নিমো খুব মনমরা হয়ে থাকে আজকাল। যে ছেলেটা এত্ত ছটফটে ছিল, সারাদিন নিজের ‘এয়ারকার’-টা নিয়ে ঘুরে বেড়াত ‘অলিম্পাস সিটি’-র অলিতে গলিতে সেই ছেলেই হঠাৎ গত তিন চারদিন ধরে নিজের রুমে বন্ধ করে রেখেছে নিজেকে। গেমরুমে সব ভার্চ্যুয়াল প্লেয়ারদের হলোগ্রাফিক ইমেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিমো সেই রুমে উঁকি দিয়েও দেখে না। অথচ আগে ওই রুম থেকে ওকে বের করাই দুঃসাধ্য ছিল।
অ্যান্টিগ্র্যাভিটি এয়ারকারটা নিমোদের প্যাশিও-র ওপর শূন্যে ভাসছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। নিমোর প্রিয় বন্ধু এমা এয়ারকারে চেপে আকাশপথে ওর রুমের জানলার পাশে ক’বার চক্কর কেটে গেছে, কোনও লাভ হয়নি। ‘প্রোজেকশন কল’ করেছে, কিন্তু নিমো শুকনো মুখে ক’টা ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলে কেটে দিয়েছে কল, হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে এমার থ্রি-ডি ইমেজ।
নিমো-র মা ফিয়োনা বড্ড চিন্তায় পড়েছেন। স্বামী সারাদিন ল্যাবে ব্যস্ত থাকেন, আপনভোলা ধরনের মানুষ। যা কিছু সব ফিয়োনাকেই সামলাতে হয়। অবশ্য কাজ বলতে সকালে উঠে মেইনলি ওদের স্মার্টহোম ডিভাইসটায় ইন্সট্রাকশন ফিড করিয়ে দিতে হয়। ফিয়োনা, নিমো আর রায়ানের দিনভর কাজের রুটিন তো ‘হোমিও-৩১’-এর সিস্টেমে প্রোগ্রাম করাই আছে, সেইমতই সব চলতে থাকে। ঠিক সকাল আটটায় রায়ানের বেসমেন্টের ল্যাবের মাদার কম্পুউটারকে স্লিপ মোড থেকে জাগানো, নিমোর ‘স্কুলরুম’ রেডি করা ন’টার ভেতর, ফিয়োনার কিচেনের তদারকি করা, সমস্তই চলতে থাকে বিনা বাক্যব্যয়ে।
তবে সবদিন তো আর একরকম যায় না, বিশেষ করে এই ডানবার ফ্যামিলির বাড়িতে, তাই রোজ সকালেই কিছু না কিছু রদবদল হ’তেই থাকে। যেমন আজই ন’টা বেজে গেছে, তাও নিমোর দেখা নেই ‘স্কুলরুম’-এ।
স্কুলরুমটা বেসিকালি ডানবার হাউসেরই একটা রুম, যেখানে ভার্চ্যয়ুলি নিমো জয়েন করে তার ক্লাসরুমে। ইনফ্যাক্ট টিচাররা, স্টুডেন্টরা সকলেই যে যার বাড়ির ‘স্কুলরুম’-এ বসেই কানেক্টেড হয়ে যায় ক্লাসরুমে। প্রতিটা স্কুলরুমই ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে পরিণত হয়, যেখানে প্রত্যেকেই দেখে বাকি ক্লাসমেটদের হলোগ্রাফিক চতুর্মাত্রিক ইমেজগুলো বসে আছে, যে যার ডেস্কে। ওরা শেখে বিজ্ঞানের নানা জটিল জটিল অঙ্ক, সমীকরণ, থিয়োরি। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে স্ট্রিং থিয়োরি, মাল্টি ডাইমেনশনস, প্যারালাল ইউনিভার্স। ওয়ার্ম হোলের ভেতর দিয়ে এক মুহূর্তে কয়েক আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দেওয়া। শেখে জটিল জেনেটিক মিউটেশনের তত্ত্ব। নাহ্ সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল এসব ওরা পড়ে না। কারণ মহাশূন্যে ভাসমান ওদের এই শহর ‘অলিম্পাস সিটি’-তে ওসবের প্রয়োজন পড়ে না। ওরা এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে শুধু।
(২)
‘অলিম্পাস সিটি’, মনুষ্যপ্রজাতির এক অনবদ্য সৃষ্টি। পৃথিবীর মাটি থেকে বহুদূরে, মহাশূন্যে এই কৃত্রিম বৃহদাকার স্পেস-সিটিটা ভেসে রয়েছে। অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি মেকানিজম, যেটার উৎস পারমাণবিক শক্তি। পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ থেকে খনন করে বার করা তেজস্ক্রিয় আকরিকের ক্ষমতাতেই ভেসে থাকে এই ‘শহর’ মহাশূন্যের বুকে।
প্রায় হাজার বছর আগে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বারোটি শাখার দিকপাল অগ্রণী বারোজন মানুষ এই মায়ানগরীর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরাই এই অলিম্পাস সিটির রূপকার।
এই বারোজন বিজ্ঞানী এবং তাঁদের বংশধরদের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে এই স্পেস সিটি গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর বুকের প্রায় সমস্ত দেশের দেশপ্রধানদের আর্থিক সহায়তায় এবং লোকবলের সাহায্য বাস্তবায়িত হয় এই স্বপ্ন। ধীরে ধীরে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে ফুঁসে উঠতে থাকা সমুদ্র, পারমাণবিক অস্ত্রের মুখে ঝাঁঝরা হ’তে থাকা এই পৃথিবীর বুক থেকে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী এবং ধনবান লোক পাড়ি দেয় ‘অলিম্পাস’-এর উদ্দেশ্যে। বারোজন বিজ্ঞানী এবং এই মানুষগুলির বংশধররাই আজ এই তৃতীয় সহস্রাব্দে অলিম্পাস সিটির বাসিন্দা। পৃথিবীর বুক থেকে প্রাণের অস্তিত্ব আজ বিলীন হয়ে গেছে বললেই চলে।
বর্তমানের বারোজন কর্তাব্যক্তির মধ্যে একজন, নিমোর বাবা রায়ান। রায়ানের পূর্বপুরুষ ‘জুলিয়েন ডানবার’ এই আদি বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন। বংশানুক্রমে রায়ানদের এই ডানবার পরিবার জেনেটিক্স নিয়ে রিসার্চ করে। এই বংশানুক্রমিক মেধা অবশ্য পুরোপুরি প্রকৃতির দান নয়। ‘দ্য ফার্স্ট ফাদারস’, অর্থাৎ সেই প্রথম বারোজন গবেষক, সমর্থ হয়েছিলেন নিজেদের জ্ঞানের ধারাবাহিকতাটি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে দিতে, জেনেটিক মড্যুলেশন-এর মাধ্যমে।
শুধু তাই নয়, ওই বারোটি পরিবারের প্রথম সন্তানটি জন্মানোর পরেই তার ব্রেনে বসিয়ে দেওয়া হয় একটা জটিল চিপ। সেই চিপ কানেক্টেড থাকে জীবিত বা মৃত পূর্বসূরীদের মাথায় বসানো চিপগুলোর সঙ্গে। তাঁদের জীবদ্দশায় অর্জিত সমস্ত নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হ’তে থাকে শিশুটার মাথায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হতে থাকে সেই ইন্টেল।
মোটামুটি একটা গতে বাঁধা এই অলিম্পাস সিটির সব মানুষেরই জীবন। একদম রুটিনমাফিক, নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। সাংসারিক জীবন, সামাজিক জীবন সবকিছুই নিয়মের গণ্ডীতে বাঁধা, যেমনটা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছিলেন ‘দ্য ফার্স্ট ফাদারস’। এই অলিম্পাস সিটিই তার বাসিন্দাদের ধ্যানজ্ঞান। পুরনো ক্ষয়ে যেতে থাকা পৃথিবীর কোনও গুরুত্ব তাদের কাছে নেই।
কিন্তু ডঃ রায়ান ডানবার বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আপাতদৃষ্টিতে উনি হাই প্রোফাইল, আলট্রামডার্ণ, টেক স্যাভি, গ্যাজেট নির্ভর দুনিয়ার আর বাকি পাঁচজনের মতই, তবুও কোথাও যেন একটু প্রাচীনপন্থী। রায়ান আজও, কিছুটা হ’লেও অতীত পৃথিবীর স্মৃতিকে আঁকড়ে রেখেছেন, বুকের ভেতর, স্মৃতির ভেতর। পুরনো তথ্য ঘেঁটে, মেমরি চিপ থেকে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি হাতড়ে যতটা সম্ভব নিজের বাড়িটিতে একটুকরো পৃথিবী লুকিয়ে রেখেছেন। পৃথিবীতে এক সময় পাওয়া যেত এরকম নানা জিনিসের রেপ্লিকা দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার ছবি, পশুপাখির মূর্তিতে ঘর সাজানো ওঁদের। যদিও ফিয়োনা এ’সব হাবিজাবি জিনিসের ডাঁই দেখে বিরক্ত হলেও রায়ানের ইচ্ছেকে সম্মান করেন।
(৩)
রাতের বেলায় নিজের বেডে শুয়ে নিমো ঘরের সিলিংটার দিকে চেয়েছিল। আলোর খেলায় সমস্ত সিলিংটা কালো আকাশের রূপ নিয়েছে, তাতে একটুকরো বাঁকা চাঁদ। ছোটো ছোটো তারারা টিমটিম করে হাতছানি দিচ্ছে। হঠাৎ ঘরের দরজায় শব্দ হয়, দরজার এপারের স্ক্রিনে ফুটে ওটে রায়ানের মুখটা। নিমো বিছনার মাথার কাছের একটা স্যুইচ টিপে দরজাটা খুলে দেয়, বাবা এসে বসে ওর পাশে। নিমো সিলিং এর প্রোজেকশনটা বন্ধ করে ঘরের আলো জ্বালতে যায়।
রায়ান ওকে বাধা দিয়ে বলে, “থাক না। এই অন্ধকারেই আমিও তোর পাশে শুই একটু।”
বাপ ব্যাটা মিলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কৃত্রিম আকাশটা দেখতে থাকে। অনেকবছর আগে ওদের কোনও পূর্বপুরুষ হয়ত সত্যিই এমন আকাশটা দেখেছিল, পৃথিবীর বুকে সবুজ নরম গালচে ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে শুয়ে। কিন্তু আজ সেই পৃথিবীর বেশিটাই গ্লোবাল ওয়ার্মিওয়ের ফলশ্রুতি হিসাবে জলে ঢাকা। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর মাটি-জল-বাতাস সব তেজস্ক্রিয় রশ্মি আর দূষণে কলুষিত হয়ে জীবজগতের বসবাসের প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
এক এক করে কনস্টেলশনগুলো নিমোকে আঙুলে করে দেখিয়ে চেনানোর চেষ্টা করেন রায়ান।
“ওই দ্যাখ, ওটা হ’ল ওরায়ন, ওই হ’ল জেমিনাই, পার্সিউস, টরাস ….”
অবশ্য এখন কাছাকাছি কনস্টেলশনগুলোয় ওয়ার্মহোল দিয়েই যেতে পারে মানুষ।
রায়ান বলেন, “হ্যাঁ রে! যাবি নাকি ওরায়নে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে বাবার দিকে চেয়ে থাকে নিমো তারপর মৃদুস্বরে বলে, “বাবা, আমি পৃথিবীতে যেতে চাই।”
রায়ান খুব একটা আশ্চর্য হ’লেন না নিমোর কথায়। গত ক’দিন ধরে নিমোর মনখারাপ, বারবার ল্যাবে এসে পৃথিবী নামের গ্রহটি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সঙ্গে কানেক্টেড ভার্চ্যুয়াল স্ক্রিনে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতে থাকে ফেলে আসা গ্রহটাকে। নিমো আর পাঁচটা ছেলের থেকে একটু আলাদা। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এটা ভাবতে ওর খুব কষ্ট হয়। প্রাণের মূল্য যে অসীম তা রায়ানের চেয়ে বেশি ভালো আর কে-ই বা বুঝবে। বিশেষ করে বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির পরেও, বহু দূরদূরান্তের গ্রহ পাড়ি দেওয়ার পরেও, এই মহাবিশ্বের আর কোথাও প্রাণের সন্ধান এখনও মেলেনি। চোখের সামনে পৃথিবীকে একটু একটু করে মৃতগ্রহে পরিণত হ’তে দেখাটা বড্ড কষ্টের। ‘অলিম্পাস সিটি’-তেও জনসংখ্যার উর্দ্ধসীমা রয়েছে তাই প্রাণের বিকাশ এবং বৈচিত্র্য এখানে বড়ই নিয়ন্ত্রিত, বড়ই কৃত্রিম। নিমো প্রকৃতি বড্ড ভালোবাসে কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মায়ানগরীতে প্রকৃতি একটা ছোট্ট পার্কেই সীমাবদ্ধ। জীবজন্তুর জগৎ ল্যাবরেটরির স্পেসিমেনের গণ্ডীতেই আটকানো।
(৪)
“তোমাদের নেক্সট ‘আর্থ এক্সপেডিশন’ তো আর কিছুদিন পরেই। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে?”
নিমোর প্রশ্নে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয় রায়ানের। মনে মনে এ’রকমই একটা আশংকা করছিলেন উনি। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে তুই ওখানে যাবি কেন? এক্সপেডিশন-টা তো হয় পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা অবশিষ্ট দামি খনিজ পদার্থগুলোকে তুলে আমার জন্য। এই অলিম্পাস সিটির বর্জ্য পদার্থগুলো ওখানের সমুদ্রের তলায়, মাটির গভীরে পুঁতে দিয়ে আসার জন্য। তুই সেখানে গিয়ে কী করবি?”
“তবু আমি যেতে চাই একবার। যে গ্রহের পাখির গান সবসময় আমাদের ঘরের মিউজিকাল ডিভাইসে বাজে, যে গ্রহের রাতের আকাশ আমার ঘরের ছাদে টিমটিম করে, যে গ্রহের ফুলের সুবাসে আমাদের ঘর ভরে থাকে, আমি সেই গ্রহে একবার পা রাখতে চাই বাবা।”
“নিমো, আমাদের বাড়ির এ সবই তো কৃত্রিম, তুই জানিস বাবু। সত্যিকারের পৃথিবীটা একদম উল্টো। বছরের পর বছর ধরে মানুষেরই অবহেলার ফলে আজ সবুজ গ্রহ প্রাণহীণ, দূষিত। এমনকি পৃথিবীর বুকে পা রাখতে গেলেও অক্সিজেন মাস্ক পরে, স্পেশাল প্রোটেকটিভ পোশাক পরে যেতে হয়। বেশিরভাগ অংশই জলের তলায় ডুবে গেছে, আর সেই জলও বিষাক্ত।”
ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন রায়ান।
নিমো শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে, “আমি জানি বাবা সব, তবুও যেতে চাই।”
শেষ চেষ্টা করেন ছেলেকে আটকানোর রায়ান, “কিন্তু তোর মা রাজি হ’বে না মোটেই।”
“আমি যদি মা’কে বুঝিয়ে রাজি করাই তাহলে নিয়ে যাবে তো?” নিমো দু’চোখ ভরা আশা নিয়ে চেয়ে রইল বাবার দিকে।
‘অলিম্পাস সিটি’ বারোজন দণ্ডমুণ্ডের কর্তার একজন ডঃ রায়ান ডানবার হয়ত সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলেটিকে না করে দিতে পারতেন, নিমোর বাবা হিসেবে রায়ান হয়ত নাকচ করে দিতে পারতেন এই বিপজ্জনক মিশনে যাওয়ার প্রস্তাবটিকে, কিন্তু পৃথিবীর প্রতি যে টান তিনি অনুভব করেন সেই একই টান অনুভব করা ছেলেটিকে ‘না’ করা মুখের কথা নয়। উপায়ান্তর না দেখে বললেন, “ঠিক আছে, তখন ভেবে দেখবখ’ন।”
পলকে নিমোর ক’দিন ধরে শুকনো হয়ে থাকা মুখটায় হাসি ফুটল, বিষন্ন চোখদুটো উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
(৫)
কী জাদুতে নিমো মা’কে রাজি করাল কে জানে! রায়ান তো হতবাক যখন ফিয়োনা এসে বলল, “আমি আপত্তি করব না কিন্তু ছেলেটার দিকে নজর রেখো। কাজে ডুবে গিয়ে সব ভুলে যেও না যেন। ও অন্যদের থেকে একটু আলাদা!”
ফিয়োনার কাঁধে হাত রেখে আলতো করে চাপ দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন রায়ান। ঠিক একসপ্তাহ পরে ‘অলিম্পাস সিটি’-র ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত মূল গবেষণাকেন্দ্র ‘ফোরাম’-এর সর্বোচ্চ গম্বুজের গায়ের প্যানেলগুলো খুলে গেল ঠিক পদ্মফুলের পাপড়ির মত, উড়ল অত্যাধুনিক মহাকাশযান ‘পেগাসাস-১৭’। তাইতে সওয়ার দশ জনের টিম। বারোজন কর্তাব্যক্তির তিনজন- রায়ান, লি ফ্যাং ও সুজান, আরও ছ’জন প্রযুক্তিবিদ্, এবং নতুন সদস্য নিমো। অলিম্পাস সিটির চৌহদ্দি পেরিয়ে যানটি রওয়ানা দিল দূরের কালো আকাশে ভেসে থাকা ধূসর গ্রহটার দিকে।
রায়ান কেবিনে এসে দেখলেন নিমো মোটা গ্লাস-উইন্ডোতে চোখ ডুবিয়ে নাক ঠেকিয়ে বাইরের মহাশূন্যের দিকে অপার বিস্ময়ে চেয়ে আছে। ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী খুশি তো রে এবার?”
নিমো বাবার দিকে ফিরে ঘাড় নাড়ে তারপর বলে ওঠে, “আচ্ছা আগে পৃথিবীর রঙ নীল আর সবুজ ছিল, তাই না বাবা?”
রায়ান বলেন,“অনেক অনেকদিন আগে তাই ছিল।”
হঠাৎ নিমো কেবিনের গায়ে আঁকা পেগাসাস-এর লোগোটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, পেগাসাস মানে কি? এ’রকম প্রাণী সম্পর্কে কোনও কিছু তো আমি শিখিনি কখনও!”
“তুই ঘোড়ার কথা জানিস তো? পেগাসাস হ’ল পক্ষীরাজ ঘোড়া মানে ডানাওয়ালা ঘোড়া। দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দিই, পৃথিবীতে পৌঁছতে পৌঁছতে তোর শেখা হয়ে যাবে।”
এই বলে, রায়ান কেবিনের গায়ে অদৃশ্য হয়ে থাকা একটা বোতামে হাত দিলেন, তখনই দেওয়ালের ভেতর থেকে কয়েকটা ড্রয়ারের মত অংশ বেরিয়ে এল। তার একটা থেকে ছোটো একটা কৌটো তুলে আনলেন, কোটোটা খুলে ভেতরের নরম সিলিকা জেল-এ ডোবানো একটা কন্ট্যাক্ট লেন্সের মত স্বচ্ছ পাতলা গোলাকৃতি একটা জিনিস তুলে, নিমোর হাতে দিয়ে বললেন, “এটা চোখে পরে নে। বহুবছর আগেই বই পড়া উঠে গেছে। কাগজের বই থেকে, ইলেকট্রনিক বই তারপর আরও বিবর্তন হয়ে বই এখন এই জায়গায়। তোদের পড়াশোনার বিষয়গুলো অবশ্য তোরা ‘ক্লাসরুমেই’ শিখে যাস। কিন্তু তার বাইরের জ্ঞানের জন্য এগুলো দরকার।”
“কিন্তু বাবা আমার তো স্পেশাল মেমরি চিপ আছে।”
“স্পেশাল মেমরি চিপ তোকে সেটুকু তথ্যই সরবরাহ করবে যেটুকু তোর প্রয়োজন বলে মনে হবে সিস্টেমের। চিপের জটিল অ্যালগোরিদমওয়ালা ব্রেন কি মানুষের ব্রেনের চাহিদা মেটাতে পারে? তার জন্য তোকে নিজেকে শিখতে হবে। এইটা চোখে দে, সমস্ত মাইথোলজিকাল ক্রিচারের এনসাইক্লোপিডিয়া বলতে পারিস এটাকে। আমি সব তথ্য এতে ভরেছি। আগেকার দিনে হ’লে বলতাম আমি এই বইটা লিখেছি।”
হেসে ওঠেন রায়ান আর নিমো দুজনেই।
(৬)
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সীমানার ভেতর আসতেই পেগাসাসের গতি বহুগুণ বেড়ে গেল। উল্কার মত ছুটে আসতে লাগল সে পৃথিবীর দিকে। কিন্তু এ তো আগেকার দিনের রকেটের মত যান নয়, আরও জটিল, উন্নত এবং ক্ষমতাশালী। দক্ষ চালক তাই গতি নিয়ন্ত্রণ করে বিশালাকায় ‘পেগাসাস-১৭’-কে পালকের মত ভাসিয়ে অবতরণ করালেন দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির বুকে। সমুদ্র, কিন্তু সে জল নীল নয়, ধূসর আকাশের মত জলও ধূসর রঙেরই প্রতিচ্ছবি। ম্যাড়ম্যাড়ে বিবর্ণ আলো বিছিয়ে আছে চারদিকে।
নিমো এবং চালকসহ আরও তিনজন ক্রু-মেম্বারকে যানে রেখে বাকিরা বিশেষ পোশাক পরলেন। পরিবেশের দূষিত বাতাস, ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাব, জল-মাটির বিষাক্ত স্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। ছোট্ট একটা বক্স সেট করা পোশাকের সঙ্গে, তাই থেকে সরু একটা নলে করে অক্সিজেন সাপ্লাই হচ্ছে মাথার ট্রান্সপারেন্ট বিশেষধরনের হালকা প্লাস্টিকের গোলাকার কভারের মধ্যে। পায়ের বুটে লাগানো ছোটো ছোটো হোভার বোর্ড জাতীয় যন্ত্রগুলো ওঁদের যানের কাজ করছে। জেট লাগানো কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় কন্টেইনারও আছে, যাতে ভরা আছে ‘অলিম্পাস সিটির’ নানা রকমের বর্জ্য, এমনকি তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও। এই সমস্ত কিছু নিয়ে টিম-টি রওয়ানা দিল। আজকের দিনটা গোটাটাই প্রায় লাগবে সমস্ত বর্জ্য ডিসপোজ করতে এবং নানা খনিজের সন্ধান করতে, যেটুকু আর অবশিষ্ট আছে। তারপর পেগাসাস আবার ডানা মেলে ফিরে যাবে তার আস্তানা অলিম্পাসে।
ওরা চলে যেতে নিমো ঝটপট কেবিনের একপাশে রাখা স্বচ্ছ টেবলটার এক কোণে আঙুল দিয়ে চাপ দিল, ত্রিমাত্রিক একটা ম্যাপ ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে। ম্যাপের লাল দপদপ করতে থাকা জায়গাটায় স্পর্শ করতে, ভেসে উঠল কিছু লেখা। তাই দেখে বুঝল, এই মুহূর্তে পেগাসাস ভাসছে একসময়ের অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের পূর্বদিকে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্জিনাল সমুদ্র বা প্রান্তবর্তী সমুদ্র ‘কোরাল সি’-তে। এখন অবশ্য কোনও মহাদেশেরই সুবিশাল সেই আকার আর নেই। সমস্ত ভূখণ্ডই আয়তনে অনেক ছোটো হয়ে গেছে, সি-লেভেল ক্রমশ উঠে আসার ফলে।
হঠাৎ নিমো অনুভব করল ওর ব্রেনের চিপে কিছু তথ্য ডাউনলোড হল। এই কোরাল সি-তেই অবস্থিত ‘দ্য গ্রেট বেরিয়ার রিফ’, বহুযুগ আগের পৃথিবীর জীবজগতের বৈচিত্র্যের এক বৃহৎ উদাহরণ। আরও কিছু তথ্য আসতে লাগল নিমোর মাথায়, ‘আটলান্টিস’, ‘মারমেইড’, ‘প্রুডেন্স’…
মারমেইড তো জলপরী, আধা মানুষ আধা মাছ, যারা জলের তলায়ও শ্বাস নিতে পারে। আর আটলান্টিস সমুদ্রের তলায় হারিয়ে যাওয়া কাল্পনিক নগর। আজই বাবার দেওয়া বুকলেন্সটা থেকে শিখল, অদ্ভুত সমাপতন। কিন্তু প্রুডেন্স কে? কেমন যেন মনে হচ্ছে পেগাসাসের অবস্থানটা কিছু ইঙ্গিতবহ।
(৭)
নিমো চুপিচুপি মেইন ডেকে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল কাচের দরজার ওপার থেকে, বাকিরা সবাই নানা যন্ত্রের সামনে ব্যস্ত। ও তড়িঘড়ি রিপোজিটরি রুমে গিয়ে ড্রেস-আপ করে নিয়ে, অক্সিজেন মাস্কটা লাগাল। তারপর সন্তর্পণে এমারজেন্সি এক্সিটের এয়ার লকটা খুলল, ওর বাবার রেখে যাওয়া আই কার্ডের ম্যাগনেটিক চিপটা দিয়ে। কোনওরকম অ্যালার্ট বাজল না তাই। দরজাটা খুলতেই সামনে ঘোলাটে জল। ধীরে ধীরে জলের মধ্যে শরীরটা ভাসিয়ে দিল নিমো, পেছনের দরজাটা অটোলক হয়ে গেল।
নিমোর দেহের পোশাকটা জল স্পর্শ করা মাত্র আস্তে আস্তে এয়ার কমপ্রেস হয়ে আঁটো-সাঁটো ডুবুরির পোশাকের রূপ নিল। পায়ের বুটের হোভার বোর্ড অংশটা থেকে পাতলা পাতলা রাবারজাতীয় ফিন বেরিয়ে এল সাঁতারের সুবিধার জন্য। ডানহাতে লাগানো ঘড়ির মত দেখতে ওয়াটারপ্রুফ ডিভাইসটায় টাচ করল নিমো। ওটা এ্যাক্টিভেট হয়ে ম্যাপ দেখাতে শুরু করল, সেই সঙ্গে একটা রাডারও বিপবিপ করতে লাগল।
এই সমস্ত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে রায়ান যাত্রার আগের এক সপ্তাহ ধরে নিমোকে ট্রেনিং দিয়ে রেখেছিলেন। তাই কোনও অসুবিধা হচ্ছে না নিমোরও। জলের অনেকটা গভীরে শরীরটাকে ডুবিয়ে দিয়ে, ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল ও। যেটুকু জেনে নিতে পেরেছে রিফটা সম্পর্কে, তাতে করে মনে হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে ওঠা, সামনের ওই অন্ধকার লম্বা টানা পাহাড়ের মত অংশটাই রিফের ধ্বংসাবশেষ। যে রিফ ছিল ফ্লোরা আর ফনা-র বৈচিত্র্যে ভরপুর সেটা এখন মৃত প্রান্তর ছাড়া কিছুই না।
হঠাৎ নিমো প্রচণ্ড চমকে ওঠে। হাতের ডিভাইসের রাডারটায় একটা সবুজ বিন্দু দপদপ করছে। তার মানে বেশ কয়েক মিটারের মধ্যেই আছে জীবন্ত কিছু। সামনের দিকে এগোতে থাকে ও জল কেটে দ্রুত। একটু পরেই সামনের ঢিবিগুলোর আড়াল থেকে ওর একদম সামনে বেরিয়ে আসে অদ্ভুত একটা জীব। মানুষেরই মত, কিন্তু তার গায়ের খোলা অংশগুলো কেমন যেন একটা চকচকে আবরণে ঢাকা। কান নেই, কানের জায়গায় সরু একটা করে চেরা, সেটার ওপরেও একটা কপাটের মত অংশ, খুলছে বন্ধ হচ্ছে। সেই একই জিনিস গলার দুপাশেও। হাতের আঙুল আর পায়ের আঙুলগুলোর ফাঁকগুলো পাতলা চামড়া দিয়ে জোড়া।
কিন্তু এই বিষাক্ত জলে ও বেঁচে আছে কী করে? শ্বাস নিচ্ছে কী করে?
অদ্ভুতদর্শন মানুষটা সরাসরি নিমোর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল তাকে অনুসরণ করার জন্য। নিমো ইতস্তত করছে দেখে এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে সাঁতার দিতে শুরু করল। কেন কে জানে ওকে নিমোর বিপজ্জনক লাগে না। কেউ যেন ওর মাথার মধ্যে বলতে থাকে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য, বিশ্বাস করার জন্য।
(৮)
বেশ খানিকটা সাঁতরে আসার পর নিমো লক্ষ করে চারপাশের জলটা কেমন বদলে যাচ্ছে। ঘোলাটে ঘোলাটে ভাবটা কেটে গিয়ে বেশ স্বচ্ছ পরিষ্কার লাগছে। আরও কিছুটা এগোনোর পর অবাক হয়ে দেখে কিছু কিছু জলজ উদ্ভিদ এদিক ওদিকে জন্মে রয়েছে ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট ছোট্ট রঙিন মাছ খেলা করছে। ঠিক যেমন অলিম্পাস সিটিতে নিমোদের বাড়ির বেসমেন্টে, ওর বাবা রায়ানের ল্যাবে রাখা একটা বিশাল অ্যাকোরিয়ামে আছে, তেমনটাই দেখতে লাগছে। এ তো অসম্ভব ব্যাপার!
কিন্তু বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। আরও কিছুদূর এগোনোর পর দেখলে সামনে অনেক অনেক বিশাল আকারের গোল গোল বুদ্বুদ। সেই বুদ্বুদগুলোর ভেতর আস্ত এক একটা বাগানসহ বাড়ি। কোনও কোনও বাড়িতে ওর সঙ্গের ‘মানুষ’টির মত আরও অনেকে বেরিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে। কয়েকজন বুদবুদের বাইরে জলের মধ্যেও ঘোরাফেরা করছে। প্রতিটা বড় বুদ্বুদ আরেকটা বুদ্বুদের সঙ্গে একটা সরু টানেলের মাধ্যমে কানেক্টেড।
ওরা দু’জন গিয়ে পৌঁছল একটা বড় আকারের বুদ্বুদের সামনে। স্বচ্ছ গোলকটার গায়ের একটা অংশে চাপ দিতে একটা জায়গায় একটা গর্তের মত সৃষ্টি হ’ল। গর্তটার ভেতর এমন কিছু এয়ার প্রেশার কাজ করছিল যে তার মধ্যে বাইরের জল ঢুকতে পারছিল না। ওরা দুজন ঢুকে যেতেই গর্তটা বন্ধ হয়ে গিয়ে গোলকের দেওয়ালটা আগের মত হয়ে গেল। গোলকের ভেতরে কোনও জল নেই। নিমোর সঙ্গীটি হাতের ইশারায় ওকে ওর পোশাক এবং অক্সিজেন-মাস্ক খুলে ফেলতে বলল। নিমো একটু ইতস্তত করলেও তাই করল। অবাক কাণ্ড! শ্বাস নিতে তো কোনও কষ্টই হচ্ছে না! আর খোলা ত্বকেও কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ওরা গিয়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়াল। বাড়িটা বেশ অদ্ভুতদর্শন, সেই পুরনো পৃথিবীর বাড়িগুলোর মত দেখতে। অলিম্পাস সিটির কোনও বাড়িই এরকম নয়। একদিন গল্পে গল্পে রায়ান নিমোকে পুরনো পৃথিবীর বেশ কিছু ছবি দেখাচ্ছিলেন তাই থেকেই নিমো জেনেছিল।
পাশের বাগান মত ঘাসে ভরা জায়গাটা থেকে একজন এসে নিমোর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। নিমো অবাক চোখে দেখল সেও নিমোর সঙ্গীটির মতই, তবে মাথায় সাদা চুল। নিমোর দিকে তাকিয়ে হেসে সম্পূর্ণ মানুষের গলায় কথা বলে উঠলেন উনি, “খুব অবাক লাগছে তাই না?”
(৯)
“আমার নাম লিয়াম, আর তোমাকে যে পথ দেখিয়ে আনল, ও হ’ল মায়া, আমার মেয়ে। আর এই সমুদ্রনগরীর নাম হল ‘আটলান্টিস’।”
নিমোর তখনও ঘোর কাটেনি। সমুদ্রের নীচে আশ্চর্য এই শহর। অলিম্পাস সিটির মতই অত্যাধুনিক এক শহর অথচ প্রাণের প্রাচুর্যে বৈচিত্র্যে ভরপুর, এবং সবচেয়ে বড় কথা এই পৃথিবীর বুকেই।
লিয়াম বলে চলেন, “জানি তোমার সব খুব অবাক লাগছে। কাম হিয়ার ইয়ংম্যান। বোসো, মেক ইওরসেল্ফ অ্যাট হোম। ইন ফ্যাক্ট আর্থ ‘ইজ’ ইওর হোম। আমি তোমায় সব বলছি। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। তুমি ক্রাফটে নেই সেটা তোমার সঙ্গীরা জানতে পারার আগেই তোমায় ফিরে যেতে হবে।”
নিমো ঘরটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা পরিস্থিতিতে পড়েও ওর কোনও ভয় লাগছে না। সত্যিই কেমন যেন নিজের জায়গা বলে বোধ হচ্ছে।
“তোমার পূর্বপুরুষ জুলিয়েন, যিনি অলিম্পাস সিটির ‘দ্য ফার্স্ট ফাদারস’-এর একজন ছিলেন, তাঁর এক বোন ছিল, ‘প্রুডেন্স’। আমরা সেই প্রুডেন্সেরই বংশধর। এই আটলান্টিসের রূপকার তিনিই। তখনও যখন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব গুরুতরভাবে সংকটাপন্ন হয়নি, বিজ্ঞানীরা সবে অলিম্পাস সিটি নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করেছেন, সেই সময়ে জুলিয়েন আর প্রুডেন্স দুই ভাইবোন, আরও কিছু বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে মিলে নানা বিকল্প পথ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। প্রুডেন্স পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাননি, তাই কীভাবে মানুষের জিনের রদবদল ঘটিয়ে এই পৃথিবীতেই বাস করতে পারা যায় সেই চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। প্রুডেন্স বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাপ্লাবনের পর মানুষের একমাত্র উপায় জলের তলায় বাসা বাঁধা। তাই সে পথেরই সন্ধান করছিলেন তিনি। মানুষকে ধীরে ধীরে উভচর বা এম্ফিবিয়ান করে তোলাই তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ ছিল।”
নিমোর দিকে ফিরে বলেন, “আশা করি তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না?”
নিমো বলে উঠল, “এখানে আমাদের যান পেগাসাস ল্যান্ড করার পর থেকেই আমি একটা অদ্ভুত সংযোগ অনুভব করছি। ‘প্রুডেন্স’ নামটাও জানিনা কীভাবে আমার মাথার চিপে…”
এই বলে নিমো থামল, চিপ ব্যাপারটা সম্পর্কে লিয়ামের ধারণা থাকার কথা নয়।
লিয়াম হেসে বললেন, “চিপ সম্পর্কে আমি জানি নিমো। জুলিয়েন আর প্রুডেন্সই এই চিপের আবিষ্কর্তা ছিলেন। আমরাও একটা সময় অবধি এই চিপ ব্যবহার করেছি, কিন্তু এখন আর প্রয়োজন পড়ে না। তোমাদের মত আমরা সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর নই। আমরা ধীরে ধীরে অভিযোজিত হতে হতে, প্রকৃতির সঙ্গে কখনও লড়াই করে আবার কখনও ভাব করে থাকতে থাকতে, অনেক ক্ষমতা অর্জন করেছি। না, যান্ত্রিক বা প্রুযুক্তিগত ক্ষমতার কথা বলছিনা। আমরা নিজেদের ব্রেনের জমা তথ্য, অন্যের ব্রেনের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের মাধ্যমে আদানপ্রদান করতে পারি। তুমি এখানে আসামাত্র যে সংযোগ অনুভব করেছিলে সেটা হল তোমার বোন মায়ার সঙ্গে তোমার অনুভূতির সূক্ষ্ম সম্পর্ক।”
একটু থেমে ফের বলে চলেন লিয়াম, “ফিরে যাই গোড়ার কথায়। জুলিয়েন কিন্তু প্রুডেন্সের মতে সামিল হলেননা। মানুষের রূপ বদলে অন্য প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্য শরীরে ধারণ করায় তীব্র আপত্তি ছিল জুলিয়েনের। তাই তিনি পথ নিলেন পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যে গিয়ে অলিম্পাস সিটি গড়ার। দুই ভাইবোন দুটি আলাদা জগতের বীজ বপন করলেন। শুরুর দিকে এঁদের বংশধরদের মধ্যে যোগাযোগ থাকলেও যখন অলিম্পাস সিটি পাকাপাকিভাবে গড়ে ওঠে তখনই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সমস্ত সূত্র। ধীরে ধীরে অলিম্পাসের জগৎ ভুলে যায় তার সিস্টার সিটি আটলান্টিসকে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে লিয়ামের কণ্ঠ থেকে।
“আটলান্টিস ভোলেনি, কিন্তু আমরা জানানও দিইনি আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে। গত দু’শো বছর ধরে, কয়েক মাস অন্তর একবার করে যখন পেগাসাসেরা আসে, আমরা আমাদের ব্রেনের সংযোগক্ষমতার সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করি অলিম্পাসের, কিন্তু যাত্রীরা কেউ বুঝতে পারে না সেটা।”
নিমো অবাক হয়ে বলে, “তাহলে আমাকে কেন বুঝতে দিলেন? কেনই বা মায়া দেখা দিল আমায়?”
(১০)
“কোনওটাই সমাপতন নয় নিমো,” বলে ওঠেন লুকাস, “তুমি কি আসার সময় দেখলে স্বচ্ছ দূষণমুক্ত জল? সেই জলে জন্মানো উদ্ভিদ? ছোটো ছোটো মাছ?”
“হ্যাঁ ! ভারি আশ্চর্য! এই বিষাক্ত জলে কীভাবে…”
উত্তেজিত হয়ে লিয়াম বলেন,
“ওই জলটা আর বিষাক্ত নেই মাই চাইল্ড। আমরা পেরেছি। সাধারণ জু-প্ল্যাঙ্কটনদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন এক নতুন ধরনের আণুবিক্ষণীক জীব আমরা তৈরি করেছি যারা ওই তেজস্ক্রিয় বিষাক্ত জলকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। এই জীবগুলো দিন পনেরো করে বাঁচে, প্রজনন চক্র সম্পূর্ণ করে মারা যায়, তারপর জলের তলার জমিতে মিশে গিয়ে সেই জমিকে উর্বর করে তোলে। সমুদ্রের জলে আমরা যত বেশি পরিমাণে সম্ভব এই বিশেষ প্ল্যাঙ্কটনগুলো মেশানোর চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে এরা ছড়াতে ছড়াতে সমস্ত পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করবে। আমরা জলের বাইরের মাটি এবং বাতাসকে পরিশোধন করার জন্যও বিশেষ আণুবিক্ষণীক জীব তৈরির গবেষণা করে চলেছি। কিন্তু…”
নিমো আগ্রহে ততক্ষণে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, “কিন্তু কী? সত্যিই কি সম্ভব পৃথিবীর মাটি জল বাতাস সব আগের মত শুদ্ধ বাসযোগ্য করা?”
নিমোর আর মায়ার দুই কাঁধে দু’টো হাত রেখে লিয়াম বলেন, “সেটা তখনই সম্ভব যখন আবার অলিম্পাস আর আটলান্টিস একসঙ্গে মিলে কাজ করবে, ঠিক জুলিয়েন আর প্রুডেন্সের মত। সেটা একমাত্র তোমরা দুজন পারো, তোমাদের প্রজন্ম পারে। জলে বাস করতে করতে আমরা এমনভাবে অভিযোজিত হয়ে পড়েছি যে স্থলভাগে গিয়ে বেশিক্ষণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের শরীর শুকিয়ে শ্বাসকষ্টে মারা পড়ব আমরা। তার ওপর নিজেদের অজান্তেই অলিম্পাস সিটির রাশি রাশি বর্জ্য পৃথিবীর বুকে কবর দিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে পৃথিবী। এই সমস্ত বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু রাতারাতি এসব বন্ধ করা সম্ভব নয় তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে অলিম্পাস সিটি। হয়ত আরও শ’দুয়েক বছর লাগবে পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করতে। কিন্তু সবাই যদি আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, পৃথিবী আবার জীবজগতের বসবাসের উপযুক্ত হবে। এই বার্তাই তোমায় বহন করে নিয়ে যেতে হবে অলিম্পাসে। জানি ভীষণ রকম কঠিন কাজ। কিন্তু তোমাদের পারতে হ’বে নিমো। অদূর ভবিষ্যতে তুমি এবং তোমার মত আরও এগারোজন তরুণ যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন সিদ্ধান্ত তোমাদেরই নিতে হবে। সেই সঙ্গীদের অবগত করাতে হবে তোমাকে, তাদের বোঝাতে হবে গুরুত্বটা।”
নিমো অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে, “ততদিন অবধি কেন অপেক্ষা করতে হবে? যদি এই আটলান্টিস নগরীর কথা, এই জলের তলার উভচর মানুষদের কথা, বিষাক্ত জল পরিশোধনের সাফল্যের কথা এখনই আ রা অলিম্পাস সিটির বারোজন অধিনায়ককে জানাই? আমি আমার বাবা ডঃ রায়ানকে বলব, উনি বাকিদের বলবেন…”
মায়া এতক্ষণে মুখ খোলে, “নিমো, পেগাসাসে করে আসা অনেক অলিম্পাস সিটির নাগরিকের সঙ্গে আমি মানসিক সংযোগের চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় না কেউ তাঁরা পৃথিবীকে ভালোবাসেন, তোমার মত করে। তোমার বাবা একটু আলাদা হ’লেও উনি দীর্ঘকাল অলিম্পাসের নিয়মের বেড়াজালে বদ্ধ থাকতে থাকতে সেই অনুভূতিগুলো হারাতে বসেছেন। বাকি এগারোজন অধিনায়ককে রাজি করানো ওঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।
তোমার মত অল্পবয়স্ক কেউ এই প্রথম পৃথিবীতে এল। তোমার মনের অনুভূতিগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়নি। আটলান্টিসের অস্তিত্ব এই মুহূর্তে অলিম্পাস জানলে হয়ত আরেকটা যুদ্ধ বাঁধবে, প্রযুক্তির দখল নেওয়ার লড়াই। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে…”
লিয়াম বলেন, “এতদিন আমরা ব্রেনের চিপগুলো ব্যবহার করিনি কিন্তু তোমার চিপটির ইমপ্রিন্ট নিয়ে অবিকল ও’রকম একটা চিপ আমি মায়ার ব্রেনে প্রতিস্থাপণ করব। অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে এবং যদি তুমি আমাদের স্বপ্নে সামিল হতে চাও তবেই। তুমি অলিম্পাসে ফিরে গেলেও সবার অগোচরে আটলান্টিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে মায়ার মাধ্যমে।”
নিমো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
(১১)
পেগাসাসে ফিরে আসার পথে একটা হলুদ রঙের ঝলমলে কোরালের টুকরো নিমোর হাতে দিয়ে মায়া বলল, “একটুকরো আটলান্টিস তোমার সঙ্গে থাক। আর একটুকরো অলিম্পাস এইখানে।”
এই বলে নিজের মাথায় টোকা দিল মায়া। নিমো হেসে উঠে ওকে বিদায় জানালো, তারপর ওপরের জলে ভেসে থাকা যানটার অভিমুখে সাঁতার কাটতে লাগল।
অনেক বড় কাজের দায়িত্ব এখন ওর কাঁধে।