উফফফ বাইরে কি অসাধারণ ঝড় উঠেছে। যাই একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। যেমনি ভাবা অমনি কাজ। লাগালাম ছুট। যেতে গিয়ে মায়ের সাথে লাগল একককককক ধাক্কা। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ছুটলাম। পিছন থেকে মায়ের আওয়াজ ভেসে এল ” এইইইইইই মেয়ে দেখে শুনে চলাফেরা করতে পারিস না। এক্ষুনি একটা কান্ড ঘটত। আর ছুটে ছুটে চলেছিস কোথায়? কিরে? ঘোড়ায় জিন দিয়ে বেরিয়েছে। ঐ দেখো বাইরে ঝড় উঠেছে আর এই মেয়ে সব জানলা-দরজা বন্ধ না করে ছুটেছে। ধূলোয় ঢুকে এক্ষুনি সব নোংরা হয়ে যাবে। ধূরররর ধূরররর বাবা আর ঠাকুমা মিলে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। কাজ কম্ম কিচ্ছু শিখল না।”
বলাবাহুল্য আমি সব এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চললাম। ছাদে গিয়ে মনটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল। মাতাল ঝোড়ো হাওয়া নেশা লাগিয়ে দেয়। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে।মাঝে মাঝে হাওয়ার তেজ এতো বেশি হচ্ছে যে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে মুখের মধ্যে আছড়ে পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। একটা অদ্ভুত মনমাতানো গন্ধ নাকে আসছে। আমি দু হাত মেলে এইসব উপোভোগ করছি। এমন সময় কে যেন এসে আমার কান টা চেপে ধরল। তাকিয়ে দেখি স্বয়ং যমরাজ। হ্যাঁ যমরাজের মতোই ভয় পাই আমি আকাশদা কে। আকাশদা মানে আকাশদীপ বসু আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। আকাশদার মা বাবা মানে জেঠু জেঠিমা কে আমি খুব ভালোবাসি ওঁরাও আমাকে খুব ভালোবাসে।
কিন্তু আকাশদাকে আমি ছোটো থেকেই ভীষণ ভয় পাই। ওহ্ এতক্ষণ হয়ে গেল আমার নিজের পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি। আমি নীলাঞ্জনা, নীলাঞ্জনা রায়। বাড়িতে মা, বাবা আর ঠাকুমার আদরে বাঁদর তৈরি হচ্ছি। এখন কলেজের ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। কেমিস্ট্রি অনার্স। আর আকাশদা হল পন্ডিতমশাই। ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনায় দারুণ, এখন কেমিস্ট্রি নিয়ে পি.এইচ.ডি করছে।আমাকে আকাশদা ই কেমিস্ট্রি টা পড়ায়। বাড়ির পাশে এরকম একজন বিদ্বান পন্ডিত থাকতে কে আর কষ্ট করে টিচার খোঁজে বলুন।
উবফফফফ বড্ড বেশি আজব মানুষ এই আকাশদা আর সেরকম বেরসিক।আকাশদার সারা ঘরময় বইয়ের মেলা। দেখলে মনে হবে কোনও মানুষের থাকার ঘর নয় আস্ত একটা লাইব্রেরি। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। কি যে এত পড়ে কি করে যে এত পড়ে আমার মাথায় ঢোকে না। আমার তো পড়তে বসলেই মনে হয় অনেক হল এবার উঠি। শুধু আকাশদার ভয়ে পড়াশোনাটা করতেই হয়। আকাশদা ছোটো থেকেই একটু ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির। খুব একটা বেশি বন্ধু বান্ধব নেই যত বন্ধুত্ব সব ঐ বইয়ের সাথে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন পড়াশুনায় আমি অতীব কাঁচা আর অন্যজন অত্যন্ত বেশি পরিমাণে পাকা। ফলেই আমার মাতৃদেবী