অগ্রহায়ণী

অগ্রহায়ণী

“আপনারা বৃষ্টিতে ভিজলে আমাকে ছাতাটা দিয়ে দেন।অনেকক্ষণ যাবত বৃষ্টির কারণে বের হতে পারছি নাহ।” ২২-২৩ বছর বয়সী ছেলের কথা শুনে স্বপ্ন আর স্মৃতি পেছনে ফিরে তাকায় কিছুটা আড়চোখে। জিন্স প্যান্ট হাটুঁর কাছে গুটানো,শার্টের হাতা গুটিয়ে নেওয়া,হাতে স্যান্ডেল জোড়া আর মাথায় পলিথিন ব্যাগ।হাস্যকর ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো,করুণ সুরে কথা গুলো বলে ছাতার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।যেনো আজ ছাতাখানা না পেলে এইজন্মে আর পাবে নাহ। স্বপ্ন আর স্মৃতি নবম শ্রেণিতে পড়ে।ছাতা থাকা স্বত্তেও দুজন আজ পণ করেছে বৃষ্টিতে ভিজবে।স্বপ্ন মানা করলেও স্মৃতি শুনতে চায় নাহ।

স্মৃতির জোরে স্বপ্ন মানতে বাধ্য হয়েছে।মেয়ে হিসেবে খুব চুপচাপ,বাধ্য স্বপ্ন।বাবার দেওয়া নাম অগ্রহায়ণী আর মায়ের দেওয়া নাম স্বপ্ন।স্বপ্নের বাবার দেওয়া নামটা বেশি পছন্দের কিন্তু সবাই নামটা ভালো ভাবে উচ্চারণ করতে পারে না।সবসময় নামের উচ্চারণ বিকৃত করে ফেলে।যাতে অনেক রাগ হয় স্বপ্নের তাই সবাইকে স্বপ্ন নামটা বলে।আর ডাক নামও স্বপ্ন হয়ে যায়।ছোট বয়স থেকেই স্বপ্ন খুব দায়িত্ববান আর বুঝদার। খাতার ভিতর নিজের নাম কিন্তু অগ্রহায়ণী লিখে রাখে স্বপ্ন।

হাতের ভেজা ছাতাটা এগিয়ে দেয় স্বপ্ন।খুব দ্রুততর গতিতে হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নেয় ছেলেটা।আর দ্রুত গতিতে হাটঁতে থাকে।অবাক চোখের চাহনিতে তাকিয়ে থাকে স্বপ্ন।ধন্যবাদ ও দেয় নাহ,কিভাবে ফিরিয়ে দিবে তাও জিজ্ঞেস করেনি ছেলেটা?অচেনা যুবক ছেলেটির চলে যাওয়ার দৃশ্যকরণ চিত্রটি যেনো মুগ্ধকর কোনো দৃশ্যরূপ।কিশোরী বয়সের স্বপ্নের যেনো এই দৃশ্যকাব্য হাজারো বছর দেখবে বলে মনের ভিতর ইচ্ছা পোষন করে।

রোজ সকালবেলা স্মৃতি আর স্বপ্ন স্কুলে যায় একসাথে।স্মৃতি কথার ফুল ঝুরি ফোটায় আর স্বপ্ন ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ততা দেখে। হঠাৎ রাস্তার পাশের রেললাইনের এক কম্পিউটারের দোকান থেকে একটা ছেলে ডাক দেয় ওদের।প্রথম প্রথম বুঝতে পারে নাহ কারণ নাম ছাড়া ডাকছিলো এই মেয়ে এই মেয়ে বলে।

রাস্তার পাশে এসে দাড়াঁয় ছেলেটা।হাপিঁয়ে উঠেছে এক বুক শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “গতকালের জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।কিছু না বলেই চলে এসেছিলাম।ছাতাটা ও ফেরত দেওয়া হয় নি।সেই সকাল থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কখন আসবেন তাই।আর ধন্যবাদ।গতকাল ছাতাটা না দিলে খুব অসুবিধায় পড়তাম।” স্বপ্ন ছাতাটা নিয়ে স্কুলের পথে হাটাঁ ধরে।মুখ বন্ধ করে মনের ভিতরের উত্তেজনা টের পায়।পেছনে ফিরে তাকানোর সাহসটুকু হয় নাহ।চোখ বন্ধ করে হাটঁতে থাকে। আবারো হাকঁ ছেড়ে ডাক দেয় ছেলেটা।

দৌড়ে এসে স্মৃতি আর স্বপ্নের সামনে দাড়াঁয়।স্মৃতির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আমি মাশুক।তোমার নাম কি?কিসে পড়?” স্মৃতি তার নতুন কালার করা চুল গুলো সামনে এনে কিছুটা ভাব নিয়ে বলে উঠে, “স্মৃতি,নবম শ্রেণিতে পড়ি।” রোদের আলোতে মাশুকের মলিনত্ব চেহারাবন্দি আনন্দ গুলো চিক চিক করে উঠে। ভদ্রতার খাতিরে স্বপ্নকেও জিজ্ঞেস করে, “আপনার নামটা?আপনি কি স্মৃতির বান্ধবী? “অগ্রহায়ণী।”

এই বলে থমকে যায় স্বপ্ন।বুঝতে পারে তার বুকের ভিতরের হৃদপৃন্ডের স্পন্দন হাজারো গুণ বেড়ে গিয়েছে।উল্টো পাশ ঘুরে হাটাঁ শুরু করে স্বপ্ন।পেছনে স্মৃতি কথা বলতে বলতে আসে। শ্যাম বর্ণের গায়ের রংয়ের মেয়ে স্বপ্ন।গোল চেহারা,নিটোল গাল,স্বাস্থ্যও ভালো,ঘন কালো চুল। অপর পক্ষে স্মৃতি বিপরীত।দুধেআলতা গায়ের রং,লম্বাটে চেহারা,ছিপছিপে দেহ,বাহারি ভাবে চুল কাটা। সবাই স্বপ্নের থেকে স্মৃতির সাথে কথা বলতে আগ্রহী। উঠতি বয়সের কিশোরী দুজন।সব কিছুতে আগ্রহ,যা দেখে সবই রঙিন লাগে।

রোজই মাশুক স্মৃতির সাথে কথা বলতো স্কুল শুরু হওয়ার আগে আবার স্কুল ছুটি হওয়ার পর।এটা ওটা কিনে দিতো।টিফিন টাইমে স্কুল ফাঁকি দিয়ে স্মৃতি মাশুকের সাথে ঘুরতে যেতো। প্রথম প্রথম স্বপ্ন স্মৃতির সাথে যাওয়া আসা করতো।যখন মাশুক কথা বলতো তখন স্বপ্ন আগে হেটেঁ চলে যেতো।আস্তে আস্তে স্বপ্ন স্মৃতির সাথে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।রোজ স্মৃতি শুধুই মাশুকের কথা বলতো তা স্বপ্নের ভালো লাগতো নাহ। বয়সটা যেনো কৌতূহলের ছিলো তখন।নতুন নতুন বড় হওয়ার স্বাদ,স্বাধীনতার স্বাদ,সব মিলিয়ে এই বয়স যেনো আগ্রহপূর্ণ বয়স।

স্বপ্ন একা একা যখন মাশুকের দোকানের পাশ দিয়ে যেতো তখন মাশুকের দিকে তাকিয়ে থাকতো।প্রায়ই স্বপ্ন দেখতে পেতো মাশুক কম্পিউটারের দিকে এক নয়নে তাকিয়ে আছে। মাশুক বিকেলবেলা দোকানে বসে চা খেতো স্বপ্ন বিনম্রতায় ভরে তাকিয়ে থাকতো।মাশুক ভুল ভাবে তাকালেও স্বপ্ন চোখ নামিয়ে চলে যেতো।যেনো কিছুই হয়নি। যেই দোকানের দিকে ভুলেও তাকায়নি স্বপ্ন।এখন রোজ নিয়ম করে দুবেলা তাকাতো স্বপ্ন। মাশুক ছিল এক তরুণ যুবক আর স্বপ্ন কিশোরী বয়সের এক মেয়ে। স্বপ্ন বইয়ের ভাজে লুকিয়ে মাশুকের নাম লিখতো আবার কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে কালো ভরাট কালি দিয়ে কালচে করে ফেলতো।

খাতার কোণায় স্বপ্নের নামের সাথে মাশুকের নাম লিখতো।আর উল্লাসিত ভাবে মুচকি মুচকি হাসতো।আবার কেটে ফেলতো মাশুকের নাম। ভালোবাসা দিবসে সবাই ফুল কিনে।আগ্রহ লাগে স্বপ্নের ও একটা লাল গোলাপ ফুল কিনে স্বপ্ন।বইয়ের ভাজে লুকিয়ে রাখে স্বপ্ন।পাছে মা যদি দেখে এই ভয়ে। নিত্য নতুন হিন্দি গানের পসরা চলতো ক্লাস রুমে।গানের কলি খেলতো টিফিন টাইমে সবাই।গান দেখার থেকে বেশি প্রথম দু-চার লাইন গান মুখস্ত করতো।স্বপ্ন ও শুনতো গান আর গুনগুন করে গান গাইতো আর ভাবতো মাশুকের কথা।

একদিন স্মৃতির খাতায় মাশুকের নাম্বার লেখা দেখে হুট করে নাম্বার টা মুখস্ত করে ফেলে।বাসায় এসে মায়ের ফোন দিয়ে ফোন দেয় ভয়ে ভয়ে।এক রিং দেওয়ার পর কেটে দেয়।আবার ফোন দেয়,মাশুক ফোন ধরার পর স্বপ্ন কেটে দেয় ভয়ে।আবারো মাশুক ফোন দেয় স্বপ্ন ফোন ধরে নিঃশব্দে মাশুকের হেয়ালি হ্যালো কথা শুনতে থাকে।তারপর ফোন বন্ধ করে দেয় ভয়ে যদি আবার ফোন করে মাশুক? আর মায়ের কাছে ধরা পরে যায়? যদি মাশুক বুঝে ফেলে এটা স্বপ্ন? কিভাবে দেখাবে মুখ স্বপ্ন?সারারাত জেগে থাকে স্বপ্ন সেই ভয়ে।

একদিন দেখতে পায় মাশুকের দোকান বন্ধ।রোজকার চায়ের দোকানে বসেও চা খেতে আসে নাহ। খুব কষ্ট লাগে স্বপ্নের,সারাক্ষণ মাশুকের কথা ভেবে মন খারাপ হতো স্বপ্নের। একদিন লাজলজ্জা ভেঙ্গে স্মৃতিকে জিজ্ঞেস করে মাশুকের কথা।স্মৃতি জানায় তার সাথে মাশুকের ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে।স্বপ্ন ব্রেকাপ শব্দের সাথে পরিচিত ছিলো নাহ।বুঝতে পারে নাহ এর অর্থ,শুধু বুঝতে পারে স্মৃতির সাথে যোগাযোগ নেই। ফোনেও ফোন দেয় স্বপ্ন কিন্তু ফোন বন্ধ পায়।

সময়ের স্রোতস্বিনীতে সময় যেনো ভেসে যায়। ভুলে যায় কৈশোর বয়সের ভালো লাগাকে।ভুলে যায় প্রথম হঠাৎ হৃদপৃন্ডের ধুকপুকুনির কথা,ভুলে যায় বইয়ের ভাজের লুকানো শুকনো গোলাপের কথা,ভুলে যায় ভয় পেয়ে ফোন বন্ধ করে রাখার কথা,ভুলে যায় অবাক চোখে তাকানোর কথা। সময় যেনো সব ভুলিয়ে দেয় এক নিমিষে। স্বপ্ন এস.এস.সি শেষ করে,এইচ.এস.সি শেষ করে এম.এ শেষ করে নতুন ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে জয়েন করে।বিয়ের জন্যে বেশ তোড়জোড় চলছে স্বপ্নের।

স্মৃতির বিবাহিত জীবন বেশ কাটছে।বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেশ সুখে ঘরকণ্যা করছে। স্বপ্নের সাক্ষর ছাড়া ব্যাংকের লোন পাশ হয় নাহ। এক কর্মকর্তা এসে স্বপ্নকে জানায় তার সাথে ব্যাংকের একজন গ্রাহক দেখা করতে চায়।স্বপ্ন রুমে আসতে বলে। এলোমেলো আধঁপাকা চুল,মোটা ফ্রেমের চশমা,ময়লাটে শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে এক লোক ভেতরে প্রবেশ করে।উচ্চস্বরে বলে উঠে অগ্রহায়ণী?স্বপ্নকে কেউ এই নামে ডাকে নাহ,শুধু সার্টিফিকেটে অগ্রহায়ণী নামটা।
লোকটা বলে উঠে,

“চিনতে পেরেছো?আমি মাশুক।তোমার স্কুলের সাথে আমার দোকান ছিলো।তুমি আমাকে ছাতা ধার দিয়েছিলে?”
“লোন ফরমে এই নামটা দেখে তোমার কথা মনে হলো।এই নাম আর কোথাও পায়নি কখনো।নামটা যে বড্ড পরিচিত আমার কাছে।”

স্বপ্ন চিনতে পেরে কিছুটা হকচকিয়ে যায়।সেই টগবগে উৎসুক যুবক আর এখনকার আধঁবুড়ো লোকটার সাথে কোনো মিল নেয়। সময় যেনো মানুষকেও সময়ের সাথে পরিবর্তন করে দেয়।স্বপ্ন এখন খুবই আকর্ষণী সময়ের সাথে স্বপ্ন পরিবর্তন হয়েছে।হয়ত সময়ের সাথে একসময় স্বপ্ন ও বুড়ি হয়ে যাবে যেমন সেই তরুণ যুবক মাশুক আজ আধঁবুড়ো।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়।নয়ত সময়টা এগিয়ে যাবে আর আপনি পিছিয়ে পড়বেন।কৈশোরের ভালো লাগা সেতো নিছক ভালো লাগা সময়ের সাথে তার ও পরিবর্তন হয়। বিশেষ দ্রষ্টব্য : সকল মানুষ এক হয়না।ভিন্নতা মানুষের মধ্যে থাকবেই এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়ম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত