নাহিদের সাথে আমার পরিচয় রং নাম্বারে ফোন গিয়ে।স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্ক না।অদ্ভুত রকম সম্পর্ক যাকে বলে সেটা।তবে এক আধবার আমি যে প্রেমাধীনি হয়নি আর নাহিদ যে প্রেমিকপুরুষ হয়নি,তা বলছিনা।হয়েছি এবং ভালোভাবেই হয়েছি।
সাদুভাই বাড়িতে আসেনা দুইদিন ধরে।আম্মুর সন্দেহ সে নূভা আপুদের বাসায় আছে।আমার কাছে ভাইয়ার বান্ধবী রিতুপুর ফোন নাম্বার আছে।নূভাপুর নাম্বার নাই।আম্মুর অবস্থা খারাপ।একটানা কেঁদে যাচ্ছেন।আমি পড়েছি বেকায়দায়।বাবাকে জানানো হচ্ছেনা।আপাকেও না।সাদুভাইয়ের খবর ও জানা যাচ্ছেনা।আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “এই রুশা,রিতুকে ফোন কর,রিতুকেই কর।ফোন দিয়ে বল,নূভার নাম্বার আছে কিনা।” “করছি।” রিতুপুর থেকে ল্যাণ্ডফোনে করে নুভাপুর নাম্বারটা যোগাড় করলাম।আমাদের বাসায় এখনো ল্যাণ্ডফোনের আমল।এই বাসায় একটা সিমপোনি T-35 বাটন ফোন আছে।তার ভেতর 2G একটা বাংলালিংক সিম,যেটাতে এখন ব্যালেন্স আছে ছয় টাকা ছেচল্লিশ পয়সা।
ফোন প্রসঙ্গ থাক।সাদুভাইয়ের আসল নাম সাদবিন।আমি আর আপা ডাকি সাদুভাই।আম্মুসহ বাড়ির অন্যসবাই সাদু সাদু ডাকে।দুইদিন আগে ভার্সিটির সেমিস্টার ব্রেকে বাসায় আসলো সাদুভাই।সন্ধ্যা বেলা আম্মু আর সে মুড়িভাজা খেতে খেতে টিভি দেখতেছে।আম্মু দেখতে চাচ্ছে সিরিয়াল চ্যানেল।তার সবচাইতে প্রিয় সিরিয়ালটা।সাদুভাই ইংরেজী চ্যানেল দিয়ে রাখছেন।মুভি দিচ্ছে।হাফ এনিমেশন,হাফ রিয়েলিটি।সাদুভাই মাঝেমাঝে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে ওঠছেন,”ওহ ড্যান,রাইট,রাইট।রাইট সাইড এগেইন, নাউ লেফট সাইড,লেফট।”
আম্মু সোফায় বসে পা দোলাতে দোলাতে মুড়ি খাচ্ছেন আর বিরস মুখে সাদুভাইয়ের উত্তেজনা দেখছেন।পাশের ঘরে বসে পড়ছি আমি।দুইমাস পরে পরিক্ষা।আমি দুমাস আগ থেকে নিয়মিত পড়ছি।ভালো ফলাফল না করলে বাবা ফুস করে বিদেশ থেকে আসবেন,এবং টুস করে আমার গলা টিপে মেরে ফেলবেন।
হঠাৎ দেখলাম মুভির আওয়াজ আসছেনা।চুপচাপ।সুনসান নীরবতা।সাদুভাইয়ের গলা খাকারি দেখলাম।আমি চুপিচুপি পা টিপে টিপে টিভির ঘরের দরজায় দাড়ালাম।আম্মু মুড়ি চাবাতে চাবাতে বললেন, “যেই মেয়েটা আমাদের বাসায় সেবার এসেছিল সেই মেয়েটাই তো?” “হুম।ওর নাম নূভা।” “নূভা।কি নাম খোদা মালুম!তা কবে থেকে?” “দু বছর আম্মু।” আম্মু রাগের ঝাঝেই সম্ভবত মুড়ির বাটিটা ছুড়ে ফ্লোরে ফেললেন।তারপর সোফা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললেন, “শুন সাদু,তোরে বলি,আর জীবনে তুই এইসব নুভা ফুভা করবি,তোর বাপেরে ফোন দিয়ে আমি এখানে আসতে বলবো,এবং তোর পুরো কাহিনী বলবো।এরপর কি হবে তুই জানিস।”
ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি তোমাদের বাসায় থাকবোনা।নূভার জন্য পৃথিবী ছাড়তেও রাজী আছি যেখানে,সেখানে তোমাদের কয়েদখানা কাম বাসায় থাকার মানে নাই।আমি এখনি চলে যাবো,আর জীবনেও আসবোনা।দোয়া করবা আম্মু।” আমি পরিস্থিতি বুঝে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।সাদুভাই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন এবং আম্মু মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি বুঝতে পারছি আম্মু স্থির হয়ে থাকলেও তার ভেতরে থাকা ইলেক্ট্রনগুলি চমকে চমকে ওঠছে।কিন্তু ব্রেইন যেহেতু ক্ষনিকের জন্য স্থায়ী,নিথর সেহেতু দেহে প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলির চমকানোতে আর কি আসে যায়?আম্মু নড়ছেন না।আমি তার হাত ধরে বললাম, বসো তো আম্মু।সাদুভাই কেমন জানোনা তুমি?এক ঘণ্টার মাঝে আসবে দেখবে।কি খাও?মুড়ি,ওয়াও!দেও তো আম্মু আমারে,মুড়ি খাই।”
আম্মু মুড়ির বাটি কোলে নিয়ে আছেন,আমি তুলে তুলে খাচ্ছি।পরেছি বিব্রত অবস্থায়।ভাজা মুড়ি খাওয়া ছাড়া আর কি করতে পারি? ভাইয়া বাড়িতে ফিরলোনা। এরপর ফোন দেওয়া হলো রিতুপুকে।রিতুপুর থেকে নাম্বার নেওয়া হলো নুভাপুর।এরা সবাই এক ভার্সিটির এক ডিপার্টমেন্টের এক গ্যাঙ।আর সেই গ্যাঙের সদস্য মোত ন জন।সাদুভাই,পিয়াসভাই,শাওনভাই,রি তুপু,নিতুপু,নুভাপু, অনিকভাই,সাবরিনাপু,লিজয়ভাই।এদের একজনের পেটের খবর আরেকজন জানে।রিতুপু সাদুভাইয়ের কথা কিছুই বলতে পারলোনা।আম্মু হতাশ হলোনা।বললো,”নুভার নাম্বারে কল দে।তোরটা দিয়ে কর।”
দিলাম আমার বাটন ফোন দিয়ে কল।বললাম হ্যালো,হ্যালো।ওপাশ থেকে গলা আসলো পুরুষালী।একটু ভারী স্বর,কিন্তু মোলায়েম।আমি ভাবলাম সাদুভাই মনে হয়।কান্নাকাটি করে অস্থির।ওপাশ থেকে বললো,”আমি সাদুভাই না।নুভাকে চিনিও না।আমি নাহিদ,নাহিদ।” “দেখো ভাইয়া,উলটাপালটা কথা বলবেনা।আমি জানি তুমিই তুমি,বাসায় আসো।আম্মু বাবাকে জানায়নি এখনো,জলদি আসো।” “আপনি কেনো জ্বালাচ্ছেন?আমি সাদুভাই বা আপনার ভাইয়া নই।আপনি সম্ভবত রঙ নাম্বারে কল করেছেন।” “কি বলছেন?সত্যি?এটা নুভাপুর নাম্বার নয়?”
“নুভাপুটা কে? আমার নুভা নামে কোনো বোন টোন নাই।আচ্ছা বলুন তো,সমস্যা কি?”বললাম খুলে সবকিছু।নাহিদ লোকটা বুঝতে পারলো।মিহি সুরে বললো আচ্ছা ঠিক আছে।আমি কাদছি বাচ্চাদের মতোন।বললাম,ফোন রাখি এখন।নাহিদ বললো,”পরে ফোন দিবো।আপনি তুলবেন।আশায় থাকবো।” না করলাম।চিনিনা জানিনা কথা বলবো কেনো?তারপরেও শেষমেষ কথা হলো।এবং কথার মাত্রা দিনদিন বাড়তে লাগলো।রুশা থেকে রশু হলাম,নাহিদকে ডাকতাম হাতি।ব্যাপারটা স্বাভাবিক না।হয়তো স্বাভাবিক, অনেক সময় স্বাভাবিক জিনিস অস্বাভাবিক লাগতে পারে,লাগেও।আমারো সম্ভবত লাগছে। প্রায়ই তার সাথে কথা হতো।আমার ভালো লাগতো।ভীষণ ভালো লাগতো।গলার স্বরটা অপরিচিত থেকে ধীরে ধীরে পরিচিতের জায়গা দখল করে নিলো।নাহিদ অন্যতম একজনে রূপ নিলো।
কি যে সমস্যা প্রেম ভালোবাসা!প্রেম কিছু নাকি মানেনা,টের পেতে লাগলাম।লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে কথা বলা,সেই নারায়ণগঞ্জ থেকে বি বাড়িয়া।সাদুভাই বাড়ি ফিরে এলো,সব ঠিক হলো,অথচ আমি বেঠিক হতে লাগলাম।রেজাল্ট খারাপ হতে লাগলো।সারাটাদিন নাহিদের চিন্তা মাথায়।মনে পড়ে সেই দিনগুলিকেও।আম্মুর ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে মোবাইলে ব্যালেন্স ঢোকাতাম।যদিও নাহিদ আমার ফোন তুলতোনা।তবু,সবসময় অন্যের ফোন ধরলে কেমন ছোটলোক ছোটলোক মনে হয়।মাঝেমাঝে নিজের ফোন করা উচিত,অন্তত একটা ক্ষুদেবার্তা পাঠানো উচিত।
গরমের সময় পর্যন্ত কাথা মুড়ি দিয়ে বালিশের নিচে ফোন রেখে কথা।অদ্ভুত।আমার হাসি পায় ভাবলে।হাসতে হাসতে মাতাল লাগে।মাঝেমাঝে পাগল হয়ে যাই।
সম্পর্ক যখন খুব বেশি খোলামেলা হয়ে যায়,তখন সে সম্পর্কের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়।দু বছর।খুব কম সময় না।আম্মু একদিন দেখলো কথা বলতে।আর কি? আমি আর কিছু জানিনা।তারপর আর কখনো ফোন ধরিনি।ফোনের ছবি দেখেছি, দূরে অন্য কারো হাতে ফোন দেখেছি।ফোনের গা ছুঁই নি।বড় হয়েও না।ফোন ছুলেই পাগল পাগল লাগতো।চারপাশে কি ঘটছে ভুলে যেতাম।হাসি পেতো খুব।সম্ভবত পাগল হয়ে গেসলাম। সাদুভাইয়ের বিয়ে হলো আরো ৬ বছর পর।ততদিনে আমার অনার্স শেষ।নিজের বিয়ের আলাপচারিতাও শুনছি।নুভাপু ভাবী হলেন।ডাকতে বললেন নুপুর।আমি নুপুর ডাকতাম।আমায় বললেন, “তোমায় রশি ডাকি,রুশার সাথে রশিটা মানায়।হাহা।” আমি হাসলাম।রশি নামটা কি না ডাকলেই নয়?আমি বললাম,আপনার ইচ্ছা।
“আমায় আপনি আপনি করো নাতো।তুমি বললে খুশি হব,আমি তুই তুই করবো তোমায়,কেমন?” হাসলাম আবারো।হাসিটা কেমন সহজ হয়ে গিয়েছে,না চাইতেই আসে।তবে সত্যি হাসি আসেনা,মিথ্যা হাসি সহজেই এসে যায়।আমার এখনকার প্রত্যেকটা হাসি মিথ্যা,ভান।ভেতরের হাসির গ্রন্থি অকেজো।আসল হাসি আসবে কিভাবে? নুপুর এক দুপুরে রেডিও শুনছিলো।৯৪.৩ এফ এম।আমি গেলাম ওর ঘরে।আমায় হেডফোনের একটা অংশ দিয়ে বললো, “দেখ,কি সুন্দর গান গায়।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও দিলাম কানে।গানটা আমার প্রিয়।সত্যি সত্যি প্রিয়।মিফতাহ জামানের গান।নিজের খেয়াল রেখো।মনোমুগ্ধকর সুর।গলাটা ভারী অথচ মোলায়েম।গিটারের টুংটাং এর সাথে তাল মিলিয়ে সুরে সুরে কথা মিলিয়ে গেয়ে চলেছে রেডিওর গায়ক, “কেনো এতোদিন পরে,আজ তোমায় মনে পড়ে,আমি কাদি নতুন করে,সে তোমার ছবি ধরে..আমার লাগছে যে অসহায়,একলা এই ঘরে..” সুরটা পরিচিত।গলার স্বরটা পরিচিত।আমি হাসতে হাসতে কান্না করে দিলাম।গান শেষে গায়ক বললো শুনলাম,”রশিটা আমার খুব প্রিয় ছিলো জানেন আপনারা?” নাহিদ না?নাহিদই তো!নুপুর আমার চোখে জল দেখে বোকার মতোন তাকিয়ে আছে।আরো দুফোটা জল গড়িয়ে গেলো।মুখে কিন্তু ঠিকই হাসি,ভান করার হাসিন না আজ।তবে কি হাসি হতে পারে? তৃপ্তির হাসি হবে বোধ হয়!তৃপ্তিটা কিসের ভাবলাম। খুঁজে পেলাম না।