সকাল বেলা রায়ার নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে ম্যারাথন রেস চলে। স্বয়ং যমরাজ বা রায়ার ফেভারিট শাহরুখ খান এলেও তাদের বলতে হবে ঘুরে আসুন, কারণ তার বাড়ির হিরো আর একটু পরেই অফিস যাবে। তার খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুটি সময় মতো হাতের সামনে না পেলে কুছ কুছ হোতা হ্যায় থেকে প্রথমে হবে হাম আপকে হ্যায় কৌন তারপর হবে দঙ্গল।
এতবার করে বলার পর ও সন্ধ্যাদি দেরী করে আসবে আর এসেই দুনিয়ার বাহানা। তাতে ও কাজ না হলে তো আছেই এই বাড়ি, ঐ বাড়ি , সেই বাড়ির বৌদি কে কত ভাল, ও দেরি করে এলে ও কিছু বলে না, শুরু করে ফিরিস্তি দিতে।
রাগে হাতা খুন্তি ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছা করলে ও কিছু করার নেই। ভগবান কে ঠিকমতো ডাকলে তাঁকে ও পাওয়া যাবে, কিন্তু সন্ধ্যা ছেড়ে গেলে দিনে-দুপুরে সংসারে, জীবনে রাত ঘনিয়ে আসবে। সুতরাং এইসব শোনা আর হজম করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এহেন সন্ধ্যা সেদিন ঠিক সৈকত খেতে বসেছে আর এসে হাজির। রায়া ওকে চুপচাপ দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল , কিন্তু সৈকত বেড়িয়ে যেতেই আছড়ে পড়ল – অ বৌদি আজ মন টা ভাল নেই কো।
রায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল – কেন গো , কি হলো !
সন্ধ্যা এর অপেক্ষায় ছিল। চোখ – নাক মুছে , ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো – অ বৌদি এমন দুক্কু যে মোটে দেকা যায় নেকো।
অ বৌদি, তুমি কি কিচুই জানোনে!
রায়া একটু চিন্তা করে বলল – তুমি কার কথা বলছ সন্ধ্যা দি ? কার কি হয়েছে গো ! তুমি তো জানো আমি ঘর থেকে বেরোই কম।
রায়ার এ রকম অর্বাচীনের মতো উত্তর শুনে সন্ধ্যা অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বলল– এরজন্য ঘরের বার হতে যাবে কেন ! এতো ঘরে বসেই দেকার গো। বৌদি, সেজোখুকির কতা কইচি। অত্ত ভাল মেয়ে, মতুর এর মত সোয়ামী,রাসমনির মত মা, কিন্তু দিদিটা কে দেকো ! বলি একই মায়ের পেটের বোন তো তোরা। কি করে অমন করিস ! ছিঃ, এরা মানুষ নয় কো !
রায়া শুনে ভাবছে – এরা কারা ! আজকের যুগেও এরকম নাম ! তারপর হঠাৎ তার মনে পড়ল – আরে কিছুদিন আগে জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষ্যে যখন বাপের বাড়ি গেছিল তার মা আর ক্লাস থ্রি তে পড়া ভাইঝি তাকে রাসমনির সেজমেয়ে অর্থাৎ সন্ধ্যাদির সেজখুকির সাথে তো পরিচয় করিয়েছিল।
রায়া অত্যন্ত নিস্পৃহ ভাবে উত্তর দিল – সন্ধ্যাদি সেজোখুকির জন্য কান্নাকাটি পরে কোরো। আগে ঘরটা ভাল করে মোছো, তারপর জামা-কাপড়গুলো টানটান করে ছাদে মেলে দিয়ে এসো। বিকালের মধ্যে এগুলো শুকাতে হবে।
রায়ার এই মূর্তি দেখে সন্ধ্যা বিনা বাক্যব্যয়ে নিজের কাজে লেগে গেল। এদিকে রায়া বসে বসে ভাবতে লাগল – নাঃ, রাসমনির টাউর কাউকেই রেহাই দিল নে। অবশ্য তার পড়াশোনা জানা, ব্যাঙ্কে চাকরি থেকে অবসর নেওয়া মা আর ইংলিশ মিডিয়ামে ক্লাস থ্রি তে পড়া ভাইঝি যদি এর কবলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে তাহলে অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া আর তার সাথে বরের মার খাওয়া সন্ধ্যাদির মত মানুষদের দোষ কি ! এই সিরিয়ালগুলোর জন্য ই এরা একটু পরিবর্তনের স্বাদ পায়। এরাই সামাজিক। রায়ার মত মানুষেরা যারা সিরিয়ালের এসটাও দেখে না তারা বোধহয় সমাজ বহির্ভূত জীব। তাই, আজকাল সন্ধ্যা বেলা কারর বাড়ি কেউই যায় না। যেখানেই যাও হয় রানী রাসমনি নয় ফাগুন বৌ কিংবা বকুল কথা এইসব গল্প। কেউ বলে না – অমুক লেখকের অমুক বইটা পড়েছিস ? কেমন লাগল রে ? ঐ গায়কের ঐ গানটা শুনলি ? আহাঃ, কি গেয়েছে !
এই সিরিয়ালময় জগতে রায়া যখন বলে, সে সিরিয়াল দেখে না এবং তাতে লোকজনের যে প্রতিক্রিয়া দেখে, তাতে মনে হয় সত্যি বুঝি সে খুব ভূল করে ফেলেছে সিরিয়াল বর্জন করে।
রায়া নিজে অনুভব করে সে খুব ভাল আছে সিরিয়াল ছেড়ে। বাড়িতে অখন্ড শান্তি বিরাজ করে। সে প্রাণ ভরে গল্প পড়ে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কোনো এপিসোড ছেড়ে গেলে কোনো টেনশন নাই। পতি-পরমেশ্বর খুব খুশি, অফিস থেকে ফিরে খবর খাওয়ার জন্য বা ক্রিকেট – ফুটবল খেলা দেখার জন্য কোনো সমস্যা নেই।
সন্ধ্যাদি আর বেশি কথা না বলে কাজ শেষ করে যাওয়ার সময় বিড়বিড় করতে করতে গেল – কেমন ধারা মানুষ গো! বেঁইচে আচে কেমন করে। টাউর-দেবতাতে ও এট্টু ডর নেই কো।
সন্ধ্যাদি সেজখুকি কে ছেড়ে এই সিরিয়াল না দেখা বৌদির ভবিষ্যৎ চিন্তায় বেজার হয়ে ব্যানার্জী বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ও বাড়ির বৌদির সাতে কতা কয়ে সন্ধ্যার খুব সুক। ঐ বৌদি সব দেকে কি না ! কত্ত ভক্তি, কত্ত জ্ঞান… এমন মানুষদের সাতে দুটো কতা কয়ে মন টা শান্ত হয় আবার জেবন টা ও সাত্তক হয়।
ওদিকে সন্ধ্যা যাওয়ার সাথে সাথে রায়া অনলাইনে গল্পের জগতে হারিয়ে যেতে যেতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
ডুবে যায় অপার শান্তির সমুদ্রে।
নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলে – রগুনাত সবই তোমার লীলে… তবে তোমার চরণে আমার শত কোটি পেন্নাম, এই সিরিয়ালের ভুত আমার ঘাড় থেকে নাম্মেছ বলে।
এদিকে ফেসবুক খুলতে ই আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, কারণ চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রিয় লেখকের একটি লেখা। লেখকের নাম টা…!! রায়া পরে জানাবে বলল। ও এখন গল্পের আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।