হ্যালোওওওও। কেমন আছেন সবাই? চিনতে পারছেন তো? সেই যে, বন্ধুর ক্রিকেট খেলার ব্যাট ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলুম। মনে পড়েছে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমি সেএএএএএই রবার্তো। না না না না, রবার্তো কার্লোস নয়, রবার্তো সুর। খাঁটি বাঙালি। অবশ্য আপনারা ওই শেষের “ই”-টা বাদ দিতে পারেন।
যাকগে, যা বলছিলুম। সেএএএই যে ব্যাট ফেলে দেওয়ার ঘটনাটা আপনাদের যখন জানিয়েছিলাম, দেখলাম আপনারা সকলেই বেশ মজা পেলেন। তা সেটা তো আমার জীবনে সত্যিই ঘটেছিল। তাই ভাবলাম যে আমার জীবনেরই একটি সত্যি ঘটনা আপনাদের জানাই। তবে হ্যাঁ আপনাদের মধ্যে যাঁদের মন দুব্বল, তাঁরা এই গল্পটি পড়বেননি। কারণ এতে কিঞ্চিৎ রক্তপাত আছে।
আমার আগের গল্পটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এটুকু বুঝে গেছেন যে আমি ছেলেটি বেজায় “শান্ত”। তা, এরকম “শান্তশিষ্ট” থাকতে গিয়ে একবার যে কি বিপদে পড়েছিলাম, সেই কথাই আজকে বলবো।
আমার মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন রকম ক্লাসে ভর্তি করেছিল। গান, তবলা, আঁকা, টেবিল টেনিস, সাঁতার, অভিনয়, কোনোটাই বাদ দেয়নি। এবং আত্মপ্রচারের মতো শোনালেও, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, প্রতি ক্ষেত্রেই আমি আমার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের গর্বিত করতে পেরেছি। কিন্তু ওই যে বললুম, বেজায় “শান্ত”। তাই অল্পেতেই খেই হারিয়ে ফেলতাম। কয়েকমাস পরে আর ভালো লাগত না। এরকমই একটা সময়ে এই গল্পের শুরু।
আগেই বলেছি, আমি তবলা শিখতাম। প্রতি সপ্তাহে মা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। স্যার খুব যত্ন করে আমাকে শেখাতেন। কিন্তু বাড়িতে এসে আমি সব বেমালুম ভুলে মেরে দিতাম। মা হাজারবার বলা সত্ত্বেও আমি প্র্যাকটিস করতাম না। ফলে পরের সপ্তাহে স্যারের কাছে বকুনি খেতাম। স্যার মায়ের কাছে অভিযোগ করতেন। আর বাড়ি এসে উত্তম-মধ্যম জুটত।
অবশেষে মা একদিন ঠিক করল, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আঙুল বাঁকাতে হবে। চুপিচুপি বলে রাখি, আমি সেই সময় অন্ধকারকে খুব ভয় পেতাম। কোনো অন্ধকার ঘরে একলা বসে থাকার থেকে মাউন্ট এভারেস্টে ওঠা বেশি সহজ মনে হত আমার। আর তার উপর যদি সেই সময় ঘরে জোনাকি ঢোকে, তাহলে তো কথাই নেই। নির্ঘাত দাঁতকপাটি।
যাই হোক, মা আমাকে জোর করে বিছানায় তবলা প্র্যাকটিস করতে বসালো। কিছুক্ষণ বাজিয়ে আমার আর ভালো লাগছিল না। বাজনা থামিয়ে দিলাম। মা তখন আমার পিছন দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই গেঞ্জিটা একটু দে তো।”
আমি পিছন ফিরে দেখলাম খাটের কোনায় একটা গেঞ্জি পড়ে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে গেঞ্জিটা নিয়ে এলাম। এসে সামনে তাকাতেই দেখলাম মা উধাও। হঠাৎ খটাস করে একটা শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা বন্ধ। বুঝলাম খটাস শব্দটা আসলে ছিটকিনি লাগানোর শব্দ। ভালো করে কিছু ঠাহর করার আগেই ঝুপ! ঘর জুড়ে অমাবস্যা।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চমকে উঠলাম। “অ্যাঁ! ফাঁদে পড়েছি!” হাতে একটা বাঁশি থাকলে শিওর “ফাউল! ফাউল!” বলে চিৎকার করতুম। কিন্তু তখন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ভৈরবী সুরে “ভ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ!” করে ডাক ছেড়ে দরজায় আছড়ে পড়লুম, “ও মাম্মি! দরজাটা খোলো না! আচ্ছা সরি, আর করবো না। প্লিজ একবার খোলো না!”
কিন্তু ধাক্কাধাক্কিই সার। ঘরের আলোও জ্বলল না, দরজাও খুলল না। তখন আমার মনে হল আমি ভালো করে তবলা বাজালে হয়তো দরজা খুলে দেবে। অগত্যা একলাফে খাটে উঠে তবলা আর বায়াটাকে কাছে টেনে নিলাম। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে বাজাতে লাগলাম। কেমন যেন “ঘুম মেরে কেটে খাক, থুতনি ফেটে যাক” গোছের একটা আওয়াজ হচ্ছিল। আর তার সঙ্গে জুড়েছে আমার ভৈরবী সুরে ভ্যাঁ। সব মিলিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজ। সেই আওয়াজ শুনলে মনে হয় ভূতের রাজাও হার্টফেল করতেন।
সেই বিতিকিচ্ছিরি আওয়াজের চোটেই কিনা জানি না, হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে আরেকটা খটাস শব্দে দরজাটা খুলে গেল। অমনি আমি তবলা বায়া ফেলে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরোলাম। মেইন সুইচ অফ করে দেওয়ার ফলে গোটা বাড়ি অন্ধকার। আশেপাশের বাড়ি এবং রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে যেটুকু আলো ঘরে আসছে সেই আলোতেই চারপাশটা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ যেন মনে হলো সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে মাকে ধরতে যেতেই মা হট করে পিছু সরে গেল। আর আমি টাল সামলাতে না পেরে মেঝের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে উবু হয়ে বসলাম। আর ঠিক তখনই কে যেন আমাকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরল। পিঠে লোমশ বুকের স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারলাম যে ওটা বাবা। বাবা আমাকে এমন ভাবে জাপ্টে ধরেছিল যে আমি মাথা ছাড়া আর কিছু নাড়াতে পারছিলাম না। গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে গুপীর গলায় একটি গান ছিল, “মুণ্ডু গেলে খাবোটা কি”। আর আমার অবস্থাটা হয়েছিল “মুণ্ডু ছাড়া নাড়াবোটা কি”।
ওই আধো আলো ছায়াতেই হঠাৎ মায়ের পরনে থাকা হলুদ ম্যাক্সিটা চোখে পড়ল। হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছিলাম না। তাই খানিকটা মরিয়া হয়েই মাথাটা এগিয়ে দিলাম। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলাম ম্যাক্সির একটা প্রান্ত। আর তাতেই ঘটল বিপত্তি।
অন্ধকারে মা বুঝতে পারেনি যে তার ম্যাক্সিটা কিসে আটকেছে। নিজেকে বন্ধনমুক্ত করার জন্য কিছু না ভেবেই মা একটা হ্যাঁচকা টান মারল। মা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ঠিকই, কিন্তু ওই হ্যাঁচকা টানের ফলে আমার ওপরের পাটির বাঁ দিকের দাঁতটা, ইংরেজিতে যাকে বলে Canine tooth, সেটা কটাস করে ভেঙে পড়ে গেল।
দাঁতটা ভেঙে পড়ে যেতেই আমি কোনোমতে একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুখে হাত দিলাম। তারপর ওই একটা হাত দিয়েই আমার ভেঙে যাওয়া দাঁতটা খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেঝেতে হাতড়াতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাতড়ানোর পর যখন দাঁতটা আমার হাতে ঠেকল, তখন হাত দিয়ে অনুভব করে বুঝলাম যে দাঁতে কোনো তরল পদার্থ লেগে রয়েছে। যার ফলে আমি যখন দাঁতটা ধরে তুলতে গেলাম, তখন সেটা পুচুৎ করে পিছলে গিয়ে আমার হাত থেকে ছিটকে গেল। তারপর হাতড়েও সেটাকে আর খুঁজে পেলাম না।
তখন আমি তারস্বরে কেঁদে উঠে বললাম, “তোমরা লাইটটা জ্বালাও! আমি আমার দাঁত খুঁজে পাচ্ছি না!” আমার কথাটা শুনেই মা বাবা দুজনেই সমস্বরে “অ্যাঁ! সেকি!”, বলে উঠল। বাবা তৎক্ষনাৎ আমাকে ছেড়ে দিল। মা দৌড়ে গিয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। তারপর দুজনে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। মা “ও মাগো!”, বলে মুখে হাত চাপা দিল। আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে ওয়াশবেসিনের সামনে গেলাম। দেওয়ালে লাগানো আয়নায় যা দেখলাম তা মনে পড়লে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দেয়।
আমার মুখের চারপাশটা পুরোপুরি রক্তে লাল! দেখে মনে হবে যেন কোনো মানুষখেকো বাঘ এক্ষুনি একটা আস্ত ছাগল খেয়ে শেষ করেছে। আমি হতভম্ব চোখে মা বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা এগিয়ে এসে আমাকে বেসিনে কুলকুচি করালো। তারপর জল দিয়ে আমার মুখটা ভালো করে পরিষ্কার করে দিল। মা রান্নাঘর থেকে চিনি নিয়ে এসে আমার ভাঙা দাঁতের গোড়ায় লাগিয়ে দিল যাতে রক্তটা বন্ধ হয়।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিয়ে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার দাঁত কই?” বাবা তখন এদিক ওদিক খুঁজে দেখতে পেল দাঁতটা ফ্রিজের তলায় চলে গেছে। বাবা বলল, “ও যাকগে। যেমন আছে থাক। কাল সকালে ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে দেব।”
আমি নাছোড়বান্দা সুরে বললাম, “না, ওই দাঁতটা দাও।”
বাবা অবাক হয়ে বলল, “কি করবি ওটা নিয়ে?”
আমি সরল বিশ্বাসে বললাম, “ওটা আবার লাগিয়ে নেবো।”
বাবা হাসতে হাসতে বলল, “ধুর বোকা ছেলে। ওটা আর লাগানো যায় নাকি?”
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কেন করিস বল তো এরকম? দেখলি তো কি একটা অঘটন ঘটল। আর কক্ষনো এরকম করবি না।”
তারপর কি হইল? জানে শ্যামলাল।
(সমাপ্ত)