“আমাদের আশীর্বাদ করবে না ঠাম্মা ও বাড়ি যাবার আগে?”লাল বেনারসি,চন্দনে রাঙা পেখম কথাগুলো বলে ওর ঠাকুমা যোগমায়াদেবীর উদ্দেশ্যে।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আজ মনটা বড়ই উদাস ওনার।কোন ছোটবেলায় মা মরা আদরের নাতনিটাকে আজ ছেড়ে দিতে হবে।শ্বশুরবাড়ি রওনা দেবে যে ও আর একটু পর।যাইহোক মন শক্ত করে এবার চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নাতনির দিকে ফেরেন যোগমায়াদেবী।মৃদু হেসে বলেন,”ও বাড়ি কি বলছিস দিদিভাই।আজ থেকে ওটাই যে তোর নিজের বাড়ি।লক্ষ্মী হয়ে থাকবি ওখানে সকলের সাথে, ওদের সকলকে আপন করে নিবি বুঝলি?আর নাতজমাই অঙ্কুশকেও ভালো রাখবি সবসময়।”ঠাম্মার কথায় ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায় পেখম।শুরু হয় কন্যাবিদায়ের আগে আশীর্বাদ পর্ব।শঙ্খ বেজে ওঠে।
আশীর্বাদ পর্ব মেটার পর ঠাকুমা পেখমের মন হালকা করার জন্য নাতজামাই অঙ্কুশ ওরফে কুশের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলেন ঠাট্টা করে বলেন,”নাও দেখি কুশ এবার আমার ওই পাগলীটাকে তুমি সামলে রাখ।আমার তো বয়স হয়েছে আর কতদিন বলো?এবার ওর দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে কাশী থেকে ঘুরে আসব বেশ কিছুদিনের জন্য।”অঙ্কুশ ওনার হাত ধরে বলে সবসময় পেখমকে ভালো রাখার চেষ্টা করব ঠাম্মি,এবার আমাদের বেরোনোর অনুমতি দাও।অনেক দূরের রাস্তা যেতে হবে যে।”
বিসমিল্লাহর সানাইয়ের বিদায়ী সুর কানে নিয়ে অঙ্কুশের সাথে গাড়িতে ওঠে নববধূ পেখম।গাড়ি এগোতে শুরু করে সামনের দিকে,পেখমের চোখে জল।এতদিনের রক্তের সম্পর্কগুলোর টান কাটা কি এতই সহজ?ইতিমধ্যেই অঙ্কুশ ওকে বোঝাবার চেষ্টা করে,আঙুল ছুঁয়ে ভরসা দেয়।কিন্তু পেখম আজ খুব অভিমানী।শেষ দুপুরের আলোয় চোখ রাখে গাড়ির কাঁচের বাইরে।মনে ভিড় আসে অনেক প্রশ্ন।যে নিজের বাড়িতে এতদিন ধরে পেখম ধীরে ধীরে বড় হল সেটা কি একনিমেষে বিয়ের পর বাপেরবাড়ি তকমা পেয়ে যায়?আর সেই দিক শ্বশুরবাড়ি সেটাও তো মেয়েদের নিজের বাড়ি নয়।তাহলে মেয়েদের নিজের আসল বাড়ি কোনটা?ঠাকুমার হাতে আমজারানো খাওয়া থেকে বড় পরীক্ষা দেবার আগে কপালে চন্দনের ফোঁটা একে দিত যে বাবা তারা কি এক লহমায় বিয়ের পরই পরজন হয়ে যায়?নিজের মায়ের কথা তো মনেও পড়ে না ঠিকমত পেখমের। শুধু একটা আবছায়া মূর্তির মত ঝাপসা একটা স্মৃতি উকি দিয়ে যায় মাঝেমধ্যে।ওর বাবা আর ঠাকুমা মিলেই তো ওকে মানুষ করে আজ অঙ্কুশের হাতে সমর্পণ করে দিল।বাবার এক পরিচিত বন্ধুর মারফত ওদের বিয়ে হল আরামবাগে। মানুষ হিসেবে অঙ্কুশ বেশ ভালো, অন্তত বিয়ে ঠিক হবার পর যতদিন কথা হয়েছে।কিন্তু ওর বাড়ির মানুষরা আবার কেমন হবে?চারদিকে যা ঘটছে তাই দেখে পেখমের খুব ভয় করে।”
এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝেই কখন যে পৌঁছে গেছে গন্তব্যে খেয়াল করেনি পেখম।হুশ ফেরে অঙ্কুশের গলা শুনে,”নেমে এসো পেখম,এসে গেছি আমরা।ওই দেখ মা দাঁড়িয়ে আছে”,ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরে নামে পেখম।শুরু হয় বধূবরণ পর্ব। একে একে সমস্ত স্ত্রী আচার সেরে পেখমকে ওর ঘরে বিশ্রামের নিয়ে যায় বাড়ির অন্য মহিলারা।মাথাটা হালকা ধরেছে পেখমের যা ধকল যাচ্ছে সেই বিয়ের দিন সকাল থেকে।আলোটা নিভিয়ে বসে ও।একটা ওষুধ হলে মন্দ হতনা।কিন্তু কাকে বলবে,আজ তো আবার কালরাত কুশকেও ডেকে কিছু বলা যাবেনা।বাড়িতে থাকতে মাথা ব্যথা হলে ঠাম্মি কেমন আদা চা বানিয়ে দিত,ওমনি এক নিমেষে ব্যথা গায়েব হয়ে যেত।আচ্ছা পেখম চলে আসার পর ওরা কি করছে এখন।বাবা প্রেসারের ওষুধটা খেয়েছে তো ঠিকমত?আর ঠাম্মি ছাদ থেকে জামাকাপড় সব মনে করে নামিয়েছে কিনা কে জানে!এমনসময় পেখম অনুভব করে একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ ওর কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে আর বলছে,”কি রে পাগলি মনখারাপ করছে বুঝি তোর বাড়ির জন্য?”
চোখ খুলে পেখম দেখে অঙ্কুশের মা নিভাদেবী দাঁড়িয়ে।ওকে দেখে হেসে বলেন,”নে এই আদা চা টা বানিয়ে আনলাম।অনেক ধকল গেছে খেয়ে নে দেখবি তোর ভালো লাগবে।”
__”মা তুমি কি করে জানলে আমার বাড়ির জন্য মনখারাপ করছে?আর আদা চা আমার প্রিয় সেটাও বা কি করে…?”ওর কথা শেষ হতে না হতেই পেখমের কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিভাদেবী বলেন ,”কি করে জানলাম তোর মনের মধ্যে কি চলছে এটাই জিজ্ঞাসা করবি আমাকে তাইতো? আমি শুধু একটাই কথা বলব তোর বয়স্ টা আমিও একদিন পার করে এসছি। আমিও একদিন কোনো না কোনো বাড়ি থেকে নববধূরূপে এই বাড়ি পা রেখেছিলাম।মেয়েদের যে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় রে… তবে নিজের বাড়ির বিকল্প কিছু হয় না রে পেখম।বড়জোর আমরা মেয়েরা বিয়ের পর আরেকটা পরিবার পাই।আর তারপর সুখদুঃখের উলকাঁটা বুনে সেটা দিয়ে তৈরী হয় আরেকটা রূপকথার সংসার।
কথাগুলো শুনতে শুনতে পেখমের চোখে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর দানার মতো জলের ফোঁটারা এসে টুপটাপ ঝরে পড়ে।স্বপ্নে আসা দুর্গামন্ডপে দাঁড়ানো নিজের মায়ের সেই ঝাপসা ছবিটার কথা মনে পড়ে আজ আবার।সেই মুখের সাথে আজ অঙ্কুশের মায়ের কোনো পার্থক্য নেই।অস্ফুটে ও বলে,”মা উঠে দাঁড়াও তো একবার প্রণাম করব তোমাকে।”
__”কেন রে পাগলি একটু আগেই তো করলি আবার করবি কেন?” উনি বলেন।
মৃদু হেসে ওনাকে জড়িয়ে ধরে পেখম বলে,”আগে নিয়ম মেনে করেছিলাম আর এখন মন থেকে তোমায় অনুভব করে প্রণাম করতে চাই মা।নাহলে বোধয় সন্তানের মনের মধ্যে কি চলে কারুর বোঝার সাধ্য নেই।”
__”আচ্ছা নে দেখি অনেক হয়েছে মায়ের সঙ্গে খুনসুটি। এবার বাড়িতে ঝটপট ফোন করে ফেল ওনারা যে তোর গলা শুনতে না পেলে শান্তি পাবেন না ঠিকমত। আর ওদের সাথে কথা হয়ে গেলে আমার ছেলেটাকেও একটা ফোন করে নিস। বেচারী একা গুমরে মরছে ও ঘরে।” উনি বলেন।
“ধ্যাত কি যে বলো মা তুমি,থাক ও, আমার ভারী বয়েই গেছে”লজ্জায় রাঙা হয় পেখমের মুখ।ফোন ওঠায় ও।ওদিক থেকে ভেসে আসে বাবার গলা,”কি রে পেখম ঠিক আছিস তো তুই ও বাড়িতে।আমি একটু পরেই তোকে ফোন করতাম রে, তোর ঠাকুমা ও বলছিল।তার আগেই তুই কেমন মনের কথা বুঝে করে ফেললি দেখ!”
__”হ্যাঁ বাবা খুব ভালো আছি, আজ থেকে যে নিজের বাড়ির পাশাপাশি আরেকটা বাড়ি পেলাম আর সেই সাথে মাকে ফিরে পেলাম বহুযুগের ওপার থেকে ঝাপসা ছবিটা জীবন্ত হয়ে উঠলো। সাবধানে থাকো তুমি আর ঠাম্মি।আমি আর কুশ খুব তাড়াতাড়ি যাব বাড়িতে। এখন ছাড়লাম।”ফোন রেখে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় পেখম।এক ঝলক দখিনা বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় ওকে।
মনেমনে ও অনুভব করে অঙ্কুশকে বিয়ে করে ও কোনো ভুল করেনি।শুধু স্বামীত্বের অধিকারে পরিবারে ঠাই নয় পেখম আসলে আরেকটা নিজের পরিবার পেয়েছে যে।অঙ্কুশদের বাড়িতে তখন মাইকে ধিমি সুরে বাজছে,”এইতো হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে/এই জীবনে যে কটি দিন পাবো/তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোঁহে/স্বপ্ন মধুর মোহে।”
(সমাপ্ত)