তোমার আমার নববর্ষ

তোমার আমার নববর্ষ

লেকটাউন ফুটব্রিজে বসা ওই লোকটা আজো পসরা নিয়ে বসেছে।পসরা বলতে সামনে একটা ছেঁড়া ময়লা চাদর।গায়ে একটা ছেঁড়া জামা , তাও খোলা।একটা হাত সামনে পাতা, আর একটা হাত পরনে লুঙ্গি।

একটা হাত সামনে পাতাই থাকে।সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি।স্কুলে যখন যেতাম মার হাত ধরে, কষ্ট হলে দাঁড়িয়ে দেখতাম।পয়সা নেই যে পকেটে! মা দিলে হাতে দিয়ে আর পেছনে ফিরে তাকাতাম না।একটা হাত ওঁর কাটা , কী জানি জন্ম থেকে হয়ত।

আজ হয়ত পসরা নিয়ে বসবে।এত গরম বাইরে, তাও ঠায় বসে থাকবে।আজ বছরের প্রথম দিন ভুলেই গেছে ও,সব অফিস ছুটি প্রায়।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ বেরোতে হলো, মুখার্জি কাকুর বাড়িতে মিষ্টি দিতে যেতে হবে।খুব বড় কাস্টমার আমাদের।আমার বাবার একটা দোকান আছে ,এই সল্টলেকেই ।ফুটব্রিজে উঠেই চোখ পড়ল ওঁর দিকে।বিড়ি খাচ্ছে একটা।দেখে তাকিয়ে থাকল একটু।কী মনে হলো, মিষ্টির প্যাকেটটা রাখলাম ওর পসরাতে।দৌড় মারলাম ওখান থেকে, একদম ব্রিজের নীচে নেমে একটু দম নিয়ে মাথার ওপর রাশভারী সূর্যটাকে দেখে হেসে ফেললাম।যাই, এবার আরো এক প্যাকেট কিনতে হবে, নইলে আবার বাবা…

রোজকার মত অফিস ফেরত সুদীপদার থেকে জামা গুলো নিয়ে বাড়িতে ঢুকি।নইলে বউ শুরু করবে,

-একটু এইটুকু কাজ করার জন্য আমায় নীচে নামতে হবে!

এমন হাব ভাব যে কোন দুবাইয়ের ষোলো তলা বিল্ডিংয়ে থাকি, আর উনি পায়ে হেঁটে উঠবেন আর নামবেন!
যাকগে! সুদীপদা আমাদের ফ্ল্যাট মানে পূর্বাচল , সল্টলেকের ক্লস্টার ফোরের সামনে ওঁর দোকান নিয়ে বসে।দোকান বলতে ইস্ত্রির।আমাদের মানে, আমাদের ব্লকের সবার জামাকাপড় খুব যত্ন সহকারে ইস্ত্রি করে কখনো কখনো ঘরেও পৌঁছে দেয়।কত বার আমায় বলেছে,

-রাহুলদা বাড়ি যাও, সেই কতদূর অফিস।আমি পৌঁছে দেব।
কিছু বলতে পারি না।সারাদিনের বসের গালাগাল, মান্থ এন্ডের টার্গেট তখন যেন কেউ হুঁশ করে ছু মন্তর করে উড়িয়ে দেয়।

ওঁর দোকানে বসে আড্ডা মেরে ফিরি।এক ছেলে, ক্লাস ফোরে উঠল।ইচ্ছে আছে ক্রিকেট টা খুব ভালো করে শেখাবে।ছেলে যতদূর চায়।রাতদিন তাই এত বেশি বেশি কাজ করে ও।
আজ দোকানে দাঁড়াতেই দেখি, এক হাতে ব্যান্ডেজ।বললাম,

-কী হয়েছে সুদীপ দা?
বলল,
-ওই আগুনে…
কতবার বলেছি ওকে, এসব কয়লা পুড়িয়ে আর চল নেই।চেন্জ করো…উফফ।বললাম,
-কিছু ওষুধ নিয়েছ?
বলল,
-হু ওই গরম চুন
এবার রেগে গিয়ে বললাম,
-দোকান বন্ধ করো এখন ই।
বলল,

-না রাহুল দা, ওই কটা ডেলিভারি দিয়ে এলেই কিছু পয়সা পাব।আজ প্রথম দিন বছরের, ছেলেটাকে একটা জামা কিনে দিতে পারলাম না।

