পাগল বৃষ্টির সঙ্গে শোনা গেল পাহাড়ের ওপার থেকে আসা বাঘের গর্জনের মতো মেঘের ঘন-সবুজ ডাক। থেমে থেমে গজরাচ্ছে; কিন্তু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল হাওয়ার দাপট, যেন এতক্ষণ কেউ হাওয়াগুলো আঁটি বেঁধে রেখেছিল, কোনো চঞ্চল তরুণী যেন খবর পেয়ে সব ঢেউয়ের আঁটির মুখ একে একে খুলে দিচ্ছে কাপড়ের কুঁচি দেওয়ার মতো ঢেউ-খেলানো হাসিতে হাসিতে। দরজা-জানালা বন্ধ না করে কোনো উপায় আর নেই। চারদিকের সব জানালা ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁধতে হচ্ছে, বাঁ হাতের বাহুমূল ও কান দিয়ে মোবাইল চেপে ধরে কথা বলতে বলতে বন্ধ করছি। জানালার একটা কপাট ধাম করে এসে বাড়ি মারল, ভালোবাসাহীন থাপ্পড়ের মতো, আঙুলে লাগল জোরে [এখানে ব্যথার গভীরতা বর্ণনা করা হলো না]।
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে সে ঝড়ের উত্কণ্ঠা নিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘কী হলো, অমন করছ কেন? কারো সঙ্গে ভালোবাসার লড়াই সেরে নিচ্ছ নাকি!’
‘বাজ, বিজুরি ও ব্যাঘ্রগর্জন—সব এককাতারে এসে গেছে। ভাগ্যিস আলোটা আছে, তবে যেকোনো সময় হাওয়া হয়ে যেতে পারে। একটু সবুর করো, ভালোবাসার অবসর দাও।’
‘আমার এখানে বিদ্যুৎ নেই। তেজি গরমও না। এ সময় তুমি যদি থাকতে!’
‘তাহলে আমারও চলে যাক বিদ্যুৎ।’
‘তোমার থাকুক।’
‘কেন?’
‘তোমার তো শহর। লেখার সময় তোমার পাখা দরকার, নইলে কে তোমাকে পাখা করবে? আমার এখানে এখন রাতে লেপ গায়ে দিতে হয়, এই শেষ জষ্টিতেও। আষাঢ়ের মেঘের পাত্তা নেই। একবার ভাবো, দিনে তপ্ত আগুন, রাতে লেপ-কাঁথা। এই আমাদের খাগড়াছড়ি। আসলে এর নাম খাঁড়াছড়ি। চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের বুলি।’
‘সেকি! হিমালয়-ভুটান কি তোমার কাছাকাছি চলে এসেছে? বৈশ্বিক উষ্ণতা! কোথাও গরম, কোথাও শীত! তবে গরমের চেয়ে শীত ভালো। বেজায় খাটুনি দেওয়া চলে। তোমার পার্বত্য চট্টগ্রামই ভূস্বর্গ। আমি ওখানে পাঁচ কাঠা জায়গা পেলেও ঘর করব। তবে দশ কাঠা হলে দু-দশটা গাছ করতে পারব।’
‘দিনে তপ্ত গরম ছিল। এখন সন্ধে সাতটা বাজতেই আদুরে ঠাণ্ডা চলে এসেছে, তার ওপর মনোলোভা টিপটিপ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোট সরকারের শীতল হাওয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ মৈত্রীময় প্রতাপ। রাতে লেপ মুড়ি দিতে হবে। কী মজা!’ [এ ছাড়াও মজার কী কী উপকরণ থাকতে পারে তা অনুমেয়।]
‘আমি যদি চলে আসি!’
‘যদি আসতে। তোমাকে দেখার খুব নির্জন-সুবর্ণ বাসনা হয়েছে, শুধু দেখা, অবুঝ সোনাভাই ইচ্ছে।’
‘শুধু দেখতে পেলেই…!’
‘অমনি ঝাঁপিয়ে পড়তাম কুয়াকাটার স্মৃতিচিহ্ন খচিত করে রাখা ঢেউয়ে ঢেউয়ে। মেয়েরা এবং রোহিত সামনে থাকলেও তুমি যদি একবার মাত্র সেখানে নিয়ে যেতে!’
‘সত্যি! তুমি পারবে?’
‘অদম্য পারব। একটু সময় তোমার সঙ্গে থাকতে পারলেই ইচ্ছেটা বেপরোয়া চুপ হয়ে যেত। রোহিত কিছু মনে করবে না। সে খুব ভালো।’
‘লজ্জা!’
‘না।’
‘না?’
‘না।’
‘না!’
‘না, না, না।’
‘…’
‘আলবত না।’
‘পাগলি!’
‘তুমি আমার এই নামটি ঠিক ঠিক দিয়েছ। অন্য সবগুলো থেকে অক্লান্ত জুৎসই (অক্লান্ত শব্দের ব্যবহারও তোমার থেকে শিখে নিয়েছি এবং মানানসই, খাপে খাপে মিল, তোমার আদরের মতো। শীতের পর প্রেমের দেবতা-সখা বসন্ত, গ্রীষ্মের পর ভরপেট বর্ষার মতো)।’
‘পাগলি!’
‘অ্যাই, শোনো শোনো। আরে শোনো না, আজ ও বাজার থেকে বুনো মাংস এনেছে। রেঁধেছি মেটে আলুর মতো প্রায় এক রকম আলু দিয়ে, খোসা ফেলে দিলে একদম সাদা, একটুতেই গলে যায়। মাংসের টুকরো করেছি ছোট ছোট। যা মজা হয়েছে না! শয়তানটা অফিস থেকে এসে খেতে খেতে বলছিল, খুব মজা হয়েছে। আমি তো আর খেতে পারি না। খালি তোমার কথা মনে পড়ে, আর ভাবছি। আচ্ছা, বলো তো কেন তুমি এত দূরে! কেন, আমরা খাব আর তুমি খেতে পাবে না!’
‘হ্যাঁ, তাইতো! ঢাকার মগবাজারে তোমার বাসা হলে চলে যেতাম। গিয়ে দু-দশ মিনিটে খেয়ে চলে আসতাম।’
‘খাওয়ার পর পর অমনি তোমাকে যেতে দিতাম না। বসতে দিতাম ওড়না পেতে, বিদ্যুৎ না থাকলে কোলে বসে পাখা করতাম আর ফাঁকে ফাঁকে গালে নাক দিয়ে শুঁকে নিতাম, গলায় শুঁকতাম, কপোল-কপাল-গণ্ড-চুল-চিবুক-চোখ সব জায়গায় শুঁকতাম, শুঁকতাম। তুমি একটু বোঝো না।’
‘তোমার মেয়েরা ততক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে আসত। ওদের চান করা, ভাত দেওয়া, খাওয়ার পর গল্প বলে গরমের দুপুরে ঘুম পাড়ানো…কাজ কি কম তোমার! আমাকে পাশে ফেলে রাখতে হতো, চাষিদের কাটা ধান যেমন এক পাশে গুছিয়ে ফেলে রাখতে হয়। ছেলে-মেয়েদেরও সময় সময় গোছগাছ করে রাখতে হয়, ওই লেপ-তোশকের মতো বা সারি বেঁধে জুমে ধান রোয়া, আল বেঁধে নিচু জমিতে বর্ষায় পানি ধরে রাখা যেমন।’
‘জানো, আমি অনেক শুকিয়ে গেছি, কোমরের মেদ অনেক কমে গেছে।’
‘সত্যি! কী করে? এখন কি যখন-তখন আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়েছ?’
‘আজ খেয়েছি।’
‘তুমি না বলেছিলে আমাকে ফেলে আর কখনো অন্তত আইসক্রিম খাবে না!’
‘কী করব? লোভ সামলাতে পারলাম না। ওটা দেখলেই আমি বাচ্চা হয়ে যাই, তুমি তো জানোই। ও সঙ্গে ছিল, কিনে দিল।’
‘কে? ও-টা কে?’
‘আরে না, শয়তানটা।’
‘শয়তানটা মানে? তোমার কয়টা পোষা শয়তান আছে?’
‘দুনিয়ায় দুই রকম শয়তান আছে। একটা বদের হাড্ডি, আরেকটা ভালো। ও হলো আমার মেয়েদের বাবা রোহিত, তোমার মতো ভালো শয়তান। তোমার বন্ধু পরীক্ষিৎ কেমন শয়তান সে তুমি ভালো জানো, পরচর্চা আমি করব না। তবে শয়তানটা সেদিন আমাকে ফোন করে বলে কিনা কেমন আছি, কত দিন আগে এরই মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে খবর নিতে ফোন করেছে।’
‘ও তেমন খারাপ শয়তান নয়, পাগলি। ওর বাড়িতে বিজু উৎসবে গেছি বলেই তোমার বাড়িতে যাওয়া হলো, তোমার সঙ্গে দেখা হলো। লাল একমাত্র এক টুকরো বীজ ছাড়ানো তরমুজের কথা একবার ভাবো, নববর্ষের পরিচয়ের দিনের।’
‘সেটা ঠিক। পরীক্ষিেক ধন্যবাদ। কিন্তু এখন মনে হয় শত্রুতা করছে, গোয়েন্দাগিরি। তোমার আসা-যাওয়ার খতিয়ান রাখছে।’
‘ওরে, ও হলো আমার কলেজজীবনের বন্ধু। সে কতকাল আগের কথা! ওকে আমি পরী বলে ডাকি। লোকজন প্রথম শুনলে মনে করে মেয়ে বন্ধু।’
‘বন্ধু, কিন্তু শয়তান। বুঝলে, শয়তান?’
‘আমি আবার শয়তান হলাম কেন?’
‘তুমি হলে দুষ্টু শয়তান আমার। শয়তান সোনাবন্ধু।’
মুঠোফোনে তরতর করে সময় উঠে গেল ৩৭.৫১ মিনিট। ওর ফোনের সঙ্গে এফএনএফ করা আছে, কিন্তু কাজের ঘন সময় বলে কথা। তখনো ওর কথা শেষ হয়নি, মাঝে টুক করে সময়টা পরিমাপ করে নিয়েছি। আমার সনি এরিকসন, ওর স্যামসাং। দুজনেরই ক্যামেরা আছে। ও আমার ছবি ফোনের পর্দায় রেখেছিল প্রথমে, পরে বাতিল করে রেখেছে। মেয়েরা যদি দেখে অথবা স্বামী নামক ভালো শয়তানের চোখে দৃষ্টিকটূ ঠেকে। পরী আমাকে বিজু উৎসবে যোগ দিতে বলেছে, আমিও সদাপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধার মতো সংক্ষিপ্ত সময়ের বিজ্ঞপ্তিতে ছুটে গেলাম খরগোশগতিতে। ভোরে পৌঁছে গিলা ও হলুদবাটা মেখে নববর্ষের অলঙ্ঘনীয় রীতি অনুযায়ী স্নান সেরে নিলাম। মাথায়ও সাবান-শ্যাম্পুর বদলে গিলা-হলুদ বাটা ব্যবহার শিখিয়েছে প্রয়াত মা-বাবা-ঠাকুমা।
রাতের বাসভ্রমণের ক্লান্তি ও ক্লেদ ধুয়ে-মুছে গেল। রাজপুত্রের অভিষেক স্নানের মতো আয়েশ করে পর্বটা শেষ হলো। তারপর সেই সকাল থেকে এবাড়ি-ওবাড়ি খেয়ে ষোলো কলা পূর্ণ হওয়ার আগে ষোলোতম বাড়িতে গেলাম। সারা দিনের পানাহারে আমার অবস্থা তখন টালমাটাল, পেট পুরে মহুয়া ফুল খাওয়া ভালুকের মতো। শেষ বাড়িটি হলো স্বর্ণ জুঁইয়ের বাড়িতে। স্বর্ণ শাড়ি পরে তরমুজের রেকাব এনে আমার সামনে ধরল। খুনখারাবি রঙের তরমুজের বড় বড় ফালির রেকাব, তার একটি মাত্র ফালিতে বীজ ছিল ছড়ানো। স্বর্ণ জু (নমস্কার) জানিয়ে পাথরের সফেদ ভারী থালাটা আমার সামনে রাখছে দেখে ভদ্রতাবশত আমি হাত বাড়িয়ে ধরলাম। দুই হাত বাড়িয়ে স্বর্ণ সফেদ রেকাব এগিয়ে ধরেছিল, আমি ভদ্রতাবশত গ্লাসটা রেখে দ্রুত অসমাপ্ত ঢোক গিলে নিয়ে ওটা ধরতে গেলাম। তখন হঠাৎ মনে হয়েছিল, হাতে হাতে নেওয়াটা বুঝি অভদ্রতা। ওর আঙুল বাঁচিয়ে ধরতে গিয়ে বৈদ্যুতিক পাখার উড়ে আসা সংসারত্যাগী দমকা হাওয়ায় ওর খোলা চুলের ধমক এসে আমার জগরাতপ্ত (বিনি চালের তৈরি সুমিষ্ট সাদা মদ) গালে, সেই সঙ্গে শরীরের নারীপ্রধান সুরভিত জ্যোত্স্না। আমি নিশ্চিত যে ওতে নাগকেশর বা চালতা ফুলের সুবাস মাখা ছিল। আমি তখন আসলে সঙ্গীদের কাছে বাঘিনীর স্বভাব ও সন্তান স্নেহের কথা ব্যাখ্যা করছিলাম হয়তো বা। টেলিভিশনের প্রকৃতি-বিষয়ক তিনটি চ্যানেলের দৌলতে সবারই এ বিষয়ে কমবেশি জানা থাকার কথা।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে তো বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রবল ঘাটতির কথা সবাই জানেন, যদিও কাপ্তাই থেকে তার বিলিব্যবস্থা সারা দেশে সুনিয়মিত সরবরাহ হয়। আমার আবার বিখ্যাত শিকারিদের বই পড়ার কঠিন ব্যামো আছে। সেখান থেকে দু-চারটি অজানা সাহিত্যিক বর্ণনা সবাইকে শোনাচ্ছি পানাহারে চুটকির মতো। সেই অসমাপ্ত বাক্য, পানের সঙ্গে মদন সখার হস্তক্ষেপ, অপরিপক্ব সময়ে দ্রুত ঢোক গেলা, নাটকীয় মুহূর্তে রেকাব ভরা থালা নিয়ে কাল্পনিক সাকির আবির্ভাব এবং সেই থালা পরী ও আমার সীমানার আন্তর্জাতিক সীমারেখায় রাখা, তার ওপর বীজহীন তরমুজের ফালিটা কার অধিকারে যাবে নিষ্পত্তি না করেই ওটা দখল করার সুরামত্ত আগ্রাসী বাসনা, নারী সুগন্ধের সুরভি, স্বর্ণর সবল-কোমল দীর্ঘ দেহতরু—সবই একসঙ্গে গোগ্রাসে আমাকে বাঘের মতো উদ্যোগী করে তুলল। ঠিক সে সময় পরী গেয়ে উঠল, ‘কী এদক্ দোল্ হইয়ছ্ তুই, মনে হয় বানা চেই থেব’—কী এত সুন্দর হয়েছিস যে তুই, মনে হয় শুধু চেয়েই থাকি—চাকমা প্রেমগীতিটি। আবার গানটি হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে পরী আমাকে স্বর্ণর হাতের সঙ্গে আমার হাতের ছোঁয়া না হয়েও ওর পেয়ারা-রাঙা কপোল আর তিরতির কেঁপে ওঠা ওষ্ঠযুগল বোধ করি বেশি শনাক্ত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। ততক্ষণে স্বর্ণ চলে গেল আন্দোলিত সুগন্ধ হাওয়াকে সঙ্গে টেনে নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধার গুলি যেমন শব্দও সঙ্গে নিয়ে গিয়ে লক্ষ্য ভেদ করে।
এ সময় পরীকে তার শুরু করা গানটি আবার শুরু করার জন্য তপ্ত অনুরোধ করেছিলাম। মলয় চাকমা ভালোবাসাদ্রব হৃদয় দিয়ে বলে দিল, হংসধ্বজ চাকমা পানি না মিশিয়ে তীব্র দু’চুঁয়ানি পান করা গলায় আবার গানটি গাইতে। আমি এত কিছুর মাঝেও ভুলিনি যে বীজ ছড়ানো নির্দিষ্ট তরমুজ ফালিটি আগেভাগে সুভদ্রভাবে দখলে নিতে হবে। তার সঙ্গে নুন মেশানো ছিল না রীতি অনুযায়ী, পাশেই ছোট্ট পাথরের নুনদানি ছিল, যাওয়ার সময় স্বর্ণ সেটি রেকাব থেকে নামিয়ে রেখে গিয়েছিল অভ্রান্ত বিবেচনায়। পরী গানের বদলে তরমুজে নুন ছড়িয়ে খেতে শুরু করল খচখচ করে। অপরাজিত নরম মিছরিদানার মতো সুস্বাদু তরমুজ। রোহিত অকারণে আমার দিকে চেয়ে একফালি নিয়ে সুভদ্র শিয়ালের মতো কামড় বসিয়ে দিল। ওপাশ থেকে বনবীর খিসা জ্যান্ত ভূতের মতো হাতটা তিন হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ে ফচফচ করে খেতে লাগল আর সেই অবস্থায় লাল চোখে বলে চলল, ‘তাহলে বাঘ তক্কে তক্কে থাকে নিজের বাচ্চাকে মারার জন্য, যাতে সে অবিলম্বে বাঘিনীকে সঙ্গমমুখী করে তুলতে পারে।’ ওপাশে আনারস ও অষ্টগ্রামের দামি পনির পড়ে আছে, সবার হাতে তৃতীয়ার চাঁদের মতো একফালি করে তরমুজ খুনখারাবি রঙে উদ্ভ্রান্ত, খাদ্য হওয়ার জন্য। একটি রাত পাখি ডেকে উঠল বুমবুম কাঁপা প্যাঁচা শব্দে, সঙ্গে সঙ্গে আবার ডাকল যেন, ‘ঝি দিবি না বউ দিবি’ বলে। ওটা বড় কানওয়ালা লালচে-পাটকিলে ভুতুম। তার বৈধ প্রেমিকা পুকুরপাড়ের বিশাল চালতাগাছের দুই ডালের ফাঁকে বাচ্চা দুটিকে মৌরলা নাকি টাকি মাছ নিয়ে খাওয়াচ্ছে বলে ঘোষণা দিল চোখ লাল হয়ে ওঠা রোহিত। আর প্যাঁচা গিন্নির বাবুসোনাটা এবার তার খাবার আনতে যাওয়ার পালা বলে ঘোষণা দিচ্ছে। হংসধ্বজ বলল, ‘জানি না।’ আর একজন (পরী হলো সেই একজন) আমার দিকে থালা এগিয়ে দিয়ে বলল অসংকোচে, ‘এবার বীজ বেছেবুছে খা। জানিস তো সূর্য পশ্চিম দিকেই ওঠে; কিন্তু পশ্চিম দিকে উঠলে হবেটা কী! সূর্য ওদিকে ওঠে বলে ওই পশ্চিম দিকটাকে লোকে পুব দিক বলতে শুরু করে দিল। সূর্য তখন রেগেমেগে আবার আগের সেই পুব দিকে ওঠা শুরু করল। কারণ সে পশ্চিম দিকে উঠলেও যখন মানুষ পশ্চিমকে পুব বলতে থাকে, তখন খামাখা সেদিকে ওঠার দরকার কী! তাই লোকে এখন জানেই না যে আসলে সূর্য কোন দিকে ওঠে। সেই প্রথম, যে লোক সূর্য পুব দিকে ওঠে বলেছে তার কথাই বহাল তবিয়ত হয়ে গেল। এখন অথচ সূর্য ওঠে পশ্চিম দিকে।
এ সময়, ঠিক এ কথাগুলো বলার বিমোক্ষম সময়ে রোহিত প্রবল আবেগে হাত ও খালি গেলাস নেড়ে কথা বলছিল। স্বর্ণ তখন হরিণের শুকনো মাংসের ভুনা নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে ওল বা ব্যাঙের ছাতা মাংসের টুকরোর সমান করে কুটে মেশানো ছিল। স্বর্ণ ছোঁ মেরে রোহিতের হাতের খালি গ্লাসটা নিয়ে মাংসের পাত্রটা রাখতে চাইছিল। রোহিত ঠিকমতো ধরতে পারছে না দেখে মাংসের পাত্রটা আমি ধরে ফেললাম, না হয় একটা কাণ্ড ঘটে যেতে পারত, এ জন্য আমি নীরবে স্বর্ণর চোখ থেকে সূক্ষ্ম বিষমাখা বাহবা পেলাম, রোহিত পেল বিষহীন ছোবল। তবে আমার বেলায় ঢোঁড়ার বিষ, ওতে বেশ ঘুম ঘুম আবেশ জাগে। আমি স্বর্ণর চোখের বাহবা সংগোপনে গুছিয়ে তুলে রাখলাম হাঁজিতে (ছিদ্রযুক্ত বাঁশের বেড়ার তাকে), তখন মনে হলো আমার হৃদপিণ্ডে ভালোবাসার খুনখারাবি শুরু হয়ে গেছে, ঠিক ওখানে শিরশির ঝিরঝির সংবেদনা চলছে, অথবা তেষ্টা পেয়ে বসেছে কলেরা রোগীর মতো অদম্য। তাড়াতাড়ি সামনের কত্তি (মাটির পেটমোটা নলযুক্ত সোরাই) থেকে নল দিয়ে ঢকঢক করে একনিঃশ্বাসে অনেকখানি পান করে বসলাম। অন্য পাশ থেকে রতন তঞ্চঙ্গ্যা কত্তিটা তুলে নিয়ে ঢকঢক গিলতে লাগল একটানা। রণক খিসা একটু আগে গান ধরেছিল, ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোর বেলায়/কৃষ্ণচূড়ার ফুল ভরা গাছটার নিচে…।’ রোহিত উৎসবমুখর গলায় যোগ দিল। পরী সুর ও বাণীর বিস্তর ফাঁক দেখে বিরক্ত হয়ে এক টুকরো মাংস চিবোতে লাগল বেজায় কসরত করে। আমি তখন নিশ্চিত হলাম ওর অন্তত দুই পাটিতে তিনটি পেষণ দাঁত নেই, আরো দু-একটিতে যাকে বলে পোকায় ধরেছে, তার পরও হরিণের শুকনো মাংসের লোভ সামলানো সবার সামনে কি অসম্মানকর নয়! তার সমারে (সঙ্গে) ব্যাঙের ছাতার মাংসল নরম সুস্বাদ। ওদিকে একফালি তরমুজ চতুর্থীর চাঁদের মতো কাত হয়ে আছে পাথরের থালার এক প্রান্তে, পাশে অনেক বীজ ছড়ানো; কিন্তু তার উত্ফুল্ল সতেজতার একটুও কমতি নেই। কার হাত লেগে পাথরের নুনদানি কাত হয়ে পড়ে আছে তো আছেই। আমার তখন আবছা আশঙ্কা জাগল যে ওরা না জানি গিলাপ (চাকমাদের হাতে বোনা শতরঞ্জি) থেকে তুলে খায়। কাঁচা নুনের সঙ্গে ওই বয়সেই আমার একটু বৈরিতা আছে হূ্দপিণ্ড সামান্য বেড়ে গেছে বলে আমার গুণশীল ডাক্তারের সুপরামর্শে। দুনিয়ায় টাকা-ধান-ঘর-নদী-যশ-প্রতিপত্তি বড় বা বেড়ে গেলে খুব ভালো, এমনকি চোখও বড় হলে তেমন মন্দ কী! চুল বড় হলেও, এমনকি পদ বা তকমাও। কিন্তু ওই বিশাল হৃদয় বা পিলে, পেট বা লোভ-লালসা বেড়ে গেলে বেশ মুশকিল। এসব চিন্তা জেঁকে বসার ফাঁকফোকর দিয়ে আরেকটা ঝামেলা পেকে বসল, সেটা শল্যচিকিৎসার পর জ্ঞান ফিরে আসা রোগীর জন্য নিষিদ্ধ সেই পানির তৃষ্ণা। মাছ নয়, মাখন নয়, ভূ-বাংলায় পানির তৃষ্ণা। তবে জগরার ক্ষেত্রে একটু খেলে তেষ্টা কমে যায় বলে আমি কোথায় যেন শুনে থাকব, আর সামনে ফালি ফালি লেবুও আছে। চর্বিদার শুয়োরের মাংসও আছে, ব্যাঙের পুষ্ট পা ভাজা ও চীনের টিনজাত গোমাংসও আছে। কোনটা খাব! নাকি শুনব আশ্চর্য সুন্দর আনচান করা গান, ‘রানজুনিয়ান উদিলে তর কদা মনৎ পরে দে—রামধনুটা উঠলে তোর কথা মনে পড়ে যায়। গানের সুর সুধা পান করব? নাকি সেই ‘তোর’ রূপস্নিগ্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকব, এমন সময় হঠাৎ কড়কড় নিষ্ঠুর শব্দে বাজ পড়ল প্রচণ্ড উৎসাহে। পশ্চিম থেকে পুব আকাশ ফুঁড়ে ঝিলিক খেলে গেল আকাশ-বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎ তো সঙ্গে সঙ্গে; কিন্তু তার চেলাচামুণ্ডা তো কর্কশতম ভয়াল শব্দবাদ্য ঠেলে দিল আমাদের দিকে, অক্লেশে।
এ সময় আমাদের ভাত খাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ি হলেও, আদিবাসী হয়েও শেষ পর্যন্ত এবং অনাদি কাল থেকেই ভেতো তো। কতক্ষণ আগে থেকে খাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছিল তা সময় মেপে বলতে পারব না। সাতখানা পাথরের অভিজাত রেকাব এলো, এগুলো সীমান্ত পাচার হয়ে এসে থাকবে। রোহিতের পছন্দের তারিফ করতেই হয়। পরী কোনোমতে উঠে শৌচাগারের দিকে পা বাড়াতেই পদস্খলন হতে যাচ্ছিল। রণক ধরে সামলে নিল। তারপর কিন্তু পরী ‘তুমি ভোরের আলো হয়ে/কৃষ্ণচূড়ার সেই ফুল ভরা গাছটার নিচে’ পঙিক্তগুলো নির্ভুল সুরে মর্মভেদী মায়ায় গেয়ে গেয়ে শৌচাগারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা সবাই ওর দিকে, ওর অদৃশ্য শরীরহীন সুরখানি নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্নকে যার যার মতো ভাঁজতে লাগলাম। আমি ‘কৃষ্ণচূড়ার চোখে’ গানের বাণীর জায়গায় স্বর্ণকে কেন যে দেখতে পেলাম তা ভাবতে ভাবতে আগে একটি দীর্ঘ চুমুকে প্রায় এক গ্লাস জগরা পান শেষ করলাম। এ সময় ঘরে একটি চামচিকে ঢুকে পড়ল, সুর না সুরার সুগন্ধে কে জানে! একসময় অসময়ে পরীর গান দুম করে থেমে গেল। সম্ভবত সে শৌচাগারে বমি করছে জোর করে, তারপর গলা খাঁকারি দিচ্ছে শোনা গেল, তার পরও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে যখন আবার গান ধরল, তখন আরো আক্রমণাত্মক ও সুরেলা হয়ে উঠল। এই সময়ের জন্য সে খুব অচেনা অমার্জনীয় হয়ে উঠল, অন্তত আমার কাছে। কারণ কোনো কথা ছাড়া সে শুরু করল চাকমা গান—
মোন্তলা আদাম্ তাইন্যাবি
কদু গেলে তুই হাজি
তুই ন থেলে কি অব
কোচ্ পানান্ দে আগে
যেদকিদন্ আগাজৎ বারগী উড়ন্
পেক্কুন্ যেদকিদন্ গীত্তুন্ শুনান্
সেদকিদন্ মুই তরে কোচ্ পেম্্
কোচ্ পানার (ভালোবাসার) এই বিষণ্ন সুরের গান শুনে কী পরিমাণ বিনি চাল থেকে তৈরি দুধের মতো সাদা মিষ্টি জগরা খেয়েছি, আমার আর মনে নেই। পরী তখন গানের শেষ কলি গাইছে, বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে ভালোবাসা উসকে দিতে।
অজল্ পাগুজগ নীঝ্ ঝুপ্
তরে বুঝানা ভারী দুখ্
যেদকিদন্ আগাজৎ তারা উডন্
পিত্থীমিৎ যেদকিদন্ ফুলুন্ ফুদন্
সেদ্কিদন্ মুই তরে কোচ্ পেম্
সেই সুর ও বৃষ্টি কতক্ষণ ছিল, ওরা সবাই কখন চলে গেল, আমিও কখন সদ্য পরিচিত বন্ধুপ্রতিম রোহিতের অতিথিঘরে ঘুমিয়ে পড়লাম, নাকি ঘুমের ভাপা পিঠের মোড়কে শুধু স্বপ্ন দেখে গেলাম তা আমার একটুও মনে নেই। ঝড়ের প্রকোপে ভুতুম যুগলের কী হলো, আমভরা আম্রপালি গাছটার কী দশা হলো এবং রাতের ঘেরাটোপে আমার গায়ে কে এত নরম কম্বল দিয়ে গেল, আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। মাথার পাশে কে মাটির কত্তিভরা পানি রেখে গেল এবং কত গলাধঃকরণ করেছি জানতে পেরেছি সম্পূর্ণ জেগে গিয়ে। তখন এত তেষ্টা পেয়েছিল যে কত্তির তলানিটুকু চেঁছেপুছে গিলে নিয়েছি আচার-চাটনির মতো। প্রবল তেষ্টায় কম্বল ফেলে উঠলাম। ছোট করে রাখা হারিকেনটা প্রহরী মুক্তিযোদ্ধার মতো জেগে আছে দরজার পাশে। আমাকে কাছে যেতে দেখে কী কারণে সে দপ করে নিভে গেল বুঝতে পারলাম না। তেল ফুরিয়ে গিয়ে নেভার মতো মোটেই নয়, তেল উঠে দপদপ করেও নয়, হাওয়া এসে তো নয়ই। তাহলে অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধার ক্যামোফ্লেজও হতে পারে! কিন্তু তেমন কিছু গুপ্ত বা ব্যক্ত কারণের সন্ধানও পাওয়া গেল না। তেষ্টার কারণেই এত কিছু ভাবতে গেছি, গায়ের শার্ট ও গেঞ্জি খোলা ছিল বলে এত ভাবতে গেছি, নয়তো কে এত পরোয়া করে! আমি তখন লুঙ্গি পরে আছি এবং যথার্থ অর্থে অন্ধকারে হারিয়ে গেছি। বিছানায় ফিরে এসে কী লাভ, রান্নাঘর ও কলসি কোন দিকে আছে আঁধার ঠেঙিয়ে পানি পাই কী করে। বসার ঘরের সেই কত্তিটা সেই একই জায়গায় থাকার কথা মোটেই নয়। আঁধার পেরিয়ে সেখানে ও পৌঁছবে কী করে! অন্ধকারে এত সব ভাবতে গিয়ে তেষ্টার অবস্থা ফাঁসিতে ঝোলা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির শামিল। এমন সময় টর্চ জ্বেলে উদয় হলো পূর্ণশশী স্বর্ণ এবং একটি কত্তি হাতে, মৃগতৃষ্ণিকায় বিভ্রান্ত পথিকের সামনে মরূদ্যানের প্রতিভূ, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ডুবন্ত বা ভাসমান মানুষের সামনে দিয়ে যাওয়া ঘরের চালের মতো, নাকি পরিত্রাতা প্রেম বলাই জটিলতম সহজ! স্বর্ণ হাউমাউ করে বলেই দিল, আমাকে নিশিতে পেয়েছে, আর সে স্বপ্ন ঝেড়ে আমাকে খুঁজতে লেগেছে। এ সময় আমার তেষ্টা পাবে সে তো জানা কথাই। সেই মুহূর্তে তেষ্টার ভারে তখন আর দুই পা-ও যেতে না পেরে সেখানে ঢলে পড়তে গিয়ে স্বর্ণ বুঝতে পারল আমার অবস্থা। তারপর কী কী ঘটেছিল কিছুক্ষণ আমার কিছুই মনে পড়ে না।
‘অ্যাই, শোনো শোনো, শোনো না…।’ নিঃশ্বাস না নিয়ে শোনো শোনো সে বলেই চলেছে।
শুনছি…।’
‘শোনো শোনো…কাল রাতে ওর সঙ্গে চুমুর লড়াই দিয়ে শুরুর সময় তোমার নাম প্রায় বলেই ফেলছিলাম। তোমার নামের প্রথম অক্ষরটা মুখ থেকে চুমুর সঙ্গে ছিটকে পড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হতে না পারলে…।’
‘সব্বোনাশ…।’
‘ঘুমের ঘোরে সেই রাতে তুমি কী করেছিলে মনে আছে?’
‘না।’
‘একটুও না?’
‘কিছুই না।’
‘সত্যি বলছ?’
‘সত্যি।’
‘কী করোনি বলো তো!’
