রান্নাঘর থেকে মা হাঁক দিলেন, “বুকাই, টুকাই খাবে এস এবার……”
পড়ার টেবিলে বসে একমনে, নিজের সঙ্গেই কাটাকুটি খেলছিল বুকাই। একবার ঢ্যাঁড়া দিচ্ছে একবার গোল্লা। কখনও ঢ্যাঁড়াটা সে, কখনও গোল্লাটা । সবসময় যে নিজে জিতছে তা কিন্তু নয়। আসলে এই নিজেকে নিজে হারিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তার বেশ মজার লাগে। তাই পড়ার বই সামনে খুলে অনেকসময়ই মন দিয়ে এরকম খেলে বুকাই। তবে আজ মায়ের গলাটা কানে যেতেই একটু সচকিত হল। পাশেই চৌকির ওপর বই-খাতা খুলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে টুকাই। মায়ের ডাক তার কানে যায়নি।
মা হাঁক দিলেও বুকাই জানে রান্নাঘরে আসন পেতে ভাত বাড়া হতে এখনও অন্তত মিনিট পনেরো দেরি আছে। আসলে এই হাঁকটা মা বুকাই-টুকাইকে খেতে আসার জন্য দেয়নি। বাইরের বারান্দায় বাবাদের তাসের আসর বসেছে। আসর যে দিব্যি জমে উঠেছে সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। তাসুড়েদের কারুরই ঘড়ির দিকে খেয়াল নেই। কোনওদিনই থাকে না। মায়ের এই হাঁকটা আসলে তাদের সময়টা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের গলা শুনলেই তাসের নেশা কেটে যায় বাবার বন্ধুদের। হুঁশ ফেরে বাবারও। তখন তাড়াতাড়ি হাতের দানটা শেষ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। খেলা শেষ হলে বন্ধুরা টর্চ হাতে বেরিয়ে যায়। বাবাও সতরঞ্চি-তাস গুটিয়ে ভিতরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে। এই পুরোটা হতে সময় লাগে প্রায় পনেরো মিনিট। গরমের দিনে এই সুযোগে মাও একবার চট্ করে গা ধুয়ে নেয়।
পুরো রুটিনটাই বুকাইয়ের মুখস্থ। তার হিসেবে বাবা এখনও বারান্দায় আর মা গেছে কুয়োতলায়। তার মানে লাইন ক্লিয়ার। ঘুমন্ত টুকাইকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে চট্ করে উঠে পড়ে বুকাই। টেবিলের তলা থেকে পুরোন প্লাস্টিকের বাটিটা বার করে সোজা রান্নাঘরে। হাঁড়ি থেকে অল্প একটু ভাত আর ডাল বাটিতে ঢেলে নিয়ে একছুটে উঠে যায় ছাদে। সিঁড়ির দরজাটা পারুলদি বিকেলে কাপড় তোলার পর বন্ধ করে দেয়। আগে একটা ছোট কাঠের পিঁড়ের ওপর চড়ে ছিটকিনিতে হাত পেত বুকাই। কিন্তু ক্লাস সেভেন ওঠার পর থেকে আর পিঁড়ির দরকার হয় না। যথাসম্ভব আওয়াজ না করে ছিটকিনিটা খুলে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালে। বড় ঝুড়িটা উপুড় করে রাখা আছে একপাশে। সেটার ওপর হাত দিতেই কিচকিচ শব্দ শোনা যায়। খুব সাবধানে ঝুড়িটা তুলে কাঠবিড়ালীটাকে বার করে বুকাই। ভয় কিচকিচ শব্দ করছে জন্তুটা। পালাতে চাইছে হাত ছাড়িয়ে। বুকাই ওর পিঠে একটু হাত বুলিয়ে আবার ঝুড়ির নিচে রেখে ভাতের বাটিটাও ঢুকিয়ে দেয়। একটা বাটিতে জল আগে থেকেই দেওয়া ছিল। ঝুড়িটা আবার উপুড় করে রেখে, ঘরের জানলাটা ভাল করে দেখে নেয় । মণিপিসিদের মস্ত হুলো বেড়ালটা সারাক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। কাঠবিড়ালীর গন্ধ পেলে এসে হানা দিতে পারে।
চিলেকোঠার দরজাটা সাবধানে বন্ধ করে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল বুকাই সেই সময় হঠাত্ চোখে পড়ে একটা অদ্ভূত দৃশ্য। তাদের খিড়কির বেড়া পেরোলে মণিপিসিদের বিশাল কলাবাগান। কলাবাগনের পর একটা আধামজা পুকুর। সেই পুকুরের ওপাশে ফুচিদিদের বাড়ি। দিনের বেলায় বুকাইদের ছাদ থেকে ফুচিদিদের বাড়ি বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। তেমন তেমন দরকার পড়লে চেঁচিয়ে দু-কথা বলেও নেওয়া যায়। কিন্তু রাতের বেলা কলাবাগান-পুকুর সবই তো অন্ধকারে ডুবে থাকে। অথচ কী আশ্চর্য ব্যাপার ফুচিদিদের বাড়ির পাশের মজা পুকুরের ওপরটা কেমন যেন আলো হয়ে আছে। আলোটা কিন্তু টর্চ কিংব হ্যাজাকের আলোর মত নয়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আলোটা যেন পুকুরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে। অথচ আলোর চারপাশটা কিন্তু একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। ফুচিদিদের বাড়িটা মোটেই দেখা যাচ্ছে না। বাড়িতে কোনও আলো জ্বলছে বলেও মনে হচ্ছে না। অবশ্য ফুচিদিদের অভ্যাস হল সকাল সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়া। কিন্তু ওদের বাড়ির কেউ কি এই আলোটা দেখতে পাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে বুকাই দেখল সেই অদ্ভূত আলোটা হঠাৎ লাফ দিয়ে আকাশে উঠে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। বুকাইয়ের মনে হল তার বাবার টেবিলে যেমন একটা ছ-কোণা কাগজচাপা আছে, অনেকটা সেইরকম একটা জিনিসের ভিতর থেকে যেন আলোটা বেরোচ্ছে। কিন্তু ভাল করে বোঝার আগেই সেটা একেবারে হুশ করে অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে গেল।
বুকাই কেমন যেন একটু হতভম্ব হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল এমন সময় নিচ থেকে আবার মায়ের হাঁক শোনা গেল। এত রাতে বুকাই চিলেকোঠার ঘরে এসেছে বুঝতে পারলেই তুলকালাম বাধাবে মা। আর তারপর যদি ঝুড়ির নিচ থেকে কাঠবিড়ালী বেরোয় তাহলে তো কথাই নেই। বুকাইয়ের এইসব নানা জন্তু-জানোয়ার ঘরে এনে তোলাটা মায়ের একেবারে পছন্দ নয়। এর আগে কানা ইঁদুর, খোঁড়া বেড়ালছানা, ঘেয়ো কুকুরের বাচ্চাকে আদর করে বাড়িতে আনার জন্য পিঠে বেশ কয়েক ঘা পড়েছে তার। কিন্তু তবু স্বভাব বদলায়নি। তাছাড়া কাঠবিড়ালীটাকে গুলতি ছুঁড়ে মেরেছিল তাদের ক্লাসের কাল্টু। বেচারার পায়ে এমন লেগেছে যে ভাল করে নড়াচড়াই করতে পারছে না। ভাগ্যিস এমন একটা ঝোপের ভিতরে পড়েছিল যে কাল্টু ওকে খুঁজে পায়নি। কাল্টু চলে গেলে বুকাই কোনওরকমে ওকে উদ্ধার করে এনেছে। এখন কয়েকদিন সাবধানে রেখে পায়ে একটু চুন-হলুদ লাগিয়ে দিলে সেরেও যেতে পারে। কিন্তু মাকে এসব কথা বোঝানো যাবে না। তাই কাঠবিড়ালীটাকে চুপিচুপি নিজের চিলেকোঠার ঘরে এনে রেখেছ বুকাই। এই ঘরটা একেবারে তার নিজস্ব। এমন ভয়ঙ্কর নোংরা যে মা কিংবা কাজের মাসি পারুলদি কেউ ভয়ে ঘরে ঢোকে না। মা তো বলে যে ওই ঘর থেকে বাঘ-সিংগি বেরোলেও নাকি তিনি আশ্চর্য হবেন না। বুকাইয়ের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। সে তার নিজের সব গুপ্তধন এই ঘরে নিশ্চিন্তে গুছিয়ে রাখে।
বুকাইরা যে গ্রামে থাকে তার নাম মিঠাইপুর। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। পাকা রাস্তা, ইলেকট্রিকের আলো এসব আছে। একটা হাইস্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পোস্টাপিসও রয়েছে। আবার মজা পুকুর, গোরুর বাথান, বাঁশবাগান, আমবাগান এসবেরও কোনও অভাব নেই। বুকাই গ্রামেরই শশীতারা হাইস্কুলে পড়ে। যদিও ওর মা-বাবা দুজনের মতেই, পড়ে বললে ভুল হবে। বুকাই আসলে ইস্কুলে যায়। পড়াশোনা মোটে করে না। এব্যাপারে ইস্কুলের মাস্টারমশাইরাও মোটামুটি একমত। পড়ার বইখাতার সঙ্গে বুকাইয়ের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। মাস্টারমশাইদের নানারকম তর্জন, গর্জন, বকুনি এমনকি সময় সময় বেতের ঘা-ও বুকাইকে ক্লাসে মনোযোগী করতে পারেনি।
বুকাইয়ের পড়াশোনা করতে মোটেই ভাল লাগে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে বুকাই সারাদিন শুধু খেলে বেড়ায়। খেলাধুলোও তার বিশেষ পছন্দ নয়। এমনকি বুকাইয়ের তেমন কোনও বন্ধু-বান্ধবও নেই। সে একলা থাকতে ভালোবাসে। আর সবথেকে বেশি ভালোবাসে একলা একলা আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াতে। এই মিঠাইপুর গ্রামের কোথাও এমন কোনও গাছ নেই যেটা বুকাই চেনে না। গাছপালা, ঝোপঝাড় এমনকি ঘাস জঙ্গলের ভিতরে ফুটে থাকা একফোঁটা ঘাসফুলও তার চোখ এড়ায় না। বুকাই জানে তারিণীদাদুদের বাড়ির সামনের বটগাছের কোটরে একজোড়া কাঠবিড়ালীর বাসা। কাল্টুদের বাড়ির পিছনে আগাছায় ভরা যে জায়গাটা সেখানে ইদানীং ছানা-পোনা নিয়ে একটা বেঁজি পরিবার এসে থানা গেড়েছে। ফুলদিদের খিড়িকির পুকুরের ঘাটের আলগা হয়ে যায় ইঁটের নিচে সাপ বাবাজি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোয়। এছাড়া বেনেবউ,দুগগা টুনটুনি, ছাতারে, দোয়েল, কাদাখোঁচা কিংবা হুপোইয়ের মত যেসব পাখি ইতি-উতি উড়ে বেড়ায় তাদের চেহারা-পত্তর তো বটেই এমন কী কে কোথায় ডিম পাড়ছে সেখবর পর্যন্ত বুকাই রাখে। তার খুব ইচ্ছে ছিল একজোড়া মোটাসোটা সোনা ব্যাঙ আর গোটা কয়েক শামুক পোষে। কিন্তু মায়ের ভয়ে পেরে ওঠেনি। বাড়িতে যখন নিজের পছন্দের জিনিসপত্র রাখার উপায় নেই, তখন বাধ্য হয়েই বুকাইকে সারাদিন বাইরেই ঘুরে বেড়াতে হয়। সে ঝোপেঝাড়ে ঘুরে ফল পাড়ে, বীজ কুড়োয়। কখনও সেগুলো এদিক-ওদিক ছিটিয়ে দেয়। কখনও আবার নিজের ঘরে এনে যত্ন করে রাখে। কোন গাছে পাখি ডিম দিল, কোথায় নদির চরে শেয়ালের ছানা হয়েছে এসবের খোঁজ নিয়ে বেড়ায়।
ফুচিদিদের পুকুরের ওপর ওরকম একটা অদ্ভূত আলো দেখার কথাটা বুকাই বাড়িতে কাউকে বলেনি। একে তো বললে কেউ বিশ্বাস করত না । তারওপর অত রাতে ছাদে যাওয়ার কথাটা ফাঁস হলে অন্যরকম বিপদও হতে পারত। কিন্তু পরদিন ইস্কুলে এসে সে শুনল যে জোর আলোচনা চলছে। গ্রামের আরও কয়েকজন নাকি আকাশ দিয়ে একটা অদ্ভূত আলো উড়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু সেটা যে কীসের আলো কেউ বুঝতে পারছে না। বুকাইদের ক্লাসে ফার্স্ট হয় অসীম মিদ্যা। ভারি পড়ুয়া ছেলে। সারাক্ষণ শুধু বই মুখে দিয়ে বসে আছে। শুধু সেরকম হলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু অসীমের ভারি কুচুটে বুদ্ধি আর ভয়ানক নালিশ করা স্বভাব। ক্লাসের ছেলেদের অঙ্ক কষে দেওয়ার বিনিময়ে গাছের আম-কলা-পেয়ারা এসব হাতিয়ে নেওয়ার অভ্যাস আছে। এছাড়া টিফিনের সময় কেউ চুরাণ কিংবা গুড় কুল কিংবা পাকা আমড়া যাই-ই কিনুক না কেন অসীমকে তার ভাগ দিতে হবে। নাহলেই সে মাস্টারমশাইদের কাছে সাতখান করে লাগিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দেবে। ক্লাসের সবাই তাই অসীমকে ভয় পায়, সমঝে চলে। বুকাই তো দুচক্ষে দেখতে পারে না অসীমকে।
সেই অসীমও নাকি অদ্ভূত আলো দেখছে। ফার্স্ট বেঞ্চের মাঝখানে বসে গল্প করছে , “বুঝলি তো, রাত তখন বারোটা। চারিদিক ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। আমাদের পাড়ার কুকুরগুলো পর্যন্ত ডাকছে না। আজ তো অঙ্ক পরীক্ষা নেবেন বলেছেন স্যার। তাই বসে বসে অঙ্ক করছিলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ টানা অঙ্ক করলে মাথাখানা কেমন ভার ভার লাগে তো! তাই ভাবলাম একবার বারান্দায় ঘুরে আসি। আমার আবার বুঝলি ভয়-টয় তেমন নেই। মাঝরাত্তিরে সিদ্ধিতলার শ্মশানে যেতে বললেও যেতে পারব। যাক্ সে কথা থাক্। বারান্দায় তো বেরিয়েছি, অমনি দেখি একটা বিশাল আগুনের গোলার মত জিনিস আকাশে উড়ছে!”
“কীরকম দেখতে রে সেটাকে?”
“ঠিক যেন একটা মস্ত কোলা ব্যাঙ। নাকের ওপর আবার দুটো মস্ত মস্ত শিং-ও রয়েছে। সেটা উড়ছে আর মাঝে মাঝে হাঁ করছে আর মুখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।”
এতক্ষণ ধরে চুপ করে শুনছিল বুকাই। এবার আর থাকতে না পেরে বলে ওঠে, “মোটেই না। ওটাকে দেখতে অনেকটা ছ-কোণা কাগজ চাপার মত। এক সেকেন্ডের বেশি তো দেখাই গেল না! হুশ করে আকাশে উড়ে গেল।”
কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে খানিকটা থতমত খেয়ে গেছিল অসীম। এবার রেগে গিয়ে ভেংচি কেটে বলে ওঠে,
“তুই দেখছিলি বুঝি!”
“হ্যাঁ দেখলাম তো! পষ্ট দেখলাম ওটা সাঁ করে আকাশে উঠে মিলিয়ে গেল। তবে তখন রাত্তির বারোটা নয় মোটেই। নটা, সাড়ে নটা হবে। আমি তখনও ভাত খাইনি..”
বুকাইকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হো হো করে হেসে ওঠে অসীম, “দ্যাখ দ্যাখ কেমন মিছে কথা বলছে বুকাইটা। নিজে তো আর রাত জেগে অঙ্ক করে না, ক্লাসে এসে নিলডাউন হয়ে থাকে, তাই বলছে সন্ধেরাত্তিরেই নাকি আলোটা আকাশে উড়ে গেছে। যেই শুনেছে আমি আলো দেখেছি অমনি বলতে এল ও–ও নাকি দেখেছে। ভারি হিংসুটে কিন্তু তুই। ওরে আমার মতন সাহস তো আর তোর নেই। সত্যি সত্যি অমন একখানা আগুনের গোলা দেখলে এতক্ষণে দাঁত ছিরকুটে পড়ে থাকতিস।”
অসীমের কথায় সায় দিয়ে ক্লাসের অন্য ছেলেরাও হো হো করে হেসে ওঠে। নন্টে আবার ডান হাতখানা কুনুই পর্যন্ত তুলে টুকাইকে বকও দেখিয়ে দেয়। মনমরা হয়ে ক্লাসের বাইরে আসতেই একেবারে ফুচিদির ভাই বল্টু সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বল্টুরা কাল রাতে কিছু দেখেছিল কীনা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল বুকাই। তার আগেই বল্টু খুব উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে, “জানো তো বুকাইদাদা আমাদের মজা পুকুরটা পুরো শুকিয়ে গেছে।”
“শুকিয়ে আবার যাবে কী করে? এখন তো সবে চত্তির মাস । আর তোদের ওই পুকুর তো জষ্টির গরমেও শুকোয় না!”
“সেটাই তো বলছি গো বুকাইদাদা। একরাতে অত বড় একটা পুকুর একেবারে শুকিয়ে খটখটে। সব মাছ নিচে মরে পড়ে আছে। ঠাকমা বলছে কলি কাল শেষ হতে চলেছে বলেই এমন সব অলুক্ষুণে কাণ্ড ঘটেছে। মা তো পীরের দরগায় শিন্নি চড়াবে আজ।”
শুধু বুল্টুর মা নয় কয়েকদিনের মধ্যেই মিঠাইপুরের মানুষজন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। এরমধ্যে আরও দুটো জলভরা পুকুর একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । একপুকুর জল কী করে ওরকম একরাতে ভ্যানিস হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না কেউ। জেলা সদরে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু পুকুরচুরির কোনও সমাধান হয়নি। পুলিশ কিংবা সদরের অফিসাররা মিঠাইপুরের মানুষের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন বলেও মনে হচ্ছে না।
ক্লাস সেভেন ওঠার পর বুকাইকে পরিমল স্যারের কাছে অঙ্ক করতে যেতে হয়। শুধু মিঠাইপুর নয় আশপাশেপ চার-পাঁচটা গ্রামে সুনাম আছে পরিমল স্যারের। তিনি নাকি গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে পারেন। তাঁর হাতে পড়লে শিবের বাবারও সাধ্যি নেই অঙ্কে ফেল করায়। বুকাই ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন ওঠার পরীক্ষায় অঙ্কে সতেরো পেয়েছিল। অতএব তাকে ঘোড়া বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পরিমল স্যারকে। সপ্তাহে চারদিন ইস্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বুকাই যায় পরিমল স্যারের বাড়িতে পড়তে। স্যারের বাড়িটা একটু দূরে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে জোর পায়ে হেঁটে গেলেও প্রায় মিনিট পনেরো সময় লাগে পৌঁছতে। ফেরার সময় সন্ধে উতরে যায় বলে সবাই একসঙ্গে আগে-পিছে আসে।
কিন্তু সেদিন হোমওয়ার্ক করেনি বলে বুকাইকে আটকে দিলেন স্যার। অন্য সবার ছুটি হয়ে গেল। হইহই করে বেরিয়ে গেল সবাই। আর বুকাই বেচারি তখন ঘামতে ঘামতে মাদুরে বসে সুদ কষছে। পুরো দশখানা অঙ্ক করিয়ে স্যার যখন ছাড়লেন পড়ার ঘরের ঘড়িতে তখন রাত আটটা।
চেনা রাস্তা। তবু একটু গা ছমছম তো করছিলই। খানিকটা আসার পর রায়দের বসতবাড়ি। তারপর ঝুপসি মত আমবাগান পেরিয়ে মণিপিসিদের খিড়কির পুকুরের পাশ দিয়ে আরও খানিকটা এগোলেই বুকাইদের বাগানের মস্ত দেবদারু গাছটার মাথা দেখা যায়। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বুঝে গেলেই আর ভয় করে না বুকাইয়ের।
কিন্তু আমবাগান পেরিয়ে মণিপিসিদের পুকুরের ধারে এসেই চমকে উঠল সে। পুকুরের মাঝখানে ঠিক আগের দিনের মত একটা সাদা আলো দেখা যাচ্ছে। সাবধানে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বুকাই দেখল, পুকুরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই কাগজচাপার মত দেখতে ছ’কোণা জিনিসটা। তার থেকেই আলো বেরোচ্ছে। তবে আলোটা মোটেই আগুনের গোলার মত নয়। হালকা নরম আলো। কাছ থেকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। মনে হতে পারে জলের ওপর জ্যোত্স্না পড়েছে।
আরও একটু ভাল করে লক্ষ করে বুকাই বুঝল, জিনিসটার গায়ে একটা দরজামত আছে। সেটা খোলা। একটু পরেই সেটা থেকে দু-তিনটি মানুষের মতন জিনিস বেরিয়ে এল, কিন্তু সেগুলোকে ঠিক মানুষ কিছুতেই বলা যাবে না। যে লোকটা একদম দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, গায়ে আলো পড়ছে বলে তাকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল বুকাই। মানুষের মতই তার হাত-পা সবই আছে। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েও আছে। কিন্তু মাথাটা অনেক বড়। নাক-চোখের জায়গায় কেমন যেন নলের মত কীসব লাগানো। তাছাড়া মাথায় আবার সরু সরু লম্বা দুখানা শিং। শিংয়ের ডগায় চাকার মত কিছু একটা আটকানো।
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে মনে হয় কিছু কথাবার্তা বলছিল। বলতে বলতে একজন আবার নিচু হয়ে শিংটা জলের দিকে নামাল। জলের মধ্যে ওরা কী দেখতে চাইছে বোঝার জন্য আর একটু এগিয়ে গেল বুকাই। আর তক্ষুণি ঘটে গেল একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পুকুরধারের কাদামাটিতে পা পিছলে একেবারে ঝপাস করে গিয়ে পড়ল জলে। আওয়াজ পাওয়ামাত্র লোকগুলো সেদিকে ঘুরে তাকাল। বুকাই ততক্ষণে হাঁচড়-পাঁচড় করে পাড়ের দিকে এগোনর চেষ্টা করছে। অদ্ভূত ব্যাপার হল, পুকুর তো ভরা থাকার কথা। অথচ সে কিন্তু ডুবে যায়নি। সে গিয়ে পড়েছে পাঁকে। জল তার হাঁটুও ছাড়ায়নি।
কিন্তু এব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবার আগেই, একটা লোক তার হাতের আঙুলটা তুলল আর তার থেকে হলুদ রঙের একটা আলোর রশ্মি এসে পড়ল বুকাইয়ের গায়ে। পড়ামাত্রই বুকাই বুঝতে পারল যে সে আর নড়াচড়া করতে পারছে না। তারপর সেই আলোটাই কীরকম অনায়াসে বুকাইকে তুলে নিয়ে সোজা সেই ছ’কোণা যন্ত্রটারা ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দিল।
তখনও নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই বুকাইয়ের। কাঠ হয়ে বসে সে শুধু চারপাশটা দেখেছে। অন্যদের মধ্যে কিন্তু তখন বেশ তাড়া পড়ে গেছে। একজন শুঁড় নিচু করে আবার কিছু দেখে মাথা নাড়ল। তখন যন্ত্রটার ভিতর থেকে আর একটা লোক বেরিয়ে এল। তার হাতে এক লম্বাটে বাক্স। বাক্সটা খুলতে বুকাই দেখতে পেল তার ভিতরে ছ’টা লম্বাটে আইসক্রিমের মত জিনিস পর পর রাখা আছে। সেটা দেখে সবাই ভারি খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। তারপর একজন গিয়ে যন্ত্রটার বাইরে যাওয়ার দরজাটা দিল বন্ধ করে।
দরজা বন্ধ করে দিলে সে পালাবে কী করে ভাবছে বুকাই। তক্ষুণি হালকা একটা ঝাঁকুনি দিল যন্ত্রটা আর বাইরের দিকে তাকিয়ে বুকাই আতঙ্কিত হয়ে দেখল সেটা সাঁ সাঁ করে আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সে যে লাল ঘুড়িটা উড়িয়েছিল, তার থেকেও অনেক অনেক উঁচুতে।
এই গ্রহটার নাম সম্ভবত সুমেরা। অন্তত ওই মানুষের মত দেখতে জন্তুগুলো যেরকম উচ্চারণ করে তাতে তাই মনে হয়। উচ্চারণ মানে অবশ্য ঠিক কথা বলা নয়। কথা হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা মনে মনে। এরা তাদের শিংটা বুকাইয়ের মাথায় একবার চেপে ধরলেই বুকাই ওদের সব কথা শুনতে পায় আর বুঝতেও পারে। যদিও এই গ্রহটা মহাকাশের ঠিক কোথায় কিংবা পৃথিবী থেকে কত দূরে সে-সব প্রশ্নের উত্তর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে এই সুমেরার বাসিন্দারা যে মানুষের থেকে অনেক উন্নত জীব সেটা কিন্তু বুকাই তাদের ছোট্ট বুদ্ধিতে বুঝতে পেরেছে।
তাছাড়া এরা ভারি ভালোও। নিজেদের মধ্যে কোনও ঝগড়াঝাঁটি মারামারি তো করেই না, বুকাইকেও খুব যত্ন করে রাখে। প্রথমদিন তো ওকে ধরে নিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে বুকাই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল। তাতে তো ওরা ভারি অবাক। কান্না ব্যাপারটা কী সেটাই ওরা জানে না। একজন তো বুকাইয়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলটা আঙুলের ডগায় নিয়ে দেখল। তারপর খুব ব্যস্ত হয়ে সেটা অন্যদের দেখাল। তখন অন্য একজন বুকাইয়ের মাথায় শুঁড়টা চেপে ধরে থেকে আপনমনে মাথা নেড়ে বাকিদের কিচিরমিচির শব্দ করে কিছু একটা বুঝিয়ে ফের বুকাইয়ের দিকে মুখ করে বসে মনে মনে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল।
প্রথমটা বুকাই বেশ ভয় পেয়ে গেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই লোকটা যার নাম ও নিজে বলেছিল গামাডি সে বুকাইকে বুঝিয়ে দিল যে ভয়ের কিছু নেই। তারা বুকাইয়ের কোনও ক্ষতি করবে না। বুকাই এখানে আরামেই থাকবে। তবে বুকাই যেরকম পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত কিংবা যেরকম খাবার-দাবার খায়, সেটার ব্যবস্থা করা যাবে না। কিন্তু তারজন্য যাতে বুকাইয়ের কোনও কষ্ট না হয় সে ব্যবস্থাও ওরা করে ফেলেছে। পৃথিবীতে বুকাই যেখানে থাকে সেখানে ওদের একটা কাজ চলছে। সেটা মিটে গেলেই বুকাইকে আবার ওরা ফেরত দিয়ে আসবে।
সেই কাজটা যে কী সেটা জানতে চেয়েছিল বুকাই। তার উত্তরে ভারি একটা অদ্ভূত কথা বলেছিল গামাডি। সুমেরা গ্রহে নাকি মিষ্টি জল ফুরিয়ে গেছে। জলের অভাবে ওদের অনেক সঙ্গী-সাথী মরে গেছে। ওরা ভাল করে মহাকাশের সব জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে যে একমাত্র পৃথিবীতেই যথেষ্ট মিষ্টি জল রয়েছে। তাই এখন ওরা ঠিক করেছে কিছুদিন পর পর মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবীতে গিয়ে মিষ্টি জল চুরি করে আনবে। এর আগে ওরা পৃথিবীর অন্য দুটো জায়গা থেকে মিষ্টি জল নিয়ে এসেছে। এখন জল আনা হচ্ছে মিঠাইপুর গ্রামের আশপাশ থেকে। বুকাই যেহেতু তাদের দেখে ফেলেছে, তাই যতদিন ওখানে তাদের যাতায়াত চলবে ততদিন বুকাইকে ছাড়া যাবে না।
গামাডির কথা শুনে ভীষণ রেগে গেছিল বুকাই, “তোমরা তো ভারি খারাপ লোক! আমাদের গ্রহ থেকে তোমরা জল চুরি করে নিয়ে আসছ। তারপর যদি আমাদের জল ফুরিয়ে যায়. তখন কী হবে?”
বুকাইয়ের কথা শুনে গামাডি একটু বিষণ্ণভাবেই বলেছিল, “আমরা জানি যে কাজটা অন্যায়। কিন্তু আমাদেরও তো কিছু করার নেই। কে আর মরে যেতে চায় বলো! তবে তোমাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। আমরা এমনভাবে সময়টা বেছেছি যাতে তোমাদের অসুবিধা না হয়। এখন আমরা জল নিয়ে আসছি ঠিকই কিন্তু আর কিছুদিন বাদেই তো তোমাদের ওখানে বর্ষা নামবে, তখন আবার পুকুরগুলো নতুন করে জল ভরে উঠবে। আমাদের এখানে তো সেরকম হওয়ার কোনও উপায় নেই।”
গামাডি-র কথা শুনে বুকাই ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে ফুচিদিদের পুকুরটা কিংবা গ্রামের অন্য পুকুরগুলো হঠাৎ ওরকম শুকিয়ে গেছিল কেন। মণিপিসিদের পুকুর থেকেও এরা জল নিয়ে এসেছে। কিন্তু এক পুকুর জল ওরা আনল কী করে ?
বুকাইয়ের মনের কথা বুঝতে পেরে গামাডি বলেছিল, “আমরা একটা বিশেষ পদ্ধতিতে জলটাকে বদলে নিয়ে অনেকটা বরফের মত একটা জিনিস বানাই। তাতে বেশ কয়েক হাজার গ্যালন জলকে ছোট ছোট টুকরোয় ভরে ফেলা যায়। তারপর সেটা একটা বাক্সে ভরে নিয়ে এসে আবার এক ধরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনি। তোমাকে সেদিন যে পুকুরটার পাড় থেকে ধরে আনলাম, তাতে অনেকটাই জল ছিল। আমাদের বেশ কয়েকদিন তাতে চলে যাবে।”
গামাডির সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে বুকাইয়ের। গামাডি তাকে সুমেরা গ্রহটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। পুরো গ্রহের সব কাজকর্মই চলে মাটির নিচে। ওপরে যে ওঠা যায় না তা নয়। মাঝে মাঝে কয়েক জায়াগায় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু মাটির ওপরটা এমন রুক্ষ্ম আর শুকনো মত যে সেখানে থাকা খুব কঠিন।
“জানো বুকাই, আমাদের গ্রহেও নাকি একসময় মিষ্টি জল পাওয়া যেত। আমি আমাদের ইতিহাস থেকে জেনেছি। তারপর কী কারণে জানিনা সুমেরাতে বৃষ্টি পড়া কমতে কমতে একসময় একদম বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যেতে একটু একটু করে নদী-নালা সব শুকিয়ে গেল। মাটি শুকনো হয়ে গেল। সবাই তখন বাধ্য হয়ে মাটির নিচে থাকতে শুরু করল। তৈরি হল খাওয়ার জলের সঙ্কট। আমরা চেষ্টা করেছিলাম যদি ল্যাবরেটরিতে জল তৈরি করা যায়। জল তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু সেই জল খেয়ে বেঁচে থাকা যায়, তৃষ্ণা মেটে না। তখন আমরা ঠিক করি অন্য গ্রহ থেকে জল চুরি করে আনব।”
গামাডির সঙ্গে একদিন উপরে উঠেওছিল বুকাই। চারিদিকটা একটা ন্যাড়া মরুভূমির মত জায়গা। যদিও বালি নেই। শুকনো ঝুরঝুরে মাটি। রোদের তাপও তেমন নেই। একটু পরে পরেই অন্ধকার হয়ে আসে আবার আলো হয়ে যায়। গামাডি ওকে বুঝিয়েছিল, যে নক্ষত্র থেকে ওরা আলো পায় সেটা অনেক দূরের। তাই আলোর তেজ নেই তেমন । আর সুমেরা যেহেতু ছোট গ্রহ আর খুব দ্রুত নিজের অক্ষরেখায় ঘোরে তাই দিন-রাতের ব্যবধান খুব কম।
“তোমাদের সঙ্গে আমাদের দিন-রাতের হিসেব মেলে না বুকাই। আমাদের হিসেবে আমরা বহু বছর বাঁচি। কিন্তু তোমরা এখানে এলে কয়েকদিনের মধ্যেই বুড়ো হয়ে মরে যাবে। তাই তোমাকে আনার সময়ই একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সুমেরার সময়ের মাপ তোমার মধ্যে কাজ না করে।”
গামাডির কথাগুলো ভারি অদ্ভুত লেগেছিল বুকাইয়ের। মহাকাশের এক একটা গ্রহে তার মানে সময়ের মাপ একেকরকম। ভূগোল বইয়ে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে অনেক কথা পড়লেও এটা কিন্তু তার স্কুলের মাস্টারমশাই কোনওদিন বলেননি। কিন্তু এরকম একটা বিটকেল ব্যাপারের জন্য বুকাই যে আসলে কতদিন এখানে আছে বোঝার কোনও উপায় নেই। কতদিনে ছাড়া পাবে তাও জানা যাচ্ছে না।
সুমেরাতে থাকতে কোনও অসুবিধা না হলেও এভাবে নিজের গ্রাম, মা-বাবা-ভাই আর পাখি, কাঠবিড়ালী, কুকুর-বেড়াল সবাইকে ছেড়ে থাকা যায় নাকি! বাড়ির কথা ভাবলেই গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করে বুকাইয়ের। বাড়ির চারপাশের গাছপালাগুলোর জন্য পর্যন্ত মন কেমন করে।
এই গাছপালার কথা মনে হতে হতেই হঠাৎ বুকাইয়ের মাথার মধ্যে চিড়িক করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সেদিন গামাডির সঙ্গে দেখা হতেই বুকাই বলল, “আচ্ছা তোমাদের গ্রহে যদি আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করে, তাহলে তো আর জলের সমস্যা থাকবে না?”
“তা তো থাকবেই না। কিন্তু বৃষ্টি পড়বে কী করে? বৃষ্টি কেন পড়ে, কীভাবে পড়ে সেই রহস্য আমাদের জানা নেই। আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও সেটা আবিষ্কার করতে পারেননি।”
“দ্যাখো গামাডি, আমার কাছে একটা গুপ্তধন আছে। সেটা যদি তোমাদের দিয়ে দিই, তাহলে কিন্তু সেটা কাজে লাগিয়ে তোমাদের এখানেও বৃষ্টি নামাতে পারো।”
বুকাইয়ের কথায় খুব অবাক হয়ে গামাডি বলে, “তোমার গুপ্তধন আছে! কীরকম গুপ্তধন? সেটা থেকে বৃষ্টি হয়?”
মাথা নাড়া বুকাই, “তুমি আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলো। আমি তোমাকে গুপ্তধন দিয়ে দেব।”
এবার হেসে ফেলে গামাডি, “আমি তো তোমাকে বলেছি, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে আমরা বাড়ি যেতে দেব না। তবে তোমার গুপ্তধন কোথায় আছে যদি বলে দাও, তাহলে আমরা সেটা নিয়ে আসতে পারি। সে-ব্যবস্থা আমাদের আছে।”
“বললে তো হবে না, দেখাতে হবে। তুমি তো খুঁজেই পাবে না।”
“বেশ তাহলে দেখিয়েই দাও।” এই বলে গামাডি একটা ছোট যন্ত্র থেকে সামনের দেওয়ালে আলো ফেলতে থাকে। বুকাই অবাক হয়ে দ্যাখে যে সেটা অনেকটা গুগলের উপগ্রহ চিত্রের মতই। মহাকাশ থেকে ছোট হয়ে পৃথিবী, তারপর তাদের রাজ্য গ্রাম হয়ে আলোর বিন্দুটা এসে থামে একেবারে বুকাইদের বাড়ির ওপর। দেওয়ালে এখন শুধুই বুকাইদের বাড়ির ছবি। ঘর-দোর, জিনিসপত্র সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাত হয়েছে বেশ। মা কী করছে জানতে খুব ইচ্ছা করছিল বুকাইয়ের। কিন্তু তার আগেই গামাডি গম্ভীর গলায় বলে,
“কোথায় আছে তোমার গুপ্তধন বলো।”
“চিলেকোঠার ঘরে।”
আলোর বিন্দুটা অমনি পৌঁছে যায় চিলেকোঠায়।
“বাঁ-দিকের দেওয়ালে, দু-নম্বর তাকে যাও। নীল রঙের টিনের কৌটোটা দেখতে পাচ্ছ? ওর ভিতরেই আছে গুপ্তধন।”
আলোর বিন্দুটা কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ কৌটোটার ওপর স্থির হয়ে থেকে নিভে যায়। বুকাইকে রেখে গামাডি বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে সেই নীল কৌটোটা হাতে নিয়ে। বুকাইকে কৌটোটা দিয়ে গামাডি বলে, “এই নাও তোমার গুপ্তধন। এবার দেখি কেমন করে তুমি সুমেরাতে বৃষ্টি আনতে পার।”
“আমি একলা পারব না। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নাও।”
“কোথায় যাব আমরা?”
“ওপরে……”
বুকাইয়ের সঙ্গে গামাডি আর তার সঙ্গীসাথীরা মাটির তলা থেকে উপরে উঠে আসে। বুকাই এবার কৌটোটা খোলে। কৌটো ভর্তি নানারকম গাছের বীজ। মিঠাইপুরের হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় যখনই যে গাছের বীজ হাতে পেত, সেগুলো সে ভরে রাখত এই নীল কৌটোয়। বীজগুলো বুকাই ছড়িয়ে দিতে থাকে সুমেরার মাটিতে। গামাডিকে বলে, “এবার বীজে জল দিতে হবে।”
“কিন্তু আমাদের তো জল খুব কম। সে তো নষ্ট করার উপায় নেই।”
“নষ্ট হবে না। বৃষ্টি যদি চাও তাহলে বীজে জল দিতেই হবে।”
বুকাইয়ের গলায় এমন একটা গেরামভারি ভাব যে বাধ্য হয়েই গামাডির সঙ্গীরা জল এনে ছিটিয়ে দেয় বীজের ওপর। সুমেরায় সময় তো এগোয় খুব দ্রুতগতিতে। তাই একটু পরেই ভেজা মাটিতে অঙ্কুরিত হয় বীজ। বেরিয়ে আসে ছোট্ট চারাগাছ। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে সেই চারা। সবুজ পাতায় ঢেকে যায়। আকাশের দিকে ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে বড় বড় বৃক্ষ। নিচের জমি ঢেকে যায় সবুজ ঘাসে। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত্ চমকে ওঠে গামাডি আর তার বন্ধুরা । সারা আকাশ জুড়ে কালো কালো তুলোর মত কী যেন একটা জমে উঠেছে। আর সেদিকে তাকিয়ে আনন্দে লাফাচ্ছে বুকাই।
একটু পরেই সেই কালো তুলোর মত জিনিসগুলো থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা নেমে আসে মাটিতে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সুমেরায়। আনন্দে দু-হাত আকাশের দিকে তুলে নেচে ওঠে সবাই। বুকাইয়ের মাথায় শুঁড় ঠেকিয়ে গামাডি বলে, “বাব্বা, তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক মানুষ! এরকম একটা দারুণ জিনিস যে তোমার কাছে আছে সে তো আমরা ভাবতেই পারিনি। সুমেরায় কারুর কাছে এরকম গুপ্তধন নেই। আমার মনে হয় পৃথিবীতেও বোধহয় আর কারুর কাছে নেই।”
আকাশটা এখনও ঘন কালো। তবে ভোর হতে খুব বেশি আর দেরি নেই। গাছের ডালে পাখির বাসায় হালকা নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সুমেরার ছয়কোণা মহাকাশযানটা নিঃশব্দে এসে নেমেছে বুকাইদের ছাদে। দরজাটা খুলে বুকাইকে নামিয়ে দেওয়ার আগে তার হাত ধরে একবার ঝাঁকুনি দেয় গামাডি। তারপরেই বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা । হুশ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যানটা আবার মিলিয়ে যায় আকাশে। সেদিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে বুকাই নিঃশব্দে এসে ঢোকে চিলেকোঠার ঘরে। ঝুড়ির ওপরে হাত দিতেই চিকচিক করে ডেকে ওঠে কাঠবিড়ালীটা। নিশ্চিন্ত হয়ে বুকাই এবার গিয়ে বসে চৌকিটাতে। গামাডি বলে দিয়েছে, পৃথিবীর হিসাবে চারদিনের জন্য হারিয়ে গেছিল বুকাই। এই চারদিন সে কোথায় ছিল তা নিয়ে একটা ঠিকঠাক গল্প বানিয়ে বলতে হবে বাড়িতে। বইয়ে পড়া ছেলেধরা আর রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের গল্পগুলো মনে করতে করতে চৌকিতে শুয়ে পড়ে বুকাই। আর তক্ষুণি চোখ পড়ে খালি তাকটার দিকে। নীল কৌটোটা নেই। গুপ্তধনের কৌটো ফেরত দেয়নি গামাডি। যাক্ গে, সে তো আর সুমেরার মত বাজে গ্রহে থাকে না। মিঠাইপুরে অমন গুপ্তধন অনেক পাওয়া যায়। মায়ের ভাঁড়ার থেকে একটা নতুন বিস্কুটের টিন হাতিয়ে নেওয়ার মতলব ভাঁজতে ভাঁজতে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে বুকাই।