”কেকটা নিয়ে সোজা ঘরে চলে যাবি।কেউ যেন দেখতে না পায়।বাবা অফিস থেকে ফিরলে কাটা হবে।”
”কিন্তু গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দা দিয়ে যাবার সময় মণিমা তো দেখতে পাবে,এতো বড় প্যাকেট টা।যদি জিজ্ঞেস করে প্যাকেটে কি তখন কি বলব?”
ছোট্ট শুভম্ প্রশ্ন করে মাকে।শুভমের মা উত্তরে বলে-
” কিছু বলতে হবে না।বলবি জানি না।মা কিনে পাঠিয়েছে।”
”কিন্তু বোনুকে ডাকব না কেন?বোনুর জন্মদিনে মণিমা তো আমাকে ডাকল।তাহলে আমি কেন একা একা কেক কাটব?বলনা মা? মণিমা, বোনু আমাকে তো কত ভালবাসে!তুমি কেন সবসময় ওদের বলবি না,ওদের ডাকবি না এরকম বল?”
মণিমা শুভমের কাকীমা।পাশাপাশি দুটো ঘরে থাকলেও নমিতাবৌদির সঙ্গে কোনো মিল ছিল না।অথচ মণিমা মানে সুচরিতা মেয়েটা খুব ভাল।শুভম্ কে খুব ভালবাসে।
রাস্তাঘাটে চলতে-চলতে সমাজ-সংসারের চারপাশ দেখতে-দেখতে প্রতিদিনই কতরকম অভিজ্ঞতা হয় মানুষের জীবনে।যেমন ঠেকে শেখার ও শেষ নেই তেমন দেখে শেখারও শেষ নেই।স্কুল থেকে বেরিয়ে আমি মাঝে-মাঝে আসি এই কেক শপটাতে।মেয়ের জন্য কেক নিই।কোনো- কোনোদিন বাড়ীর জন্য টুকিটাকি কুকিজ, বিস্কুট এইসব কিনে নিয়ে যাই।আজ ঢুকেই দেখি আমাদের বাড়ীর নীচ তলার ভাড়াটে নমিতা বৌদি আর তার আট-বছরের ছেলে শুভম্ কেক শপটাতে কেক পছন্দ করছে।কেক পছন্দ করার ফাঁকে এইধরনের কথোপকথন আমার কানে এল।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আমি হাসতে-হাসতে শুভম্ কে বললাম-
”কি আজ বুঝি শুভম্-বাবুর বার্থ ডে?আমিও তাহলে কেক খেতে যাচ্ছি কিন্তু।”
শুভম্ বেচারা ঘাবড়ে গিয়ে একবার আমার মুখের দিকে একবার ওর মায়ের মুখের দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকাতে লাগল।আমাকে যেতে বলবে কি বলবে না সেটা বুঝতে পারছিল না ও।
”হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি আপনি আসবেন, আপনার মেয়েকেও নিয়ে আসবেন। আটটার সময় কেক কাটবে শুভম্।ঐ ওর বাবা অফিস থেকে ফিরলে।কিছুই না।সব বন্ধুদের দেখে তো কেক কাটতে।তাই আর কি !একটু আয়োজন করেছি ঘরোয়া।একটু রান্না করা,কেক কাটা।ছেলেটার মনে আফশোস থাকবে কেন বলুন?ওর বাবা তো কিছু কম দিয়ে মানুষ করছে না ওকে।দামী স্কুল,দামী মাস্টার সবই দিয়েছে।মাস গেলে কম টাকা তো যাচ্ছে না।আপনি আসবেন একটু চা খেয়ে যাবেন সন্ধ্যেবেলা।”
আমি কেমন হতচকিত হয়ে গেলাম।একটা সামান্য কথার প্রত্যুত্তর এমন লম্বা হতে পারে।সে আমার জানা ছিল না।মাস্টার দিয়েছে,টাকা খরচ করছে ওর বাবা,এ কি দরদাম করে কেনা বেচা চলছে নাকি?ছিঃ! কি নিচু মানসিকতা।অবশ্য আমি আর কিছুতেই অবাক হই না আজকাল।নমিতাবৌদিকে হাড়ে-হাড়ে চিনি আমি।যাইহোক হ্যাঁ হ্যাঁ করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলাম।কিছু আর কিনতে ইচ্ছে হল না।দরজার দিকে এগোতে-এগোতে শুনলাম চাপা গলায় নমিতা বৌদি ছেলেকে বকছে-
”হাবলা ছেলে একটা।সুলেখাদি বলছে যাবে কেক খেতে। বলবি তো হ্যাঁ।তা না হাঁ করে তাকিয়ে রইলি।তোর মাথার বুদ্ধিটা তোর বাপের মতোই মোটা।সুলেখাদি কত বই এনে দেয় স্কুল থেকে।জন্মদিনে ভাল গিফ্ট দেয়।পড়া দেখিয়ে দেয় দরকার পড়লে!বেশ হবে দরকারে আর পড়া দেখিয়ে দেবে না।—-কোনো গিফ্টও দেবে না।”
”আমি কি করে জানব? একটু আগেই তো মণিমা আর বোনুকে কেক কাটার কথা বলতে না করলে।আবার বলছো সুলেখাদিদিকে বললি না কেন?একটু পরেই তো বলবে কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা খরচ হয়ে গেল।গুষ্টিবর্গকে গেলাতে হল।আমি বুঝব কি করে মা?”
কাঁদো-কাঁদো গলায় শুভম্ বলতে লাগল।এরপর আরও কি কি বলল সেসব শোনার প্রবৃত্তি রইল না আমার। মুখটা কেমন বিস্বাদ লাগল।একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম।
কতরকম মানুষ দেখি,কতরকম কথা শুনি রোজই ,চুপ করে দেখতে থাকি। মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব।আজকাল আবেগ অনুভূতি,ভালবাসার কোনো দাম নেই।কত ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের মনে বিষ ঢেলে দিচ্ছে বাবা-মা।পরিবারগুলো যেন এক একটা একাকীত্বের দ্বীপ।কেউ কাউকে চেনে না, জানে না, খবর রাখে না।শুধু আমি আর আমার।শুধু নিজেকে ভালবাসা শুধু নিজের জন্য বাঁচা।এরাই আবার অন্যদের অসামাজিক বলে।আসলে এরা তো নিজেরাই হাতে করে অসামাজিক মানুষ তৈরীর বীজ বপন করছে।আরো কি ভয়ঙ্কর সময় আসতে চলেছে ভেবে নিজে -নিজেই শিউরে উঠি।
মনে-মনে ভাবলাম আজ আর তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরব না।বাড়ী ফিরলেই শুভম্ ডাকাডাকি করবে।আজ ওদের ঘরে আর যেতে ইচ্ছে নেই।কাল স্কুল থেকে ফিরে বাচ্ছাটার হাতে কিছু একটা উপহার দিয়ে দেব।ছোট্ট বাচ্ছার কি দোষ।এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে হাঁটছিলাম।গঙ্গার ওপারের আকাশটা লাল করে সূর্য শেষবারের মত তার বিদায়ী আলোয় সারাদিনের ক্লান্তি মুছিয়ে দিচ্ছে।ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার দুচোখ।কোন এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় চোখ দুটো জ্বালা করছে।
সকলকে নিয়ে মিলেমিশে আনন্দ করে জীবনটা কাটাব এই ভেবেই তো রজতের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি।কিন্তু আস্তে-আস্তে দেখলাম এই দুনিয়ায় কেউ কারো নয়। প্রয়োজনে ,
দুঃখে খুব কম সংখ্যক মানুষকে পাশে পাওয়া যায়।কখনও হয়তো বা পাওয়াও যায় না।অথচ অসামাজিক এই তকমাটা কত সহজে কারো-কারো নামের আগে বা পরে বসে যায়। এমন সমাজের কি দরকার?এমন সামাজিকতার কি প্রয়োজন?যেখান থেকে দুঃখ, যন্ত্রণা,সমালোচনা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না?হ্যাঁ আমি অসামাজিক।অসামাজিক হয়েই থাকব।সমাজ আমাকে কিছু দেয়নি।সামাজিকতা আমাকে আরও নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে।ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে জাতে নাপিতকে বিয়ে করার জন্য গোটা সমাজ যখন আমার বিরুদ্ধে চলে গেছিল, সেদিন বাবা বলেছিল-
” অসামাজিক হয়ে বাঁচতে পারবি না।গোটা সমাজকে বাদ দিয়ে একা বাঁচা যায় না।ভুল করছিস।আমি কিন্তু তোদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবো না।চোখের জল ফেলতে-ফেলতে চলে এসেছিলাম ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার সমস্ত স্মৃতিকে পিছনে ফেলে—,সেসব কথা থাক।আমি অসামাজিক।”
বিরাট বড় বাড়ী, গাড়ী,অর্থবৈভবে যখন আমার জীবনটা ঝলমল করছিল তখন আবার আস্তে-আস্তে সমাজ আমার কাছে এগিয়ে এসেছিল।যারা আমাকে কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতো না তারা কোন মধুর লোভে জানিনা আমাকে সবেতে ডাকা আরম্ভ করেছিল।কিন্তু রজত বড় একগুঁয়ে।ওর একটাই দোষ ও যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার দিকে আর তাকায় না।আমি একাই সব জায়গায় যেতাম।সকলের সাথে ভাল ব্যবহার করতাম।
”রজত আসেনি?ও কোথাও যায় না, না রে সুলেখা?একটু ঘরকুনো?একটু অসমাজিক না রে?যাকগে কি আর করবি! মানিয়ে তো নিতে হবে।”
এর কোনো উত্তর দিতে পারতাম না।এরপর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল।যারা এত সামাজিক সৌজন্যবোধের ধ্বজা উড়িয়ে দিত, তাদের কারো থেকে একবিন্দু সাহায্য পাওয়া গেল না।অত্যধিক ধকলে আমার পেটে থাকা পাঁচমাসের সন্তান আমাকে ছেড়ে চলে গেল।আমি ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়লাম।ঘরের কোণে নিজেকে নিক্ষেপ করলাম।কারো সাথে কথা বলতে ভাল লাগত না।লোকজন ভাল লাগতো না।সমাজ বলল বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিলে বিয়ে সুখের হয় না।কিন্তু কি কষ্ট দিয়েছি সেটাই বুঝতাম না।আমি তো ওদের জন্য আপ্রাণ করার চেষ্টা করেছি।অথচ কার অভিশাপে জানি না বাচ্ছাটাও বাঁচলো না।সকলে নানা কথা আলোচনা করতে লাগল-
”সুলেখা তুই ঘরের ভেতর থাকিস না এইভাবে।একটু বাইরে বেরো, একটু সামাজিক হ।পাঁচজনের সাথে মেলামেশা কর।এইভাবে জীবন চলবে না।বড় অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিস তুই।”
এদিকে বাবার অসুখে আপ্রাণ সেবা যত্ন করেও যখন বাবাকে বাঁচানো গেল না।তখন সমাজ নানা কথা বলল।রজত দূর থেকে সব দায়িত্ব পালন করলেও মুখোমুখি হল না কারো।শ্রাদ্ধবাসরেও এসে দাঁড়াল না।আমি কিছু বলতে পারলাম না।সকলে বলল ছেলেটা বড় অসামাজিক।এরপর অনেক চেষ্টা করেও যখন আমাদের আর সন্তান হল না।তখনও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল আমাকে।রজত কাজে থাকে।আর এইসব ব্যাপারে মেয়েরাই সব চেয়ে বেশী কথা শোনে।মনে-মনে ভাবলাম একটা বাচ্ছা দত্তক নেব।কিন্তু শ্বশুরবাড়ীর কেউ রাজী হলনা।তবু নানা অশান্তি করে রজত আর আমি একটা মেয়েকে দত্তক নিলাম।এরপর শুরু হল নানা প্রশ্ন-
”চেষ্টা করেছিলে আর?ডাক্তার কি বলল?আমার ননদ কিন্তু অমুক ডাক্তারকে দেখিয়ে ভাল ফল পেয়েছে।রত্নদীপে একজন জ্যোতিষী বসে।অব্যর্থ ফল পাবে।একবার দেখাতে পারো।”
এইরকম অজস্র উপদেশ।বাধ্য হয়ে সকলের সাথে যোগাযোগ ছেড়ে দিলাম।আমাকে কেউ খাওয়াবেও না, পরাবেও না।অথচ এইসব কথা শুনে মনটা বিক্ষিপ্ত হবে।
”যেমন দেবা তেমনি দেবী।মোস্ট অসামাজিক আর স্বার্থপর।”
এইসব কথা এখন আর গায়ে লাগে না।শ্বশুর বাড়ীতে মাকে নিয়ে এলাম।আমার মেয়ে শ্রাবণী তখন একটু বড় হয়েছে।নীচের তলার নমিতা বৌদি একদিন গল্পচ্ছলে মেয়েকে ইচ্ছে করে বলে বসলো ও আমাদের মেয়ে না।নিদারুণ মানসিক চাপে মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল।অনেক চেষ্টাতে যখন ও সুস্থ হল।আমি ওকে গল্পচ্ছলে বললাম একটা মেলা থেকে পছন্দ করে ওকে কিনে এনেছি।মেয়েটা বাচ্ছা তো তাই সেটাই বিশ্বাস করল।কিন্তু তার পর থেকেই নমিতাবৌদির মতো মানুষদের আমি পছন্দ করতাম না মোটেই।এই ধরনের মানুষের সংখ্যাই সমাজে বেশী যারা দুঃখের কথা শুনে সেই কথাকে ডালপালা, শিকড় ছড়িয়ে, ফুলে ফলে সাজিয়ে, পরিবেশন করতেই স্বচ্ছন্দ।এরা আসলে বন্ধুবেশী শয়তান।
এইরকম সমাজে সামাজিকতা রক্ষা করা যায় না।সমাজই বাধ্য করে মানুষকে অসামাজিক হতে।তাই আজ আমি অসমাজিক।এতে আমার কোনো দুঃখ নেই।