– দয়া করে তোরা থাম, জামাই বাবাজীদের থামতে বল,মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার মধ্যে সবাই মিলে আর গোল পাকাস না।
কোলাহল টা থেমে গিয়ে ফিসফিসানি তে পৌঁছে গেলো। নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলেন রুক্মিনী দেবী, মন্মথ রায়ের স্ত্রী, সোনালী, রুপালী, দীপালী ও পূবালীর মা।
আজ ছয় দিন হয়ে গেলো মন্মথ রায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। কোথায় গেলেন কে জানে, ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে রোজকার মতো হাঁটতে বেরিয়ে গেছিলেন। বেলা বাড়তে যেই তিনি ফিরলেন না ,তখন ভুতুকে পাঠালেন তার খোঁজে রুক্মিনী। নাহ্ খুঁজে হন্যে হয়ে গেলেও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না তার। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো মন্মথ বাবুর নিখোঁজের খবর।
খানিক পরে হইহই করে বড় মেয়ে ও জামাই এসে পড়লো। তারা বাড়ির কাছেই থাকে, সেজ মেয়ে দীপালী ও থাকে বাপের বাড়ির কাছাকাছি। সোনালী এসে সামনে ভুতুকে দেখে জিগ্যেস করে- মা কোথায় রে, কখন জানলি যে বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না? দীপু কি এসে গেছে?
-মা ওপরের ঘরে আছে, সকাল ৭. ৩০এ যখন বড় মা চা নিয়ে…
-ওরে থাম মুখ পোড়া আর বলতে হবে না, দীপু কি এসে গেছে? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো সোনালী!
-না সেজদিদি এখোনো আসে নি বড় দিদি।
বড় জামাই তমালের উদ্দেশ্যে সোনালী চাপা গলায় বললো- দেখছো কেন এতো তাড়াহুড়ো করছিলাম? তোমার তো আঠের মাসে বছর ,ওরা যদি আগে চলে আসতো তো! মা কি ভাবতো না যে আমরা কোনো চিন্তাই করি না! হঠাৎ ভুতুর দিকে নজর যেতেই বললো” হতচ্ছাড়া ,এখানে দাঁড়িয়ে কথা গিলছে দেখো কেমন যাহ্ বড় দাদাবাবুর জন্য এক গ্লাস গ্লুকোজ গুলে জল নিয়ে আয়, তেতে পুড়ে খবর পেয়েই ছুটে এসেছে, আমায় একটু দিস” খবর শোনার পর থেকে… মা, মা গো, কী সর্বনাশ হলো গো আমাদের বলে মরা কান্না জুড়ে দিলো সে।
দীপু এসে জিগ্যেস করলো- কি রে বড়দি, কোনো খারাপ খবর পেলি নাকি? বাবা কি আর…
আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সোনালী বললো- চুপ কর, চুপ কর, ওসব কথা মনে ও আনিস না, রক্ষাকালী মা আমার! আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও মা! জোড়া পাঁঠা, নাহ্ পাঁঠা মানত করলাম মা !ভুতুর হাত থেকে গ্লুকোজের জলটা এক ঢোকে খেয়ে নিয়ে অপরটি তমালের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
দীপু কিছু বলার আগে বললো ,শোনার পর থেকে মুখে জল তুলতে পারিনি, আর তোর বড় জামাই বাবুতো শোনার পর থেকে কি অস্থির! কি অস্থির!আসলে বাবাকে অনেক সময় কাছে পেয়েছে তো টান তো হবেই। আর বাবা তো তমাল বাবাজী বলেই অস্থির।
-সে তুমি যা বলেছো! বাবার পিছে পিছে ঘুরে ছিলো বলেই না বুদ্ধিসুদ্ধি বেড়েছে। যাই হোক, দেখি আবার আমার টা গেলো কোথায়? সেই শোনার পর থেকে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। মেজদিদি ও ছোটনকে খবর দেওয়া ,থানা পুলিশ! উফফ্ বাবাটা যে কি করে না বলা নেই, কয়া নেই হঠাৎ করেই…
-তা বড়দি শোনো, মেজদি ও ছোটন আসার আগে একটা দরকারী কথা সেরে নি, বিশ্ব বলছিলো ঐ যে আম বাগানটা বাবার, যেটা বিশ্ব দেখাশোনা করে সেটা কিন্তু আমাদের চাই, তুমি আবার ওতে কোনো বাগড়া দিও না!
-শোন দীপু, আমি ও তোকে বলে রাখি এই বাড়িটা কিন্তু আমার লাগবে, কত দিন আর ছেলে মেয়ে নিয়ে ঐ পায়রার মতো খোপে থাকবো, তখন যেন তোরা, মানে বিশ্ব নাক না গলায়, ওর তো সবকিছু তে নাক গলানো অভ্যেস!
তার কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করে মা, মা করে ওপরে ছুটলো, বিশ্বর জন্যই যত দেরী হয়ে গেল তার, মায়ের কাছে আগে পৌঁছানোর জন্য বড় বড় করে পা ফেলতে লাগল।
সোনালী মনে মনে বললো- কি চালাক রে বাবা, পরে এসে মায়ের কাছে আগে নাম কেনার চেষ্টা, ঐ জন্যই বলে বেঁটেদের গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি! ধ্যাত্ ভালো লাগে না, মা, ও মা করো সেও মায়ের ঘরের দিকে ছুটলো।
পূবালী পৌঁছালো রাত এগারোটার দিকে, এসে এমন মরা কান্না জুড়ে দিলো যে ওর কোলের মেয়েটাও ভয়ে কেঁদে উঠলো! রুক্মিনী দেবী বললেন ছোটন যাও, হাত মুখ ধুয়ে নাও, মেয়েকে খাইয়ে নিজেরাও কিছু খেতে নাও। তোমার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার মানে এই নয় যে উনি মারা গেছেন! অযথা মরা কান্না জুড়ো না বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে।
সে কান্না থামিয়ে দিয়ে দেখলো বড়দি, সেজদি ওর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে, বুড়ো শ্বশুরটাই যত নষ্টের গোড়া, ঘুম থেকে উঠেই রঞ্জনকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে, নইলে তিন ঘন্টা তো মোটে পথ, দুপুরের মধ্যেই চলে আসতে পারতো। ঐ বুড়ো না মরা পর্যন্ত শান্তি নেই তার জীবনে।
সকাল নটার দিকে সপরিবারে রুপালী ঢুকেই মা কে ডাকতে ডাকতে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বললো- বড় দিদি কোনো খবর পেলে বাবার, শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার হৃৎপিন্ড টা যেন কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে, ও বাবা কি এমন কষ্ট পেলে গো, যে তোমায় এ বয়েসে চলে যেতে হলো। আমি তোমার কাছে থাকলে এমনটা হতোই না। বাবা ও বাবা কার ওপর অভিমান করে চলে গেলে গো!
কানে সবই আসছিলো রুক্মিনী দেবীর, যে টুকু আসেনি তা ভুতুই তাকে বলেছে। মেয়েদের কথা শুনে বুঝে গেছেন তাদের মনোভাব, আর জামাইদের কথা কি বলবেন, ওরা তো পরের সন্তান! এই জন্যই তো “যম, জামাই, ভাগ্না, কভু হয় না আপনা “বলে।
কর্তার খোঁজ যে করেই হোক পেতেই হবে, কর্তার এক বন্ধুর ছেলে বিকাশ যে পুলিশে কাজ করে তার সাথে কথা বলেছেন ,দেখা যাক সে কি খবর আনে।
কদিন ধরে একটা অশান্তি ছিলো কর্তার মধ্যে। এই বিষয় আশয়, সম্পত্তি নিয়ে, কাকে কি দেবেন, এসব নিয়ে! ঠাকুর ভালো রাখুক ওকে ,ফিরলেই এসব বিলিয়ে কাশীবাসী হবেন।
তিন দিন পর রুপালী বললো -তুই যে খুব বললি দিদি ,এখন চুপ করে থাক!তো কতদিন চুপ করে বসে থাকবো বল তো? ছেলেটা মাধ্যমিক দেবে, কত পড়া নষ্ট হচ্ছে বলতো? আর নিপেনের কত দায়িত্ব আছে বলতো কাজের! ফোনের পর ফোন এসেই যাচ্ছে, ও কত দিন বসে থেকে শোক পালন করবে? মা কে দেখছি তো কোনো শোক তাপের বালাই নেই, এই যে এতোদিন পরে এলাম, কোনো কথাই নেই দেখছি তো? আমি তো তোমাদের মতো ঘরের দুয়ারে থাকি না যে ছুটে ছুটে আসবো, তোমরা যখন সবাই আছো বলে রাখি আমি কিন্তু মায়ের গয়না গুলো নেবো, আমার বিয়েতে সবচেয়ে বাবা কম গয়না দিয়েছে। পূবালী তার কথা শুনে বলে- বাহ্ ভালোই ওসব তোমরা নাও, আমার কিন্তু বাবার সব ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স চাই, আমি ওখানে একটা ১২০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট বুক করেছি।
কখন যে রুক্মিনী দেবী ওখানে এসেছেন কেউ খেয়ালই করে নি।
তিনি এসে বললেন- তোদের বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু তিনি এখোনো বেঁচে আছেন। তার মধ্যেই তোরা বিষয় আশয় নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছিস। তোদের বাবা ঠিকই বলতেন যে তিনি চোখ বুজলেই আমার দুর্গতির শেষ থাকবেনা,এখন দেখছি তোরা আসার পর থেকে এসব নিয়ে আলোচনা করছিস।
-নাহ্ মা আমরা তো….
-থাম ,আমার কথা এখোনো শেষ হয়নি !থমতম খেয়ে সবাই থেমে যায়।
তিনি বলেন- তোদের বাবার বন্ধুর ছেলে বিকাশ খোঁজ এনেছে তোদের বাবা বেনারসে গুরুদেবের আশ্রমে গেছেন। সেখানে একটা আশ্রম সংস্কার কাজ চলছে। তিনি সেই খরচ বহন করবেন, এটা তার অনেক দিনের ইচ্ছে, উনি খাম খেয়ালী মানুষ হলেও অত্যন্ত সৎ ,ওনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো কাজ করিনি।
উনি অাগেই তোদের সবার নামে সম্পত্তি ভাগ করে রেখেছেন। বাড়িটা আমরা ভুতুকেই দেবো। সেই ছোট্ট থেকে ও আমাদের বাড়িতে থাকে, আমাদের খেয়াল রাখে, শেষ জীবনটায় ও আমাদের দেখাশোনা করবে। বিয়েতে তোদের কমবেশী, যতটুকু যখন যেমন পেরেছি দিয়েছি। আমার গয়না গুলো আমার সব নাতি নাতনী ও ভুতুর বউ বাচ্চাদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেবো। টাকা যা আছে তা আমাদের ভবিষ্যতের সম্বল। আম বাগান খানি আমাদের মতো অসহায় মানুষের কাজে লাগবে। তোরা তোদের সংসার ছেড়ে এসেছিস, অনেক মূল্যবান সময় জামাই বাবাজীদের নষ্ট হয়েছে। এবার তোরা সবাই তোদের সংসারে ফিরে যা। আমি কালই তোদের বাবার কাছে গুরুদেবের আশ্রমে যাবো। ভুতু আমাকে গিয়ে রেখে আসবে। বাবা ফেরার পর একদিন কোনো ভালো দিন দেখে তোদের ডেকে পাঠাবো, তখন সবাই এসে। এই বলে রুক্মিনী দেবী ভুতুকে ডাকতে ডাকতে নিজের ঘরে দিকে পা বাড়ালেন।
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো মেয়েরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাউই করতে লাগলো।