এবং পিতৃদেবের কাছ থেকে ছোটো থেকেই শুনে আসতে হয় “আকাশকে দেখে কিছু শেখ। যেমন ভালো পড়াশুনায় তেমন ভালো ছেলে। একেবারে রত্ন। সারাদিন এরকম উড়নচন্ডীর মতো ঘুরে না বেড়িয়ে কিছু তো শিখতে পারিস মা।” এই নামাবলী শুনলেই আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি জ্বলে যায়। সেই ছোটো থেকে ঐ গোমড়ামুখোটার গুণগান শুনে আসছি। কিন্তু মা বাবার কথা আমি কোনোকালেই কানে তুলিনি। শুধু ঐ বজ্জাতের হাড্ডি আকাশদা কে দেখলেই আমার পিলে চমকে যায়। উফফ কম মার আর বকা খেয়েছি ওঁর থেকে। তখন ক্লাস টেনে উঠেছি, সামনে মাধ্যমিক, ভালো ফল করা আবশ্যক; সুতরাং আমার পড়াশুনার গুরুদায়িত্ব বাবা আকাশদার উপর দিয়ে দিল। ব্যাস শুরু হল দ্বিগুণ অত্যাচার। তখন আমার আকাশদার উপর এতো রাগ হত না মনে হও জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে নি। তবে এই চশমা পড়া গোমড়ামুখোটাকে যে কখন একটু একটু করে ভালোলাগতে শুরু করেছিল বুঝিনি। সেবার আকাশদার দৌলতেই মাধ্যমিকে বেশ ভালো ফল করেছিলাম, সায়েন্স টা ও নিতে পেরেছিলাম। নয়তো অঙ্কে আমার যে পরিমাণ ভয় ছিল বলার নয়। আকাশদার জন্যই এই ভয়টা দূর হয়।
আকাশ:- বদমাইশ মেয়ে।
আকাশদার আওয়াজ শুনে আমি ফ্ল্যাস ব্যাক থেকে ফিরে এলাম।
আমি:- আহহহ ছাড়ো লাগছে তো। এবার আমার কানটা ছিঁড়ে তোমার হাতে চলে আসবে।
আকাশ:- লাগছে?? আরও জোরে কানটা মুলে দেব। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিস। সামনে না তোর পরীক্ষা। এরপর ঠান্ডা লাগাবি। শরীর খারাপ করবি তারপর পড়তে পারবি না আর পরীক্ষা খারাপ দিবি।
আমি:- কোথায় বৃষ্টি?? এইটুকু বৃষ্টিতে কারুর ঠান্ডা লাগে নাকি।
তখনই নীচ থেকে মায়ের গলা ভেসে এল-
” নীল আকাশ নীচে নেমে আয়।”
এই নীল আকাশ ডাকটা আমার ভীষণ প্রিয়।
শুনলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। ওহ নীল হচ্ছে আমার ডাক নাম, সবাই ঐ নামে ডাকে।
নীচে এসে মা আর আকাশদার আর এক দফা বকা খেয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকলাম।
মনে মনে বিড়বিড় করছি ” ধূররর পুরো মোমেন্টাই নষ্ট করে দিল।”
আকাশ :- কি বললি??
পিছন ফিরে দেখি আকাশদা চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম ” না মানে ওয়েদারটা এত ভালো। ঝড় বৃষ্টি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।”
আকাশ:- বোকা বোকা কথাগুলো একদম বলবি না নীল। এরকম দোতলা পাকা বাড়িতে বসে হাওয়া খেতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু যাঁরা রাস্তায় পড়ে থাকে তাঁদের কথা ভেবেছিস কখনও?? এই ঝড় বৃষ্টিতে কি ভোগান্তি টাই না হয় ওদের। এরকম বিধ্বংসী ঝড় কত ছোটোখাটো বাড়িঘর উড়িয়ে নিয়ে যায় তোর কোনো ধারণা আছে? কত মানুষ গৃহহীন হয়। কিংবা যদি রাস্তার মাঝে গাছ ভেঙে পড়ে কোনো এমার্জেন্সি সিচুয়েশনে যাতায়াতের কত অসুবিধা হতে পারে জানিস? নীল এবার তো বড়ো হ। স্বপ্নের এই রোম্যান্টিক দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব টা চিনতে শেখ।
এইজন্য আকাশদা কে আমার এত ভালো লাগে। আকাশদা সবার থেকে আলাদা। ওঁর চিন্তা ভাবনা গুলোই অন্যরকম। সবাই যা ভাবে যা করে আকাশদা তার ধার কাছ দিয়ে ও যায় না। ওঁর ব্যাক্তিস্বতন্রটাই আলাদা। এই আকাশদাকেই একসময় মনে মনে কত গালমন্দ করেছি। হিটলার একটা। কিন্তু এই গোমড়ামুখো হিটলারটার প্রতি কখন যে আমি এত দুর্বল হয়ে পড়েছি নিজেও জানি। কবে কখন প্রথম যে ভালোলাগাটা মন ছুঁয়ে গেছিল মনে পড়ে না। হয়তো সেদিন যেদিন পড়ানোর সময় আকাশদা খুব রেগে গেছিল। সেদিন আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। আসলে আকাশদা বাড়িতে যে কাজগুলো দিয়েছিল আমি করতে ভুলে গেছিলাম। আর এই সব ব্যাপারে আকাশদার কাছে কোনো ছাড় পাওয়া যায় না।
“গেছো মেয়ে, পড়াশুনায় মন নেই। সারাদিন শুধু ঘুরে বেড়ানো” – বলতে বলতে আকাশদা একটা স্কেল নিয়ে হাতের চাটুতে সপাসপ মারছিল।
আমি চুপচাপ মারগুলো হজম করছিলাম। একটা শব্দ ও করিনি।
স্তব্ধতা ভেঙে আকাশদা বলে উঠল- ” নে এবার কাজগুলো চটপট করে দে।”
অগত্যা আমিও কাজগুলো করতে শুরু করলাম, কিন্তু মার খেয়ে হাতে এত ব্যাথা যে পেনটা ঠিক করে ধরতেই পারছিলাম না। বোধহয় আকাশদা সেটা বুঝতে পেরেছিল।
কারণ ঠিক তখনই আকাশদা আমার কাঁধে হাত রেখে নরম ভাবে বলে উঠল- ” কিরে খুব লেগেছে?”
আমি চুপ করেই ছিলাম। একটা চাপা কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে ছিল ফলে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না।
আকাশ:- কিরে খুব কষ্ট হচ্ছে??
আর থাকতে পারলাম না এবার হূ হূ করে কেঁদে ফেললাম।
আর তখনই মহা খারুশ আকাশদা আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল “কাঁদিস না নীল। খুব লেগেছে না। আসলে মাথাটা এত গরম হয়ে গেল যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। এত জোরে তোকে মারা আমার উচিত হয়নি।”
আমার চোখের জল মুছিয়ে হাতটা নিয়ে দেখে বলল- ” ইশশশ পুরো লাল হয়ে গেছে। চল ওষুধ লাগিয়ে দি। আজ আর পড়তে হবে না।”
তারপর খুব যত্ন করে আমার হাতে ওষুধ টা লাগিয়ে দিয়েছিল।
আমি শুধু আকাশদাকে দেখছিলাম। খুব অদ্ভুত ভাবে সেদিন এত মার খেয়েও আকাশদার উপর আমার একটুও রাগ হয়নি। সব কষ্ট নিমেষে উধাও হয়ে গেছিল। একটা ভালোলাগায় মনটা ভরে ছিল। আকাশদা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল অদ্ভুত একটা শিহরণ, অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছিল। সেদিন সারারাত শুয়ে শুয়ে বারবার আকাশদার কথা মনে হচ্ছিল। সেদিনই কি প্রথম ভালো লেগেছিল নাকি সেই বৃষ্টিভেজা সকালে। যেদিন বাড়ি ফেরার সময় তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। তার মধ্যেই দেখলাম আকাশদা দাঁড়িয়ে আছে একটা দোকানের নীচে। নিশ্চয়ই ছাতা নেই। সৌজন্যের খাতিরেই হয়তো এগিয়ে গিয়ে বললাম ” আকাশদা আমার সাথে চল। ছাতাটা বড়ো দুজনের অসুবিধা হবে না আর এই বৃষ্টিও এত সহজে থামবে বলে মনে হয়না।”
আকাশদা ঠিক দু মিনিট সময় নিয়ে ভেবে বলল “ঠিক আছে চল।”
সেদিন পাশাপাশি হাঁটার সময় মাটির ঐ সোঁদা গন্ধে সাথে আকাশদার গায়ের গন্ধে মনটা পাগল হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ই মনে ভাবনা চলে আসে যদি এইভাবেই সারাজীবন হাঁটা যেত। ভাবনাটা মনে এসেই সেদিন মিলিয়ে গিয়েছিল।
এরকম টুকরো টুকরো কত ঘটনা যে ছড়িয়ে রয়েছে তার ঠিক নেই। তার মধ্যেই কোনো এক মুহূর্তে হয়তো প্রথম ভালো লেগেছিল।
এইসব অনেক পুরানো কথা। তারপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। ঐ অনুভূতি গুলো শাসন না পেয়ে পেয়ে আরও বাড় বেড়েছে। তাদের উৎপাতে আজকাল আমার টেকা দায়। ঐ পঁচা, বজ্জাত ছেলেটার উপর কখন যে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। কখন যে মনের সিংহভাগ অংশ দখল করে বসল টের ও পেলাম না। এইভাবেই দিন কাটতে লাগল। আমিও সারাদিন অপেক্ষা করতাম ঐ বিকেলটা আসার, আকাশদা কখন পড়াতে আসবে। ঐ কয়েকটা ঘন্টা আমার সারাদিনের অক্সিজেন। ওই সময়টুকু আকাশদার সাথে থাকতে পেরে মনের সব আশ মিটিয়ে নি। হোলির দিনগুলোতে ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতাম, যখন আকাশদা আসত দরজা খুলতাম। প্রথম রঙ টা আকাশদার থেকে মাখার জন্য। কিন্তু আমার এই গোপন অনুভূতিগুলোর কথা শুধু আমার মনই জানে। মুখ ফুটে আকাশদা কোনোদিন বলতে পারিনি। কতবার ভেবেছি এবার বলে দি -” ভালোবাসি তোমাকে। অনেক অনেক ভালোবাসি। পারবো না তোমায় ছেড়ে থাকতে।”
কিন্তু ঐ যে বললাম আকাশদার সামনে আমি ভীতুর ডিম। কিচ্ছুটি বলতে পারি না।
আকাশ:- কী ব্যাপার বল তো তোর?? কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিস আজকে বারবার??
আমি:- কই কিছু না তো। বলো কি পড়াবে আজকে?
আকাশ:- (চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে) ভূতের মুখে রাম নাম শুনলেও এতটা অবাক হতাম না যতটা তোর মুখে পড়ার কথা শুনে হচ্ছি।
আমি:- উফফফফ আকাশদা তুমি না যা তা।
আকাশ:- হা হা। নে আর রাগ করতে হবে না। আজকে তোর পড়ার ছুটি। একটা ভালো গান শোনা তো।
আমি:- (অবাক হয়ে) কী? ছুটি? তুমি নিজে ছুটি দিচ্ছ। ভূতের মুখে রাম নাম শুনলেও এতটা অবাক হতাম না যতটা তোমার মুখে ছুটির কথা শুনে হচ্ছি।
আকাশ:- তুই আমাকে নকল করছিস?
আমি:- না মানে না তো। আসলে তুমি এর আগে তো কোনোদিন বলোনি তাই।
আকাশ:- তো? আজ তো বলছি। গান শোনাবি কিনা বল।
আমি:- আচ্ছা শোনাচ্ছি।
এই বৃষ্টির দিনে একটা বৃষ্টিমুখর গান ই ধরলাম।
আজি ঝরোঝরো মুখরো বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে
উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান ।
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায় …মন চায় …
হৃদয় জড়াতে কারো চির -ঋণে
আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে . . .
জানি নে জানি নে … কিছুতে কেন যে মন লাগে না।
গান শেষে আকাশদা বলল- ” বাহ্ গানটা কিন্তু তুই দারুণ গাস। যে শুনবে সেই প্রেমে পড়ে যাবে।
কথাটা শুনেই আমার হৃৎপিন্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল- যে কেউ মানে আকাশদাও। না ধূর কী সব ভাবছি আমি। আকাশদা তো কোনোদিন আমাকে এরকম কোনো আভাস দেয়নি।
আকাশ:- কী ব্যাপার বল তো তোর?? এসে থেকে দেখছি তুই কিছু ভেবে যাচ্ছিস। কী হয়েছে বল??
আমি :- না কিছু না।
আকাশ:- দেখ বলতে না চাইলে বলিস না, কিন্তু মনের কথা বেশিদিন মনে চেপে রাখতে নেই। আর বেশিদিন পারবি ও না চেপে রাখতে। কোনো না কোনোভাবে তা প্রকাশ পাবেই। আর তাছাড়া বেশিদিন মনের কথা মনে রেখে দিলে মনের উপর চাপ বাড়ে আর সেটা যেকোনো দিন ব্লাস্ট করতে পারে। তো বেটার মনের কথা মনে চেপে না রাখা।
(মনে মনে) আকাশদা এসব কেন বলছে?? তাহলে কি কিছু বূঝে গেল?? কিন্তু সত্যিই তো আর কতদিন চেপে রাখব একদিন তো সবাই বুঝেই যাবে তার চেয়ে ভালো আমি নিজেই বলে দি। কিন্তু আকাশদা আমার ব্যাপারে কি ভাবে না জানা পর্যন্ত। আচ্ছা আকাশদা তো আমার কত কেয়ার করে, খেয়াল রাখে। নিশ্চয়ই আকাশদা আমাকে ফেরাবে না। হ্যাঁ আজকেই আমি বলে দেব।
আমি:- ইয়ে আকাশদা তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।
আকাশদা:- হুম বল।
আমি:- বলছি। মানে অনেকদিন ধরেই বলব ভাবছি।
আকাশ:- কী হয়েছে নীল? এই ঠান্ডা ওয়েদারে ঘামছিস কেন?? তাও ফ্যান চলছে।
আমি:- (ঢোঁক গিলে) জল খাব।
আকাশ:- (জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে) এই নে জল।
আমি প্রায় এক নিঃশ্বাসে পুরো জলটা খেয়ে নিলাম।
কিছুক্ষণ পর………
আকাশ:- নীল তুই কিছু বলবি বলে আমাকে পনেরো মিনিট ধরে চুপচাপ বসিয়ে রেখেছিস। এবার কি বলবি??
আমি:- (কান্না কান্না মুখ করে) আমাকে বকবে না তো??
আকাশ:- (হেসে) আমি কি সব সময় তোকে বকি?? এত ভয় পাস কেন আমাকে??
আমি :- না মানে (মনে মনে- বাবারে এত টেনশন তো অঙ্ক পরীক্ষার আগেও হয়নি)।
আকাশ:- আচ্ছা বাবা বকবো না। এবার বল।
আমি:- আকাশদা আমার না তোমাকে খুব ভালো লাগে। অনেকদিন থেকেই। কিন্তু তোমাকে বলতে পারিনি। মানে আমি কি তোমাকে বোঝাতে পারছি?? আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আকাশ:- নীল (চিৎকার করে উঠল আকাশদা)।
এই মূহুর্তে আকাশদার মুখটা একদম থমথমে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমি এমন কিছু বলে দিয়েছি যেটা আকাশদা একদম আশা করেনি। এমন একটা কথা যেটা আকাশদা শুনতে চায়নি। খুব ভয় করছে আমার। আকাশদা কি খুব রেগে গেল।
তারপর দেখলাম আকাশদা আস্তে করে আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল- ” ভালোবাসা কি শুধু নারী পুরুষ বা স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই হয়? আর কারুর মধ্যে হয় না?”
আমি:- মানে?? কি বলতে চাও তুমি??
আকাশ:- মানে আমিও তোকে ভালোবাসি নীল কিন্তু এই ভালোবাসাটা নারী পুরুষের ভালোবাসা নয়। ছোটো থেকে তোকে আমি আমার ছোটো বোনের মতো দেখে এসেছি। এখনও তাই দেখি। ভালোবাসার অনেক ধরণ হয় রে নীল। সব ভালোবাসা তো আর এক ধাঁচে গড়া হয় না। সেই ছ’বছর বয়সে ছোট্ট নীল কে কাকিমা আমার কোলে দিয়ে বলেছিলেন এই দেখ তোর বোন। সেইদিন থেকে আজ অবধি তোকে শুধুমাত্র নিজের বোন ই ভেবে এসেছি। ছোটো থেকেই আমার একটা বোনের শখ ছিল তুই এসে আমার সেই ইচ্ছেটা পূরণ করলি। তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি রে। তোকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু আজ তোকে এই কষ্টটা না দিলে ভবিষ্যতে তোকে আরও বেশি কষ্ট পেতে হত। আজ আসি রে। প্লিজ কষ্ট পাস না। ভালো থাকার চেষ্টা কর।
আকাশদা চলে গেল। আমি থম মেরে বসে রইলাম।
বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে কিন্তু আমার মনে আরও বড়ো ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ে সব তছনছ হয়ে যাবে। এক বিধ্বংসী ঝড়। খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সব স্বপ্নগুলো এক এক করে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। মানুষটা আমাকে নিজের ছোটো বোনের মতো দেখে আর আমি কিনা তাঁকে, ছিঃছিঃ। কি করে দাঁড়াব আমি মাথা তুলে আকাশদার সামনে।
কিন্তু আমি যা করেছি তারপর তো আমার একবার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। হ্যাঁ ক্ষমা চাইতেই হবে। যাবে আমি এক্ষুনি যাব আকাশদার কাছে। দৌড়ালাম। যাওয়ার সময় মা পিছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করল। সাড়া দিলাম না। এই মূহুর্তে আমার মাথায় একটাই জিনিস চলছে।
সোজা আকাশদার ঘরে চলে গেলাম।
আমি:- আকাশদা।
আকাশ:- একি তুই?? এখন এখানে?? এত বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এসেছিস। ঠান্ডা লাগবে তো, একটা ছাতা নিয়ে আসতে পারতিস। আচ্ছা ফোন নামক একটা বস্তু তো আছে নাকি। সেটা দিয়ে কল করে বলা যেত না যা বলার আছে। বলিহারি বুদ্ধি তোর। দাঁড়া তোয়ালে আনছি। মাথাটা মুছে নে। নাহলে জল বসে ঠান্ডা লাগবে।
আমি শুধু আকাশদাকে দেখছি। কি করে পারে এই মানুষটা এখনও এতটা স্বাভাবিক থাকতে।
আকাশ:- এই নে ধর।
আকাশ:- কি হল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মাথাটা মোছ। এবার ঠাণ্ডা লাগবে তো।
আমি:- আকাশদা তুমি এখনও এত স্বাভাবিক কি করে আছো?? তুমি এখনও আমার কথা ভাবছো। কি করে?? তোমার আমার উপর রাগ হচ্ছে না?? আমাকে তুমি বকো, মারো যা খুশি কর। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করে দাও। খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছি আমি।
বলেই কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লাম।
আকাশ:- ওঠ আগে তুই। আরে ওঠ ( আমাকে নীচ থেকে তুলে এনে বিছানায় বসালো)। কিসের ক্ষমা নীল? তুই তো কোনো ভুল করিস নি। ভালোবাসায় কোনো ভুল থাকে না। হ্যাঁ প্রথমে শুনে আমার একটু খারাপ লেগেছিল ঠিকই। কিন্তু পরে ভাবলাম এতে তো তোর কোনো দোষ নেই। আমরা কখন কোথায় কীভাবে কাকে ভালোবেসে ফেলি এটা কেউ বলতে পারে না। হ্যাঁ তুই যেভাবে চাস সেভাবে হয়তো কোনোদিন তোকে ভালোবাসতে পারবো না কিন্তু আমার মতো করে আমি তোকে সারাজীবন ভালোবাসব। যা হয়েছে সব ভুলে যা। নতুন করে শুরু কর। পড়াশুনাটা মন দিয়ে কর, নিজের পায়ে দাঁড়া। এখনও তোর সামনে অনেক বড়ো জীবন পড়ে আছে। এরকম অনেক ঘটনায় আমাদের জীবনে ঘটে। অনেক মানুষ জীবনে আসে। পরে এইসব কিছুর জন্য অনেক সময় পাবি।
এখন বাড়ি যা। কাকিমা চিন্তা করবে। চল আমি তোকে দিয়ে আসছি। নাহলে আবার বকা খাবি। কি হল এখনও মুখ ভার। এবার একটু হাস।
বাড়িতে এসে চুপচাপ খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল না। মনের মধ্যেকার ঝড়টা এখনও থামেনি। আকাশদার কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গেছে।
উঠে দেখলাম ঝড় থেমে গেছে। শান্ত পরিবেশ। ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ টা এখনও আছে। সূর্য্যিমামা যেন সদ্য স্নান করে এসেছে। এই সুন্দর পরিবেশ দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। মনের সব গ্লানি মুছে গেল।
ঠিকই তো বলেছে আকাশদা। ভালোবাসায় তো কোনো অন্যায় নেই। আমার ভালোবাসা তো এই সকাল টার মতোই পবিত্র, সুন্দর, স্বচ্ছ। ভালোবাসা তো সবসময় একরকম হয় না।ভালোবাসার অধিকার সকলের আছে। যে যেভাবে চাই সেভাবে ভালোবাসবে। আকাশদা তোমার কথা অনুযায়ী হয়তো আমার জীবনে ও অন্য মানুষ আসবে কিন্তু যেই আসুক না কেন তোমাকে আমি কখনও ভুলতে পারব না। আমি আমার মতো করেই তোমাকে ভালোবেসে যাব নীরবে।
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশিথিনিসম।