“এই যে আপনি, শুনিতেছেন; আপনার সহিত আমার যাবতীয় সম্পর্ক এই অবধিই সমাপ্ত হইল। আজি হইতে আমা সহিত কোনো প্রকারের যোগাযোগ করিবার প্রচেষ্টা করিবেননা, আশা রাখি। দুরাভাষ যন্ত্র যোগে ক্রমপীড়ন সহ সর্বপ্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমাকে নিষ্কৃতি প্রদান করিবেন কামনা করি। প্রসঙ্গত, সমুদায় এ সকল আখ্যায়িকার অবতারনের হেতু হইল, আমার অভিভাবকেরা পাণিগ্রহণ নির্ঘন্ট চূড়ান্ত করিয়াছেন। পাত্র উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা। উক্তদিবসের প্রীতিভোজে আপনার সপরিবারে নিমন্ত্রণ রইল, অন্তিমবারের মত শ্রীমন্তের পাদস্পর্শে আমাদিগকে ধন্য করিলে বাধিত হই। অবশ্য ইহাতে অস্মদীয় ‘প্রথম ও অন্তিম’ অবেক্ষণ পর্বটিও বরদাস্ত করিয়া লইব।
শুভায়ু ভবত”
চলমান দূরাভাষযন্ত্রের প্রদর্শন যবনিকার উপরিতলে দৃষ্টিপাত করিয়া- দেবাহুতির অন্তিম বৈদ্যুতিন-বার্তাটি বারংবার পড়িতেছিল বভ্রুবাহন। দেবাহুতি তো তাহার প্রণয়াসঙ্গী ছিল না! তথাপি তাহার এই মনবেদনার হেতু কি? বক্ষদেশের বামপার্শ্বেও মৃদু শূলনাভুত হইতেছে। মনে হইতেছে যেন, অতি মূল্যবান কোনো বস্তু হারাইয়া যাইবার উপক্রমক্ষণ উপস্থিত হইয়াছে!
সংযোগ রাশির ভ্রমবসত, চলমান বার্তাযন্ত্রের মাধ্যমে কিয়ৎ পরিমাণ অদ্ভুত ভাবে পরিচয় ঘটিয়াছিল বভ্রুবাহনের সহিত দেবাহুতির। বভ্রুবাহন স্মৃতিপথ বাহিয়া ঠিক এক বৎসর পূর্বে পশ্চাতধাবন করিল।
– অপরপ্রান্তে কে রহিয়াছো সুহৃৎ?
– আজ্ঞে আমার নাম বভ্রু, বভ্রুবাহন শুভার্থী। আপনি কে প্রিয়ংবদা?
– আমি! আমি আপনার সখী…
– সখী? কোন সখী? কি বলিয়া সম্বোধিত করিব আপনারে?
– দেবাহুতি, আমার নাম দেবাহুতি।
– দুঃখিত, এ নামধারী কেহ আমার পরিজনবৃত্তে ঠাহর হয়না।
– তাহাতে দোষের কি হইল, ভাবিয়া নিন আজি হইতেই পরিচয় হইল। আমি আপনার নতুন সখী! হিহিহি…
গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা মতে উহা ছিল বিশ্বমৈত্রী দিবস। অনর্থক তামাসাজনিত কারনেই, আপন দূরাভাষ সংযোগ-রাশি-ক্রমঙ্কন সমন্বয়ের বিন্যাস বিচ্যুতি ঘটাইয়া, উদ্ভুত রাশিতে দূরাভাষ সংযোগ করিল দেবাহুতি। অতঃপর সেই যন্ত্রচালিত আহ্বানটি বভ্রুবাহনের মুষ্ঠিযন্ত্রে অবলোকিত হইয়াছিল, বাকিটা ইতিহাস।
প্রারম্ভকালীন সময়ে বভ্রুবাহন কন্যাটিকে উপেক্ষা করিলেও, অনতিবিলম্বেই দুইজনের মধ্যে অন্তরাল মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া গেল। ললনাটি কিঞ্চিৎ প্রগলভ স্বভাবজাত ও বাচাল, তথাপি এই চারিত্রিক বৈশিষ্টটিই বিশেষভাবে মনে ধরিল বভ্রুবাহনের। বভ্রুবাহনের সরলতায় সম্পৃক্ত গম্ভীরভাবে বলা কথাগুলিও হৃদয়াবৃত্তিতে নাড়া দিতে লাগিল দেবাহুতির।
ইতিপূর্বে এইরূপে কোনো রমণীর সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ ঘটেনি বভ্রুবাহনের। বাল্যকাল হইতে মা ব্যাতিত অন্য স্ত্রীজাতি হইতে নিজেকে গুটাইয়া রাখিয়াছিল কোনো নির্দিষ্ট কারন ব্যাতিরেকেই। সহসা অনাহূত আগুন্তকের ন্যায় তাহার জীবনে আসিয়া পরা দেবাহুতি নাম্নী কন্যাটি তাহাকে পরিপূর্ণ রূপে বদলাইয়া দিল। হৃদয়ের অন্তঃপুরে এই কন্যার নিমিত্ত প্রাসাদও নির্মিত হইল যতনে। বভ্রুবাহনের উপলব্ধি করিল, এই কন্যাটি তাহার আগত ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র ভরসা যোগ্য।
সত্য সত্যই এই কন্যাটির মধুর কথাবার্তাতে একটা নিঃসংশয় আস্থাভাব ফুটিয়া উঠিয়াছিল। মায়াবতীর ন্যায় প্রতিটি বাক্যে একটু একটু করিয়া বভ্রুবাহনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল। বভ্রুবাহনেরও মানসপটে কন্যাটির পরিপূর্ণ একটি চিত্র অঙ্কায়িত হইয়াছিল, উহা যতটা না বাহ্যিক তাহা হইতেও চিত্তগত অধিক ছিল। অতএব আগামী জীবনটুকু অতিবাহনের জন্য জীবনসঙ্গী হিসাবে ইহার থেকে উত্তম আর কাহাকে ভাবিতে পারিলনা উভয়েই, তাহাদের প্রত্যেকর ভাবনা জুড়িয়া অপরজন বিরাজ করিতে লাগিল এমনভাবে যে, অন্য কাহারো প্রতি ভাবনা ও দৃষ্টিই যাইতনা।
বভ্রুবাহন দেবাহুতির অন্তিম বার্তাটির প্রতি নিষ্পলক দৃষ্টিপাত করিয়াই রহিয়াছে। চক্ষু দুইটি ক্রমশ ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল রোদনবাষ্পের প্রভাবে, ভাবিতেছিল মনুষ্যের প্রনয় জীবন কেনইবা এমন নিষ্ঠুর হইয়া থাকে! যেন ভয়াবহ কোনো গোলকধাঁধাঁর পরিলেখতে জীবনটি চিরতরে আঁটকা পড়িয়া রহিয়াছে, যাহা হইতে মুক্তি নাই।
আজ দেবাহুতির গৃহে বিবাহঅনুষ্ঠানের আসর। সমস্ত গৃহখানি রঙ্গিন সুদৃশ্য বাহারি আলোক সজ্জায় ঝিকমিক করিতেছে। বভ্রুবাহন ভাবিতেছে, হয়ত অনতিবলম্বেই অশ্বপাল তাহার বিত্তের প্রদর্শন স্বরূপ দামি বাহনে চড়াইয়া দেবাহুতিকে তুলিয়া লইয়া যাইবে। সমগ্র অনুষ্ঠানবাটিকা শশব্যস্ত নানাবিধ অনুষ্ঠানাচারে। বভ্রুবাহন একটি অট্টালিকা স্তম্ভের কোণায় দাঁড়াইয়া নিবাসটির অঙ্গসজ্জার প্রতি স্থাণু দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছে। আঁখিপল্লব দুইটি আজ যারপরনাই পরিমাণে দুর্বহ অনুভূত হইতেছে। অচম্বিতে বভ্রুবাহনের চলমান দূরভাষ যন্ত্রে, বার্তা আগমনী সুরটি বাজিয়া উঠিল; দেবাহুতি কিছু সন্দেশ পাঠাইয়াছে-
– আপনি কি আসিয়াছে?
