সত্যি সত্যি শেষ পর্যন্ত এয়ারপোর্টে যে এত লোক রিসিভ করতে আসবে টুইদের – সেটা টুই ভাবতেই পারেনি! ফ্লাইটটা খুব লেট করল। এমনিতে সিয়াটেল ওয়াশিংটন থেকে কলকাতা মোটামুটি চৌত্রিশ -পঁয়ত্রিশ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু, এবারে সময় লাগলো পাক্কা চল্লিশ ঘন্টা। বাডির চোখ-মুখ খুব কাহিল হয়ে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দমদমের ‘নেতাজী সুভাষ এয়ারপোর্টের’ সব কিছু বেশ খুঁটিয়ে দেখছে বাডি । প্রায় দশ বছর বাদে
এলো দেশে। শেষ যেবার এসেছিল টুইরা সেবার মম ও ছিল। বাডি সারাটা রাস্তা কি এক্সাইটমেন্টএর সঙ্গে গল্প করতে করতে যে এসেছিল!
এবারে অবশ্য বাডি সারা জার্নিতেই সেই
-‘ বিচ্ছিরি’ মুখটা করে বসেছিল। ডিমেনশিয়া রোগীরা নাকি যত দিন যায় তত বেশি চুপ করে যায় আর ওরকম একটা ভাবলেশহীন মুখ করে বসে থাকে। আস্তে আস্তে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে নিজের কি প্রয়োজন সেটা বোঝাতে থাকে! ডঃ মরিসনের কথা গুলো সত্যিই এত মিলে যাচ্ছে!
আজকে এয়ারপোর্ট এ যারা এসেছে তাদের সবার সাথেই মাঝে মাঝে ভিডিও কল করে কথা হয় টুইয়ের। বুড়োদা আর ওর বউ পিংকি, ওদের ছেলে রায়ান, বুড়োদার বোন বান্টিদি আর ওর দুই মেয়ে তুয়া আর তৃষা। বুড়োদা -বান্টিদি বাডির দাদার ছেলে মেয়ে। বাডি সব সময় চেয়েছে – টুই ওনাকে মানে বাডির দাদাকে জ্যেঠু বলে ডাকুক আর বাডি কে ‘বাবা! ‘ কিন্তু অত ডিফিকাল্ট বাংলা শব্দ বলতে গেলে টুইয়ের খুব কষ্ট হতো। তাই বাডির দাদাকে টুই -‘ জে’ বলতো। আর বাবা আর ড্যাডি মিশিয়ে – ‘বাডি’ বলে চিরকাল ডেকেছে নিজের বাবাকে। এই ব্যাপারটাতে বাডি খুব দুঃখ পেত । কেন পেত ? যে কোন মানুষ তার মাতৃভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ । টুইয়ের মাতৃভাষা তো ইংলিশ । টুইয়ের মা মানে বাডির স্ত্রী মিসেস মিশেল রায়চৌধুরী যে আসলে একজন আমেরিকান মহিলা মিশেল জনসন সেটা যে কেন বারবার ভুলে গিয়ে বাডি ওনার একমাত্র সন্তান টুইকে সব সময় বাঙালী মেয়ে বানানোর চেষ্টা করত আর সে ব্যাপারে সাকসেসফুল না হয়ে চিরটা জীবন খালি কষ্ট পেল কে জানে! বাডি তো এটাও কোনদিনও বুঝলো না যে – বাডি শব্দটার একটা আলাদা অর্থও কিন্তু আছে। বাডি মানে হলো-‘ বন্ধু! টুই কিন্তু বাডিকে নিজের খুব ভালো বন্ধুই ভাবে- ভেবে এসেছে সব সময়।
যদিও সারা সপ্তাহ ব্যাংকে গাধার খাটনি খেটে, বাডির নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করানো, বাডিকে ডাক্তারের পরামর্শ মত প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে নিয়ে যাওয়া,ঘরে- বাইরের সমস্ত কাজ সামলানো- এগুলো মেইনটেন করতে করতে এই তিরিশ বছর বয়সেই অনেকটা বুড়িয়ে যাওয়া টুই তেমন সময় পায় না- তবুও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে গিয়ে নানা খবর -টবর দেখে যা বোঝে তাতে করে একটুও অসুবিধে হয় না এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে যে- বাডির হোম টাউন, বাডির স্বপ্নের শহর কলকাতাতেও কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। এই বুড়োদা বা বান্টিদির ছেলেমেয়েরাও কিন্তু বাডির সেই স্বপ্নের বাঙালী ছেলে মেয়ে হয়ে, বাঙালী কালচারকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ধরে রেখে আর নেই! সারা পৃথিবীর ইয়াং জেনারেশনের মতই কলকাতার বাঙ্গালী নিউ জেনারেশনের মধ্য থেকে দেশী ঐতিহ্য- বং কালচার আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে পোশাক খাওয়া-দাওয়া, পছন্দ রুচি লাইফ স্টাইল – সবেতেই পাশ্চাত্য দেশের প্রভাব বিশেষ করে আমেরিকান কালচারটা খুব বেশি ভাবে এসে গেছে ! বাডিকে বলা যেত যে- বাডি কলকাতায় থাকে না বলে, বাডির একমাত্র সন্তান টুই বাঙালি সংস্কৃতি জানে না বলে, বাডির মনে যে সবসময় একটা দুঃখ কাজ করে – সেটা ঠিক নয়। বাডি সুস্থ থাকলে এ ব্যাপার গুলো বাডিকে বুঝিয়ে বলা যেত ! কিন্তু মম মারা যাবার পর থেকে বাডি আস্তে আস্তে এতটাই ডিপ্রেশনে চলে গেল!
ডিমেনশিয়া – সারা পৃথিবীর একা মানুষদের জন্য একটা অভিশপ্ত রোগ! চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্ট, স্বামী বা স্ত্রী কারুর মৃত্যুর পর অন্য জনের একা হয়ে যাওয়া – ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে যে যার নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়া …! ডিমেনশিয়া রোগের নানা রকম কারণ হতে পারে !
টুই দের জন্যে বুড়োদারা গোলপার্কের কাছে একটা গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করেছে। গেস্ট হাউসটাতে নাকি বাড়িতে থাকার সমস্ত কম্ফর্ট আছে। এর আগেও যে ক-বার কলকাতায় এসেছে
টুইরা সিয়াটেল ওয়াশিংটন থেকে – সে ক’ বার ই বৌবাজারে বাডিদের পৈত্রিক বাড়িতে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা ওরা হোটেলে চলে যেত। বেশিক্ষণ ওই বাড়িতে থাকলে মম আর টুইয়ের খুব প্রবলেম হত। এই ব্যাপারটাতেও বাডির খুব মন খারাপ হতো! বাডি কিছুতেই বুঝতে চাইতনা যে – বিদেশ থেকে আসা মেম সাহেব মম আর হাফ মেম সাহেব টুইকে দেখতে বাডিদের আত্মীয়-স্বজনরা এসে এত ভিড় করত আর এত কৌতূহল মেটানোর জন্য প্রশ্ন করে করে মিনিমাম প্রাইভেসি টুকুও দিত না মা মেয়েকে – যে অন্তত রাতের বেলা একটু শান্তি মত না ঘুমোলে পরের দিন আবার ওই কোয়েশ্চেন -আনসার পর্ব চালিয়ে যাওয়া মম বা টুই কারো পক্ষেই সম্ভব হতো না!
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ,গাড়ি করে যাবার সময় পথের দুপাশটা মন ভরে দেখতে থাকলো বাডি। বুড়ো দা আর বান্টি দি বারবার কারণে-অকারণে – ‘কাকামণি – কাকামনি’ বলে যেই না বাডিকে ডাকছে, টুই অবাক হয়ে দেখছে প্রতিবারই বাডির মুখটা যেন সামান্য একটু খুশী দেখাচ্ছে!
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কলকাতা শহর ছেড়ে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে চাকরি করতে গেছিল বাডি। ওখানকার স্থানীয় মেয়ে বিয়ে করেছে, আমেরিকান আ্যাকসেণ্টে ইংরেজি বললে কেউ বুঝতেই পারবে না যে গগন রায় চৌধুরী মানে বাডি মানুষটা খাঁটি বাঙ্গালী। তবুও, বাডির ভেতরের বাঙ্গালী মানুষটা, বাঙালী- জিনটা কি ভীষণ ভাবে এখনো যে বেঁচে আছে! তাই বোধহয় থাকে! থাকা উচিত! কিন্তু টুইয়ের সমস্ত আইডেন্টিটিই তো আমেরিকান! মম চাইত – টুই পারফেক্ট আমেরিকান মেয়েদের মত ব্যবহার করুক। আর বাডি চিরকাল মনে মনে চেয়ে গেল -টুই বাঙ্গালী কালচার শিখবে, রবীন্দ্র সংগীত গাইবে, বাংলায় গরগর করে কথা বলবে! বাংলা থেকে এত দূরে সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশে থেকে আমেরিকান মায়ের কাছে বড় হওয়া মেয়েটির এমন বাঙালী আচরণ করা কি খুব সহজ? বাডি যে কেন চিরকাল এত অভিমান রেখে গেলো নিজের ভেতরে! তাই এত খারাপ একটা রোগ ডিমেনশিয়া বাডিকে একদম ধরাশায়ী করে ফেলল! ঝুম্পা লাহিড়ীর -‘Interpreter of Maladies’ বইটাতে তো টুইদের মতো এরকম দুই সভ্যতার, দুই সংস্কৃতির মাঝে ঘুরপাক খেয়ে নিজের আসল পরিচয়টা যে ঠিক কি – সারা জীবন সেটাই আবিষ্কার করে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া দোভাষী- মানুষদের যন্ত্রণার অসামান্য বর্ণনা রয়েছে!
গাড়ির ভেতরে বোঝা যায়নি, এ সি চলছিলো। গাড়ি থেকে নামতেই – বেশ গরম লাগছে এবার। বুড়োদা বলল প্রথমে বৌবাজারের বাড়িতে থেকে ফ্রেশ হয়ে তারপর বাডিকে নিয়ে টুই গোল পার্কের গেস্ট হাউসে যাবে। বাডির দাদা মারা যাবার পর থেকে বুড়োদাই এখন বৌবাজার- বাড়ির কর্তা । বুড়োদা মানুষটা সত্যিই খুব ভালো। এত বছর পরেও, বাডির ঘরটা কিন্তু সেই আগের মতই সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। বডি পায়ে-পায়ে ঘরটাতে ঢুকে চারিদিকে চোখ বোলাতে লাগলো! কি করুণ দেখাচ্ছে বাডির মুখখানা! এই অসহায়, করুণ মুখখানা সারাদিন টুইকে তাড়া করে ফেরে বলেইনা অফিস -ফেরত আর অন্য কোথাও না গিয়ে টুই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায় বাডির কাছে। মম মারা যাওয়ার পর থেকে এটাই টুইয়ের রোজের রুটিন। সাত বছরের স্টেডি বয়ফ্রেন্ড জেসন ব্রেকআপ করার সময় টুইকে বলেছিল
– টুই যে এত বাডি বাডি করে এটা নাকি খুব অ্যাবনরমাল। এইভাবে টুই কোনোওদিনই একটা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন কাটাতে পারবে না!
তারপর থেকে টুই আর অন্য কোনোও রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়েনি। বাডিকে সময় দেওয়া, বাডির দেখাশোনা, বাডির মুখে একটু স্বাভাবিক হাসি দেখতে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাওয়া – এগুলো ছাড়া টুইয়ের আর কোনোও স্বপ্নই নেই এখন আর জীবনে! নিজের সমবয়স্ক অন্য যেকোনো মেয়ের মতো আনন্দ করতে, হাসতে, স্বাভাবিক থাকতে, স্বপ্ন দেখতে -টুই ভুলেই গেছে!
দেখতে দেখতে তিনটে দিন কেটে গেল। আজ সারা কলকাতায় একটা বিশেষ উৎসব। ‘বাংলা নতুন বছর’ সেলিব্রেশনের উৎসব আজ। বাঙালীরা বলে -‘নববর্ষ ।’ বান্টিদি দুই মেয়ে তুয়া আর তৃষা কে নিয়ে সকাল সকাল বৌবাজারের বাড়িতে চলে এসেছে। পিংকি বৌদির সাথে মিলে জোর কদমে রান্না বান্না করছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ বাডি আর টুইও গেস্ট হাউস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে বৌবাজারের বাড়িতে। বান্টিদি একটা খুব সুন্দর পাঞ্জাবি পরিয়ে দিল বাডিকে। আজকের দিনে নাকি সকাল-সকাল স্নান সেরে নতুন জামা পরতে হয়। তুয়া আর তৃষা মিলে খুব যত্ন করে টুইকে পরিয়ে দিয়েছে একটা সুন্দর নতুন তাঁতের শাড়ি। বাডি অবাক হয়ে টুইকে দেখছে। আগেও কথাটা অনেকবার শুনেছে টুই – আজ আরও একবার শুনলো, বুড়োদা বান্টিদির মুখে। টুইয়ের মুখখানা নাকি একদম বাডির ‘মায়ের’ মত!
বিকেলে একটা ঘরোয়া গান- বাজনার আয়োজন হল। পিঙ্কি বৌদি কয়েকটা রবীন্দ্র সংগীত গাইলেন- বাঙ্গালীদের খুব ফেমাস আইডেন্টিটি এই রবীন্দ্র সংগীত। তার মধ্যে একটা গান বাডিও মাঝে মাঝেই গাইতো- ‘ কি গাবো আমি কি শোনাবো। ‘
অনেক অনেক দিন হয়ে গেল বাডি আর গানটা গায় না। ইউটিউব থেকে গানটা খুঁজে বার করে টুই শিখে নিয়েছে। ডক্টর বলেছিলেন – ডিমেনশিয়া পেশেন্টের জন্য মিউজিক থেরাপি খুব ভালো। টুই মাঝে মাঝেই বাডিকে গানটা গেয়ে শোনায়। অনেকবার রিকোয়েস্ট করা সত্ত্বেও বাডি একটা লাইনও গায় না । চুপ করে টুইয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আজও পিংকি বৌদির গান, বুড়োদার আবৃত্তি আর তুয়া- তৃষার নাচের সময় ওই একই রকম শূণ্য দৃষ্টিতেই বাডি পুরো অনুষ্ঠানটা দেখল।
টুই হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজে থেকেই গাইতে শুরু করে দিল -‘ কি গাবো আমি কি শোনাবো।’ গলায় কোনোওদিনই তেমন সুর নেই টুইয়ের! গানের বাংলা উচ্চারণগুলো খুব ভাঙ্গা ভাঙ্গা, কিন্তু আন্তরিকতাটা পুরোমাত্রায় নিখাদ। হয়তো আজকের দিনের এই বিশেষ আন্তরিক পারিবারিক পরিবেশ – এত অসাধারণ অমায়িক ব্যবহার দুই জ্যাঠতুতো দাদা দিদি ও তাদের সমস্ত পরিবারের- টুইয়ের ভেতরের বাঙ্গালীয়ানাটাকে জাগিয়ে দিয়েছে, এই গানটা আরো একটু দরদ দিয়ে আন্তরিকভাবে গাইতে সাহায্য করছে!
সিয়াটেলে চিরকাল ‘নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে’ কোনো পার্টিতে গিয়ে সেলিব্রেট করেছে টুই, মম আর বাডি। ও দেশে তো ওদের কোনো আত্মীয়-স্বজন তেমন ছিল না, তাই এমন ঘরোয়া পরিবেশে বাড়ির সবাইকে নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই ব্যাপারটা বেশ অভিনব টুইয়ের কাছে। তুয়া, তৃষা, রায়ান -তিনজনই কিন্তু টিন- এজার। প্রচুর বন্ধু-বান্ধবও আছে ওদের। কিন্তু তাও আজকের এই বিশেষ দিনটা ওরা কিন্তু ওদের ফ্যামিলির সাথেই কাটাচ্ছে।
বাডি চিরকাল এই ফ্যামিলি বন্ডিং, পরিবারের সব সদস্যদের মধ্যে এই সুন্দর বোঝাপড়া, চমৎকার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক টুইকে দিতে চেয়েছে।
বাডি আর বাডির দাদা মানে টুইয়ের -‘জে’ র মধ্যেও সম্পর্কটাও ছিল চমৎকার। বুড়োদা আর বান্টিদিও কী চমৎকারভাবে আগের প্রজন্মের ভালোবাসার ,ভালো রাখার, ভরসার- সম্পর্কটা বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো! কলকাতাতে এসে বাডিকে নিয়ে এ -কটা দিন যে কি আনন্দে কাটছে টুইয়ের! আর যেটা দেখে শুনে আরো আশ্চর্য লাগছে – যে অফিসিয়াল সব কাজকর্ম ইংরেজী বছর আর তারিখ মেনে করলেও, বাংলা নববর্ষ টা কিন্তু এখনো বাঙালীরা খুব যত্ন নিয়ে, নিজেদের মতো করে সেলিব্রেট করে। যে ছেলে মেয়ে যতই মর্ডান হয়ে যাক না কেন- কোথাও যেন নিজেদের -‘বাঙালী রুটটা’ কে এখনো তারা নিজেদের মতো করে ধরে রাখার চেষ্টা করে এইসব অনুষ্ঠানগুলোতে। এসব কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ঘরের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাডি গাইতে শুরু করল -” তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা, অসীম শূন্যে ধাইছে-
রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে। ”
অনেক অনেক দিন পর বাডি এমন মগ্ন হয়ে প্রিয় গান -‘কি গাবো আমি কি শোনাবো’ গাইছে! বাডি যেন ভুলে গেছে চারপাশ! যেন ভুলে গেছে সারা জীবন নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতিকে ছেড়ে অন্য এক দেশে অন্য এক সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ লড়াইয়ের ইতিহাস! যেন ভুলে গেছে – নিজের একমাত্র আত্মজাকে নিজের শেকড়ের সঙ্গে পরিচিত করবার অফুরান চেষ্টা। সমস্ত কিছু ভুলে আপন তানে -আপনি মেতে উঠে বাডি গান গাইছে! কখন যেন বুড়োদা আর বান্টিদি উঠে গিয়ে দুজনে দু দিক দিয়ে বাডিকে জড়িয়ে ধরেছে! আর টুইকে অবাক করে দিয়ে দুই ভাইপো- ভাইঝিকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে বাডিও অঝর- ধারায় কাঁদছে!
এতো কান্নাও জমে ছিল মানুষটার মধ্যে! এতো কান্না ও জমে থাকতে পারে? কান্নাও যে কত আনন্দের হতে পারে- কান্নাও যে কখনো কখনো জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসার হতে পারে- তা আজকের দৃশ্যটা না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতো না টুই!
পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল টুই। বাডিদের বৌবাজারের এই পৈত্রিক বাড়ির বারান্দাটা চমৎকার! এপ্রিলের পনেরো তারিখ আজ। এখন সময়টা মাঝ-বিকেল । সূর্য অস্ত যাবার পথে পা বাড়িয়েছে। দিনের এই বিশেষ সময়টাকে বাংলায় বলে ‘গোধূলি’! টুই খুবই ভাল জানে এই শব্দটা! বাডি খুব চেয়েছিল নিজের নাম গগনের সাথে মিলিয়ে একমাত্র সন্তানের নাম -‘গোধূলি’ রাখতে। মম রাজী হয়নি। মমের যুক্তি ছিল -এমন শক্ত বাঙালী নাম সিয়াটেল ওয়াশিংটনে চলবেনা। তাই বাডির ভাবনাটাকে মাথায় রেখে মম মেয়ের নাম রেখেছিল-‘ টুইলাইট’ – বাংলা মানে গোধূলি। আর টুইলাইটকে ছোট করে ‘টুই’ হল মেয়ের ডাকনাম।
নিজের মনে বহুদিন ধরেই এই টানাপোড়েনটা চলছিল। আজ শেষমেশ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল টুই। মম কে হারিয়ে ফেলেছে চিরজীবনের মতো, কিন্তু টুই বাডিকে কিছুতেই হারাতে পারবে না! বাডিকে ভালো রাখার জন্য সবরকম চেষ্টা মরিয়া হয়ে চালাবেই টুই। আর বাডি ভালো থাকবে কলকাতায়- নিজের শেকড়ের কাছে -নিজের পরিবারের মানুষজনের কাছে!
-‘ঘোষণাটা’ করতেই কি অসম্ভব হুল্লোড় যে শুরু হয়ে গেল ঘরের মধ্যে! বাডি কি আদৌ বুঝলো টুই কি বলতে চাইছে? বুঝলো বোধহয়। বহুদিন বাদে বাডির চোখ দুটো খুব ‘স্বাভাবিকভাবে’ টুইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল! যেন নীরবে বলতে চাইল -” তুই শুধু আমার মায়ের মতো দেখতেই নয় টুই। তুই সত্যি সত্যিই আমার মা। তাইতো শুধুমাত্র আমার আনন্দের কথা ভেবে- নিজের বেড়ে ওঠার শহর, নিজের শেকড় কে ছেড়ে নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে দূরে সরিয়ে রেখে – কলকাতায় আমায় নিয়ে থেকে যেতে চাইছিস! ”
কবেকার পুরনো কলকাতা শহরের পুরনো রাস্তাগুলো বাংলা নববর্ষের আনন্দ মুখর সন্ধ্যেতে তারা ঢাকা মেঘ ,মেঘে ঢাকা তারাদের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলল -” নব আনন্দে জাগো আজি। একজন পুরোনো মানুষ আবার ফিরে আসছে এই শহরে, তার নিজের শহরে – তার প্রাণের বাঙ্গালীয়ানার কাছাকাছি ফিরে আসছে। নববর্ষে নব- হর্ষে ফিরে আসছে ,ফিরে আসছে ,ফিরে আসছে…! ”
( সমাপ্ত)