আধো-অন্ধকার ঘর। শুধুমাত্র একটি ডিমলাইট জ্বলছে। দরজাটা অর্ধেক ভেজানো। ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়। যদিও ডিমলাইটের হালকা আলোয় স্পষ্ট নয় কিছুই। এটুকু অবশ্য বোঝা যায় যে, বিছানায় কেউ শুয়ে আছে। আর দরজায় দাঁড়িয়ে তা দেখছে একজন। ছোট্ট একটি ছেলে। হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আম্মু!” কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেমন শুয়ে ছিল তেমনি আছে। ছেলেটি আর ডাকল না। ধুপধাপ শব্দ তুলে বসার ঘরের দিকে দৌড় দিল।
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে একজন। এ ঘরটাও খুব একটা আলোকিত নয়। অথচ যে বসে আছে তার হাতে একটি বই, খুব যেন মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছে সে। এমন সময় ঘরের মধ্যে দৌড়ে ঢুকল সেই ছোট ছেলেটা। এসে বসে থাকা অবয়বটির গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তারপর বলল, “আব্বু? আম্মু এখন রুমে শুয়ে আছে কেন? ডাকলাম, শুনলো না।”
“না রাব্বি, আম্মুকে এখন ডিস্টার্ব কোরো না। আম্মু একটু অসুস্থ তো, তাই আগে আগে ঘুমিয়েছে।” বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বলল লোকটা।
“আম্মু অসুস্থ? তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবা না?”
“না, ডাক্তার লাগবে না। একটু রেস্ট নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি আর ডিস্টার্ব কোরো না, কেমন?”
“আচ্ছা।” এই বলে আবার ধুপধাপ করে বেড়িয়ে গেল রাব্বি। উদ্দেশ্য আরেকটা ঘর। এটা ওর একধরনের খেলা। এই খেলা সে মাঝে মাঝেই খেলে। একঘর থেকে দৌড়ে আরেকঘর যায়। সেখানে একবার ঢুঁ মেরে আবার আরেকঘরে।
এবার রাব্বি রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। এই ঘরটাও পুরোপুরি আলোকিত নয়। ঘরে লাইট জ্বলছে। তারপরও যেন অন্ধকার দূর হচ্ছে না। পাতিলে চামচ নাড়াচাড়া করার শব্দও আসছে ভেতর থেকে। রাব্বি ঘরে উঁকি দিল। দেখল, ওর আম্মু রান্না করছে ভেতরে। পাতিলে চামচ নেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাব্বি সেখান থেকে দৌড়ে আবার বসার ঘরে চলে এলো। ওর আব্বুর কাছে এসে বলল, “আব্বু! আম্মুকে দেখলাম রুমে শুয়ে আছে। আবার আম্মুকে দেখলাম রান্নাঘরে রান্না করছে।”
“কি বলো! তোমার আম্মু তো অসুস্থ, ঘুমিয়েছে। রান্নাঘরে থাকবে কেন! তুমি ভুল দেখেছ রাব্বি।” এবারো বই থেকে চোখ সরালো না লোকটা।
“আচ্ছা আব্বু, তখন যে লোকগুলো এসেছিল, ওরা কারা?”
“ওরা? ওরা তো বিজনেস করে আমার মতো।”
“ওদের হাতে যে পিস্তল ছিল? ওগুলো কি খেলনা?”
“হ্যাঁ, বাবা। খেলনা ওগুলো, তোমার খেলনা পিস্তলের মতোই।”
“ও…আব্বু ওটা একটু নিলাম।” এই বলে টেবিলে রাখা মোবাইলটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল রাব্বি। আবার শোবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মোবাইলের মেনুতে গিয়ে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালালো। ঘরের দরজা পুরোপুরি না খুলেই দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল। ভেতরে ফেলল মোবাইলের আলো। বিছানায় এখনো শুয়ে আছে ওর আম্মু। মোবাইলের আলো মেঝের দিকে ফেলতেই ও দেখল, মেঝেতে পড়ে আছে কেউ। ওর আব্বু। এটা দেখেই রাব্বি আবার দৌড়ে চলে গেল। বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, এখনো ওর আব্বু বসে বসে বই পড়ছে। রাব্বি আর ঘরে ঢুকল না। সেখান থেকে সোজা চলে গেল রান্নাঘরে। গিয়ে দেখল, ওখানে ওর আম্মু তখনো রান্না করছে। রাব্বি ঘরে ঢুকে ওর আম্মুকে জিজ্ঞাসা করল, “আম্মু? আব্বুকে দেখলাম রুমের ফ্লোরে শুয়ে আছে। আবার দেখলাম, বসার ঘরে বসে বই পড়ছে।”
“তোমার আব্বুর হয়তো গরম লেগেছে, তাই ফ্লোরে শুয়েছে।”
“তাহলে আবার যে দেখলাম বই পড়ছে?”
“তুমি ভুল দেখেছ।”
রাব্বি আর কিছু বলল না। আবার শোবার ঘরে চলে এলো। দরজাটা হালকা ঠেলা দিয়ে দরজার পাশে দেয়ালে লাগানো সুইচ বোর্ডের সুইচ চেপে লাইট জ্বালিয়ে দিল। লাইট জ্বললেও ঘরটা কেন যেন সম্পূর্ণ আলোকিত হলো না। তারপরও যতটুকু দেখা যায় রাব্বি তা দেখে ফেলল। দেখল, বিছানায় পড়ে আছে ওর আম্মু, রক্তাক্ত। পেট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। বিছানার চাদরে লেগে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে তা। অন্যদিকে, মেঝেতে পড়ে রয়েছে ওর আব্বু। মাথায় একটা ফুটো। সারা মেঝের অর্ধেকটাই রক্তে ছেয়ে আছে। রাব্বি গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
কিন্তু ওর একবারও চোখে পড়ল না দরজার পেছনের অংশটা। যেখানে পড়ে রয়েছে একটা দেহ। একটা ছোট্ট ছেলের। বুক থেকে রক্ত পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেছে একদম। আতঙ্ক এবং ভয় দুটোই যেন খেলা করছে তার চোখগুলোয়।