বোকারাই নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে জানে বা ভালোবেসে অনেকেই বোকা বনে যায় । এমন কথা আকছার শোনা যায়। যাদের ভালোবাসা সার্থকতা পায় তাদের জন্য ভ্যালেন্টাইন্স ডে আর যারা বোকার মতো ভালোবাসে তাদের বরাদ্দ এপ্রিল ফুল ডে।
ভাবছেন নিশ্চই , গল্পের কি কম পড়িতেছে ? এতো ভাট বকছেন কেন ?? না না গল্প একটা আছে …একদম সত্যিকারের গল্প তাই বুঝতে পারছিনা শুরুটা কি ভাবে করি…কারণ মিথ্যে বলাটা বেশ সোজা কিন্তু সত্যি বলা যে বড্ড কঠিন। যাক মনের অ্যালবাম ঘেঁটে একটা গল্প বলি আপনাদের । ভালো লাগাবার গ্যারান্টি দিতে পারলাম না…তবু শুনুন
বেশ কিছুটা পেছনে যাই, মানে আমার কিশোরী বেলায়। আমার জেঠিমার বাপের বাড়ি ছিল ছোটবেলায় আমার খুব প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওই বাড়িতে জেঠিমার মা, দাদা, বৌদি আর তাদের দুই মেয়ে দোয়েল আর পায়েল থাকতো। দোয়েলদি তখনই কলেজে পড়তো আর পায়েল আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে। আমার খেলার সঙ্গী তাই ওদের বাড়ি যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। আর একজন ছিল ওই বাড়িতেই যাকে ছাড়া খেলা জমতোই না…পরেশদা । ওদের বাড়িতে খাওয়া-পড়ার কাজের লোক। বাজার করা, দিদাকে রান্নায় সাহায্য করা পায়েলকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া করা , বাগানের গাছে জল দেওয়া সব করতো হাসি মুখে। নেপালী, তবে বাড়ি পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো এক গ্রামে, নামটা আমার এখন আর মনে পড়ছে না বা হয়তো জানতামই না।
তা এই পরেশদা কে খেলায় নিতাম আমরা। ক্যারম, লুডো, চোর পুলিশ এমন কি রান্না বাটিতেও পরেশ দাকে থাকতে হতো…বাজার করতে যাবে কে? পরেশদা, আবার কে। চোর ডাকাত সামলে নিলেও ভূতে ভয় পেত খুব । আর ভীষণ সোজা সরল ছিল , মানে সোজা কথায় বোকা। তাই পরেশদা কে বোকা বানানো দুইবোনের প্রিয় খেলা ছিল । আমি গেলে আমিও মজা পেতাম কারণ বড়রা তো চালাক হয় দেখেছি কিন্তু কেউ যে বড় হয়েও বোকাই থেকে যায় এটা পরেশদা কে না দেখলে জানতাম না…. খুব মজা লাগতো।
তো এক বিকেলে পরেশদা ছাদে দাঁড়িয়েছিল আমি আর পায়েল গল্প করছিলাম আর দোয়েলদি দোলনায় বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ বলে উঠলো
-কি গো পরেশদা, প্রায়ই দেখি তুমি মুন্নিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকো, কি দেখো বলতো ?
পরেশদা অপ্রস্তুত হেসে বললো
-কিছু না তো, এমনি দেখছিলাম। পরেশদা নীচে নেমে গেল।
দিদির মুখে একটা হাসি খেলে গেল। পায়েল জিজ্ঞেস করলো
-কি রে দিদি , এবার কি প্ল্যান ? হাসছিস যখন নিশ্চই পরেশ দাকে বোকা বানাবার কোন মতলব পেয়েছিস ?
-পেয়েছি, এবার দারুন প্ল্যান।
-কি ? কি ? বল না !
-বলছি শোন। সামনের বাড়ির মুন্নিকে পরেশ দা মনে হয় পছন্দ করে । তাই এবারের গল্প পরেশ দার লাভ স্টোরি।
সবাই হেসে গড়াগড়ি।
আমি বললাম
-মুন্নি কে গো ?
দোয়েলদি বললো
-সামনের বাড়িতে থাকে। মুন্নির বাবা ডাক্তার ও নিজে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। কোথায় মুন্নি আর পরেশ কিন্তু দারুন মজা হবে তোরা শুধু দেখ।
দোয়েল দির ওপর আমাদের খুব আস্থা। বুঝলাম জব্বর কিছু হবে।
সপ্তাখানেক পর পায়েলের ফোন
-একবার আসিস, খেলা জমে গেছে। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটলাম ওদের বাড়ি।
যেতেই পায়েল বললো
– দিদি পরেশদা কে বলেছে মুন্নি ওর কাছে জানতে চেয়েছে আমাদের বাড়িতে যে হ্যান্ডসাম ছেলেটা থাকে, ব্রুসলির মতো দেখতে সে কে ?
শুনে আমি তো আমি থ ,
-মানে ! ওই মুন্নি , যে ডাক্তারি পড়ে সে পরেশ দার খোঁজ নিচ্ছে !! বলিস কি ?
-ধুর বোকা সত্যি করে তাই কখনো হয় নাকি , এটা তো খেলা। বলেই হাসি।
খেলা এগোতে থাকলো। মুন্নি দি যে প্রায় নিয়ম করে পরেশ দার খোঁজ খবর করে এটা দোয়েলদি খুব সহজেই পরেশ দাকে বিশ্বাস করিয়ে ফেললো। বারান্দায়, ছাদে আসে শুধু পরেশদা কে দেখবে বলে এই শুনে পরেশদার খুশি আর ধরে না। নিজের মনের ভুলকে মুন্নির ভালোবাসা ভাবতে থাকলো বোকা লোকটা। কখনো কখনো আবার বলতো
-জানতো আজ আমার দিকে তাকিয়েছিল । কোনোদিন হয়তো বলতো আজ মনে হয় হাসলো।
ওর বোকামি দেখে আমরা হেসে খুন। আর মুন্নি ? সে তো এসবের কিচ্ছু জানতোই না। দোয়েলদি সেই ইস্তক পরেশ দার চোখে ভগবান। এমনিতেই কেউ কোনো কাজের কথা বললে না বলতো না তায় এখন মুন্নির সব খবর যেহেতু দিদির কাছেই পাওয়া যাবে তাই বাড়িতে দিদির কদর সবচেয়ে বেশি। দিদি হুকুম করার আগেই সেটা তামিল হয়ে যেত। কিন্তু রিলেশনটা এগোচ্ছে না দেখে পরেশ দা মাঝে মাঝে একটু অধৈর্য্য হতো। দিদি বুঝিয়ে দেয় , বলে
-দেখো ওকে ভালো করে পড়াশুনা করতে দাও। ডাক্তারি তো কম ব্যাপার নয় অনেক পড়া, একবার পাস করে গেলেই ও তোমার সাথে কথা বলে নেবে। তারপর বাড়িতে বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু প্রেম করতে গিয়ে যদি ফেল করে যায় তাহলে কিন্তু সব গেলো।
পরেশ দা ভয় পেয়ে যেতো। বলতো
-না না থাক..আমার কোনো তাড়া নেই। ওকে রোজ দেখতে তো পাই এতেই হবে।
ওরে আমার দেবদাস রে ! হাসতে হাসতে পেতে খিল ধরতো আমাদের।
এমন করে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো।
একদিন দেখা গেলো পরেশ দার ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। সমবেত প্রশ্ন।
-কি হয়েছে পরেশদা ?
একটু চুপ থেকে বললো
-আজ দোকানে দেখা হয়েছিল। আমরা তো প্রবল উৎসাহী , -তারপর কি হলো !!!??
-সাথে একটা ছেলে ছিল। জিনিষ কিনে ছেলেটার হাত ধরে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। ইচ্ছে করছিল বলি বড়লোকের মেয়েরা এমনই হয় বুঝি ?
এই রে, কেস দেখছি স্যুটকেস ! দোয়েলদি বলে উঠলো
-তুমি কিছু বলো নি তো ?
-না বলি নি। কিন্তু এমন কেন করলো বলতো? আমি ওকে খুব সুখে রাখতাম । গত দু বছর বাড়িতে টাকাও পাঠাইনি। সব জমিয়েছি ওকে বিয়ে করবো বলে। বাড়িতে ওদের কি করে চলছে কে জানে। কিন্তু যার জন্য এত কষ্ট করলাম সে অন্য ছেলের হাত ধরে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল ! শহরের লোকেরাই এমন হয়। আমি দেশেই ফিরে যাব।
এই মরেছে ! পরেশদা কাজ ছেড়ে দিয়ে দোয়েলদি দের বাড়ির কি হবে ? এই বাজারে এমন বিশ্বাসী লোক কোথায় পাওয়া যাবে ? শুনেছি মাইনেও বেশ কম নেয়। ওই যে…বোকা বলে।
দোয়েলদি প্রমাদ গুনলো। পরেশদা কে অনেক বোঝালো যে সে মুন্নিকে বুঝিয়ে পথে আনবেই ।
পরেশ দার ছোট ছোট কুত্ কুতে চোখে এবার কিন্তু অবিশ্বাস স্পষ্ট। গ্রামের সহজ সরল নেপালী ছেলেটা আর যেন কলকাতার ভদ্র সমাজকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
মনটা আমারও খারাপ হয়ে গেছিল । এই খেলাটায় আর মজা লাগছিল না।
পরেশদা শেষের কদিন খুব মন মরা আর খিটখিটে হয়ে গেছিল তারপর একদিন কারুকে কিছু না বলে কাজ ছেড়ে চলে যায়।
কদিন অকূল পাথারে পড়ার পর আবার নতুন কাজের মেয়ে আসে ওদের বাড়িতে। মনের মধ্যে কিছু অপরাধ বোধ নিয়ে জীবন এগোতে থাকলো। পরেশদা কে আমরা আসতে আসতে ভুলতে শুরু করলাম। তারপর ভুলেই গেলাম।
প্রায় বছর দশেক পরে এক গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে দু হাতে চৈত্র সেলের ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠেছি। সিটে বসে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি উল্টো দিকের সিটে একটা নেপালী লোক বসে ঝিমোচ্ছে । মলিন জামা প্যান্ট। অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো পর পর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তখন ছোটো ছিলাম বুঝিনি কারুর ফিলিংস নিয়ে খেলাটা কতোটা অন্যায়। পরে বুঝতে পারি। একটা কাঁটা ফুটেই ছিল। আজ ওকে সামনে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। উঠে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। গায়ে অল্প ঠ্যালা দিয়ে ডাকলাম , পরেশদা !
চমকে উঠে তাকালো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
আমায় চেনার কথা নয়। এতো বছরে আমার চেহারা যথেষ্ট পাল্টে গেছে।
-বললাম চিনতে পারছো না ? আমি তুলি। দোয়েল – পায়েল এর বন্ধু।
একটু তাকিয়ে থেকে বললো ,
-পেরেছি , ছোটবেলায় তোমরা কত খেলতে আমার সাথে। কত বড় হয়ে গেছ তুমি।
-আমি বললাম চলো আমার বাড়ি। আমার ছেলে কে দেখবে চলো।
বললো
-না গো, মুন্নির বাবা আমার পেছনে পুলিশ লাগিয়েছে যখন তখন ধরে নিয়ে যাবে। আমি চট করে কাজ শেষ করেই ঘরে ফিরে যাব ।
বলার সময় মুখের ভাব সম্পূর্ণ বদলে গেল। আমার ভেতর টা কেঁপে উঠলো। কি বলবো বুঝতে পারলাম না। ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকা বের করে হাতে গুঁজে দিলাম। অবাক হলো আবার।
-এটা দিয়ে কিছু খেও।
আচ্ছা বলে পকেটে রাখলো টাকাটা।
আমার স্টপেজ এসে গেছে এবার নামতে হবে। হাতের প্যাকেট গুলো বড্ড ভারী লাগছে। এগুলো না কিনলে হয়তো ওকে আরো কিছু টাকা বেশি দিতে পারতাম। কিন্তু তাতেই কি আমাদের প্রায়শ্চিত্ত হতো ? জানি না।
সমাপ্ত