উড়ান

উড়ান

আজ পনেরো দিন হল ঐষীর সাথে আকাশের রেজিস্ট্রি হয়েছে । পাত্র কন্যা দুপক্ষ মিলিত ভাবে বেশ ঘটা করেই অনুষ্ঠান টা করেছে । তারপরের দিনই আকাশ ব্যাঙ্গালোরে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেছে।তিনমাস পরে মার্চে বিয়ের দিন ফাইনাল হয়েছে ।ঐষীও কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর বদলি নেওয়ার জন্য অফিসে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।

সবই ঠিক চলছিল । শুধু একটা ব্যাপার নিয়ে ঐষীর মনের খচখচ টা চোখে বালি পড়ার মতো কিছুতেই যাচ্ছে না।একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে বাবা মা এতটাই মেতে আছে যে এরমধ্যে এসব চিন্তা তাদের মাথায় ঢোকাতে ঐষীর ইচ্ছে করছেনা। আর মাত্র তিনমাসের পরিচয়ে বিয়ে ঠিক হওয়া আকাশ কেও এখনি এসব জানতে কেমন কুন্ঠাবোধ হচ্ছে ঐষীর।

আসলে ঘটনা টা সামান্য নাকি জীবন পাল্টে দেবার মত অসামান্য কিছু সেটা ঐষী এখনো নিজেই জানে না। আইনি বিয়ের একদিন আগে আকাশ দেখা করতে চেয়েছিল ঐষীর সাথে।শাড়ি পরে আসতে আবদার করেছিল । ঐষী সেদিন অফিস ছুটি নিয়ে ছিল । তারপর সারাদিন আকাশের কথা ভেবে হলুদ লাল বিষ্ণুপুরী সিল্ক আর হালকা সোনার গয়নায় নিজেকে অপরুপ ভাবে সাজিয়ে ছিল।

কিন্তু সেদিনই হঠাৎ শাড়ির কুঁচি টা গুঁজতে গিয়ে পেটে নাভির ঠিক ওপরে গোলাকার একটা সাদা দাগ চোখে পড়ল ঐষীর । এমন কিছুতো আগে তার নজরে পড়েনি।ভালো করে দুতিনবার খেয়াল করলো ।বেশ কিছুটা জায়গার রঙ পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।সেই থেকে এই ব্যাপার টা ঐষীর সবকাজের মধ্যে মাছের কাঁটার মত বিঁধছে।

তারপর থেকে দিনে যখন ই সময় পেয়েছে জায়গাটা লক্ষ্য করছে ঐষী। এই পনেরো দিনের মধ্যে সাদা দাগটা আয়তনে বেশ বড় হয়েছে।রঙটাও আগের থেকে বেশি সাদাটে হয়েছে ।ঐষীর চিন্তা ও গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে ।তার চিন্তিত ভাবটা মায়ের চোখে ও ধরা পড়েছে। কিন্তু বিয়ের আগে সব মেয়ের এমন হয় এইভেবে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

আকাশ এখন দিনে অনেকবার ফোন করে।সদ্য বিয়ে করা বউ এর প্রতি তার দায়বদ্ধতা ঐষী বেশ টের পায়।আকাশের স্বপ্নের শেষ নেই।সে তার সব স্বপ্ন ঐষীকে উজাড় করে বলতে চায়।কিন্তু এই ব্যাপার টার ধোঁয়াশা না কাটা পর্যন্ত ঐষী যেন কিছুতেই ঠিক মন দিতে পারছেনা।

আজ ঐষী তার খুব কাছের বন্ধু পিহু কে নিয়ে বিশিষ্ট স্কিন স্পেশালিস্ট ডক্টর মালাকারের চেম্বারে এসেছে ।বুকের মধ্যে ঢিবঢিব মাদল টা যেন তার বেজেই চলছে । অনেকক্ষন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর উনি গম্ভীর মুখে বললেন ,

“একটু দেরি করে ফেলেছেন ।খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে এ জিনিস। চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। প্রথমে কয়েক টা টেস্ট করতে হবে।”

ঐষী যা বোঝার বুঝে যায়।চেম্বার থেকে বেরবার আগে পিহু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,

“এটা কি শ্বেতী ডাক্তার বাবু।ওর সামনে বিয়ে। মানে অসুবিধা হবে।নাকি ঠিক হয়ে যাবে ।”

ডক্টর মালাকার চিন্তিত মুখে বললেন ,

“দেখুন।এটা লুকোবার বিষয় নয়।দীর্ঘ চিকিৎসার মাধ্যমে সাফল্য আসে।আবার অনেক সময় আসেও না। যেকোন দিন মুখেও শুরু হতে পারে।”

ঐষীর পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে।এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া ঘনিয়ে আসে চারদিকে।পথচলতি সাদা দাগের মানুষজনের মুখ ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে ।শিউরে ওঠে সারা শরীর ।

ঐষী বাড়ি ফিরে বাধ্য হয়ে সবটা জানায় তার বাবা মা কে। অকস্মাৎ এই অভাবনীয় বিপদে তাঁরা বাকরুদ্ধ । কিন্তু সেদিন ই ঐষীর জেদে আকাশের বাড়িতে সবটা জানাতে বাধ্য হন তাঁরা। প্রথম টা চুপ করে সবটা শুনলেও পরে আকাশের বাবা রাগে ফেটে পড়েন,

“আপনারা রসিকতা করছেন আমাদের সাথে।পনেরো দিন আগে ও কি জানতেন না মেয়ের গায়ে শ্বেতী আছে।নাকি রেজিস্ট্রিটা হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।আমাদের ছেলেটা কি ফেলনা।সারাজীবন একটা শ্বেতীওয়ালা মেয়ের সাথে থাকবে।এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না ।”

