সারমেয় সঙ্গরস

সারমেয় সঙ্গরস

কয়েকদিন আগেই আমার ছেলেদের কলেজে ‘ কুকুরদের’ নিয়ে এক বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সেই নিয়ে খবরের কাগজে ,সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা-লেখি চাপান-উতোর! এই লেখাটা তৈরি করবার সময় তাই অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সমূহ এক জায়গায় জড়ো করেছি। আমার লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় -‘সারমেয় সঙ্গরস! ‘ অর্থাৎ সারমেয় বা কুকুরদের নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা বলীর ব্যক্তিগত আবোল তাবোল শব্দ চয়ন।
বিশেষ সতর্কীকরণ: যেসব মানুষ কুকুরপ্রেমী তাদের প্রতি আগেই সসম্মানে জানাই কারোর ব্যক্তিগত ভালবাসা বাসিতে -আঘাত দেওয়ার জন্য এই কথোপকথন নয়। এক ভারত বিখ্যাত বিশিষ্ট পশু প্রেমিক ব্যক্তিত্বকেও আগের থেকেই নমস্কার জানিয়ে রেখে বলছি যে -‘ ম্যাডাম, কুকুরদের প্রতি কোনরকম আক্রোশ বশতঃ নয় – সারমেয় বাহিনীর অপার মহিমায় ‘বশ’ মেনে আমার এই আখ্যানের উপক্রমণিকা।

[ উপাখ্যান নম্বর ওয়ান .]
ছোট মাসি ও ছোট মেসো সপরিবারে পুরী বেড়াতে যাচ্ছেন, আমাকেও সঙ্গী করলেন। দুই মাস তুতো বোন লিলি -ঝিলি আমার থেকে বয়সে অনেক টা ছোট হলেও আমার সঙ্গে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জগন্নাথ এক্সপ্রেসে করে ‘পুরী-ধাম ‘ যাত্রা শুরু করবার পর থেকেই ছোট মাসি ও মেসো বারবার ফোন করে ‘ওদের ‘ খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে ‘ওদের’ কে রেখে এসেছেন। লিলি -ঝিলি ও দেখলাম ‘ওদের’ ব্যপারে খুব সচেতন। কথা প্রসঙ্গে জানলাম ছোট মাসি দের বাড়ির এই নতুন সদস্যদের সম্পর্কে। মাত্র দু মাস হল ছোট মাসি দের বাড়িতে ‘ ওরা ‘ আবির্ভূত হয়েছেন। এর মধ্যেই বেশ একটা এলাম ,দেখলাম, জয় করলাম গোছের ব্যাপার সাধিত যে করে ফেলেছেন তা ছোট মাসি দের পরিবারের প্রত্যেকের কথোপকথনের ঢং এই বুঝতে পারলাম বেশ। ব্যক্তিগত কিছু কাজে ব্যস্ত থাকায় মাস দুয়েক ছোট মাসির বাড়িতে যাওয়া হয়নি। না গিয়ে আমি যে কি অসম্ভব এক দুর্লভ- দর্শন মিস্ করেছি -সেটা হাবে -ভাবে বারবার ছোট মাসি, মেসো এবং লিলি- ঝিলি আমাকে বুঝিয়ে দিতে লাগলো! লতা মঙ্গেশকর এর সুরে কিশোর কুমারের বিখ্যাত গানটা মনে পড়ছিল আমার।

-‘ তারে আমি চোখে দেখিনি -তার অনেক গল্প শুনেছি। ‘
তবে এই তাদের আমি কিন্তু মোটেই ‘অল্প- অল্প’ ভালবাসতে পারিনি, পারবোও না। ছোটবেলা থেকেই ‘তাদের ‘ দেখলেই আমার কিরকম মাথা ঝিমঝিম করে, জিভ শুকিয়ে যায়। মনুষ্য সাইকোলজিতে -‘তাদের’কে দেখে এই বিশেষ ভীতি কে একটা বেশ গাল ভরা নামে ডাকা হয়ে থাকে। রক্ষে কর বাপু! অত শক্ত ইংরেজি শব্দ টা মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে। তো যাই হোক , এবার থেকে ছোট মাসির বাড়িতে বেশ বুঝে -শুনে পা ফেলতে হবে, সেটা মনে মনে বুঝে গেলাম।

পুরীতে নির্বিঘ্নে পৌছিয়ে, চেনা পান্ডা সহযোগে পুজো দিতে গেলাম আমরা জগন্নাথ দেবের মন্দিরে। ছোট মাসি ভক্তিতে গদগদ হয়ে পান্ডা ভদ্রলোকটিকে নাম এবং গোত্র বলা শুরু করলেন।

আশীষ মিত্র( অর্থাৎ ছোট মেসো), সীমা মিত্র( অর্থাৎ ছোট মাসি), আহেলী মিত্র( অর্থাৎ লিলি), অপূর্বা মিত্র( অর্থাৎ ঝিলি) এবং সবশেষে গড় গড় করে এক নিঃশ্বাসে ভক্তিভাবে গদগদ হয়ে তিনটি নাম উচ্চারণ করলেন – ‘ হানি মিত্র, মোটু মিত্র, ছোট মিত্র। পুরো পরিবারের গোত্র একই- ‘ শান্ডিল্য গোত্র। ‘

পান্ডা ভদ্রলোক বিশুদ্ধ ওড়িয়া তে ভক্তি ভ’রে জগন্নাথ দেবের সামনে নাম এবং গোত্র পরপর আউড়ে যেতে লাগলেন। অত্যন্ত কৌতূহলবশত আমি লিলি কে জিজ্ঞাসা করলাম হানি মিত্র, মোটু মিত্র এবং ছোটু মিত্র কারা? জগন্নাথ ,বলরাম এবং সুভদ্রার দিকে তাকিয়ে করজোড়ে খুব গদগদ ভাবে লিলি উত্তর দিলো -“আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য তিনটি কিউট কিউট অ্যালসেশিয়ানের বাচ্চা। ”

আমিও গদগদ সুরে মনে মনে বললাম – ‘ ভাগ্যিস পান্ডা ভদ্রলোক লিলির কেতাদুরস্ত ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা টি বুঝতে পারেননি। না হলে এই মুহূর্তে এখানে যে একটা বিপর্যয় হতো না!সুনামির থেকে সেটা কোন অংশেই কম হতো না বোধহয়। ‘

অদেখা হানি মিত্র, মোটু মিত্র এবং ছোটু মিত্রর উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রণাম করলাম। ঋষি কাপুরের একটা পুরনো সিনেমার টাইটেল টা মনে পড়ল – ‘ নসিব আপনা আপনা! ‘
ভাবলাম – অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি।

[ উপাখ্যান নাম্বার দুই]:
শিলিগুড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক পরিচিত ভদ্রলোকের বাড়িতে দেখা করতে গেছিলাম। ভদ্রলোক আমার বাবার বন্ধু। বাবার মুখে অনেকবার শুনেছি উনি নাকি অমিতাভ বচ্চন এর ডাই হার্ড ফ্যান। একসময় বাবারা ওনাকে -‘লগা বচ্চন’ বলেও নাকি ডাকতেন। এখন অবশ্য বেল বটম, লম্বা জুলফি, আর অ্যাংরি ইয়ং ম্যান ইমেজ ছেড়ে একেবারেই পাতি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জীতেই যে উনি অভ্যস্ত -সেটা ওনাকে দেখেই মালুম হলো। প্রাথমিক আলাপ পর্বের পরে, ওনার ছেলে- বৌমার সঙ্গে কথা বলছি – ভদ্রলোক হঠাৎ অমিতাভ বচ্চনের ঢঙে একটা ‘ব্যর্থ -বাজ খাই ‘ কণ্ঠস্বরে বেশ একটা -‘আমাকে দেখো ,আমাকে শোনো’ ভঙ্গিমায় -“অমর, আকবর ,এন্টনি ” বলে চিৎকার করে উঠলেন। ওই অদ্ভুত হাঁকডাকের চোটে আমি তো চমকে চল্লিশ! তারপরে যে দৃশ্যটা দেখলাম !তার সাথে তুলনা দিব? সে রূপের সাথে কিসের তুলনা দিব? তিনটি অতিকায় বিশাল কুকুর দাঁত বার করে কোথা থেকে জানি দৌড়িয়ে এসে , হাসি হাসি মুখে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার যে কি অবস্থা হল সে আমার ইষ্ট দেবতা ও জানেন না! বুঝলাম মৃত্যু আসন্ন। আমার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বোধ করি বাবার বন্ধু ভদ্রলোক কেমন যেন অমিতাভ বচ্চনের ‘হাম’ সিনেমার একটা গান ‘ এক দুস্রে সে করতে হে পেয়ার হাম, এক দুস্রে কে লিয়ে বেকারার হাম’ – গোছের কথাবাত্রা বলে অমর আকবর এন্টনির সঙ্গে তার গোটা পরিবারের কতটা নিবিড়, নিগূঢ় সম্পর্ক – তার ব্যাখ্যা দিতে বসলেন। এই ব্যাখ্যা এমতাবস্থায় আমাকে দেবার কারণ আমি সত্যি সত্যিই উপলব্ধি করে উঠতে পারছিলাম না।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পরে হুশ টা একটু একটু ফিরে আসছিল যেন! বুঝলাম ভদ্রলোক আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন যে ওনার পারিবারিক এই তিন সদস্য – ‘অমর ,আকবর, এন্টনি ‘ আমাকে অতিথি হিসেবে পেয়ে অতিথি সৎকার করতে চাইছে। -‘ সৎকার ই বটে! ‘ এই মুহূর্তে নিজের ওপরে যা রাগ হচ্ছিলনা! বাবার ওপরেও যে কি ভীষণ রাগ হচ্ছিল আমার! মনে হলো হয়তো বা বাবার সাথে কোনোও পুরনো শত্রুতার ঝাল মেটাতেই উনি বাবার মেয়েকে পেয়ে ‘ অমর আকবর এন্টনি’ কে লেলিয়ে দিয়েছেন। ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার! চোখ বন্ধ করেই এতক্ষণ এসব ভাবছিলাম – যাতে ওই তিন ভীষণ দর্শন নাম না জানা প্রজাতির কুকুর তিনটি কে দেখতে না হয়। হঠাৎ অনুভব

করলাম – আমার পা দুটো অসম্ভব ভিজে যাচ্ছে। কি এক অদ্ভুত তিনটে জিনিস যেন ক্রমাগত আমার পায়ের ওপর নাচানাচি করছে। কোনোক্রমে চোখ দুটো খুলে দেখি -‘ উফ !কি যে দেখলাম! ‘

দেখি, ‘অমর, আকবর, এন্টনি ‘ একমনে জিভ দিয়ে আমার পা -টা চেটে চলেছে! বাবার বন্ধু ভদ্রলোক অত্যন্ত পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলছেন -” তোমাকে ওদের বেশ মনে ধরেছে। তাই এভাবে জিভ দিয়ে তোমার পা চেটে তোমাকে আদর করছে। ”

কিসের ভিত্তিতে মনে ধরেছে আমাকে ওদের? মানে আমাকে ভয় দেখিয়ে কি ওরা অত্যন্ত পুলকিত? তা বেশ পুলকিত হয়ে এবার মানে মানে কেটে পড় না বাপু! আমার জীবনী -শক্তি টি তো অর্ধেক বানিয়েছিস আজ! আর কি চাস?

আর যে কি চায় তা পরমুহূর্তে বুঝলাম।
-‘ আনহোনিকো হোনি করদে -হোনি কো অনহোনি।
অমর ,আকবর ,এন্টনি। ‘
হঠাৎ দেখি – ঐ তিন মক্কেল , আমি যে সোফাটাতে বসে ছিলাম – তার ওপরে উঠে , প্রায় কেমন যেন একটা গল্পগাছা করবার স্টাইলে আমার গা ঘেষে পাশাপাশি বসে পড়ল। তিন জনের হাব-ভাবেই কিন্তু – কেমন একটা ‘মানদা মাসি ‘ টাইপ ব্যাপার। কেমন যেন -‘কি? ভালো আছেন? বাড়ির খবর কি ?’ জিজ্ঞাসা তিনজনের চোখেমুখে !

জিভ থেকে সমানে নাল- ঝোল পড়ছে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে আলাপ করবার ছলছুতো। বাবার বন্ধু ভদ্রলোক ‘ হে হে হে ‘ করে হেসে কেমন দেখছো? কেমন বুঝছো? এমন একটা ভাব দেখিয়ে যাচ্ছেন।

আর অবাক কান্ড – ভয় পেতে পেতে, আমার ভয়টা কেমন যেন তিরোহিত হয়ে গেল। বাবার বন্ধু ভদ্রলোকের নাম – নিত্যগোপাল। যদিও বন্ধু মহলে ওনার -‘বচ্চন ফ্যান -শিপ ‘ কে সম্মান দেখিয়ে ওনাকে – ‘বিজয়’ বলেই ডাকা হতো। তবে বাবারা নাকি অনেক সময় প্রচন্ড লেগ- পুলিং করে ওনাকে ‘নেত্ত- বিজয় ‘ বলে ডাকতেন। কুকুরদের দিয়ে ট্রাপিজ খেলা দেখিয়ে আমার পিলে চমকিয়ে, চমকিয়ে – আমাকে একেবারে ভয়ে ভীত করে দেবার শাস্তি স্বরূপ ‘অমর ,আকবর, এন্টনির তোয়াক্কা না করেই – আমি হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলাম – ” রিস্তে মে তো তুম ইন কুত্তো

কে বাপ লাগতে হো – নেত্ত বিজয় ?তোমহারা নাম কেয়া হ্যায়
নেত্ত বিজয়? ‘…!
এবার গরমে আমার কর্তার আর ছেলের খুব গ্যাংটক যাবার ইচ্ছা। আমারও! তবে অনেক বেশি খরচা হলেও আকাশ পথে যাবার কথাই ভাবছি। কারণ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে শিলিগুড়ির ওপর দিয়ে গাড়ি চড়ে গ্যাংটক যাবার বাসনা আমার নেই। সেদিনের ওই ঘটনার পর থেকে শুনেছি মিস্টার নেত্ত বিজয় এবং তার অমর ,আকবর ,এন্টনি নাকি আমাকে এখনো প্রবলভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন…!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত