প্রথমে মনে হল যে অামি কিছু ভুল দেখলাম।পরে যখন অারেকটু খুটিয়ে দেখলাম তখন খেয়াল করলাম অাসলেই মেয়েটা ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছে।মেয়েটার অাশেপাশে অনেকেই অাছে।তবে তারা সেদিকে নজর দিচ্ছেনা কিংবা নজরে পড়ছেনা।মেয়েটা কিনারায় দিকে অাসতে চাইছে কিন্তু পারছেনা।ভাবলাম উঠে অাসবে।কিন্তু অবস্হা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।তারপর অামি অার বেশিকিছু না ভেবে সোজা পানিতে নেমে গেলাম।অার মেয়েটাকে টেনে সামনের দিকে অনেকটা নিয়ে এলাম।মেয়েটা বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে।মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে অাসছে।পোশাক দেখে শহরের মেয়ে বলেই মনে হয়।তাই সাঁতারও জানেনা। মেয়েটার চোখদুটো কেমন মায়ায় জড়ানো।চেহারায় খানিকটা ভীতির চাপ।বললাম-
– সাঁতার জানেননা যখন পানিতে নামেন কেন।অাজকে কিছু একটা হয়ে গেলে কি হত? মেয়েটা ভয়ে একদম চুপসে গিয়েছে।অামার কথার কোন জবাব দিলনা।অামি অাবার বললাম-
– সাথে কে এসেছে?
– বাবা, মা।
– কোথায় ওনারা?
– ওই যে ওইদিকে।( অাঙ্গুল দেখিয়ে)
– এখন যান ওনাদের কাছে।অার হ্যাঁ ভবিষ্যৎতে পানিতে নামলেও হাটুর উপর পানিতে নামবেন না।এরপর অামি
অামার ডিপার্টমেন্টর ছেলেদের সাথে মিশে গেলাম।এটা গত একবছর অাগের ঘটনা মনে হচ্ছে কয়েকদিনের বেশি না।ঠিক এ জায়গাটাই দেখেছিলাম সেই কক্সপরীকে।অাজ অাবার এসেছি যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায়।।
– অামি দূর থেকে খেয়াল করলাম তুই কাউকে খুঁজছিস? কাকে খুঁজছিস বলত? অাদ্রিতা পানি থেকে কখন যেন উঠে এসে বলল কথাটা।বললাম-
– কাকে খুঁজব অাবার, তোরা তিনজনই তো চোখের সামনে অাছস।
– না, না, না! তোর চোখ মুখ কিন্তু অন্যকথা বলছে।
– দূররর! কিসব বলতেছস….।
– তোরা এখানে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে অাছিস কেন।পানিতে নামবি চল…( সুমা)
সুমার পিছন পিছন হৃদয়ও উঠে এসেছে।সুমা অামার ডান হাতটা প্রচন্ড জোরে চেপে ধরে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।অপরদিকে হৃদয়ও অাদ্রিতার সাথে এমনটাই করল।
ওরা প্রায় অাধঘন্টা পানিতে নাচানাচি করে ফেলেছে।অাদ্রিতার পোশাকেও কোমর অবদি ভিজা ছিল।কেবল অামার শরীরটাই শুকনো ছিল।অাসলে অামি ওদের মোবাইল মানিব্যাগ ওগুলো দেখার অযুহাতে উপরে দাঁড়িয়েছিলাম।সত্যি বলতে পানিতে নামার একদমি ইচ্ছে ছিলনা অামার।যদিও কক্সবাজার সৈকতে অাসার প্ল্যানটা অামিই করেছি।তবুও অামার কেমন জানি মন সায় দিচ্ছেনা কোন কিছুতে।এর অাগে যতবার এখানে এসেছি প্রতিবার ভিজে একাকার হয়ে যেতাম।অাজ ঠিক তার উল্টোটাই করছি। কারণ প্রতিবার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে অাসা হত এবারের উদ্দেশ্য তার চাইতে কিছুটা ভিন্ন।
অামি ওদের সাথে পানিতে নেমেছি ঠিকই কিন্তু নজর রাখছি অাশেপাশে।অাদ্রিতার ধারনা সঠিক।অাসলেই অামি একজনকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছি।গতবারের সেই কক্সপরীকে খুঁজছি।ভীতু ভীতু চেহারায় মেয়েটাকে অাজকাল খুব বেশি মনে পড়ে অামার।হয়ত ভালোবাসি।কিন্তু এটা নিয়ে এদেরকে কিছু বলা যাবেনা।যদি বলি তাহলে এরা অামাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।অার অামি সেটা কোনমতেই চাইছিনা।তাছাড়া এদের এত সুন্দর অানন্দ ভ্রমনে জল ঢেলে দেয়া মোটেও ঠিক হবেনা।অামার শুধু মনে হয়েছে সেই কক্সপরীর দেখা মিলবে।এসময় ওর এখানে অাসার কথা।
খেয়াল করলাম হৃদয়ের দুইপাশে অাদ্রিতা অার সীমা দাঁড়িয়ে কাকের মত অপেক্ষা করছে কিছু একটার।তারপর প্রচন্ড গতিবেগে ঢেউ অাসতেই ওরা তিনজনই একিসাথে সেটার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে।সুমা যেহেতু একটু হ্যাংলা পাতলা মেয়ে তাই সে কন্ট্রোল হারিয়ে প্রায় ৮-১০ ফুট কিনারায় দিকে চলে অাসতেছে।সেখান থেকে সামনের দিকে যেতে যেতে আরেকটা ঢেউ এসে তাকে একেবারে কিনারায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।অাহা! বেচারি অাজ হ্যাংলা বলে।বাকি দুইজন নিজেদের মোটামোটি ঠিক রাখতে পারছে।সুমার কান্ড কারখানা দেখে হাসিও পাচ্ছে একটু।তবে অামার এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসলে চলবেনা কক্সপরীকে খুঁজতে হবে।
– শোন, তোরা পানিতে ইনজয় কর।অামি উপরে দাড়াচ্ছি।
অামি ওদের থেকে একটু দূরে ছিলাম তাই সামান্য চিৎকার করেই বলতে হল কথাটা। হৃদয় ‘ অকে ‘ বলল। পাশ থেকে সীমা বলে উঠল-
– কেন উপরে যাবি কেন?
– ওই এমনি।পেট ব্যাথা করছে তো সেজন্য।( অামি)
কথা বলার সময় খেয়াল করলাম অাদ্রিতা অামার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অাছে।সন্দেহের দৃষ্টি।দুইঘন্টার জন্য অামরা সিট ভাড়া নিয়েছি যেখানে সবার ব্যাগপত্র রাখা আছে।অামি সেখানে ব্যাগের একপাশে করে বসলাম।ব্যাগ থেকে অামার মোবাইল বের করলাম।টাইম দেখলাম ১২:৫০।অার প্রায় অাধঘন্টার মত সময় বাকি অাছে সিটের।
খুব তৃষ্ণা পেয়েছে সিগারেটের।ব্যাগ থেকে গোল্ডলিপ সুইচের প্যাকেট বের করলাম।সাথে লাইটারও।অাসার সময় তিনদিনের জন্য পুরা তিন প্যাকেট নিয়ে এসেছি।অামি অন্যান্য ব্রান্ডের সিগারেট মুখে দিতে পারিনা।বমিবমি পায়।কেবল এ ব্রান্ডটাই অামার অধিক পছন্দ।খেলে এটাই খাব অার না খেলে কিছুই খাব না।সুমাকে তখন পেট ব্যাথার মিথ্যা অযুহাত দেখিয়েছিলাম।কিন্তু এবার সত্যি সত্যি পেট ব্যাথা করতেছে।অাসলে পরপর কয়েকটা ঢেউ খুব জোরে তলপেটে এসে লেগেছিল।তখন অন্যমনস্ক ছিলাম বলে মালুম হয়নি।এখন হচ্ছে।প্রায় পাঁচ-সাতবার ট্রাই করার পর সিগারেটখানা ধরাতে পেরেছি।
খুব জোরে হাওয়া বয়ছে।অাগুন ঠিকিয়ে রাখা সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।প্রতিবার ধোয়া ছাড়ার পর্যন্ত সময় পাচ্ছিনা।অাদ্রিতা ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝেমাঝে পিছন দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার স্বভাব চরিত্র অাজকাল ভালো ঠেকছেনা।অামার উপর একটু বেশি নজরদারি করছে।যেটা মোটেও পছন্দ না অামার।অামি অাশেপাশের পুরো জায়গাটা যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিলাম।পিপড়ার মত শুধু মানুষের মাথাই দেখা যাচ্ছে।বছরের এই শেষ সময়টাতে ভ্রমনপিপাসু লোকের বেশি সমাগম হয় এখানে।পুরো এগার মাসে যতগুলো পর্যটক এখানে অাসে,অামার মনে হয় তার চেয়ে দ্বিগুন পর্যটক অাসে এ ডিসেম্বর মাসে। মৌসুমটাই এমন। অামি হৃদয়কে ডেকে বললাম সময় শেষ হয়েছে, উপরে উঠে অাসতে।পাশ থেকে সুমা বলল-
– থাকিনা অার কিছুক্ষণ।এত তাড়াহুড়া করছিস কেন।
– তাহলে তুই থাক।অামরা রুমে যাচ্ছি।(অাদ্রিতা)
– সুমা, অামরা তো অার অাজকেই চলে যাচ্ছিনা।অারো দুইদিন অাছি।এখন প্রচন্ড খুদা লাগছে লাঞ্চ করতে হবে।চল।(হৃদয়)
– হ্যাঁ চল।কিন্তু বিকেলে অাবার অাসব।( সুমা)
– অাসবি ঠিক অাছে।কিন্তু পানিতে নামতে পারবিনা।( অামি)
– কেন?
– তার কারন বিকেলে অামরা শুধু ছবি তুলব।
– অকে। সুমা প্রথমবারের মত কক্সবাজার এসেছে।সেই হিসেবে একটু বেশি এক্সাইটেট সে।
পরপর দুইদিন এভাবেই কেটে গেল অথচ কক্সপরীর দেখা নেই।এখানে এসেছে কিনা তাও জানিনা।হয়ত অাসেনি।এতগুলো মানুষের ভীড়ে কাউকে খুঁজে নেয়াটাও দুঃসাধ্য বটে।তবুও অামার চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি।ওদের তিনজনকে ফাঁকি দিয়ে অামি অনেকবার বিচের এদিক-সেদিক হন্য হয়ে তাকে খুঁজে বেরিয়েছি।তাই একটু হতাশ অামি।হয়ত আর দেখা হবেনা তার সাথে।অাজ সন্ধ্যার পরেই গাড়িতে উঠে যাব।রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি।চোখ বুজলেই ওই দুইটি চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম।কেবল তার ভীতু ভীতু চোখদুটি অামার সপ্নে ভাসছিল।এমন মনে হচ্ছে যেন অামার চোখদুটো তার চোখের কাছে অতি সস্তায় বিক্রি হয়েছে।নাহলে এমন হওয়ার কথা না।
অামি তো পুরোপুরি অাশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।ভাবতেই পারিনি এমন শেষ মুহুর্তে এসে মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যাবে।হয়ত বিধাতা চেয়েছে অামাদের অাবার দেখা হোক।নাহলে এমন অদ্ভুতভাবে কি কারো দেখা হয়ে যায়।সন্ধ্যায় অামরা সানসেট দেখছিলাম।বলতে গেলে বেশিরভাগ মানুষই এখানে অাসে মূলত সানসেট দেখার জন্যই।সবার দৃষ্টি পশ্চিম অাকাশে ওই রক্তাভ সূর্যের দিকে।অামি দেখছিলাম বাকি সবার মত।এমন সময় একটা পাঁচ-সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে এসে অামাকে খোঁচা দিয়ে ডেকে বলল-
– ভাইয়া, ভাইয়া অাপনাকে একজন ডাকতেছে?
– কে ডাকছে অামাকে সোনা…
– অামার সাথে অাসেন।
অামি ওরা তিনজনকে ডাকলাম না।কেবল চুপচাপ পিচ্ছিটার পেছন পেছন গেলাম।অামি ভাবলাম কে ডাকতে পারে।পরিচিত কেউ নিশ্চয় হবে।তারপর পিচ্ছিটা অামাকে যার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল তাকে দেখে অামি অবাক না হয়ে অার পারলাম না।নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলামনা।সেদিনের সেই কক্সপরী।যাকে গত তিনদিন ধরে পাগলের মত খুঁজছিলাম সে এখন অামার ঠিক সামনে দাড়িয়ে।খুব সুন্দর লাগছে।পরনে তার সাদা রঙের টপ জিন্স।বললাম-
– তুমি….
– হ্যাঁ অামি।কেন চিনতে পারছেন না।।
– অারে সেরকম কিছুইনা।
– অাসলে অাপনি সেদিন সময়মত না অাসলে হয়ত অামি এখানে দাঁড়াতেই পারতাম না।
মেয়েটা অাবার বলল-অাচ্ছা অাপনি সেদিন কোথায় উদাও হয়ে গিয়েছিলেন।একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেওয়ার সময় দিলেন না।জানেন পরে অামার মা-বাবা অামিসহ কত খুঁজেছিলাম অাপনাকে কিন্তু পাইনি।
মেয়েটা একনিমিষে কথাগুলা বলে শেষ করল।কথাগুলা বলার সময় কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে যেন অনেকদিনের জমানো কথা ছিল।অামি অার বেশিকিছু বলতে পারলাম না।শুধু বললাম-
– বাই দ্যা ওয়ে, তুমি থাকো কোথায়?
– ঢাকা, শাহবাগ।অাপনি?
– অামিও তো ঢাকায় থাকি।সদরঘাট।
– ঢাকায় গিয়ে দেখা হচ্ছে তাহলে।
– তুমি চাইলেই হবে। অামি অাবার বললাম অামাকে এখন যেতে হবে।বন্ধুরা সবাই আমার জন্য দাড়িয়ে অাছে।
– অকে।যান। অামি পিছু হেঁটে এক পা দিতেই মেয়েটা অাবার বলল- অাপনার নাম?
– সেতু জিৎ
– অামার নাম জিজ্ঞেস করবেন না?
– না।
– কেন, অামার নাম জানেন নাকি।
– জানিনা।তবে একটা নাম রেখেছি।
– কি নাম বলেন শুনি।
– কক্সপরী।
মেয়েটা একগাল হাসল।হাসিটা সুন্দর।অামি অার কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলাম।বাকি যা কিছু সব ঢাকায় গিয়ে হবে।অাপাতত অাদ্রিতার ভাবসাব অামার কাছে মোটেও ভালো ঠেকছেনা।