বভ্রুবাহন ঈষৎ বিবেচনা করিয়া দেখিল, শিষ্টাচার বসত যেহেতু আচারঅনুষ্ঠানে উপগত হইয়াছেই সুতরাং অন্তিমলগ্নে প্রতুত্তর না দেওয়ার মত দুর্বিনীত হইতে অন্তর সায় দিলনা। অতঃপর জবাব দিল-
– হুম, আসিয়াছি।
– আমি আপনাকে দেখিতে পাইতেছি। কষ্ট করিয়া ক্ষণকাল অপেক্ষার আর্জি রাখিলাম, আমি স্বয়ং আসিতেছি সাক্ষাৎ অভিপ্রায়ে।
পাদঘন্টা মুহুর্তের মধ্যেই অতিক্রান্ত করিল বভ্রুবাহন, অতঃপর মনোহরা গোলাপশোভিত এক অপরূপা উর্বশীসম কন্যা বভ্রুবাহনের সম্মুখে আসিয়া মৃদুভাবে বভ্রুবাহনের নাম উচ্চারণ করিতে তার চকিতভাব কাটিল। আজিই প্রথববারের জন্য চাক্ষুষ করিল দেবাহুতিকে, তাহা আবার রক্তিম সাজে। কি অপূর্বই না লাগিতেছে, যেন স্বর্গ হইতে কোনো দেবী মর্তধামে আসিয়াছে, নতুবা বভ্রুবাহন কল্পলোকে বিরাজিছে। পুনঃর্বার চকিতভাব কাটিল আলাপনের প্রশ্নে-
– আপনিই বভ্রুবাহন?
– আজ্ঞে আমিই
– আপনি তো দেখছি ভক্ষ্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত লালস প্রজাতির ব্যাক্তি? আপন গৃহে কি যথেষ্ট পরিমাণে ভোজন সামগ্রী বাড়ন্ত? আসুন মণ্ডপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করুন। আমিষদ্রব্য, মণ্ডামিঠাই সহ ষোড়শোপাচারে আপ্যায়নের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা রহিয়াছে, প্রাণভরিয়া উদরপূর্তি করিতে দ্বিধা করিবেননা।
– তাহার আর প্রয়োজন নাই, ধন্যবাদ সাক্ষাতের জন্য। এ অভিপ্রায়েই আসিয়াছিলাম, অতএব এবারে আমি চলিলাম, বিদায়।
– ঠিক আছে, আপনার মনোকামনাই পূর্ণ হউক। তবে একটি প্রশ্ন ছিল, আপনার অক্ষিগোলক কি এমনই স্বাভাবিক রঞ্জিত রক্তাভ বর্ণের!
বভ্রুবাহন বাকশক্তি হারাইয়াছে, যেন কোনো অপ্রার্থিব শক্তি তাহার গ্রীবাদেশে সর্বশক্তি প্রদান করিয়া পেষন করিতেছে।
– আমাপ্রতি আপনার অনুষঙ্গ ঠিক কোন পর্যায়ের? উহাকে কি প্রণয়প্রীতি হিসাবে গ্রহন করিতে পারি?
দেবাহুতির এই বাক্যাটি শ্রবণমাত্র ভীষণ বিষম খাইল বভ্রুবাহন। মেকি হাসি হাসিয়া বভ্রুবাহন কহিল-“ নাহ, মোটেই নয়। কেন তাহা হইবে। আপনার সহিত…! সামান্যটুকুও না”।
অন্তিম শব্দটিকে, বক্ষদেশের অভ্যন্তরের দলাপাকানো একরাশ বেদনা ও ক্ষোভ- ঈষৎ কম্পিত করিয়া দিল। সাথে সাথে দুই ফোঁটা অশ্রুও চিবুক পর্যন্ত শিক্ত করিয়া তুলিল, যাহা দেবাহুতির অগোচরে রহিলনা।
দেবাহুতি কহিল, “আচ্ছা, প্রণয় বা ভালো না হয় না ই বাসিলেন, এক্ষণে অন্দরমহলে তো চলুন। ভোজনাদিও নাহয় একসাথে মিলিয়াই করিব, সত্বর চলুন, অবকাশ অত্যন্ত কম। বরযাত্রী আসিল বলিয়া, দিদিকে তাহারা অচিরেই লইয়া যাইবে”।
বভ্রুবাহন পেল্লাই আকারের বিষম খাইয়া ও বিহ্বল হইয়া বিস্ফোরিত চক্ষু করিয়া দেবাহুতির পানে চাহিয়া রহিল। দেবাহুতি কপট ক্রোধ প্রদর্শিত করিয়া কহিল, “ভারি অসভ্য মানুষ বটে আপনি, কি ভাবিয়াছেন, সখ্যতাও আমি যাচিয়া করিয়াছিলাম, তথাপি ভালোবাসার প্রস্তাবনাও আমাকেই করিতে হইবে? মহা বেহায়া ধরনের ধৃষ্ট পুরুষ আপনি। যে কাজ পুরুষের তাহা আমি কোনো অবস্থাতেই করিবনা, আই বলিয়া দিলাম, হ্যাঁ।
এতক্ষণে অন্তঃপুরে কনে’র ঘরে পৌঁছাইয়া গিয়াছে উভয়ে, উপস্থিত সকলের সহিত বভ্রুবাহনকে আপন বিশিষ্ট বন্ধু হিসাবে পরিচয়ের সাথে সাথে বধুবেশী কন্যাটিকে আপন জ্যাষ্ঠো ভগিনী হিসাবে উল্লেখ করিয়া উপর্যুপরি খিলখিলাইয়া হাসিয়া উঠিল দেবাহুতি। যাহা বভ্রুবাহন ব্যাতিরেকে অবশিষ্ট সকলের মাঝে সংক্রামিত হইল।
বধুরূপী হিরন্ময়ী কহিল, আমার তো গতি হইল, কিন্তু আমার ভগিনীর প্রেমিকপ্রবরটি ঠিক কতখানি প্রণয়াশক্ত সেইটি দেখিবার জন্যই এই নাটিকার অবতারণা, যাহা হউক আপাতত যবনিকা পরিল ভাই। তুমি আমাদের পরমাত্মীয়, ক্ষণকালের এই মনকষ্টের জন্য বড় দিদি ভাবিয়া মার্জনা করিয়া দিও”। ঘরে পুনঃরায় হাসির রোল উঠিল।
দেবাহুতি কৌশলী দন্তবিকাশ করিতে করিতে বলিল , আমি কিন্তু কখনো বলিনাই আমারই বিবাহ। বভ্রুবাহনের হতচকিত পরিস্থিতি অনুধাবন করিয়া আকাশ বাতাস কম্পিত করিয়া আবার সকলে খিলখিলিয়ে হাসিয়া উঠিল। মুগ্ধতা ছড়ানো সেই হাসিতে সমস্ত পৃথিবির যাবতীয় সুখের সন্ধান পাইতেছিল বভ্রুবাহন, সে দেবাহুতির প্রতি নির্নিমেষে চাহিয়া অপার মুগ্ধতায় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
অভাগা লেখকও এমনই কোনো অযাচিত দূরাভাষের প্রতীক্ষায়, যদি পাঠককূলের কোনো সহৃদয় ললনা আকৃষ্ট হয়, অকৃতদার তকমাটি ঘুচে তাহা হইলে।
সমাপ্ত