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে কী যে মারা মারল, বলার মত না। দোআ ইউনুস পড়তে লাগলাম। আচ্ছা মতো পিটিয়ে তক্তা বানানো হলো আমাকে।পাছায় ও কোমরে ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে লাথি মারে। পরে বাঁশডলা দেয়। ডান হাতের হাড় ফেটে গিয়েছিল। রক্ত বমি হয়েছিল। মেরুদন্ডের ব্যাথাটা এখনো যায় নি।
মাইরের চোটে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে পুলিশ এসে আমাকে থানায় নিয়ে যায়। ভাগ্য ভাল মাষ্টার সেদিন বাড়িতে ছিল না। থাকলে থানায় না নিয়ে আমাকে সোজা মর্গে যেতে হত। ওই সোনার হার ও চুড়িগূলো নাকি মাষ্টারের মায়ের ছিল। মাস্টারের দাদি সেগুলো নতুন বউ মাষ্টারের মাকে দিয়েছিল। বছর খানেক আগে উনি মারা গেছিল। সেই স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনাই। অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যাথার মতই মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে উঠে। বুঝলে বউ পাবলিকের মাইর আর ঘরোয়া মাইরের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্দতা। ব্যাপারির বাড়ির বিদ্যুতের বাতির ঝাপ্সা আলো এত দূর থেকেও দেখা যায়। কিন্তু জায়গাটা আর ভাল নেই। গায়ে কয়েক জায়গায় তারপিন তেল মেখে একটা কালো গেঞ্জি চাপিয়ে থলি আর তেলের শিশি নিয়ে মন্ত্র জপ্তে জপ্তে বেরিয়ে পড়ল মতি চোর। সরু একটা রাস্তার শেষে একটা মাঠ। মাঠটা পেরোলেই ব্যাপারির বাড়ি। মাঠের মাঝখানটায় বড় বট গাছটার নিচে যেখানে গ্রামের চ্যাংড়া ছেলেগুলো আড্ডা দেয় সেখানে বসে পড়ল মতি। মৃদুমন্দ বাতাসে শুকনো পাতা পড়ার শব্দ। ঝিঝি ডাকছে চার পাশে। কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল দূরের নীল কুয়াশায়। উত্তরের বিলের ওপারে শ্মশান থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে।
কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেন যেন অচেনা লাগছে আজ মতির কাছে। ব্যাপারীর টিনের চালার কাছে অন্ধকার ভেদ করে কালো কালো ছায়া শরীর বা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। দিয়াশলাই জ্বালানোর আর বিড়ির ধোঁয়ার আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল লাঠি হাতে ব্যাপারির বাড়ির লোকজন পাহারা দিচ্ছে। মতি বুঝল আজ তার কপাল খারাপ। আর একটু হলেই ধরা পড়তো।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। এই কন কনে শীতেও তার শরীর বেয়ে ঘাম পড়ছে। মন্ত্র পড়তে পড়তে ফিরে চলল। আজ আর তার মন সায় দিচ্ছেনা। কিন্তু একবার মন্ত্র পড়লে তো আর খালি হাতে ফেরা যায়না। ফেরার পথে জেলে পাড়ার এক জেলে বাড়ি থেকে একটা হুইল চেয়ার মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরল।
তুমি রুগিদের এই চেয়ার কোথা থেকে আনলে? আমার জন্য গলার হার এনেছো?
না বউ আনতে পারিনাই। কপাল খারাপ। ব্যাপারির বাড়িতে পাহারা বসাইছে। জান নিয়ে ফিরে আসলাম। খালি হাতে তো আসা যায়না। তাই আসার পথে জেলে পাড়ার এক বাড়ির আঙ্গিনা থেকে চেয়ারটা আনলাম। তাই বলে তুমি বুড়া মাইনসের চেয়ার আনবে? চোর হয়েছো বলে কি বিবেক বুদ্বি পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হবে।
এত কিছু দেখলে চোর হওয়া যায়না।
রাগ করনা ফুল। তুমি যদি রাগ কর তাহলে আমি কোথায় যাই বল?
আসলে আমার কপাল খারাপ। না হলে তোমার মত একজন চোরের সাথে আমার বিয়ে হয়? মানুষের সাথে মিশতে শরম লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কুকর্মের কথা মানুষের কাছে কইয়া দেই।
না ফুলবানু, মাথা গরম কইরনা। তোমার কপাল ভাল যে তোমার মত একজন সামান্য ভিখারীর মেয়ে আমার মত একজন নামকরা চোরের সাথে বিয়ে হয়েছে। আমি ইচ্ছে করলে আরো ভাল ঘরে বিয়ে করতে পারতাম। যাক যা হবার হয়েছে। এখন আমাদের এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি না করে বুদ্বিমানের মত একসাথে সংসার করতে হবে। ভাতের নিশ্চয়তা চাই। শরম দিয়ে, সন্মান দিয়ে কি পেট ভরে? যদি না খেয়ে থাকতে হয়—তাহলে শরম, সন্মান ধুয়ে পানি খেয়ে কি করবা?
দুপুর বেলা মতি রেডিওতে হিন্দি গান শোনে আর দাড়িতে মেন্দি লাগায়। ফুলবানু পান খেতে খেতে মুখ লাল করে বলে, কি গো জুয়ান সাজতেছো যে। নতুন একটা বিয়ে করবা নাকি। আমি ভেবে পাইনা সারা রাত চুরি করে দিনের বেলা আবার এত রস করতে পার কিভাবে?
সেদিন করিমগঞ্জের রজব চোরের কাছে শুনলাম শহর এলাকায় সি সি নাকি ছি ছি ক্যামেরা চালু হয়েছে, সেটা দেখে সহজেই চোর ধরা যায়। বাপ দাদার পেশা মনে হয় আর ধরে রাখা যাবেনা। মতি ছোট শিশুর মত কাঁদতে লাগলো। পরক্ষনই সে মনোবল ফিরে পেয়ে বলতে লাগল, আমি যদি আমার চুরি করা যন্ত্রপাতি সাথে নিয়ে বের হতে নাও পারি, তাহলে খালি হাতেই চুরি করতে পারব। তাছাড়া মন্ত্রতো আছেই। নিত্য নতুন প্রযুক্তি দিয়ে মন্ত্রের শক্তি কেউ ধ্বংস করতে পারবেনা। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদেরও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
তবে বউ আর একটা কারনে মন খারাপ হয়। সেটা হল পুলিশ কিন্তু আমাদের মত ছোট চোরদের ধরে, বড় চোরদের কিন্তু ধরেনা বা ধরতে পারেনা।
তবে এত কিছুর পরেও চুরির কর্ম কঠিন কিছু নয়, আমি মনে করি। সমস্যা হল চুরির মাল খাপানো বা লুকিয়ে রাখা। আমি শুনেছি বড় বড় চোরেরা তাদের চোরাই মাল সহ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় পালিয়ে যায়। কিন্তু এদেশগুলো কোথায় তা একমাত্র দুষ্ট দেবতারাই জানে। আমেরিকা দেশটি কোথায়? আমিতো লেখাপড়া জানিনা। তাই বড় চোর হতে হলে তোমার অবশ্যই শিক্ষা থাকতে হবে, তোমাকে শিক্ষিত হতে হবে। আমার মত অশিক্ষিত চোর বেশি কিছু চুরি করতে পারবেনা আজকাল।তার ঘরের অপ্রশস্ত বারান্দায় বসে মতি চোর ঘন কালো মেঘলা আকাশের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ঘন কালো সঙ্কুচিত আকাশে কিসের যেন অস্পষ্ট, আতঙ্কের বানী। অন্তরের ও বাইরের রেখায় রেখায় মিল। বিষণ্ণতায় ভরা দিনটা।