এবার সারাদিনের ঘাম মাখা শুকনো চোখটা দিয়ে আপনা আপনি জল পড়ল হঠাৎ।শ্রেয়াটা যখন তিন মাসের গর্ভবতী, ইউএসজি রিপোর্টটা আমাদের পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছিল।না হারিনি আমরা! আজো হারব না।পকেট থেকে ১০০০টাকা বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম,

-নাও
বলল,
-না রাহুল দা ,পারব না নিতে এটা।
হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম,
-পরের মাসের এডভান্স, নাও দোকান বন্ধ করো।নইলে কাপড়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

সকাল থেকে ঘন্টার আওয়াজ, মন্ত্র, মিষ্টি দেখে জাস্ট তিতি বিরক্ত হয়ে গেছে লক্ষী।যেখানে যাচ্ছে, শুধু পোজ! কেউ কেউ তো সেলফি তুলে, কি যেন লিখল! হম্ম..”পুরাতন, তুমি থাকবে মনের কুটিরে..”।বাকিটা দেখতে পারে নি লক্ষী, ব্যাটা কি তাড়াতাড়ি টাইপ করে।দাদাকে খুঁজে পাচ্ছে না পাশে।একটি দূরে দেখল, পেট বার করে বসে আছে।পাশে গিয়ে বসল, জিজ্ঞেস করল ওকে,
-কী হয়েছে দাদা?
বলল,

-ধুর, শুধু কিছু না কিছু চাই সবার।ব্যবসায় লাভ, কেউ চাইছে আরো পয়সা কেউ বা শুধুই ভালো থাকুক এতেই খুশি ।এত কষ্ট পৃথিবীতে রে?

কিছু বলতে যাবে, শুনতে পেল লক্ষী একটা মেয়ের গলা।শোভাবাজার ঘাটের ঠিক ওপরে বসে ও,পাশে মনে হয় ওর মা।ওঁর মা গরম জিলিপি ভাজছে, আর ও সেগুলো ডেকে ডেকে বিক্রি করার চেষ্টা করছে।
বড্ড কষ্ট হলো লক্ষীর।দাদাকে বলল,

-দেখ দাদা
ওঁর দাদা অনেক আগেই বুঝেছে।বলল,

-দেখ ম্যাজিক এবার!
লক্ষী দেখল একটা লোক এলো ওই মেয়েটার দোকানের সামনে।কি যেন বলল,তারপর সব জিলিপি নিয়ে চলে গেল।
ভাই বোন দূর থেকে দেখছে।কী খুশি মা মেয়ে আজ বছরের প্রথম দিনে,কড়কড়ে টাকা হাতে।যাকগে মেয়েটা হয়ত আজ কিছু কিনতে পারবে।

উপহারটা নববর্ষের আগেই পেয়ে গেছে শ্রেয়া।কোল আলো করে ওর অতীতকে মুছে দিয়ে ওর ভবিষ্যত এসেছে ওঁর কাছে।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অখিল, বলল,

-ছেলে ঘুমিয়েছে।একটু ঘুমিয়ে নাও।
মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল ও।চোখ বন্ধ করে আছে শ্রেয়া।চোখের কোন থেকে অবাধ্য “ও”টা গড়িয়ে পড়ল আবার।

বড্ড খুশি হত আজ থাকলে হয়ত।কোলে নিয়ে বলত,
-দেখিস সব না পাওয়া টা তোকে দিয়েই পূরণ করব।
সব গল্পের শেষ হয়না, ওরটাও হলো না।
পাশে শুয়ে থাকা ওর চ্যাম্পিয়ন কে দেখে বলল,

-দেখিস বাবু, তোকে না একটুও কষ্ট ছুঁতে দেব না আমার।মস্ত বড় ক্রিকেটার হবি তুই।অনেক বড় মনের মানুষ হবি।রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ।এই বছরটা তোকে দিয়ে শুরু করলাম, সব খারাপের শেষ হয়ত।

এমন অনেক সুখে দুঃখের বর্ষ আসবে।মানুষ হাসবে, কাঁদবে,আছড়ে পড়বে, লাগবে খুব আবার উঠবেও,কিন্তু লড়াই চালিয়ে যাবে।তাই চলুন আরো একটা কান্না হাসির বর্ষকে ভেজা চোখেই আলিঙ্গন করে নিই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত