ফিরে পাওয়া

ফিরে পাওয়া

আমি যখন বিরিয়ানির অর্ডার দিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে।অফিসে একটা মিটিং থাকায় দুপুরে খাওয়া হয়নি।অবশ্য সময় যে পাইনি তেমন না।যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম কিন্তু ইচ্ছে ছিল না।মাঝে মাঝে এরকম ইচ্ছে না করাটা আমার বেশ লাগে।বেশ লাগে।

টেবিলে রাখা ফোনটা যখন কেপে উঠলো তখন আমার খাওয়া প্রায় শেষ।ভাবনার জগতে আছি।বেশ গভীর ভাবেই ভাবছি।আরও এক প্লেট খাব কিনা।আবার এত খেলে ফুলে একদম ড্রাম হয়ে যাব এ চিন্তাটাও আমার মাথায় ছিল।
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না।ফোনটা হাতে নিলাম।এই অসময়ে আবার কে আমাকে স্মরণ করলো এইটা তো দেখা দরকার।আমার ফোনে খুব কম মানুষের কল আসে।হাতেগোনা কয়েকজন।অপরিচিত নাম্বার থেকে তো কল আসা দূরে থাক,মিসড কল ও আসে না।কিন্তু আজ কে এই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দিল,কে?

অবশ্য নাম্বারটা বেশ চেনা চেনা লাগছে।
আমি ফোন ধরে সালাম দিলেও ওপাশ থেকে কোন উত্তর পেলাম না।বেশ চুপচাপ।ছেলে না মেয়ে সেটাও বোঝার উপায় নেই।আমি যখনি আবার কিছু বলতে যাব তখনি ওপাশ থেকে গম্ভীর ভাবে কেও একজন বললেন,
-কাজটা কি তুমি ঠিক করলে?

কণ্ঠ শুনে এটুকু বুঝলাম যে উনি কোন মেয়ে না।বয়সটাও হয়তো মাঝামাঝি বরাবর।কিন্তু আমি কোন কাজটা ভুল করলাম।আমি একটু চুপ থেকে বললাম,

-আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে,নাম্বারটা একটু চেক করে দেখুন।
-আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন দিয়েছি মিস্টার আহাদ।

লোকটার কথায় আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।তারমানে উনি আমাকে চেনে।কিন্তু উনি কে?আমি টিস্যু নিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললাম,

-আসলে আপনাকে আমি চিনতে পারছি না,আর কি বলছেন সেটাও বুঝতে পারছি না।
আমার কথায় লোকটা মনে হয় একটু রেগেই গেলেন।ভারী গলায় বললেন,
-আমার মেয়েটাকে ভাগিয়ে নিয়ে এখন বলছো আমাকে চিনতে পারছো না।
লোকটার কথায় আমি আশেপাশে বেশ ভাল ভাবে তাকালাম।কোই কোন মেয়েকে তো দেখতে পাচ্ছি না।তাহলে কাকে নিয়ে পালালাম আমি!
লোকটাকে আমি শান্ত গলায় বললাম,

-আসলে আপনার কোন কথাই আমার মাথায় ঢুকছে না।আপনি বরং কাল সকালে ফোন দেন।রাতে ভাল একটা ঘুম হলে আপনিও আপনার ভুল বুঝতে পারবেন আর আমিও তখন আপনাকে বোঝাতে পারবো।

আমার কথাটা বোধহয় কাজে লাগলো।লোকটা বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।কিন্তু ফোনটা কেটে দেওয়ার আগে বেশ রাগি গলায় বললেন,

-আমার নাম যদি আফজাল চৌধুরী হয়ে থাকে তাহলে আমি তোমাকে দেখে নেবো,দেখে নেবো।
কথাটি বলেই লোকটা ফোনটা কেটে দিলেন।কিন্তু নামটা শুনে আমার হাতে থাকা ফোনটা কেমন যেন ফোন না আসাতেই কাপতে শুরু করলো।

আফজাল সাহেব।তখন আমি মাস্টার্স শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ইন্টার্ভিউ দিচ্ছি।সুট, বুট পড়ে যাচ্ছি আর মলিন মুখে তারা ফিরিয়ে দিচ্ছে।অবশ্য আমার এসবে খারাপ লাগেনি।সবকিছুরই অভিজ্ঞতা রাখা দরকার।

আর এই অভিজ্ঞতা নিতে নিতেই আফজাল সাহেবের সাথে আমার পরিচয়।এক ইন্টার্ভিউ বোর্ডে।সেদিন উনি আমাকে চাকরি না দিয়ে দিয়েছিলেন ওনার মেয়েকে পড়ানোর প্রস্তাব।

অবশ্য উনি কেন এমন করেছিলেন সেটা আমার আজও অজানা।তবে আমি সেদিন না করিনি।অন্তত চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত টিউশনি করাই যায়।হাত খচরটা তো পাওয়া যাবে।

মানহা।মানহা চৌধুরী।আফজাল চৌধুরীর একমাত্র কন্যা।মেয়েটাকে যেদিন দেখি সেদিন ভেবেছিলাম বাচ্চা একটা মেয়ে,খুব ভাল একটা মেয়ে।কিন্তু আমার এই সহজ সরল ধারনাটা মেয়েটা বেশ তাড়াতাড়িই পালটে দিল।ইন্টার পড়ুয়া মেয়েটা আমাকে দু দিন যেতেই প্রশ্ন করলো,

-স্যার,আপনি যদি মানুষ না হয়ে সিংহ হতেন তাহলে কি হতো?
মেয়েটার হঠাৎ এমন প্রশ্নে আমি কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম।তবে একটু থেমে বলেছিলাম,
-তাহলে আজ আমি চিড়িয়াখানায় থাকতাম,আর তুমি টিকেট কেটে দেখতে যেতে আমাকে।
আমার কথায় মেয়েটা হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।তবে এসময় আমার রাগটা বেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও মেয়েটার হাসি দেখে সেটা আর হলো না।একটা মেয়ে এত সুন্দর করে হাসতে পারে কেমনে!

এরকম আরও উদ্ভট প্রশ্নের মধ্যে যখন আমি আটকে গেলাম তখনই মেয়েটা তার বাচ্চামির সাথে সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে আমাকে প্রপোজ করে বসলো।

সেদিন মানহাকে আমি কিছু বলিনি।এই বয়সে এরকম চিন্তাভাবনা মাথায় আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।কিছুদিন পর যখন ও নিজেই বুঝতে পারবে তখন মুচকি হেসে ভাববে ওর বোকামির কথা।

মানহার যেদিন এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলো সেদিন মেয়েটাকে বলেছিলাম, তোমার রেজাল্ট যদি তোমার বাবা মা কে খুশি করতে পারে তাহলে তুমি যেটা চাইবে আমি সেটাই দেবো।

সেদিন মেয়েটা আমার কথায় মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়েছিল।কিন্তু এই মুচকি হাসিতে যে লুকিয়ে ছিল অন্যকিছু সেটা আমি বুঝেছিলাম ওর রেজাল্টের দিন।মেয়েটা আমাকে বলেছিল,

আমার রেজাল্টে আমার বাবা মা দুজনেই খুশি।আর এই খুশির দিনে আপনার কাছে আমার চাওয়াটা আপনি নিজেই।হ্যা আমি টিকিট কেটে আপনাকে দেখতে চাই না।আমি চাই সেই খাচায় আপনার সাথে একসাথে থাকতে।
মানহার কথায় আমি সেদিনও কিছু বলিনি।এই মেয়েটাকে যতটা পিচ্চি ভেবেছিলাম ঠিক ততটা পিচ্চি না।মানহাকে যে আমার ভাল লাগে না তেমন না।বেশ লাগে মেয়েটাকে।কিন্তু কিসের টানে যেনো আমি আর এগুতে পারি না।ওর ডাকে সাড়া দিতে পারিনা।সেদিন আফজাল সাহেবের আমার প্রতি বিশ্বাসের প্রতিদান স্বরূপ আমি মানহাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম।সেদিন কেন যেন মেয়েটার জন্যে আমার চোখটাও ভিজে উঠেছিল।এটাকে যদি ভালবাসা বলে তাহলে আমিও মানহাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম।এরপর প্রায় কেটে গেছে বছর তিনেক মানহার সাথে আর যোগাযোগ করিনি।আর আমার সাথে ওর যোগাযোগের রাস্তাটাও আমি আর রাখিনি।

কিন্তু এতদিন পর আজ মানহা এমন কি করলো যে ওর বাবা আমাকে সন্দেহ করলো।তাহলে কি মানহা এখন অন্য কাউকে ভালবাসে আর তার সাথেই পালিয়ে গেছে।সেটা গেলে আফজাল সাহেব আমাকে সন্দেহ কেন করবেন,উনি তো কিছু জানতেন না।আর এতদিন আমার নাম্বারটাই বা কেন রেখে দিয়েছিলেন!

আমি আর ভাবতে পারলাম না।উঠে দাঁড়ালাম।বিলটা দিয়ে বাইরে বের হয়ে দেখি প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে।বাসায় যাওয়া দরকার।কিন্তু আজ কেন যেন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।এই সোডিয়ামের আলোতে হাটতে ইচ্ছে করছে।
মানহার সেই মায়াময় মুখটা চোখে ভেসে উঠতেই ভেতরটা কেমন যেন কেপে উঠছে।কাউকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।আজ আমার জব আছে, আছে মোটা অংকের সেলারি।কিন্তু ভেতরটা তবুও ফাকা মনে হচ্ছে।কি যেন নেই আমার, কি নেই!

রাত প্রায় দশটা।আমি গেইট দিয়ে ঢুকতেই দারওয়ান চাচা বললেন,
-স্যার,আপনার সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছিল।আপনি আসছেন না দেখে মাত্রই চলে গেলো।
দারওয়ান চাচার কথায় আমি থমকে দাঁড়ালাম।একটা মেয়ে।মেয়েটা মানহা নয়তো।আমার চুপ থাকা দেখে উনি আমার দিকে একটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিল আপনার জন্যে,যাওয়ার আগে এই কাগজটা দিয়ে গেলো।
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে ভাজ খুলতেই দেখি লাল কালিতে লেখা,
এসেছিলাম সিংহের খাচায় সিংহের সাথে একসাথে থাকতে,কিন্তু সে হয়তো অন্য খাচায় বন্দি।চলে যাচ্ছি।
তারমানে মানহা ই এসেছিল।লেখাটা পড়ে আমি চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আচ্ছা মেয়েটা কতক্ষন আগে বের হয়েছে?
-এইতো দু তিন মিনিট।
-কোনদিকে গেছে বলতে পারেন?

চাচা হাত দিয়ে ইশারা করতেই আমি আর দাড়ালাম না।এই মেয়েটাকে এতদিন পর কাছে পেয়েও যদি হারিয়ে ফেলি তাহলে নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবো না।কোন ভাবেই না।

এই রাতের বেলা মেয়েটা কোই যাবে কি করবে,কোন বিপদ হলে কি করবে মেয়েটা এসব ভাবতে ভাবতে যখন আমি আশেপাশে খুজছিলাম মেয়েটাকে তখনি ওভারব্রিজে উপর আমার চোখ আটকে গেলো।দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও আমি সেদিকেই দৌড়ে গেলাম।রেলিং ধরে কেও একজন দাঁড়িয়ে আছে।তবে এবার আমি কোনকিছু ঝাপসা দেখছি না।স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে নিচে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম,
-সিংহের খাচায় সিংহটা এখনও একাই থাকে।কেও চাইলে থাকতে পারে।
আমার কথায় মেয়েটা ঘুরে তাকালো।আমি যে ওর পাশে এসে দাড়িয়েছি সে খেয়ালই নেই মেয়েটার।আমার কথায় মানহা কিছু বললো না।তবে ওর চোখের পানি আমার চোখ এড়ালো না।
আমি মানহার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম,

-এতকিছু কিভাবে করলে?
মেয়েটা এবারও কিছু বললো না।কিছুক্ষন চুপ থেকে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো,
-আপনি জানেন আপনাকে আমি কতো খুজেছি।কত জায়গায় খুজেছি।
-তো কিভাবে খুজে পেলে?
-বলবো না।
-আচ্ছা,একটা ফোনও তো দিতে পারতে।
-নাম্বার কোই পাবো।তবুও আমি জোগার করেছিলাম।কিন্তু ফোনটা ভুলে বাসায় রেখে আসায় আর সেটাও করতে পারিনি।

মানহাকে আমি আর কিছু বললাম না।এই কয়েক বছরে মেয়েটার মাঝে অনেক চেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি।চিকন ফ্রেমের চশমাতে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।

আমি মানহার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-বাসায় কি বলে এসেছো?
-কিছু বলিনি তবে লিখে আসছি।সাথে আপনার নামটাও দিয়ে আসছি।
মানহার কথায় আমার কেন যেন হাসি পেলো।কিন্তু আমি হাসলাম না।তারমানে আফজাল সাহেব আমার নাম দেখেই আমাকে ফোন করেছিলেন আর নাম্বারটা মানহার ফোন থেকেই নিয়েছিলেন।

হাটছি,একা নয়।আজ আমার সাথে মানহাও হাটছে।সোডিয়ামের আলোতে মানহার মুখটা দেখতে আজ অন্যরকম লাগছে।মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব সৌন্দর্য আজ মানহার মুখে এসে ভর করেছে।পিচ্চি মেয়েটাকে আজ আর পিচ্চি লাগছে না।বেশ বড় হয়ে গেছে।যাকে আমি চাইলেও এখন আর ছাড়তে পারবো না।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত