-ঈশু, এই ঈশু, ও কাকিমা, তোমার মেয়েটা কোথায় গো? ফোন করলাম রিসিভ করলো না, মহারাণীর ঘুম ভাঙেনি নাকি গো?
-না রে ভোরে তো দেখলাম নিচে নেমে ছিলো, আবার হয়তো গিয়ে ঘুম দিচ্ছে, দেখ্ গে যা, তা তুই কবে এলি মা? জামাই এসেছে? ক’দিন থাকবি তো মা এখানে? একটু তোর বন্ধুটাকে বোঝা না মা, বিয়েতে যেন মত দেয় এবার!
-ঠিক আছে কাকিমা, তুমি এতো ভেবোনা, চাকরি করে তো, একটু নিজের মতো থাকতে দাও না, বিয়ে করলেই পরাধীন জীবনযাপন!
-যা দেখ কি করছে?আমি তোদের চা পাঠিয়ে দেবো।
ঈশানীর রুমে গিয়ে দেখলো বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে।
-এই কুম্ভকর্ণ, আর কত ঘুমোবি? অফিস নেই বলে কি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবি নাকি? এই ওঠ তো তুই!
চোখ খুলে এমিলিকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো ঈশানী–কখন এলি তুই, রূপক দা এসেছে?
-কোনো প্রশ্ন নয়, তোর খবর কি রে, আজকাল ফোন করিস না, অনলাইনে ও তোকে দেখতে পাই না, আজ ও ফোন করলাম কোনো রেসপন্স করলি না, কি হয়েছে রে তোর? সমিক ভালো আছে তো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ সব ঠিকঠাক আছে, অফিস বাড়ি নিয়ে বেশ আছিরে! চল নিচে যাই, জমিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করবো।
-এখানে চুপ করে বোস তো তুই, কি হয়েছে তোর? সমিকের সাথে কাল দেখা হয়েছিলো, জিগ্যেস করলাম তোর কথা, কেমন যেন উদাস দেখাচ্ছিলো ওকে! বললো ভালোই আছে হয়তো? এড়িয়ে গেলো আমায়, বল না কি হয়েছে তোদের? ওকে দেখে বুঝলাম মোটেও ভাল নেই।
সমিকের কথা উঠতেই ঈশানীও কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল।
বললো- জানি রে, ও মোটেই ভাল নেই। আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে আমাদের দেখা হয়নি, ফোনেও কোনো কথা হয় নি। বুঝলি, আমি না ব্রেকআপ করে নিয়েছি আমাদের রিলেশান টা। অঝোরে কাঁদতে লাগলো ঈশানী।
সেই ছোট বেলার থেকে তাদের দুজনের বন্ধুত্ব। দুজনেই খুব মেধাবী ছিলো পড়াশোনায়। দুই বাড়ির মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো।
ঈশানীর বাবা ও দাদু ছিলো নাম করা উকিল। বাড়ির একমাত্র মেয়ে ঈশানীর কোনো অভাব ছিলোনা কখনো। সব সময় সবচেয়ে যেটা ভালো সেটাই পেয়ে এসেছে সে। একি পাড়ায় থাকার জন্য এমিলি একসময় তার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলো ঈশানীর।
ছোট থেকে একটু কল্পনাপ্রবন ছিলো সে। স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা, গল্প লিখে খুব হইচই ফেলে দিয়েছিলো। সমিক ছিলো তার একমাত্র অনুরাগী। উৎসাহ দিতো তাকে লেখার, তার সাহচর্য না পেলে হয়তো ঈশানীর লেখালেখি অনেক আগেই থেমেযেতো।
যখন কলেজে ভর্তি হলো নবীন বরন অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলো। একদিন এমিলি তাকে বলেছিলো- কি সুন্দর লিখিস রে তুই! যত দিন যাচ্ছে তোর লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি, কবি বা লেখক হয়ে গেলে ভুলে যাবি না তো?
তাকে জড়িয়ে ধরে ঈশানী বলেছিলো- এতে আমার কোনো ক্রেডিট নেই রে, ও যদি না থাকতো তবে আমি লেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতাম, লিখি তো শুধু ওর অনুপ্রেরণায়। ও চায় আমি ভালো লেখক হই, কবিতা লিখি, আমার বই বের হোক !বলতে বলতে ও হারিয়ে গেছিলো, হঠাৎ খেয়াল হতেই দেখে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে এমিলি, লজ্জায় থেমে গেছিলো সে।
সে থামলেই কি তাকে থামতে দিয়েছিলো এমিলি? চেপে ধরে জিগ্যেস করে ছিলো- তোর ঐ ও টা কে রে? পরিচয় করাবি না?
পরিচয় করিয়ে ছিলো পরে একদিন সমিকের সাথে, গঙ্গার ঘাটে, কোনো এক বিকালে। গল্প করতে করতে এমিলি লক্ষ্য করছিলো সমিক কে, মনোযোগ দিয়ে ঈশানীর এলোমেলো গল্প গুলো শুনছে, ঈশানীর প্রতি একরাশ মুগ্ধতা ছিলো তার চাউনিতে, তার অন্তরেও।
ঈশানীই একদিন বলেছিলো বন্ধুত্ব থেকে কবে যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে নিজেই জানেনা, মনেহয় সমিককে ছাড়া সে ভালো থাকতেই পারবে না, নিশ্বাস নিতে পারবেনা এই পৃথিবীতে! আর আজ সেই ঈশানী এ কি বলছে! ব্রেকআপ হয়ে গেছে তাদের, ঈশানী যে ভালো নেই সে বেশ বুঝতে পারছে, হয়তো কোনো মান অভিমানে এসব বলছে। জানতে হবে তাকে, কি এমন সমস্যা তাদের মধ্যে।
নিজেকে সামলে নিয়েছিলো ঈশানী, মা এসে তাদের চা জলখাবার দিয়ে গেছিলো। গল্প করে যাবার সময় সে বলেছিলো, আজ তো তোর অফিস নেই, চলনা দুজনে মিলে একসাথে সপিং করবো, একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসবো। ঈশানী কাটিয়ে দিতে চাইলে তার মা বললো- যা না এতোদিন পরে এলো মেয়েটা একটু ঘুরে আয় গিয়ে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে স্কুটিটা নিয়ে সে গেছিলো এমিলির বাড়ি, সে আসতেই বললো- চলুন মহারাণী,কি কি কেনাকাটা করবেন চলুন, আপনার সারথী হাজির! তার স্কুটির পেছনে বসতে বসতে এমিলি বলেছিলো পাগলী একটা তুই!
টুকটাক কেনাকাটা করে তারা এসে বসেছিলো কফি হাউসে,এখানে ঈশানী আসতে চায়নি, জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছিলো এমিলি।
কফি অর্ডার করে বললো, তখন বাড়িতে কাকিমা এসে পড়ায় তোর কথা শোনাই হয়নি, বল তো তোদের কি এমন হলো যে…
-বাদ্ দে তো, তোর কথা বল, কেমন কাটছে তোদের বিবাহিত জীবন?
তার হাতে হালকা চাপ দিয়ে এমিলি বললো, এড়িয়ে যাচ্ছিস আমায়? প্লিজ ঈশু বল তুই, কাল সমিককে দেখার পর থেকে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না রে,তাই তো ছুটে গেছিলাম তোর কাছে, আমায় কিছু লুকোস না ঈশু।
চোখের জল লুকিয়ে ঈশানী বললো- জানিস তো কতদিন আমরা ছুটির দিনে এখানে মিট করেছি, রোজ দেখা করতে চাইতো সে , আমি না বললেও থেমে যেতো ও, একদিন খুব জেদ করছিলো এখানে দেখা করবে বলে, আমি রাজিও হয়েছিলাম, কিন্তু স্যার হঠাৎ করেই জানালেন যে পড়াবেন, ওকে সেটা জানাতে পারিনি, বৃষ্টির জন্য পড়া শেষ হওয়ার পরও একঘন্টা থেমে যেতে হয়েছিলো। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে, ভাবলাম চারটেতে আসার কথা ও হয়তো অপেক্ষা করে ফিরে গেছে। ভাবলাম একবার তাও দেখেই যাই এখানে! কি দেখলাম জানিস, ও তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য ঐ কোণের টেবিলটায়।
চিত্কার, চেঁচামেচি করে, ওকে মেরে বললাম- পাগল নাকি তুমি? এতোক্ষণ কেউ অপেক্ষা করে? এগারো কাপ কফি খায়? চুপচাপ তাকিয়ে ছিলো জানিস আমার মুখের দিকে, আর কিছু বলতে পারিনি সেদিন থেমে গেছিলাম আমি।
চোখের জল মুছে নিয়ে বললো -কি করবো বল তো আমি? বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। মাকে এটা ওটা বলে ম্যানেজ করলেও বাবা কে এভাবে এড়াবো কি করে? আমি চাকরি করি, আমি জানি ও চাকরি না করলেও আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো কিন্তু আমার বাড়ির সবাই তা মানবে কেনো?
একটা বেকার ছেলের সাথে কেউ বিয়ে দেয় একটা মেয়ের?ওকে আমি দোষ দিইনা, ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, তার বাবা রিটেয়ার করার পর সংসারের অনেক দায়িত্ব তার কাঁধে, ছোট দুটো ভাই বোন আছে ওর। পাগলের মতো চাকরি খুঁজছে, খুঁজলেই তো পাওয়া যায়না, তারজন্য কোচিং নিতে হয়।টিউশানের টাকা দিয়ে এসব কি হয় বল?
বলেছিলাম যে আমি তোমার কোচিংয়ের খরচ দেবো, তুমি নাও, তাতে ওর মানে লাগছে, কি করতাম বল আমি? গলা ধরে আসে ঈশানীর।
দুম করে একদিন বলে দিলো, ওর আর আমার রাস্তা আলাদা, বিয়ে করে ওকে সব বন্ধন থেকে যেন মুক্ত করে দি। ভালোবাসা আছেই, একটা বন্ধুর প্রতি আরেকটা বন্ধুর যা থাকে তাই, তার বাইরে আর কিছু নেই!
চলে এসেছিলাম সেদিন ওর কাছ থেকে, অভিমানে তিনদিন ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলাম, ভেবে ছিলাম ও আমার বাড়ি আসবে, হয়তো কফি হাউসে… নাহ্ সে আসেনি!
থাকতে পারছিলাম না জানিস, সত্যি আমি পারছিলাম না রে ওকে ছাড়া থাকতে, ফোন করে দেখি সুইচ অফ, ফেসবুক,হোয়ার্ট আ্যপ সব ডিএক্টিভেট করে দিয়েছে।
পাগলের মতো ছুটে গেছিলাম ওর বাড়িতে, ওর বোন বললো দাদা বাইরে গেছে, কবে ফিরবে জানিনা। জানিস তো কেউ যদি ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাকে খোঁজার চেষ্টা করা বৃথা, তাই আর খোঁজ করিনি ! খুব ভালো আছি রে আমি, সত্যি খুব ভালো আছি। চল বাড়ি যাই, আমার অফিসিয়াল কিছু কাজ আছে।
ফিরে এসেছিলো তারা, নিজের কাজে ডুবে গিয়েছিলো ঈশানী। ভেতরে চাপা কষ্ট থাকলেও কঠিন করে নিয়েছিলো মন, চেষ্টা করছিলো চেনা শহর, চেনা মানুষ সব কিছু থেকে দূরে গিয়ে একা থাকতে।
তিনদিন পরে হঠাৎ এমিলি ফোন করে বলে- আর্জেন্ট দরকার, কখন ফ্রি থাকবি দেখা করবো।
ঈশানী বললো – অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাতটা হয়ে যাবে, তারপর তুই চলে আয়। নাহ বাড়িতে না, কফি হাউসে দেখা করবো নয়তো গঙ্গার ঘাটে। সাড়ে ছটা নাগাদ ঈশানী গঙ্গার ঘাটে এসে দেখে এমিলি বসে আছে, তাকে দেখে হাত নাড়ায়। সে বসে তার পাশে, বলে হঠাৎ এতো জরুরী তলব যে!
এমিলি তার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে- নে তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে,
-কি আছে এতে, কীসের সারপ্রাইজ রে? একের পর এক প্রশ্ন করে ঈশানী।
এমিলি বলে- খুলেই দেখ না, তাহলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি। আবার ঈশানীর মনে পড়ে যায়, সমিক ও তাকে মাঝে মধ্যে এমন হেঁয়ালি করে সারপ্রাইজ গিফ্ট দিতো। চকলেট, খোঁপার কাঁটা, পায়ের তোড়া, রাইটিং প্যাড কত কি! সে বলতো- কেন আনো এসব, তুমি কষ্ট করে যা পাও সেগুলো এভাবে খরচ কোরনা, আমার কষ্ট হয়। তার হাত টা নিজের হাতে নিয়ে সমিক বলতো- কতটুকুই আর পারি আমি, গিফ্ট খোলার সময় তোমার ঐ চকচকে চোখ ও মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আমি জাষ্ট পাগল হয়ে যাই, আমার নিজের খুশীর জন্য এ টুকুতো আমি করতেই পারি। পাগল না হলে এমন বলে! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে তার।
সমিককে ঈশানীও অনেক কিছু দিয়েছে, হাসি মুখে নিয়েছে সব, শেষ বার যখন একটা টাই দিয়েছিলো সমিক বলেছিলো- টাই পরে যাবো কোথায় আমি?কোনো হাই লেবেলের মানুষ আমাদের নেমতন্ন করবে না যে পরবো!
ঈশানী বলেছিলো- তা কেন কোনো ইন্টারভিউ বা চাকরি করতে গেলে তখনি না হয় পরবে? সে বললো- বেঁধে দেওয়ার জন্য লোক চাই আমার, আমি এসব পারিনা, যদি কথা দাও বেঁধে দেওয়ার জন্য তুমি থাকবে তবেই নেবো নইলে তোমার বাবাকে দিও।
সেদিনও এখানেই কাটিয়ে ছিলো সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে, আর আজ…
-কিরে কি ভাবছিস? খোল প্যাকেট টা!
প্যাকেট টা খোলে ঈশানী, সুন্দর মলাট দেওয়া একটা বই, নাম “স্বপ্নের দিনগুলি”নিচে লেখা একটা নাম” ঈশানী চৌধুরী”।
পাগলের মতো বইটির পাতা উল্টাতে থাকে সে, তার প্রতিটি কবিতা, গল্প তাতে লেখা। ভিতরে একটা ছোট্ট চিরকুট, তাতে লেখা —
কবিতা ও গল্প লেখা কখনো ছেড়োনা, আমি চাই এই লেখার জগতে তুমি সুপ্রতিষ্ঠিত হও, বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হও, আগাম জন্মদিনের গিফ্ট পাঠালাম। পারলে ক্ষমা কোরো আমায়।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ঈশানী বললো- তুই চলে যা বাড়ি, আমার ওর সাথে কথা আছে, কি ভাবে নিজেকে? কষ্ট কেন দিচ্ছে এতো? আমি পারবো না রে ওকে ছাড়া আর আমিও জানি ও পারবে না ভালো থাকতে।সারাজীবন যদি ওর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আমি তাই করবো।
বইটাকে ঝোলায় পুরে স্কুটিতে চালিয়ে চলে গেলো সে, পেছন থেকে এমিলি বলে উঠলো “অল দ্যা বেস্ট “।