ঐষীর বাবা এতকিছু শুনেও শান্ত ভাবে বললেন,

“আপনারা আমাদের ভুল বুঝছেন ।আমাদের তেমন উদ্দেশ থাকলে আজও জানাতাম না।তাছাড়া আমার মেয়ে নিজেই এ বিয়ে করতে চাইছেনা।আপনি প্লিজ আকাশ কে সবটা বুঝিয়ে বলুন।এরপর কি করনীয় আপনারা ঠিক করুন।”

ফোন টা কেটে দিয়ে কপালে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন ঐষীর বাবা।ঐষীর মা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা ।ঐষী এখনও ঠিক নিজের ভাগ্য কে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এমন ঘটনাও কারোর জীবনে ঘটে।তবে কিছুতেই সে আকাশের জীবন নষ্ট করবে না। তকে সে ঠকাতে পারবেনা।কিন্তু আকাশের মুখোমুখি হবে সে কেমন করে। না পাওয়ার হাহাকারে কঁকিয়ে ওঠে ঐষী। কি বলবে সে আকাশ কে।সে যে কত পরিকল্পনা ইতিমধ্যে করে ফেলেছে । নাহ্ আকাশের সাথে কথা বলার দরকার নেই ।কথা বললেই যন্ত্রণা বাড়বে।যা বলার তো তার বাড়ির লোককেই বলে দেওয়া হয়েছে ।ঐষী ঠিক করে নেয় কিছুতেই আকাশের ফোন রিসিভ করবেনা। বাবা মাকে ও বারন করে দিল।

আধঘন্টা পর থেকে ক্রমাগত আকাশের ফোন আসতে শুরু করে।ঐষী পাথরের মত নিশ্চুপ বসে থাকে।একরাশ অবসাদ ঘিরে ধরছে তাকে।একবার মনে হচ্ছে সব যন্ত্রণা সব কান্না উজাড় করে আকাশ কে বলে হালকা হবে।কিন্তু পরক্ষণেই মনেহচ্ছে কি লাভ । আকাশ কে তো ভুলে যেতেই হবে।বাড়ি র সবকটা ফোনে বহু বার চেষ্টা চালিয়ে আকাশ একসময় থেমে যায়

পরের দিন থেকে বাড়ি তে যেন শ্মশানের নীরবতা ।মেয়ের কষ্ট টা বাবা মা অনুভব করছেন প্রতি মুহূর্ত। ঐষী আজ অফিস যায় নি।ভেবেছিল টেস্ট করাবে কিন্তু শরীর সঙ্গ দিচ্ছেনা । ভয়ানক এক ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তাকে।বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছেনা।সকাল প্রায় দশটা।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মা ঢোকেন ঐষীর ঘরে।

“ওঠ মা এবার কিছু খেতে হবে তো।আকাশ আর ফোন করেছিল।”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঐষী বলল,

“কই না তো।”

“এটা কি ঠিক করলি।একবার তো পুরোটা নিজে ওকে বলতে পারতিস ।বিয়েটা তো তোদের হয়েই গেছে।”

মায়ের শেষ কথাটায় ঐষীর বুক ধড়াস করে ওঠে।

ডোরবেল টা বেজে ওঠে।ব্যস্ত পায়ে মা দরজা খুলতে যান।দরজা খুলেই অবাক তিনি

“একি আকাশ তুমি কি করে এলে।”

প্রনাম সেরে আকাশ বলল

“আপনার মেয়েটা যে এত ছেলেমানুষ সেটা তো জানতাম না।কোথায় সে।”

বলে নিজেই ঐষীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

“এই যে মহারানি ।লেপের তলায় আরামে শুয়ে আছেন ।আর আমি কাল সারারাত একটা টিকিটের জন্য হন্যে হয়ে মরেছি।শেষে তিনগুন টাকা দিয়ে আজ সকালের ফ্লাইটে আসতে হল।”

ঐষী আকাশ কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ।তারপর কোনমতে বলল,

“তুমি হঠাৎ আসতে গেলে কেন।আমি কি বলেছি আসতে।”

“না আসবে না।কি একটা সাদা দাগ হয়েছে অমনি আমাদের বাড়ি তে জানানো হয়ে গেলো।অথচ আমাকে জানানো হলনা।বিয়ে ভেঙে দেবে ?এত সস্তা ।বিয়ের মানে বোঝ?তোমার সুখ অসুখ সবটাই আমার ।”

বলেই আকাশ পিছন ফিরে ঐশীর মায়ের দিকে তাকাল তারপর বলল,

“কি মা ঠিক বলেছি কিনা বলুন।ওর অসুখ হলে সেটা সারাবার দায়িত্ব কার?”

“আমিতো সেটাই বলছিলাম বাবা।তোমার সাথে একবার কথা বলতে।”

“শুনুন মা একমাসের মধ্যে আমি ওকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাব।ওখানে ট্রিটমেন্ট হবে।এটা কোন বড় ব্যাপার নয়।যদি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চান এরমধ্যে সেরে ফেলুন ।না হলেও ক্ষতি নেই।বিয়ে তো হয়েই গেছে ।”

“কিন্তু তোমার বাবা—”

“ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।”

দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে ঐষী।এতক্ষণের জমানো যন্ত্রণা হাহাকার কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে।

“তোমরা কথা বলো আমি চা নিয়ে আসছি।”

বলেই রান্না ঘরের দিকে গেলেন ঐষীর মা।

আকাশ এগিয়ে যায় ঐষীর দিকে তারপর দুহাতে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঐষীকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত