খুব সকালবেলা বাসায় এসে পৌঁছালেন মকসুদ সাহেব। গত এক সপ্তাহ তিনি ছিলেন ফ্লোরিডায়, ব্যবসায়িক কাজ ও অবকাশ যাপন- দুটোর সূত্রেই। ভোরবেলা উড়োজাহাজ মাটি স্পর্শ করার পর বেশী সময় এয়ারপোর্টে খরচ করতে রাজি হন নি। উবারে একটা গাড়ি ডেকে মিরপুরে তাঁর ফ্ল্যাটের দিকে চলে এসেছেন। ভ্রমণের ক্লান্তি এবং জেটল্যাগে বিধ্বস্ত শরীর।
ফ্ল্যাটের লিফটে আট চাপলেই তাঁর বাসায় পৌঁছে যাওয়া যায়। সোজা বের হয়ে হাতের ডানের প্রথম দরজাটি তাঁর। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন তাঁর এক মেয়েকে নিয়ে। বয়স পঁয়ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার তিন বছর পার হলেও আর কোন বিয়ে করেন নি। এমনও হতে পারে যে আর আগ্রহ পান না। একমাত্র ছোট মেয়েকে বনশ্রীতে দাদুর বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। এখন ফেরত আসার পর সময় করে নিয়ে আসবেন। এই চিন্তা তাঁর মাথায় পুরো দিনের কর্মকাণ্ড হিসেবে ঘুরপাক খাচ্ছে ভোর থেকে। ধীরে ধীরে আরও বিক্ষিপ্ত হতে থাকছে চিন্তার শাখাপ্রশাখা। বিস্রস্ত দেহ-মন নিয়েই দরজা খুলে বাসায় ঢুকলেন।
একপাশে ব্যাগ রেখে, বেসিনের পাশে ঝোলানো তোয়ালে নিয়ে শাওয়ার নিলেন। ফ্রিজ থেকে একটা ডিম বের করে ভেজে নিয়ে, তার সাথে দুধের প্যাকেট খুলে ছোট করে চনমন করে ওঠা ক্ষিদে মেটালেন। ক্লান্তির সাথে ঘুম ধীরে জেঁকে বসছে। নিজেকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকবেন এবং শরীর বিছানায় এলিয়ে দিবেন ভাবছেন, এমনকি এক পা দিয়েও দিয়েছেন ঘরে, ঠিক তখনই বিছানার সামনে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেলেন।
সাদা রঙের চাদর বিছানো খাটে কেউ শুয়েছে এরকম কোন চিহ্ন নেই। বিছানার পাশে বেডসাইড টেবিল, তাতে একটা ছোট ল্যাম্প, বন্ধ। টেবিলের উপরে মাঝারি আকারের একটা ওয়াল-লকার। সেটার রঙ আর দেওয়ালের রঙ প্রায় একসাথে মিশে গেছে। না খুললে আলাদা করে বুঝার উপায় নাই সেখানে কিছু আছে। কিন্তু, এখন সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে লকারের অস্তিত্ব। কারণ, সেটি খোলা আর নিচের টেবিলে সারি সারি করে টাকার বাণ্ডিল সাজানো।
মকসুদ সাহেব হতবাক হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি কাটিয়ে উঠলেন দ্রুত। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখেন জানালা লাগানো, পর্দা সাঁটা। অন্যান্য জিনিসপত্র- ওয়ার্ডরোব, চেয়ার, লেখার টেবিল, বইয়ের ছোট কেস কোনকিছুই তাদের স্থান থেকে নড়ে নি। এমনকি বিছানার চাদরও এলোমেলো না। টাইলসের মেঝেতে কারও জুতোর ছাপ নেই। কোথাও কারও অনুপ্রবেশের চিহ্ন দেখছেন না। তাতে দুশ্চিন্তা, সংশয় আরও শক্ত হয়ে চেপে বসলো তাঁর কাঁধে, তা বেয়ে পিঠ এবং কোমরের নিচ পর্যন্ত। এক্ষণে তাঁর ঘুমের রেশ কেটে গেছে।
দ্রুত টেবিলের কাছে গিয়ে দুই একটা বাণ্ডিল উঠিয়ে হাতে নিলেন। অভ্যস্ত হাতে গুনে দেখলেন একটি একটি করে সবগুলো। বাণ্ডিলে আটকে থাকা টাকার অঙ্কও হিসেব করে নিলেন। বিশটার প্রতিটিতে একশ করে এক হাজার নোট। বিশ লাখ টাকা। কোন হেরফের নাই। যাওয়ার আগে লকারে এত পরিমাণ টাকাই রেখে গিয়েছিলেন। তাহলে? এগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে কেন?
তাঁর স্পষ্টতই মনে আছে, যাওয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু দেখে নিয়ে, ঠিকঠাক বন্ধ করে তারপর বেরিয়েছিলেন। সোমবারই তো! তারিখটাও মনে আছে- ৯ তারিখ। সকালে নীলকে দাদুর বাসায় দিয়ে এসে বিকেলবেলা একচোট ঘুমিয়ে নিয়েছিলেন। তাও ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে। উঠে বাইরে থেকে কিনে আনা বিরিয়ানি খেয়ে এক ক্যান লন্ডন ব্ল্যাক বারান্দায় বসে বসে শেষ করেছিলেন। তারপর উঠে বারান্দার দরজা বন্ধ করলেন, ওয়ার্ডরোবের প্রতিটি ড্রয়ার ভালো করে লাগালেন, লকার খুলে এমাউন্ট চেক করলেন এবং নিশ্চিত হয়ে কম্বিনেশন সহকারে বন্ধ করে দিলেন। রাত দশটায় যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, বাইরের দরজার নব কয়েকবার যে ঘুরিয়েছিলেন এটাও মনে আছে। তাহলে টাকাগুলো বাইরে কিভাবে?
হতে পারে কেউ চুরি করতে ঢুকেছিলো, কিন্তু টাকা না নিয়েই চলে গেল? না শেষ সময়ে এসে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে চোর অনুতপ্ত হয়ে চলে গিয়েছিলো? খুব হাইপারবলিক চিন্তা। আর যদি এরকম হয়, তাঁর আসবার কিছুক্ষণ আগে প্রবেশ করেছে কেউ, মকসুদ সাহেবের পদশব্দ শুনতে পেয়ে লুকিয়ে পড়েছে এক ফাঁকে, টাকা সরাবার সময় পায় নাই। এই ভাবনা মাথায় আসতেই তিনি দ্রুত খাটের নিচে একবার, ওয়ার্ডরোবের পিছনে চোখ বুলোলেন। না কেউ নাই। অনুপ্রবেশকারী যদি এত কষ্ট করে কম্বিনেশন ব্রেক করে (আর কারও তা জানার কথাও না, ভাঙা তো পরের কথা) লকার খুলে টাকা বের করে সাজিয়েই রাখতে পারে তাহলে দুই-এক বাণ্ডিল সরানো তার জন্যে কঠিন কিছু না। যত পরিমাণ টাকা রেখে গিয়েছিলেন ঠিক তত পরিমাণই কেন সাজানো?
এই ধরণের নানাবিধ প্রশ্ন এবং রহস্যময় পরিস্থিতি মকসুদ সাহেবের হতবুদ্ধিতার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রমণের ক্লান্তি ও জেটল্যাগকে উড়িয়ে দিয়ে শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগের হরমোন।
এই বাসায় তিনি কি একা?
প্রতিটি ঘর- ডাইনিং, বেডরুম, বাথরুম এবং বারান্দা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কারও অস্তিত্ব আছে কিনা নিশ্চিত হতে চাইলেন। বারান্দা দিয়ে নয় তলা নিচে মেইনরোডে প্রাইভেট কার এবং রিকশার আসা যাওয়া দেখতে পেলেন। কোথাও কেউ নেই।
তিনি ফিরে এলেন তাঁর বেডরুমে।
সবগুলো টাকা গুছিয়ে আবার লকারে তুলে রাখলেন। ভালো করে দেখলেন কম্বিনেশন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বন্ধ করলেন। এই টেবিলে কোন টাকা ছিলো না। মকসুদ সাহেবের স্বগতোক্তি।
কাপড় পরিবর্তন করে বিছানায় শুতে গেলেন। শোয়ার সময় বেডসাইড টেবিলে খালি করে যাওয়া পানির গ্লাস দেখলেন, স্থিত। গ্লাসে একটা আরশোলা মরে পড়ে আছে। বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে মকসুদ সাহেবের ইন্দ্রিয় আবার শক্ত হলো। বালিশের নিচে কিছু একটা খচখচ করে উঠেছে। দ্রুত হাতে বালিশ সরিয়ে দিলেন। দেখলেন, বাদামী রঙের এনভেলপ শুয়ে আছে। অফিসে যেরকমটা ব্যবহার করা হয়। সেটা হাতে নিয়ে খামটা খুলতেই হাতে কিছু কাগজ এসে পড়লো।
প্রিন্ট করা কাগজে টাইপ করা কিছু লেখা। ভালো করে চোখ বুলোতেই মকসুদ সাহেবের মুখ অল্প করে ফাঁক হয়ে গেলো। এ কী দেখছেন! এ যে অসম্ভব! তাঁর ফরসা বিস্মিত চেহারা লাল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেটা কি লজ্জায় না রাগে তা বোঝা যাচ্ছে না।
তিন পৃষ্ঠা জুড়ে দুইজন মানুষের অনলাইনের কথোপকথন টাইপ করা। মকসুদ সাহেব এবং তাঁর পিএ শায়লা তাসনিমের আলাপচারিতা। ফেসবুকে এক সপ্তাহ এবং আরও দুই দিন আগের চ্যাট কে যেন পরিষ্কার ভাষায় টাইপ করে এবং প্রিন্ট করে তার সামনে তুলে ধরেছে। এই চ্যাটে কী কী ছিলো সেগুলো আমরা জানতে পারছি না। কিন্তু, মকসুদ সাহেবের লাল হওয়া মুখ দেখে একটু বোধহয় আঁচ করতে পারছি।
কিন্তু- কিন্তু- এই চ্যাট তিনি ও শায়লা তাসনিম ছাড়া আর কারও সাথে তো শেয়ার করা হয় নি। আর গতকালও তো ফ্লোরিডা থেকে শায়লার সাথে তাঁর ইমোতে কথা হয়েছে। মিটিংগুলো ঠিক করা হয়েছে কিনা, দ্রুত টিকেট ম্যানেজ করা হয়েছে কিনা এগুলো জানতে চাওয়া ছাড়া আর শেষে ছোট একটা উষ্ণ চুম্বন বিনিময় ছাড়া তো তার থেকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায় নাই। আর গত এক সপ্তাহেও কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না কথোপকথনে।
এমনকি হতে পারে, শায়লা তাসনিম তাকে ব্ল্যাকমেইল করবার চেষ্টা করছে? অন্তরঙ্গ কথার সুবাদে জানিয়ে দিতে চাইছে, তোমার বেডরুমের লকারের খবর আমি জানি? কিন্তু, এতে তো কোন স্বার্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শায়লা যেটাই চেয়েছে এই দুই বছরে তাকে তাই দেওয়া হয়েছে। ওরকমভাবে তার নতুন কোন প্রয়োজনও দেখছেন না মকসুদ সাহেব। উপরন্তু, এই ফ্ল্যাটে তাঁর সাহায্য ছাড়া শায়লা তাসনিমের ঢুকবার কোন উপায়ও নাই। হতে পারে, শায়লা কোনভাবে ঢুকে টাকার গোছা সাজিয়ে রেখে বের হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, কম্বিনেশনের পিনকোড জানা তো তার পক্ষে সম্ভব না। শায়লার সামনে কখনও তিনি মদ খান না, মাতাল হয়ে বলে দেওয়ার সুযোগও নেই। আর চ্যাট প্রিন্ট করে রাখবার অর্থই বা কী? সে তো সরাসরি ফেসবুক থেকে প্রিন্ট করে নিতে পারতো। এতো ওয়ার্ড ডকুমেন্টে সযত্নে টাইপ করা। শব্দেরও কোন হেরফের নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এত বুদ্ধি খরচ করে এতসব কিছু করতে যাবে শায়লা তাসনিমের মতো ডিগ্রী পাশ করা পিএ? “শায়লা তাসনিম“ তত্ত্ব মকসুদ সাহেব ভিতর থেকে গ্রহণ করতে পারলেন না।
কিন্তু তবুও-। বাইরে থেকে হতে পারে কিছু বোঝা যায় নি। শায়লা তাসনিম যদি প্রবেশ করেই থাকে কিভাবেই বা প্রবেশ করলো আর কেনই বা- এইসব প্রশ্নের আবর্তে ঘটনার জটিলতা ভয়াবহরূপ ধারণ করলো মকসুদ সাহেবের কাছে। তিনি টের পেলেন তাঁর হৃৎকম্পন ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।
খামটাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি বিছানা থেকে নেমে পড়লেন।
বেডরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে ধীর পায়ে হেঁটে এলেন। যে চেয়ারটায় বসে ডিম ও দুধ দিয়ে নাস্তা সেরেছিলেন সেটার কাছাকাছি গিয়ে পানির জগ নিয়ে গ্লাসে ঢেলে পুরোটা এক ঢোকে শেষ করলেন। গ্লাস রাখতে যেয়ে দেখেন এঁটো প্লেটের নিচে একটা প্রিন্টেড ছবি। মকসুদ সাহেব কিছুক্ষণ আগেই এখানে ছিলেন তখনও এখানে কিছু ছিলো না।
ছবিটি নিচ থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরতেই তাঁর চোখ স্থির হলো।
মাত্রই ডেভেলপ করা। ছবিতে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, ‘মকসুদ সাহেব‘ মনোযোগ সহকারে ডিমের মামলেট কাটছেন আর তার পাশেই দুধের গ্লাস, অর্ধেক খালি।
তাঁর দশ মিনিট আগের খাওয়ার সময়কার ছবি।
তিনি চকিতে তাঁর বর্তমান অবস্থান থেকে সামনে দেখলেন, কোন ধরণের যান্ত্রিক কিছু চোখে পড়ছে না, না ক্যামেরা, না ফোন বা এমনকি তাদের ফেলে যাওয়া চিহ্ন। আরও সামনে গিয়ে দেওয়ালের পেইন্টিং সরালেন। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত চোখ বুলোলেন। কিছু নেই, কেবল ভ্যানগগের আতঙ্কিত মুখ চিৎকাররত।
এই পর্যায়ে, মকসুদ সাহেব হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। এই মুখ দেখে তাঁর চেহারার যে অভিব্যক্তি তাতে মনে হচ্ছে তিনি ধরতে পেরেছেন পুরো রহস্যজনক ব্যাপারটার তল। এরপর তাঁর পদক্ষেপও শান্ত হয়ে উঠলো। তিনি ফ্ল্যাটের মূল দরজার কাছে গেলেন। দরজাটি হাট করে খুলে দিলেন পুরোপুরি। বাইরের সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠছেও না, নামছেও না। লিফটও গ্রাউন্ডফ্লোরেই আটকে আছে, যাত্রীর অভাবে। দরজা খোলা রেখে তিনি শোবার ঘরে ফেরত এলেন। এই ঘরের দরজাও লাগালেন না। লকারের কাছে গেলেন। কম্বিনেশন দিয়ে লকারের ছোট দরজাও খুলে দিলেন। এনভেলপটা পাশের টেবিলে সরিয়ে রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন।
এই পর্যায়ে এসে গল্পটি আমাদের কাছে জটিলরূপ ধারণ করলো। লেখক নিজেও বুঝতে পারছে না, মকসুদ সাহেব হঠাৎ এত শান্ত হয়ে গেলেন কিভাবে, আর নিশ্চিন্তে শুয়েও পড়লেন কিভাবে। তাকে ধাক্কা মেরে জাগানো হলো।
মকসুদ সাহেব, গল্পের মাঝখানে আপনি ঘুমাতে লাগলেন কেন? এখন তো আপনার ক্রাইসিসের সময়!
যখন আমার আর ব্যক্তিগত বলে কিছু নাই, তখন আর এত চিন্তা করে কী হবে? বন্ধ দরজার এপারে ঘরের ভেতরও যদি নিজস্বতার নিরাপত্তা নাই, দরজা লাগিয়ে ‘নিরাপদ হয়েছি‘ এই ভান নিয়ে থেকে কী হবে? আমি তো এখন আপনার আন্ডারে, নজরদারীর আওতায়।
লেখক মকসুদ সাহেবকে কী করে বুঝাবেন, লেখক নিজেও যে কারও আন্ডারে, নজরদারীর প্রহরায়?