সেল

সেল

এস্প্ল্যানেড সবাই চেনেন নিশ্চই??হু, মেট্রো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আগে যেখানে মেট্রো সিনেমা হল ছিল, তার সামনেই দোকান ছিল আমাদের।এখন তো শপিং মল হয়েছে, তাই ওখান থেকে একটু হেঁটে নিউ মার্কেটের ঠিক সামনেই এখন আমাদের দোকান।আমাদের মানে বাবার।আমার বাবার নাম আফসার আলী, মাকে তো জন্ম থেকেই দেখিনি।শুনেছি পালিয়ে গেছে নাকি! থাকি আমরা পার্ক সার্কাসের তিলজলার কাছে।আমার আব্বু মানে বাবার এক ছেলে আর এক মেয়ে, বোনের নাম নাফিসা, আর আমি! আমি হলাম নূর, তবে গল্পটা আমার নয়।

বাবার ব্যবসা বলতে টুপির।মানে বাবা ধরে ধরে সবাইকে টুপি পরায়।না না, সত্যি কারের টুপি কিন্তু! স্কুলে যাওয়ার সময় দেখে যেতাম, বাবা ঘাড়ে একটা রুমাল নিয়ে বসে থাকত।বার বার উঠে সাজিয়ে রাখা টুপি গুলোর ওপর পড়া ধুলো পরিষ্কার করত।একটা কথা শিখিয়েছিল,

-বাবু, আর যাই হোক, মিথ্যে বলিস না।দেখবি দিনের শেষে স্বস্তির ঘুমটা আসবে চোখে।
ব্যস আমার বোকা আব্বুকে কে বোঝাবে? যুগটাই মিথ্যের যে!
ফুটে বসার একটি বিপদ ছিল যখন তখন এসে পুলিশ অত্যাচার করত, উচ্ছেদ করবে বলে।বে আইনি যে!
বাবাকে দেখতাম ইচ্ছের বিরুদ্ধে পকেট থেকে টাকা বার করে হাতে গুঁজে দিতে ওদের।তাতে আর কি! কিছুদিন পর আবার আসবে ওরা।

তিলজলা মানে আমাদের বাড়িটা ছিল একদম বস্তির ভেতর।স্কুলে যাওয়ার সময় একটা মাঠ পেরিয়ে যেতে হত।এই মাঠের কোন একদিন দেখা হলো ওঁর সাথে।ওঁ টা ঠাকুমা, নাম , নামটা জানি না।

আগের বছর ঈদে চাচীর ঘর থেকে ফেরত আসার সময় দেখেছিলাম ওঁকে।অর্ধনগ্ন প্রায়, কিছু বাচ্চা ঢিল মারছে।ওদের তাড়িয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম, বসে একা, ভ্রূক্ষেপ নেই কিছুর।হাতে রাখা পায়েসের বাটি সামনে রাখতেই গিললো যেন।হঠাৎ দু হাত দিয়ে মুখটা ধরে দেখে ছেড়ে দিল এক ঝটকায়।বললাম,
-দাদী
সাড়া নেই, বললাম,
-আমি নূর, ও দাদী!

চলে এলাম।সারা রাত ঘুমাতে পারিনি সেদিন, শুধু মনে হচ্ছিল এই ছুটে দাদীর কাছে চলে যাই।প্রায় দেখা হত ফেরার পথে।এক দৃষ্টিতে দেখত, একটু গাল, আর মাথায় আদর করতাম।চুপ করে থাকত, না ঢিল মারেনি আমায়।
সেদিন সকালে আব্বু,

-আজ এসে নাফিসা কে খাইয়ে দিস, দেরী হবে ফিরতে।
এই সময়টা আব্বু খুব কষ্টে থাকে।সারাদিনের হেরে যাওয়া মানুষটা একটু কষ্টের ছিটে ফোঁটা বুঝতে না দিলেও বুঝি সব।আসলে চৈত্র মাসের শেষ, এ সময়টা বড় বড় দোকানে সেলে কাপড় জামা আরো অনেক কিছু পাওয়া যায়।কাস্টোমারেরা আর কেনই বা ফুট থেকে জিনিস কিনবে! বাবার মতই অনেকে দিনের শেষে দীর্ঘশ্বাস নাহলে বাংলার একটা বোতল নিয়ে ফেরে।আবার পরের দিন থেকে শুরু করতে হবে তো যুদ্ধটা!
রাতে বোন ঢুকল ঘরে, দেখে বলল,
-দাদা , ছিল আজ দোকানে ওটা?
তাকিয়ে বললাম,

-হু
চলে গেল ও , এবার না কান্নাটা গলা দিয়ে উঠছে যেন! একটা সালওয়ার, বোনের খুব পছন্দ, না কিনতে বলেনি আমায়।শুধু যখন দোকানের পাশ দিয়ে যায়, অসহায় মুখ দেখে নিজেকে মনে হয়,
-আল্লাহ ,কিছু তো দিয়ে পাঠাতে পারতে।

দুটো টিউশনি করাই, ভেবেছিলাম টাকাটা পেলে নিশ্চই সেলে দামটা আরো কমবে, তাই চুপি চুপি বোনটাকে তাক লাগিয়ে দেব।

রবিবার দিন মাইনে পেয়ে , ছুট্টে গেলাম দোকানে, বললাম দোকানদার কে,
-ওই সালওয়ার টা কত?
বলল,
-দেখার জন্য?
হেভি রাগ ধরল আমার, বললাম,
-বাংলা বোঝো না?
বলল,
-৮০০
হাতে গুনে দেখলাম সব চলে যাবে, হেঁটে ফিরতে হবে, বললাম,
-দাও।

কি আনন্দ আমার! এখন শুধু ওর স্কুল থেকে ফেরার অপেক্ষা। হাঁটতে হাঁটতে মাঠের পাশ দিয়ে এসে দেখি, খুব ভীড়! কি মনে হলো, ভীড় সরিয়ে দেখলাম দাদীকে, আজ আর গায়ে কিছু নেই! কি হাসছে সবাই! মনে হচ্ছিল সব কটাকে ধরে এক্ষুনি অন্ধ করে দিই।এক ছুট্টে ওই দোকানে এলাম আবার, বললাম
-শাড়ি পাওয়া যায়?
বলল,
-হ্যাঁ কেন?
বললাম,
-এই জামাটা রাখুন , শাড়ি দিন দুটো।
দুটো শাড়ি নিয়ে দৌড় মারতে যাব, বলল,
-দাঁড়াও পয়সা পাবে।
একটু দাঁড়িয়ে বললাম,

-রেখে দিন, এতদিনের কাঁচের বাইরে থেকে দেখার পয়সা ভেবে ।
মুখটা আর দেখা হয়নি ওনার।দৌড়ে মাঠে এসে দেখি, দাদী উঠে বসেছে।দৌড়ে এসে কাপড় টা জড়িয়ে দিলাম গায়ে, আর একটা ওর শতছিন্ন প্লাস্টিকে।এবার আদর করল আমায়, স্থির চাউনি টা আজ একটু অন্যরকম।বলল,

-নূর,নূর, নূর
আমি আর তাকাইনি পেছনে।বোনটা খুব খুশি হবে শুনলে।বলবে হয়ত,
-দাদা পরের সেলেই কিনে দিস।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত