কিছু বুঝে উঠার অাগেই অারশি অামার বুকে সজোরে ঝাপিয়ে পড়ল।অামি তখন পুরোপুরি অপ্রস্তুত।প্রায় দুই তিন মিনিটের মত এভাবেই রইল সে।মনে হচ্ছে অারশি অনেক অাগে থেকেই এটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল।সে কারো কাছ থেকে জেনে নিয়েছে অামার এই রাস্তা দিয়ে অাজ অাসার কথা।অামার দুই হাতের ল্যাগেজ দুটা নিচে রেখে তারপর বললাম-
– “এসব কি হচ্ছে অারশি।পাড়ার লোকজন দেখলে খারাপ ভাববে তো “।
– “ভাবলে ভাবুক তাতে অামার কি।”
তখনও মুখ তুলেনি ও।অামার বুকের উপর মুখ রেখেই কথাটা বলল অারশি।অাহ!অাজ কত বছর বাদে সেই কন্ঠ শুনলাম।প্রতিটা শব্দ যেন হৃদয়ে মৃদু কম্পন ধরিয়ে দিল।অামি মন থেকে চাইনা অারশি অামার বুক থেকে মুখ সড়িয়ে নিক।খানিক্ষণ পর ও নিজেই মুখ তুলে অামার দিকে তাকাল।চোখের জলে মুখ ভেসে গেছে তার।একটু সেজেছিল হয়ত অামার জন্য এখন সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।যখন ওর চোখ দুটো মুছতে গেলাম তখন নিজের চোখটাই খুলে গেল।অাসলে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম।
চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি বের হতে লাগল।অাধশোয়া হয়ে উঠে বসলাম।একটু হাহাকার লাগছে।রাজু ছেলেটা কেমন করে জেগে গেল হয়ত অামার গোঙানির শব্দ শুনে।অামি ওকে প্রথমে খেয়াল করিনি।বলল-
– কিরে তুই এত রাতে বিছানার উপর এভাবে বসে অাছিস যে? প্রবাস জীবনে অামার অাপন বলতে একমাত্র রাজুই অাছে।ওর সাথেই অামার যত ভাব।বললাম-
– অামাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবি রাজু।। রাজু বড় মগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল-
– এত রাতে কার কথা ভাবছিস বল তো।অনেকটা কেঁদেও ফেলছিস দেখছি।
– অারশির কথা।
অামি এটুকু বলে রাজুর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিলাম।তারপর রাজুর হাতে গ্লাসটা দিতে দিতে বললাম-
– স্বপ্নে দেখলাম ও অাবার ফিরে এসেছে।
– যে পাখি একবার খাঁচা থেকে বের হয় সে পাখি দ্বিতীয়বার খাঁচায় ফিরে না।এটা নিশ্চয় জানিস?
– কিন্তু রাজু অামার খাঁচা তো ভালোবাসা দিয়ে বানিয়েছিলাম কোন লোহার শিকল দিয়ে না।কিসের অভাব ছিল অামার খাঁচায় বলতে পারিস?
– মুক্ত অাকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা তুই তাকে দিতে পেরেছিস?
– হয়ত না।( অামি)
– এজন্যই তো সে তোকে ছেড়ে গেছে।
– তাই বলে অামার শূন্য অাকাশটার কথা একবারও ভাবল না।
– অাচ্ছা রাত অনেক হয়েছে,এবার ঘুমিয়ে পড়।
রাজুর কথামত অামি চোখে ঘুম অানার চেষ্টা করলাম। বয়স অার কত হবে কুড়ি ছুঁই ছুঁই।কখনও ভাবতেও পারিনি এটুকু বয়সে অামি দুইবছরের প্রবাসী হয়ে যাব।এমন দিনে হয়ত অামার শাটলে কিংবা ঢাকা ভার্সিটির লাল বাসে বসার কথা ছিল, সবুজ ক্যাম্পাসে দশ-বারোজন একসাথে বসে অাড্ডা দেয়ার কথা ছিল।সেটা অার হলো কোথায় নিজের পায়ে কুড়ালটা তো নিজেই চালিয়ে দিয়েছি।পড়ালেখায় মোটেও খারাপ ছিলাম না।সরকারি স্কুল থেকে সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছিলাম।বড়জোর দেড় মাসের মত ক্লাস করেছিলাম।পরিস্থিতি এমন করে দিয়েছে এখন নিজের নামটা লিখতেও হাত কাঁপে।ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল অামার।পাড়ার একটা স্পোর্টিং ক্লাবে আমি ওপেনারের জায়গায় ছিলাম।সারাক্ষণ ব্যাট বল নিয়ে পড়ে থাকতাম।কি জানি হয়ত এখন ব্যাট ধরার কৌশলটাই ভুলে গিয়েছি।
অর্ণব, গোলাম, সাজ্জাদ, দিহান হারামী বন্ধুগুলো এখনো অাগের মতই অাছে।অামাকে না জানিয়ে কিচ্ছু করেনা।সেদিন দিহানের বার্থডে ট্রিট নিতে একটা রেস্টুরেন্ট বসেছিল সবাই।তারপর অামাকে ভিডিও কল দিল, শুধু পারছিলনা ফোনে অামাকে খাইয়ে দিতে।হারামীগুলোর সামনে ভালো করে কাঁদতেও পারিনা।ছোট্ট বোনটা এবার ক্লাস টেনে উঠেছে।সন্ধ্যার দিকে প্রতিদিন একবার হলেও ফোন দিয়ে অামার খবর নেই।অাসলে রক্তের সম্পর্কের ধরনই অালাদা।যতকিছুই হোক ছাড়াছাড়ির প্রশ্নই অাসেনা।বাবার সাথে তেমন কথা হয়না, জড়তা কাজ করে।মার সাথে অাগে কথা বলতাম না। সেদিন বোনের সাথে কথা বলার সময় মার কান্নার শব্দ শুনে মায়া জমে গেছে।এখন বোনের পাশাপাশি মার সাথেও কথা হয়।তবুও অভিমানটা একটুও কমেনি।
অার অারশি! সে তো দুইবছর অাগের অতীত।যখন রাগের মাথায় বিদেশ চলে অাসছিলাম একবারের জন্যও বাঁধা দেয়নি সে।ভাবতেও কেমন জানি লাগে।অাগে যে মেয়েটা বলত-” অামি তোমাকে ছাড়া বাঁচবনা।” অার এখন সে মেয়েটাই অামাকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে অাছে।যে মেয়ে অামাকে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় কল দিত।এখন তার নাম্বার অার ডায়াল লিস্টে ভাসেনা।যে মেয়ে অসুস্হ শরীরে সবার অাগে অামাকে পাশে চাইত।তার এখন সুস্থ হওয়ার জন্য অামাকে প্রয়োজন পড়েনা।অারশি সব পেরেছে।ওর যত অভ্যাস সব পাল্টে ফেলেছে।কিন্তু অামি পারিনি।সেই অাগের অামিই রয়ে গেছি।স্মৃতিগুলো বালিশচাপা দিয়ে খুন করা অার সম্ভব হয়না।
কেমন ভালোবাসতে অামায় সামান্য বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পারলেনা।কিভাবে মনে করলে নিশির সাথে অামার সম্পর্ক ছিল, অামি ঠকিয়েছি তোমাকে।জানো তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে নিজের ভিতর অন্যকাউকে ভালোবাসার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে।আচ্ছা ওই রেলরাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তোমার কি অামার কথা মনে পড়েনা।ওই যে আমরা একসাথে হাতে হাত রেখে লাইনের উপর হাঁটতাম।অাচ্ছা তুমি যখন শহরে যাওয়ার সময় বাসে জানালার পাশের সিটে বস তখন কি অামার কথা মনে পড়েনা।ওই যে ছোট ছোট করে কথা বলতে বলতে অামার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে।তোমার মনে পড়ে কিনা জানিনা। অামার কিন্তু খুব মনে পড়ে।
অারশিকে যখন প্রথমবার ভালোলাগার কথা বলেছিলাম ও সাতদিন অামার সাথে কোন কথা বলেনি।তখন অামার মনে হল যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।তারপর একদিন কোচিং এ এসে বলে তারও নাকি অামাকে ভালো লাগে।তখন থেকেই শুরু হল অামাদের ভালোলাগার পথচলা।একপর্যায়ে অামি অারশিকে প্রপোস করে বসি।অারশিও রাজি হয়ে যায়।এরপর থেকে দিনগুলো অারো সুন্দর হতে থাকল।রাতভর ফোনে কথা হত,সারাক্ষণ এসএমএস চলত।অামি রাতে ফোনে কথা বলার জন্য পুকুরপাড়ে চলে যেতাম।মোবাইল টিপতে টিপতে অনেকসময় রাস্তার উপর উঠে যেতাম।একবার তো চলন্ত রিক্সার হুডের সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কাও খেয়েছিলাম।এখনো মাঝে মাঝে সেখানে ব্যাথা করে।
তারপর একদিন অারশিকে কোচিং ক্লাসে একদম চুপচাপ লাগছিল।বললাম-
– অারশি কি হয়েছে তোমার এমন মুখ গোমরা করে বসে অাছো যে?
অারশি প্রথমবার কিছু বলেনি।দ্বিতীয়বার যখন অাবার জিজ্ঞেস করলাম তখন বলল-
– কদিন ধরে কতগুলো ছেলে পিছন পিছন অামার বাসা অবদি চলে যাচ্ছে।এটা নিয়ে মা প্রতিরাতে ভীষন বকাঝকা করছে অামায়।
– তুমি চিন্তা করোনা।কাল থেকে অামি তোমার সাথেই যাব।
অারশি অামার কথায় ভরসা খুঁজে পেল।তখন একটা সমস্যা ছিল।অারশিদের স্কুল ছুটি দিত ৩.৩০ মিনিটে অার অামাদের ৪ টায়।তাই অামি ছয়টা ক্লাস করে ৩.২০ এ ব্যাগ নিয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে যেতাম।পোস্ট অফিস মোড়ে অামরা এসে এক হতাম।সুবিধা হত বাড়ি অামাদের এক রাস্তায় হওয়ায়।
স্কুল জীবনের সমাপ্তি হল।দুইজনের গ্রেড পয়েন্ট ভালো ছিল।একটা সরকারী কলেজে দুজনেই এডমিট হলাম।গ্রুপটাও সেইম ছিল দুজনের।অামাদের প্রেম অার অাটকায় কে।অামরা বাঁধাহীনভাবে ছুটিয়ে প্রেম করতে থাকি।জানা ছিল না সুখ জিনিসটাই যে ক্ষণস্থায়ী।চিরস্থায়ী হয় সবার অপ্রিয় দুঃখটাই।তারপর একদিন তাকে বিষন্ন দেখে জিজ্ঞেস করলাম-
– কি হয়েছে তোমার অাবার?
– সেই ছেলেগুলো অাবার এসেছে।এবার অামার গায়েও হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে।
– ঠিক অাছে তাইলে কাল থেকে অামি তোমার সাথেই যাব।দেখি কিভাবে ছেলেগুলো তোমার শরীরে হাত দেয়।
অারশি পুনরায় ভরসা পেল।অাসলে গত একমাস ধরে তার সাথে যায় না।ভেবেছিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।আর ওই সময় অামার টিমের খেলাও থাকে।সবমিলিয়ে যাওয়া হয়না।
পরদিন সকালে অামাদের সেমি-ফাইনাল খেলা ছিল।অামি ওই ম্যাচটা অারশির জন্য বাদ দিলাম।এজন্য অনেক মিথ্যা বলতে হয়েছে অামাকে।পরদিন লুকিয়ে লুকিয়ে অারশির পিছন পিছন হাঁটলাম।শুধু দেখতে চেয়েছিলাম অাদো তার গায়ে হাত দিতে পারে কিনা।একপর্যায়ে গিয়ে দেখলাম ছেলেগুলো তার গাঁয়ে হাত দিয়ে ফেলেছে।অামার মাথায় রক্ত চেপে গেল।অামাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হল।এসময় অারশি ছেলেগুলোকে বলল- “সে নাকি অামাকে চিনে না”।কথাটা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সড়ে গেল।বুঝতেই পারিনি অারশির মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে।ছেলেগুলো অামাকে মারল তবে ততটা ব্যাথা পাইনি যতটা ব্যাথা পেয়েছি তার কথায়।
পরে শুনলাম সে নাকি অামার একটা নাম রেখেছে ‘ইভটিজার’।খুব সুন্দর নাম।প্রিয়মানুষের দেয়া নাম।চার-পাঁচ দিন ধরে অারশি কোন যোগাযোগ করেনি অামার সাথে।তবে অামি যে হাত পা ঘুটিয়ে বসে ছিলাম সেটা কিন্তু না।অামি অনেক চেষ্টা করেছি ওর সাথে কথা বলার।কারন একটা সম্পর্কের রাগ, অভিমান, ঝগড়া,বিবাদ থাকবেই।তাই বলে চুপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।তাছাড়া একজন রাগ করলে সম্পর্ক গভীর হয়।অার দুইজনই রাগ করলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।নানা অভিযোগ অনুযোগে বার বার তার কাছেই ফিরে যেতাম।কেননা একটু বেশিই দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম তার প্রতি।বিনিময়ে অবহেলাটাও বেশি করেই পেতাম।একটা জিনিস বুঝলাম না সেদিন ইভটিজার কেন বলল অামায়।
রাতে ভাবলাম এভাবে কাজ হবেনা, অামাকে অন্যকিছু করতে হবে।অামি নিশিকে বললাম কিছুদিন অামার সাথে প্রেমের অভিনয় করতে।ও প্রথমবারই রাজি হল অামার প্রস্তাবে।কারন অামরা ভালো বন্ধু ছিলাম।চেয়েছিলাম অারশির মধ্যে ভালোবাসার হিংসে ঢুকিয়ে দিব।ভাবলাম অামি অার নিশিকে কাছাকাছি দেখলে ও ভিতর ভিতর জ্বলবে।ভাবিনি সেটা হীতে বিপরীত হবে।অারশি উল্টো ভুল বুঝে বসে অামাকে।একদিন কলেজে অারশি আমাকে বলল-
– যেটা করলে সেটা ভালো করলেনা।
অামি কিছু বলতে পারিনি।শুধু মনে হল যে, অামি অাসলেই ভুল করছি।রাগের মাথায় ভুল সিদ্বান্ত নিয়েছি। এরপর অামি নিশিকে বারণ করে দিলাম।কিন্তু অারশি মিথ্যেটাকেই সত্যিই বলে মনে করল।অথছ একবার নিশিকে দিয়ে সত্যিটা জানানোর চেষ্টাও করেছি কিন্তু কাজ হয়নি।বাড়িতে সবকিছু জানাজানি হয়ে গেল।সেদিন রাতে খাবার টেবিলে বাবা ভীষণ জোরে বকাঝকা করল অামাকে।অামি কেমন জানি হয়ে গেলাম।অারশির পথ অাগলে রাখার চেষ্টা করতাম।অধিকারটুকু ফিরে পেতে চাইতাম।অকথ্য ভাষায় গালি দিতাম, সন্দেহ করতাম।বিশ্বাস কর অামি এমন ছিলাম না। তোমার অবহেলাগুলো অামাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে।তোমার মুখ অামার দিক থেকে উল্টো দিকে ঘুরে গেছে।তাই ভাবলাম এ শহর অামাকে সুখ দিতে পারবেনা।সিদ্বান্ত নিলাম শহর থেকে অনেক দূরে চলে যাব।তারপর সাতদিনের মধ্যে ভিসা লাগিয়ে সোজা ডুবাই চলে অাসলাম।
অাচ্ছা ওই শুকনো ফুলগুলো কি বইয়ের ভাঁজে এখনো অাছে নাকি ফেলে দিয়েছ জানালায় হাত বাড়িয়ে? হয়ত ফেলেই দিয়েছ।অার শুন কাউকে স্টার প্লাসের নাইলার কাহিনী শুনাবেনা।সবাই তো অার অামার মত না।হয়ত বিরক্তবোধ করবে।তুমি একবার অামাকে বলেছিলে না ” সমবয়সী প্রেমগুলো টাকার জন্য থেমে যায়।পড়ালেখা অবস্হায় প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায়।অার প্রেমিক শুধু দেখে যায়।” নিয়তির কি পরিহাস দেখ, আগামি দুইবছরে অামি লাখ টাকার মালিক হয়ে যাব কিন্তু তুমি পাশে থাকবেনা।বাড়িতে এখন অার যাবনা,২০২২-২০২৩ সালের দিকে যাব।মন উঠে গেছে সবার থেকে।ভুল তুমিও বুঝেছ অামিও বুঝেছি। পার্থক্য শুধু এখানেই তুমি ভুল বুঝে দূরে চলে গেলে অার অামি ভালোবেসে গেলাম।