মৈথিলী তার বাবার হাত ধরে ছোট থেকেই মন্দিরে যায়।পুরোহিতের মেয়ে, তাই পুজোর কাজ সে ছোট থেকেই দেখে দেখে নিজেই শিখে গেছে।বাড়িতেও লক্ষী-নারায়ণের নিত্যপুজো হয়।এই ষোলো বছর বয়সেই মৈথিলী পুজোর আচার বেশ রপ্ত করে ফেলেছে।বর্ধমান শহরে বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্য বেশ নামকরা পুরোহিত,শহরের বেশ কয়েকটি মন্দিরের স্থায়ী পুরোহিত তিনি।মৈথিলী বাবার সাথে মন্দিরে গিয়ে হাতে হাতে পুজোর থালা এগিয়ে দেয়, ফল কেটে দেয়, চন্দনও বেঁটে দেয় মাঝে মাঝে।গ্রাম থেকে বাবার সাইকেলের পেছনে বসে চারিদিক দেখতে দেখতে আসে সে, গ্রামের স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ছে।তবে বাবা বলেছে,আঠারো হলেই কুলীন ঘর দেখে মৈথিলীর বিয়েটা দিয়ে দেবে।বিয়ে হয়ে যাবে ভাবলেই মৈথিলীর দুচোখ জলে ভরে যায়, বাবাকে সে বড্ড ভালোবাসে, ছোট থেকেই বড্ড বাবা ন্যাওটা।তাই বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা ভাবলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দেয়।
শহরের মাঝে গত দু-তিন বছরের মধ্যে এই হনুমানজির মন্দিরটা আকারে এবং আয়তনে বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে।অথচ কয়েক বছর আগেও মৈথিলী দেখতো পাকুড় গাছের নীচে টিনের ছাউনিরছোট্ট বেদিতে হনুমানজির একখানা শিলামূর্তি।এখন মন্দিরে ঢালাই হয়েছে,মার্বেল বসেছে।মঙ্গল আর শনিবার সন্ধ্যের দিকে এত ভীড় হয় যে বাবা একা সামাল দিতে পারেনা,গ্রাম থেকে তরুণকাকাকে সঙ্গে আনে।মৈথিলীও আসে, স্নান করে কাচা চুড়িদার পরে।সবার হাত থেকে নাম লেখা পুজোর প্যাকেটগুলো নেয়, পুজো শেষ হলে হাতে হাতে প্রসাদ দিয়ে, নাম লেখা প্যাকেটগুলো আবার ফেরত দিয়ে দেয়।
ভীড়ের মাঝেই গত কয়েক মঙ্গলবার ধরে মৈথিলী খেয়াল করছে, একজোড়া চোখ শুধু তার দিকে তাকিয়েই পলক ফেলছে।আলগোছে মৈথিলীও দু-একবার তাকিয়ে ফেলছে।ছেলেটা হয়তো মৈথিলীর থেকে বছর দুয়েকের বড়ো হবে।লাড্ডু প্রসাদ নেবার জন্য হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, ওকে প্রসাদ দিতে গেলেই আজকাল কেমন যেন একটু লজ্জা পাচ্ছে মৈথিলী। পুজোর জোগাড় করার ফাঁকে মৈথিলীও আড়চোখে দেখে ছেলেটাকে।এলোমেলো চুল,নরম দাড়ির রেখা, মায়াময় চোখদুটো যেন মৈথিলীর দিকে তাক করা।বাবার সাথে সাইকেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতেও মনে পড়ে সেই ছেলেটার কথা।মৈথিলী বাড়িতে এসে নিজেকে বার বার আয়নায় দেখছে, আনমনে ফিকফিক করে হেসে উঠছে, আর মনে মনে বলছে নিশ্চয় ছেলেটা পাগল, নাহলে ওমন ভ্যাবলার মতো কেন তাকিয়ে থাকে তার দিকে।অথচ আবার কবে শনিবার আসবে সেই ভেবে ছটফট করছে মৈথিলীও, এক অজানা টান অনুভব করছে, কিন্তু তার কারণ সে জানে না।ছেলেটার বোধহয় বর্ধমান শহরেই বাড়ি, হয়তো হনুমানজির মন্দিরের আশেপাশেই।
হনুমানজিকে খুব ভক্তি করে বোধহয়, প্রসাদ খেয়ে যায় যে রোজ, যতক্ষন পুজো হয় মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়েই তো থাকে, পুজোও দেখে, এসবই ভাবছে আজকাল মৈথিলী সারাক্ষন।হয়তো কিশোরী বয়সের প্রথম ভালোলাগা একেই বলে.. ধীরে ধীরে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকা মৈথিলীর অভ্যেসে পরিণত হলো, ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মৈথিলী খুঁজে পেত নিজেকে,যেন অনেককিছু বলতে চায় ঐ চোখদুটো।তবুও বাবার চোখ এড়িয়ে কথা বলার সাহস হয়নি কখনোও।প্রসাদ দেওয়ার সময় আলতো করে ছুয়ে যায় হাতদুটো,লজ্জা গড়িয়ে পড়ে মৈথিলীর চোখেমুখে।ছেলেটাও আজকাল দু-একটুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয়।
আজ রামনবমী।হনুমানজির মন্দিরের বাৎসরিক উৎসব।তাই আজ সকাল সকাল স্নান করে নতুন একটা চুড়িদার পরে নিয়েছে মৈথিলী, চোখে হালকা করে কাজল টেনেছে,একটা হালকা দুলও পরেছে কানে।আজ মন্দিরে খুব ভীড় হবে, খাওয়া দাওয়াও হবে, নিশ্চয় আজ আসবে ছেলেটা, সেই ফাঁকে আজ একবার হলেও কথা বলতেই হবে ওর সাথে, মৈথিলী মনে মনে স্থির করে নিয়েছে।আসলে কিশোরী বয়সের ভালোলাগা বড্ড দুঃসাহসিক, বড্ড আবেগের,শুধু ভালোলাগার জন্য একটা সম্পূর্ণ অজানা ছেলের সাথে কথা বলতেও ভীষণভাবে মন টানে।
মন্দিরে এসে থেকেই দেখছে মন্দির কমিটির লোকজন ভীড় সামাল দিচ্ছে।মন্দিরের একপাশে ত্রিপল খাঁচিয়ে লুচি,তরকারি রান্না হচ্ছে।পুজো হলেই প্রসাদ বিতরন হবে।মৈথিলী আজ বার বার পুজোর জোগাড়ে ভুল করছে, বাবা একটু অসন্তুষ্টও হচ্ছে।তার চোখ কেবল এদিক ওদিক খুঁজকে বাদামী চোখের তারার,ফরসা টুকটুকে চেহারার সেই ছেলেটাকে।অস্থির হয়ে উঠছে মৈথিলী, পুজো তো প্রায় শেষ অথচ সে এলো না,প্রতিদিন তো আসে, আজ তাহলে কি হলো,চোখে জল এসে গেলো তার……
হঠাৎ প্রসাদের লাইনে চিৎকার শুনে মৈথিলী ওর বাবার পেছন পেছন ছুটে গেলো।মন্দির কমিটির কয়েকজন লোক বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, ওদের মধ্যে মারপিট লেগেছে মনে হচ্ছে।কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলো ওরা সবাই মিলে একটা ছেলেকে মারছে, আর ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি মিনতি করছে, “কাকু ছেড়ে দাও আমি আর কখনো আসবোনা, ক্ষমা করে দাও কাকু, আমে বুঝতে পারিনি আমাকে মন্দিরের প্রসাদ খেতে নেই”। অবাক চোখে মৈথিলী ছেলেটার মুখটা দেখছে,গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অজস্র নোনতা জল,তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁটদুটো।আচমকাই ভীড়ের মধ্যে ঢুকে,ছেলেটার মাথা ফেটে গড়িয়ে পড়া রক্তটা হাতে করে চেপে নিজের ওড়নাটা বেঁধে দিলো মৈথিলী।পুরোহিতের মেয়েকে দেখে সবাই একটু একটু করে সরে গেলো, পাশ থেকে দু-চারজন কয়েকটা নোংরা কথাও ছুঁড়ে দিলো।তবুও সকাল থেকে খুঁজে যাওয়া, সেই বাদামী চোখের ছেলেটার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে রইলো মৈথিলী, জিজ্ঞাসুচোখে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটির দিকে……আধো আধো গলায় ছেলেটি বললো, আমার নাম জোসেফ,খৃষ্টানপাড়ায় থাকি….
চকিতে একটা ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো মৈথিলীর সারা শরীরে। ভয়ে ভয়ে মুখটা তুলে ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকালো,নরম হৃদয়ে ধর্মের হিংসা এখনো প্রবেশ করেনি যে।সবটা বুঝতে পেরে ধীর পায়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসছেন তিনি, উত্তেজিত জনতা স্তব্ধ হয়ে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে,হয়তো মেয়েকে চরম ভর্ৎসনা করবেন খৃস্টান ছেলেটিকে বাঁচানোর অপরাধে,হিন্দু না হয়ে রামনবমীর প্রসাদ খেতে আসে কোন সাহসে…
সবাইকে অবাক করে তিনি মেয়ের পাশে বসে একটা গ্লাসে জল নিয়ে খানিকটা খাইয়ে দিলেন ছেলেটাকে এবং গলা খাঁকারি দিয়ে উত্তেজিত কমিটির লোকেদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “ও প্রত্যেক শনি মঙ্গলবার মন্দিরে আসে, পুজো দেখে প্রসাদ খায়,হয়তো প্রসাদ খেতে ভালোবাসে বলে প্রসাদের লোভেই দাঁড়িয়ে থাকে…এতটুকু তো প্রাণ, জাত-ধর্মের কিই বা বোঝে, আর তোমরাই বা কতটুকু বোঝো যে এমনভাবে মারলে…”আস্তে আস্তে একটু গুনগুন করতে করতে ফাঁকা হয়ে গেলো ভীড়টা।বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে মৈথিলী।হয়তো আজ বাবা না থাকলে এই টুকরো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরী হতো এক ভয়ঙ্কর ধর্মের দাঙ্গা।আসলে কিছু দাঙ্গাবাজরা দাঙ্গা করার ছুতো খোঁজে কেবল, প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী কোনো মানুষ কখনও দাঙ্গাকে প্রশ্রয় দেয়না আর অন্যের ধর্মকে ঘৃণা করেনা।যাঁরা নিজের ধর্মকে ভালোভাবে জেনে নিজের ধর্মকে ভালোবাসেন,তাঁরা অন্য ধর্মকেও সমানভাবে শ্রদ্ধা করেন।
জোসেফ এসবের মাঝে সবকিছু ভুলে দুচোখ ভরে দেখছে তার প্রেয়সীকে….