এখনও বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কাল রাতেও ভালোভাবে ঘুমোতে পারিনি। আর মাত্র একটা ঘন্টা। তারপরেই ফ্লাইট কলম্বো এয়ারপোর্টে নামবে। উফফ, উত্তেজনার একটা শিরশিরে স্রোত যেন বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে।
জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালাম। পেঁজা তুলোর মতো মেঘের স্তূপ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। আমার পাশের সিটে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সুব্রত। ওপাশ দিয়ে হাই-হিল জুতোয় খটখট শব্দ তুলে একটা জলের বোতল হাতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন একজন সুন্দরী এয়ারহোস্টেস। ল্যান্ড করার আগে শেষ এক ঘন্টার তোড়জোড় চলছে বোধহয়। আমার চোখের সামনে ছবির মতো বারবার ভেসে উঠছে আগামীকালকের কিছু অদেখা দৃশ্য। কে জানে, হয়তো আগামীকালই সেই হাজার হাজার বছর আগের হারিয়ে যাওয়া পাতালপুরীর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াব আমরা। কেউ জানে না কী লুকিয়ে আছে তার অনন্ত অন্ধকারের আড়ালে। হয়তো কোনও গোপন ইতিহাস, যা কোনওদিন লেখা হয়নি বইয়ের পাতায়। হতে পারে যুগান্তরের লুকোনো গুপ্তধন বা তার চেয়েও আশ্চর্য কিছু।
জিনিসটা সুব্রতই খুঁজে পেয়েছিল। একদিন সকালে হঠাৎ ফোন করল সুব্রত। কী একটা নাকি খুব জরুরি দরকার। আমার সেদিন কলেজে ক্লাস ছিল না, তাই বাড়ি থেকেই সোজা বেরিয়ে পড়লাম। আমার বাড়ি থেকে সুব্রতর বাড়ি প্রায় একঘন্টার পথ। সুব্রত আমার কলেজের সময় থেকেই খুব ভালো বন্ধু। দুজনেই কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে পড়তাম। তারপর একসঙ্গেই এম.এ। তবে পি.এইচ.ডি তে গিয়ে অবশ্য আমাদের কাজের মোড় কিছুটা আলাদা হয়ে গেছিল।
সুব্রতর বাড়িতে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা। দরজায় গিয়ে কলিং বেল টিপতেই, “এদিকে আয়, একটা দারুণ জিনিস দেখাব”, বলতে বলতে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গেল সুব্রত, ওর পড়ার ঘরে। ওর চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম নিশ্চয়ই খুব পুরোনোদিনের কোনও জিনিস হাতে পেয়েছে। পুরোনো এন্টিক জিনিসের শখ ওর চিরকালের। তার ওপর সেটা যদি হিন্দু মাইথোলজির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তবে তো কথাই নেই ! সুব্রত পি.এইচ.ডি-তে এই বিষয়েই কাজ করেছিল কিনা।
“কী বস্তু যে খুঁজে পেয়েছি তা তুই ভাবতেই পারবি না গৌতম।” পেছনের আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করতে করতে বলল সুব্রত। তারপর একটা বেশ পুরোনো হলদেটে হয়ে আসা কাগজ এগিয়ে দিল আমার দিকে। হাতে নিয়ে দেখলাম। ১৯২৮ সালে লেখা একটা চিঠি। কিন্তু নিচে লেখকের সইটা চোখে পড়তেই চমকে উঠি। আর.ডি. ব্যানার্জি। আমি সুব্রতর দিকে বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে নিজেই বলল, “হ্যাঁ, যা ভাবছিস তা-ই। আর.ডি. ব্যানার্জি মানে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি মহেঞ্জোদারো অবিষ্কার করেছিলেন।”
আমি আবার চোখ ফেরালাম চিঠিটার দিকে। কালির কলমে ঝকঝকে ইংরেজিতে লেখা চিঠিটা। লেখা হয়েছিল জোনাথন স্মিথ নামে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কোনও এক পুরাতত্ত্ববিদকে। সুব্রতকে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম গতবছর কেমব্রিজে থাকাকালিন একটা নিলামে হঠাৎ তার চোখে পড়েছিল জিনিসটা। সুব্রত একটা চেয়ার টেনে আমার কাছ ঘেঁষে বসল। তারপর যেন ইচ্ছে করেই একটু নিচু গলায় বলল, “আসল জিনিসটা কিন্তু এটা নয়। আসল জিনিসটা পেয়েছি গতকাল”।
“আসল জিনিস ?” কৌতূহলভরা চোখে তাকালাম সুব্রতর দিকে। সে বলল, “দেখাব। কিন্তু তার আগে তুই একবার চিঠিটা পড়।”
আগাগোড়া বেশ মন দিয়েই পড়লাম চিঠিটা। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ধাতব জিনিসের উল্লেখ করেছেন এতে। জিনিসটা পাওয়া গেছিল মহেঞ্জোদারোতেই। তার সামনের দিকের মুখটা ষড়ভুজাকার, মানে হেক্সাগোনাল আর পেছনটা একটা অদ্ভুত প্যাটার্নে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মোটা থেকে সরু হয়ে গেছে। জিনিসটা লম্বায় প্রায় ১০ ইঞ্চি এবং বেশ ভারী কোনও ধাতুর তৈরি। শুধু লোহা যে এত ভারী হতে পারে না সে কথাও রয়েছে চিঠিতে। কিন্তু যে ব্যাপারটা রাখালদাস বাবুর চিন্তার কারণ ছিল তা হল ওই বস্তুর ডিজাইন আর সামনের ষড়ভুজাকার মুখের ওপর লেখা ভাষা। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এই বস্তু বা ভাষা মহেঞ্জোদারোর নয়। তাহলে সেটা ওখানে পৌঁছল কীভাবে? সুব্রত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করায় চিঠিটা উল্টে দেখলাম। সেই জিনিসটার বেশ নিখুঁত একটা ছবি এঁকেছেন রাখালদাস।
আমি চিঠিটা টেবিলে রেখে এবার সুব্রতর দিকে ফিরলাম। জিগ্যেস করলাম, “সবই তো বুঝতে পারছি, কিন্তু তুই হঠাৎ কাজকম্ম ছেড়ে এর পেছনে পড়লি কেন?”
একটু হেসে উঠে দাঁড়াল সুব্রত। তারপর আলমারির একেবারে নিচের চাবি দেয়া লকারটা খুলে একটা বাক্স বের করে টেবিলের ওপর রাখল। ঠিক আমার সামনে। “নে। এবার খোল বাক্সটা। এতেই আছে আসল জিনিস।”
ওর ব্যাপারস্যাপার দেখে একটু অবাকই লাগছিল আমার। ধীরে ধীরে বাক্সটা হাতে তুলে নিলাম। সুব্রত আরেকটু এগিয়ে বসল। কিন্তু বাক্সের মুখটা খুলতেই আমি একেবারে চমকে গেলাম। রীতিমত চোখ কপালে ওঠা যাকে বলে। এটাই তো রাখালদাসের চিঠিতে লেখা সেই জিনিসটা। আস্তে আস্তে বের করলাম বাক্স থেকে। সত্যিই বেশ ভারী, ঠিক যেমনটা লেখা আছে। দূর থেকে দেখলে একটা বড় মাপের আইসক্রিম-কোন বলে ভুল হতে পারে। পেছনের দিকটা অনেকটা স্ক্রুয়ের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সরু হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিটা প্যাঁচে খুব সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ চিহ্ন আঁকা। অনেকটা যেন আজকালকার কিউ.আর কোডের মতো।
“পেলি কোথায় এটা ?” জিগ্যেস করলাম সুব্রতকে।
সে ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসির ঢেউ তুলে বলল, “কাল সন্ধের দিকে একটা কাঁস-পেতলের দোকানে ঢুকেছিলাম। মা একটা পেতলের কৃষ্ণমূর্তি আনতে বলেছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে জিনিসটা। হাতে নিয়ে ঠিক তোর মতোই চমকে উঠেছিলাম তখন। চিঠিটা আগেই পড়া ছিল আমার। হবহু মিলে যাচ্ছিল রাখালদাসের বর্ণনার সঙ্গে।”
আমি বাধ সেধে জিগ্যেস করলাম, “কিন্তু ওই পেতলের দোকানে কীভাবে এল এই জিনিস ? এটা তো কোনও মিউজিয়ামে থাকার কথা।”
“ছিল”, সুব্রত বলল, “ন্যাশনাল মিউজিয়ামেই ছিল। তোকে এর পুরো ইতিহাসটা খুলে বলি তাহলে। মহেঞ্জোদারোতে এই জিনিসটা খুঁজে পাবার পর এটা নিয়ে গবেষণা করার জন্যে নিজের কাছেই রেখেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ অনেকবছর ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু ১৯২৮-এ এই চিঠিটা লেখার মাসখানেক পরেই জিনিসটা চুরি যায় তাঁর বাড়ি থেকে। ১৯৩০-এ তিনি মারা যাবার আগে অব্দি এর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।
“প্রায় চার দশক পর, ৭০-এর গোড়ার দিকে পার্ক স্ট্রিটের কাছে পুলিশ একটি ছেলেকে গুলি করে। সে-সময় যেমনটা হরদম হতো। তল্লাশি করতে গিয়ে আশ্চর্যভাবে এই জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যায় তার কাছে। কিন্তু সে এটা কোথায় পেয়েছিল তখন আর জানার উপায় নেই। তারপর থেকে এটা চলে যায় ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। অনেকদিন ছিল সেখানেই। বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষাও হয় জিনিসটা নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ ২০০৬ এর ডিসেম্বর নাগাদ জিনিসটা উধাও হয়ে যায়। এত বছর আর কোনও হদিশ নেই। আর তারপর ফাইনালি গতকাল আমার হাতে এসে পড়ে।”
এটুকু বলে একটা হালকা দম নিয়ে থামল সুব্রত। আমি বললাম, “দারুণ ব্যাপার তো। একেবারে গল্পের মতো। কিন্তু জিনিসটা তো চোরাই মাল। মিউজিয়ামে জমা করে দেওয়াই তো উচিত।”
আমার কাঁধে হাত রেখে একটু হাসল সুব্রত। “আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু কাল রাতে একটা মাইথোলজিক্যাল রিপোর্ট পড়তে গিয়ে সব হিসেব ওলোটপালট হয়ে গেল। ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তবে গৌতম আমি হলপ করে বলছি, আমাদের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে।”
“কী যা-তা বলছিস ? ক্ষেপে গেলি নাকি ?” ওর কথায় বেশ অবাক হয়েছিলাম তখন। কিন্তু সুব্রত ততক্ষণে নিজের ল্যাপটপে একটা পি.ডি.এফ ফাইল খুলে এগিয়ে দিল আমার দিকে। “নে, একবার চোখ বুলিয়ে দেখ। সব বুঝতে পারবি।”
১৯৬৫ সালের একটা হিন্দু মাইথোলজি সম্পর্কিত রিপোর্ট। মিশেল ক্যারোল নামে একজন আমেরিকান গবেষকের লেখা। রিপোর্টের শীর্ষকটাই বেশ আজব লাগল আমার। “The door of the hidden world”, মানে সোজা বাংলায় বললে, “গুপ্ত বিশ্বের দরজা” । রিপোর্টটা পড়ে যা বুঝলাম, তামিল রামায়ণে লেখা পাতালের গুপ্ত কোনও পথের ব্যাপারে বেশ লম্বা একটা আলোচনা রয়েছে। সেই পথ দিয়েই নাকি রাক্ষসেরা পৃথিবীতে উঠে আসত মাঝে মাঝে। আর সেই পথকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে ছিল একটা আশ্চর্য চাবিও। যার মালিক ছিলেন স্বয়ং রাক্ষসরাজ রাবণ ! মানে এককথায় পুরাণের ছেলে-ভোলানো আজগুবি গপ্প আরকি। কথাটা বললাম সুব্রতকে। সে একটু রাগের সুরেই বলল, “ওই তোর এক দোষ। পুরো জিনিসটা না পড়েই বিদ্যে জাহির করতে শুরু করিস। লাস্ট পেজটা দেখ, তারপর কথা বলিস।”
স্ক্রল ডাউন করে লাস্ট পেজে যেতেই আবার ধাক্কা খেলাম। সেই জিনিসটার ছবি। তামিল রামায়ণে নাকি এটাই আঁকা আছে সেই পাতালের চাবি হিসেবে।
সুব্রত বলল, “এটা দেখেই তো আমার সব হিসেব তালগোল পাঁকিয়ে গেল। ভাবতে পারছিস, পাতালের চাবি আমাদের হাতে !”
এবার সত্যিই না হেসে পারলাম না। বললাম, “ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং মানছি। কিন্তু তাই বলে তুই কি আসলেই বিশ্বাস করিস যে পাতাল বলে কিছু আছে ? যেখানে তোর মাইথোলজির রাক্ষস-খোক্ষসগুলো লুকিয়ে রয়েছে !”
সুব্রত গম্ভীরভাবে বলল, “না সেটা বলছি না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, এটা কোনও হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নগরের রাস্তা হতে পারে, হতে পারে কোনও বিশাল গুপ্তধনের ভাণ্ডারের চাবি। দেখ গৌতম, গুপ্তধনের বা অন্যকিছুর লোভ আমার নেই। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাব, যদি সত্যিই আমরা ওই রকম ঐতিহাসিক একটা কিছু, যা হাজার হাজার বছর ধরে মাটি চাপা পড়ে আছে, খুঁজে পাই তাহলে তুই বুঝতে পারছিস ? ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাবে রে। আর তার কারিগর হব আমরা।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজনায় গলাটা কাঁপছিল সুব্রতর। আমি একটু সময় চুপ থেকে বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে, সে নাহয় হল। কিন্তু এবার কী করতে চাস বল।”
“তুই জিনিসটা বাড়ি নিয়ে যা। এর ওপর কোনও একটা পুরোনো ভাষায় কিছু সংকেত লেখা আছে। তোর তো এসবের ওপরই কাজ। তুই একটু চেষ্টা করলে আশা করি ঠিক বুঝতে পারবি।” সুব্রত বলল, “আমার বিশ্বাস এই সংকেত পাতালের সেই দরজায় পৌঁছনোর রাস্তা ছাড়া আর কিছু নয়।”
সুব্রতর কথাটা মন্দ লাগল না আমারও। পাতাল বলে কিছু নাই বা থাকুক, কিন্তু ইতিহাসের কোনও অজানা যুগের সন্ধান তো হতেই পারে এই অদ্ভুত জিনিসটা। “ঠিক আছে”, বলে জিনিসটা বাক্সে ভরে উঠে পড়লাম আমি। গেটের কাছাকাছি আসার পর সুব্রত আবার পেছন থেকে ডেকে বলল, “ওহ, একটা কথা বলা হয়নি তোকে। যখন মিউজিয়ামে ছিল তখন জিনিসটা কোন ধাতুতে তৈরি সেটা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিছুটা লোহা, সীসা, কার্বন, জিঙ্ক এসব দিয়ে গড়া। কিন্তু সঙ্গে খুব অল্প পরিমাণে এমন একটা ধাতু পাওয়া যায় যার সম্পর্কে আজ অব্দি পৃথিবীতে কারও কোনও আইডিয়া নেই। পিরিওডিক টেবিলে থাকা মৌলগুলোর কোনওটার সঙ্গে মিল খায়নি সেটা।”
বেশ অবাক লাগল কথাটা শুনে। আমিও সুব্রতর মতো আস্তে আস্তে বেশ ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ছিলাম জিনিসটা নিয়ে। তাই বাড়ি ফিরে সেদিন রাতেই সেটাকে নিয়ে বসলাম। সামনের ষড়ভূজাকার মুখটার ওপর কিছু সংকেত লেখা। খুব ছোট ছোট অক্ষরে, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছাড়া পড়ার উপায় নেই।
ভালো করে দেখার পর ভাষাটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে কিছু পুরোনো সংরক্ষিত গবেষণাপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেই বুঝতে পারি, অনুমান ভুল ছিল না আমার। এটা প্রাচীন আর্যভাষা। মানে পাণিনি যেই ভাষাকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার জন্ম দেন, এটা সেই আদিম অ-সংস্কৃত ভাষা।
সেই ষড়ভুজাকার মুখটার একেবারে ওপরে লেখা রয়েছে “বীজাঙ্ক” আর তার ঠিক নিচে তিনটি সারিতে এক একটি করে বেশ লম্বা লম্বা সংখ্যা লেখা। বৈদিক গণিতে “বীজাঙ্ক” মানে হল কোনও সংখ্যায় যতগুলো অংক আছে তাদের যোগফল। মানে ১২৩ এর বীজাঙ্ক হল ১+২+৩=৬। কিন্তু আমি ঠিক শিওর ছিলাম না যে বেদের আগেকার যুগেও এই শব্দের একই অর্থ ছিল কি-না ! তবে এছাড়া আর কোনও অর্থ খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। তাই শেষ অব্দি প্রতিটি সংখ্যার অংকগুলোকে যোগ করেই দেখলাম। তিনটে সংখ্যা পাওয়া গেল। কিন্তু ওই অবধিই। আমি অনেক চেষ্টা করেও এগুলোর আর কোনও মানেই ঠাওরে উঠতে পারলাম না। ফোন করে জানালাম ব্যাপারটা সুব্রতকে।
দিন তিনেক পর হঠাৎ আবার সুব্রতর ফোন। ফোনের ওপাশ থেকে বেশ উত্তেজিত গলায় ভেসে এল, “এক্ষুণি আয়।” আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই দেখি ফোনটা রেখে দিয়েছে। অগত্যা সেদিন কলেজ কামাই করেই ছুটলাম সুব্রতর বাড়িতে। সঙ্গে বাক্সবন্দী সেই পাতালের চাবিটা।
কিন্তু সুব্রতর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ একটা ব্যাপারে কেমন যেন খটকা লাগল। ওর বাড়িতে ঢোকার মুখে ঠিক গলির মোড়টায় কালো চশমা পরা একটা লোককে দেখতে পেলাম। মনে হল যেন কিছুদিন আগে একেই আমার কলেজের সামনে দেখেছি। যাই হোক, তখন আর অতটা পাত্তা না দিয়ে সুব্রতর বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
সুব্রতর চোখমুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি ও নিশ্চয়ই সংকেতের কিছু একটা মানে বের করতে পেরেছে। উত্তেজনা যেন ঠিকরে পড়ছিল তার চোখে। আমাকে সামনে বসিয়ে একটা খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখ। যা বলেছিলাম তাই। এই সংখ্যাগুলোই ওই দরজার হদিশ।”
বীজাংকের হিসেব কষে আমি যেই তিনটে সংখ্যা পাঠিয়েছিলাম সেগুলোই লেখা ওর খাতায়, আর নিচে কীসব যেন যোগবিয়োগ করেছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না। সুব্রত একটু হেসে বলল, “বুঝিয়ে বলছি দাঁড়া। তুই ওই সংকেতগুলো ডিকোড করে আমাকে তিনটে সংখ্যা পাঠিয়েছিলি। ৫, ১৮, ৫৪। তাই তো ?”
আমি ঘাড় নাড়লাম। সুব্রত আবার বলতে লাগল, “সেটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল এটা কোনও জায়গার দ্রাঘিমাংশ হতে পারে। সেই মতো খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না। কারণ আমি গ্রিনউইচ মানে আধুনিক প্রাইম মেরিডিয়ানের হিসেবে সার্চ করছিলাম। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ কথাটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে মাথায়। প্রাইম মেরিডিয়ান হওয়ার বহু আগেই তো হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা মতে শূন্য দ্রাঘিমারেখা টানা হত উজ্জ্বয়িনীর মহাকালেশ্বর লিঙ্গের ওপর দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বসে গেলাম খাতা কলম নিয়ে। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, প্রাইম মেরিডিয়ানের হিসেবে উজ্জ্বয়িনীর দ্রাঘিমাংশ হল ৭৫ ডিগ্রি ৪৬ মিনিট ৬ সেকেন্ড, পূর্ব। এর সঙ্গে যোগ করে দিলাম তোর পাঠানো নম্বরগুলো। আর যোগফল দাঁড়াল ৮১ ডিগ্রি ০৫ মিনিট, পূর্ব। জানিস এটা কোন জায়গার দ্রাঘিমাংশ ?”
আমি এতক্ষণ বেশ মন দিয়ে শুনছিলাম সুব্রতর কথা। ওর প্রশ্নে মাথা নেড়ে বললাম, “না। কোথায় এটা ?”
সুব্রত আমার কাঁধে একটা হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই দ্রাঘিমারেখা ত্রিঙ্কোমালির ওপর দিয়ে গেছে।”
“ত্রিঙ্কোমালি ? কিন্তু শুধু ত্রিঙ্কোমালি কেন ? একই দ্রাঘিমারেখা তো অনেক জায়গার ওপর দিয়েই যায়।” ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলাম আমি।
সুব্রত গম্ভীর ভাবে বলল, “নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু অন্য কোনও জায়গার সঙ্গে রামায়ণ বা রাক্ষসরাজ রাবণের কোনও যোগাযোগ নেই।”
“মানে ?”
“ত্রিঙ্কোমালি জায়গাটা কোথায় জানিস? শ্রীলঙ্কায়। উত্তরপূর্ব উপকূলের একেবারে সমুদ্র ঘেঁষে। একটা শিবমন্দির আর জঙ্গলের ভেতর একটা গুহাও রয়েছে সেখানে। লোকে বলে রাবণের যুগের।” একটু থেমে সুব্রত আবার বলল, “ভেবে দেখ। একদিকে তামিল রামায়ণ-মতে এই চাবির মালিক রাবণ আর অন্যদিকে সংকেতগুলো থেকে যেই দ্রাঘিমাংশ পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গেও রাবণের যোগ রয়েছে। সব হিসেব মিলে যাচ্ছে গৌতম।”
সুব্রতর কথা শুনে এবার সত্যিই চমকে উঠলাম। তবে কি আসলেই আমরা সেই অজানা ইতিহাসের এতটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি ?
(২)
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে বসলাম। ফ্লাইট এইমাত্র ল্যান্ড করল কলম্বো এয়ারপোর্টে। কখন যে একটা ঘন্টা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। সুব্রতও উঠে বসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে সব আইনি ব্যাপারস্যাপার সামলে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরোতে বেরোতে আরও প্রায় একঘন্টা লেগে গেল। আজ একটা হোটেলেই থাকার প্ল্যান আমাদের। কাল ভোরের দিকে গাড়ি নিয়ে ত্রিঙ্কোমালি রওনা হব। এখান থেকে প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার। গাড়িতে পাঁচ ঘন্টার মতো লাগবে।
এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাব নিয়ে কাছাকাছি একটা হোটেলের দিকে এগোলাম আমরা। মিনিট পনেরোর রাস্তা। হোটেলে নেমে রিসেপশনে চেকইন করছি এমন সময় সুব্রত কনুই দিয়ে আমায় হালকা খোঁচা মেরে ওদিকের সোফায় বসে থাকা লোকটার দিকে ইশারা করল। খুব নিচু গলায় বলল, “লোকটাকে আমি আমার বাড়ির সামনে একবার দেখেছি। আমাদের ফ্লাইটেই ছিল আর এখন এখানেও। ফলো করছে না তো?”
কিন্তু আমি একটু ভালোভাবে দেখবার জন্যে লোকটার দিকে তাকাতেই চট করে উঠে চলে গেল সে। মুখটা ঠিক দেখতে পারলাম না। কিন্তু খটকাটা আমার মনেও লেগে রইল। এই লোকটাই কি তবে সেই যাকে আমিও দেখেছিলাম ?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমে এসে ঢুকলাম আমরা। বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে রুম। নরম বিছানার ওপর ধবধবে সাদা সুন্দর বেডশিট বিছানো। সার্ভিস বয় এসে নতুন দুটো ফ্রেশ তোয়ালে আর সাবান দিয়ে গেল। দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে এসে বসল সুব্রত। “তোর কী মনে হয় ? লোকটা ফলো করছে ? কিন্তু জানলো কীভাবে যে আমাদের কাছে জিনিসটা আছে ?”
সুব্রতর প্রশ্নে একটু সময় চুপ থেকে বললাম, “জানি না। তবে একটা কথা তোকে বলা হয়নি। সেদিন যখন তোর বাড়িতে গেছিলাম তখন একটা লোককে দেখতে পাই তোর গলির মোড়ে, মনে হয়েছিল যেন একে আগেও আমি একদিন আমার কলেজের বাইরে দেখেছি। তখন এতটা পাত্তা দিইনি কিন্তু আজকে তোর কথাটা শুনে আমারও কেমন যেন খটকা লাগছে।”
“সে কী ? আগে জানালি না কেন ?” সুব্রতকে একটু চিন্তিত দেখাল।
“যাগ্গে, এখন আর সেসব ভেবে লাভ নেই। এত দূর যখন এসে পড়েছি তখন এই রহস্যের একটা এসপার-ওসপার না করে ফিরছি না। যা হবে দেখা যাবে।”
ঘড়িতে এখন রাত আটটা বাজে। কাল কাকভোরে বেরোতে হবে। তাই আর বেশি দেরি না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম দুজনেই। কিন্তু উত্তেজনায় অনেকক্ষণ চোখের পাতা এক হচ্ছিল না আমাদের। আর মাত্র একটা রাত। তারপরেই না জানি কোন রোমাঞ্চকর অতীতের মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। পাশের টেবিলে একটা চামড়ার ব্যাগে রাখা সেই পাতালের চাবি, যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করে আছে পাতালপুরীর দরজার।
ভোর চারটেয় বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আগের কথামতো গাড়ি বাইরেই রেডি ছিল। ত্রিঙ্কোমালির ইয়ালা গুহা। সেখানেই যাচ্ছি আমরা। সমুদ্র থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার ভেতরে বনজঙ্গলে ঘেরা একটা পাথুরে গুহা। রাবণ নাকি এখানেই শিবের গুপ্ত সাধনা করত। এখানকার লোকজনের তেমনটাই বিশ্বাস। আর যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। সেখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে রাবণের কোনও গোপন শহর বা ভাণ্ডারের দরজা। পাতালের দরজা !
বেশ সুন্দর ভাবেই এগোচ্ছিলাম আমরা। চারপাশে ঘন সবুজ বন। মাঝ বরাবর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটা। কিন্তু এই পাহাড়ি রাস্তার একটা ঢালের কাছ দিয়ে নামার সময় হঠাৎ ড্রাইভার ছেলেটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, “আপনাদের কি কেউ ফলো করছে ?”
ওর প্রশ্নে বেশ চমকে উঠলাম আমরা। সে গাড়ির সাইড মিররের দিকে ইশারা করে বলল, একটা কালো স্করপিও গাড়ি বেশ অনেকক্ষণ ধরে আমাদের পিছু পিছু আসছে। আমাদের দুজনেরই বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল। হুজুগে মেতে রহস্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু এভাবে যে কেউ সত্যিই পিছু নিতে পারে সেটা একবারও মাথায় আসেনি আমাদের। আরও কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর আমি ড্রাইভারকে একটু সাইড করে গাড়িটা থামাতে বললাম। পেছনের গাড়িটা কিন্তু থামল না, পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। ভয় কিছুটা কাটলেও মনের ভেতর একটা কী যেন খচখচ করতেই থাকল।
সাড়ে ন’টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম সেই ইয়ালা গুহার কাছাকাছি। চারপাশে বেশ অনেকটা ঘন জঙ্গল ঠেলেই আসতে হয়েছে আমাদের। গুহার চারদিকেও অন্ধকার হয়ে আছে গাছগাছালির ভিড়ে। গাড়িটা একটু দূরে রেখে পায়ে হেঁটেই গুহার মুখ অব্দি এলাম। পাহাড়ের মাঝখানে গাছপালায় ঢাকা প্রায় দুই-মানুষ উঁচু একটা সুড়ঙ্গ-পথ সোজা এগিয়ে গেছে অজানা অন্ধকারের রাজ্যে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে আমার। উত্তেজনা আর চাপা একটা ভয়ের আমেজ ঘামের সঙ্গে যেন চুঁইয়ে পড়ছে শরীরের আনাচে কানাচে। সুব্রতরও একই অবস্থা। দুজনে একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম গুহার মুখ দিয়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতে টর্চ না থাকলে কিচ্ছুটি দেখার উপায় নেই। টর্চের প্রথম আলোতেই একঝাঁক বাঁদুড় আর চামচিকে ফরফর করে উড়ে বেরিয়ে গেল।
কার্বলিক এসিড সঙ্গেই ছিল। চারপাশে বেশ করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে চলতে লাগলাম আমরা। কিছুটা যাবার পর হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরল সুব্রত, “গৌতম, ওই দেখ”। গুহার ওপর দিকে তাকালাম। পাথরে খোদাই করা কিছু রাক্ষসের মূর্তি। মানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই গুহা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। আবার সামনে পা বাড়ালাম আমরা। যত এগোচ্ছি ভেতরের বাতাসটা কেমন যেন গুমোট হয়ে উঠছে। একটা ভ্যাপসা গরম আর স্যাঁতসেঁতে আঁশটে গন্ধ।
কিন্তু বেশি দূর আর এগোনো গেল না। পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল দেওয়াল। তার গায়ে গায়ে রাক্ষুসে সব মূর্তি খোদাই করা। এগোবার আর কোনও রাস্তা নেই। তবে কি এখানেই গুহা শেষ ? ওই পাতালের দরজা কি নিছক পৌরাণিক গল্প ? প্রায় আধঘন্টা আমরা এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোনও পথ পাওয়া গেল না। এমনসময় হঠাৎ সুব্রত টর্চের আলোয় একটা চারকোণা ফুটো দেখতে পেল। বেশ ছোট। সহজে চোখে পড়বার জো নেই। কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে সুব্রত বলল, “ওই জিনিসটা দে তো। দেখি চেষ্টা করে যদি কিছু হয়।”
ব্যাগ থেকে জিনিসটা এগিয়ে দিতে সে ওটার পেছনের সরু অংশটা আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিল সেই ফুটো দিয়ে। বেশ মিলে গেল। প্রথমে ডানদিকে মোচড় দিল, কিছুই হল না। কিন্তু বাঁদিকে হালকা একটু ঘোরাতেই ঘড়ঘড় শব্দে দু’ভাগ হয়ে গেল দেওয়ালটা। রাস্তা খুলে গেল চোখের সামনে। বিশাল একটা পাথরের মন্দির। অদ্ভুত অদ্ভুত সব মূর্তি চারপাশে। আর পুরোটা মন্দির জ্বলজ্বল করছে এক অজানা আলোয়। কোত্থেকে আসছে সেই আলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। এই কি তবে পাতাল ?
“না।” পেছন থেকে একটা কর্কশ গলায় উত্তর ভেসে এল। চমকে ফিরলাম আমরা। সেই লোকটা ! একেই আমি সুব্রতর বাড়ির সামনে দেখেছিলাম। সুব্রতও চিনতে পারল তখনই, একেই সে হোটেলে দেখেছিল। কখন যে আমাদের পেছন পেছন গুহায় ঢুকে পড়েছে বুঝতেই পারিনি।
“ক-কে ? কে তুমি ?” কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করল সুব্রত।
সেই কালো চশমা পরা লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল আমাদের দিকে। তার গায়ে কালো কোট জড়ানো, টিকালো নাক আর মাথাটা এমন অদ্ভুত রকম পালিশ করে কামানো যে দেখলে পাথরে গড়া মনে হয়। পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করতে করতে আগের মতোই রুক্ষ স্বরে বলল, “আমি কে ? দেখতে চাও ?”
তারপর আমাদের চোখের সামনে যা ঘটল তা এই জীবনে কোনওদিন ভুলতে পারব না। লোকটার অট্টহাসিতে যেন কেঁপে উঠল মন্দিরের দেওয়ালগুলো। অবাক হয়ে দেখলাম, লোকটার সারা শরীর দিয়ে একটা নীল আলো বেরোচ্ছে। চোখের নিমেষে সে পাল্টে গেল একটা অদ্ভুত জীবে। শরীরের রং সমুদ্রের মতো নীল হয়ে উঠল তার। হাত-পাগুলো দড়ির মতো চিকন। মাথাটা দেহের অনুপাতে অনেক বড়। আর কালো কালো বিশাল চোখদুটো যেন পাথরের মতো নিশ্চল।
সুব্রত অজ্ঞান হয়ে গেল। মনে হল,আমার বুকের ভেতরেও কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বেশ টের পেলাম, হাতটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে আমার। কপাল বেয়ে গরম ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে বাকি রইল না, আমাদের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে এই গ্রহের প্রাণী নয়। সেই নীল ভিনগ্রহীটার হাতের পিস্তলটা এখনও আমাদের দিকেই তাক করা। সে আরেকটা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “যদি মরতে না চাও তাহলে সেই জিনিসটা আমাকে দিয়ে দাও। ওটাকে কাজে লাগবার মতো উন্নত প্রযুক্তি তোমাদের নেই।”
আমার আর কিছু ভাববার মতো অবস্থা ছিল না। আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো জিনিসটা ব্যাগ থেকে বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ঠাণ্ডা নীল একটা হাত তুলে নিল জিনিসটাকে। তারপর সেই ভিনগ্রহী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জানো এটা কী ?”
আমি পাতালপুরীর কথাটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারলাম না। সেই নীল লোকটা নিজে থেকেই আবার বলতে লাগল, “এটা একটা চাবি। অন্যমাত্রার জগতের দরজা খোলার চাবি। ওই যে দেখছ দেয়ালটা, ওটাই সেই দরজা। যার ওপারে রয়েছে সিক্স ডায়মেনশনাল ইউনিভার্স, মানে ষড়মাত্রিক ব্রহ্মাণ্ড। সেখানে কোয়ান্টাইজড গ্র্যাভিটিকে কাজে লাগিয়ে অতীত বা ভবিষ্যতের যেকোনও মুহূর্তকে বদলে দেওয়া যেতে পারে ইচ্ছেমতো। মানে এই চাবি যার হাতে সেই সৃষ্টির আদি অন্তের নিয়ন্তা, ঈশ্বর। বহুবছর ধরে এই জিনিসটা পাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি আমরা, ওরিয়ান গ্রহের লোকরা। কিন্তু আজ শেষ অব্দি আমার হাতে এল এই আশ্চর্য জগতের পাসওয়ার্ড।”
লোকটার সামনে আমি মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে যেন পা দুটো গেঁথে গেছে। সুব্রতর জ্ঞান ফেরেনি এখনও। এবার লোকটা সেই জিনিসটা নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেল দেওয়ালটার দিকে। ঝকঝকে মসৃণ কষ্টিপাথরের একটা দেওয়াল। তার ওপর অজস্র নকশা কাটা রয়েছে। আর ঠিক মাঝখানে একটা ষড়ভুজ আঁকা। সেই ধাতব জিনিসটার ষড়ভুজাকার মুখটা সেখানে বসাতেই খাপে খাপে মিলে গেল। থরথর করে কেঁপে উঠল মন্দিরটা। একটু একটু করে দেওয়ালটা ফাঁক হতে লাগল। আমার চোখের সামনে খুলে যেতে লাগল সেই অচেনা অদ্ভুত জগতের দরজা। অবাক হয়ে দেখলাম, ঘন কালো অন্ধকারে কতগুলো আলোর রেখা যেন এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে সাপের মতো। কিন্তু তারপর যা ঘটল তা আরও ভয়ানক। সেই অজানা জগতের অন্ধকার হঠাৎ যেন মেঘের মতো ঘনিয়ে এসে জাপটে ধরল সেই ভিনগ্রহীটাকে। আর্ত চিৎকার করতে করতে সে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল সেই অন্ধকার জগতের অন্তরালে। দেয়ালটা আবার একটু একটু করে বন্ধ হতে লাগল। মন্দিরটাও যেন আরও জোরে কাঁপতে শুরু করেছে। ধসে পড়ছে পাথরের মূর্তিগুলো। ভূমিকম্প ! এই মন্দির ভেঙে পড়বে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি ততক্ষণে এই চোখের পলকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর আবেশ থেকে কিছুটা সামলে উঠেছি। সুব্রতরও একটু একটু জ্ঞান ফিরছে। আর দেরি করা যাবে না। ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তুলে ছুটে বেরোতে লাগলাম আমরা। পেছনে বড় বড় পাথরের টুকরো ধসে পড়ার শব্দ। ঠিক যেন বাজ পড়ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াতেই আমাদের পেছনে আস্ত পাহাড়টা ধসে পড়ল বালির স্তূপের মতো।
পেছন ফিরে তাকালাম। পাতালপুরীর দরজা তখন হারিয়ে গেছে সার সার পাথরের নিচে।
সেই ভিনগ্রহী কী বলেছিল তা বোঝার মতো বিদ্যে আমার নেই, কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছি, সব দরজা খোলার অধিকার প্রকৃতি আজও দেয়নি আমাদের। কিছু অজানা জগত অজানার অন্ধকারেই থাক, তাতেই সবার মঙ্গল।