‘আমার মনে নেই অতশত।’
‘একেবারে তুলাধোনা করে ছেড়েছে।’
‘আমার কিছু মনে নেই। ঘুম থেকে উঠেও মনে করতে পারিনি।’
‘শয়তান!’
‘ভালো, না খারাপ।’
‘বলব না।’
‘তাহলে খারাপই।’
‘তোমার ঠোঁট দিয়ে আমার জিব এমন টেনে নিয়েছ যে ব্যথা হয়ে গেছে।’
‘সত্যি…!’
‘পিঠে আঙুল ও নখের দাগে লাল। তোমাকে বারবার বলেছি ওতে আমার গায়ে লাল হয়ে যায়।’
‘তুমিই তো বলেছিলে আরো আরো জোরে আঁকড়ে ধরতে।’
‘বাব্বা, এক রাতেই এত দূর।’
‘আমার কিছু মনে নেই।’
‘জীবনে এই আমার প্রথম ভালোবাসা। রোহিতের সঙ্গে ভালোবাসা তো বিয়ের পর, সে তো সবার হয়। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে রোহিতের বাবার সঙ্গে সম্বন্ধ করে।’
‘কলেজে প্রেম করোনি!’
‘কলেজে উঠতে উঠতেই তো বিয়ে হয়ে গেল। সময় পেলাম কোথায়!’
‘সেকি!’
‘রোহিত খুব ভালো, খুব ভালোবাসে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার করে আমাকে ডাকে। তারপর বাজারে যায়। বাজার রেখে সে আমার বানানো ভারী খাবার খেয়ে স্কুলে যায়। আমাকে খুব বোঝে। মেয়ে দুটিকে স্কুলে পাঠানো, পড়াশোনা, ওর সব দায়িত্ব আমার। বেতনের টাকা সব আমাকে দিয়ে দেয়। খুব ভালো ও।’
‘রাতে সে যদি জানতে পারত!’
‘কী করে জানবে। সে-ও তো তোমার মতো খেয়ে বর্ষার কর্ণফুলীর কাদা। অন্য অন্য রাতে সে উঠে পানি খায়। মাথার কাছেই থাকে কত্তি। কাল একবারও জাগেনি।’
‘ও প্রচুর খেয়েছিল।’
‘তোমার প্যান্ট আমিই পাল্টে দিয়েছিলাম। রোহিত তোমার হাতে লুঙ্গি তুলে দিয়েছিল। তুমি প্যান্ট না বদলে অমনি ঘুম।’
‘আমার মনে পড়ে না। একবার মনে হয়েছিল বমি হবে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করেছিলাম মনে পড়ে।’
‘আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম করেছিলে, মনে আছে?’
‘কখন?’
‘কখন আবার! তুমি একটা পচা লিচু।’
‘সব তুমি বানিয়েতুনিয়ে বলছ, আলিফ লায়লা ওয়া লায়লার গল্প।’
‘আরব্য রজনীর গল্পই, তবে ওগুলো তো আর মিথ্যে নয়। আমার নিজস্ব আরব্য রজনী শুরু হয়ে গেল।’
‘গল্প সব সময় গল্প। আরব্য রজনী হোক আর অ্যালান পোর ভৌতিক গল্প হোক।’
‘তাহলে আমাকে একটু আদর করো। ভালো করে, বেশি করে।’
‘তুমি একটা ঢেঁড়স। মুকুল, ও মুকুল, মু…।’
‘আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়। দাদা ডাকো।’
‘কচুদা, আলুদা, লিচুদা…।’
‘এটা কী হলো!’
‘তুমি আমার শুধুই মুকুল, মুকুল, মুকুল, মু-কু-ল…।’
‘আমি তোমার থেকে ষাট বছরের ব-ড়-।’
‘তুমি আমার সমান, তুমি আমার শুধু মুকুল। মাথায় মাত্র এক ইঞ্চি খাটো আমি।’
‘বড়দের সম্মান করতে কবে আর শিখবে?’
‘তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম ঠিক তেত্রিশ দিন আগে। তখন তোমাকে বুড়ো হাবড়া মনে হয়েছিল। চুল রুক্ষ, কাঁধে ঝুলে পড়েছে, বেশ পাকা চুল ছিল ভেতরে-বাইরে। মুখের ভাঁজ ছিল সুপুষ্ট, জামা-পাতলুনের আড়ালে মনে হয়েছিল বুড়ো একটা মানুষ। আর এখন দেখি চল্লিশ বছুরে যুবক। কী হাঁটা। কথাবার্তায় তারুণ্য। চুলও অনেক বেশি কাঁচা ও চকচকে, কী জেল্লা! ভোজবাজি জানো নাকি!’
‘চল্লিশ হলেও তো তোমার থেকে বছর দশেক বড়।’
‘তাহলে তুমি আমার লিচুদা, লেবুদা, জামদা…। এই, তুমি আমাকে একটা বাবু দাও। আমার একজন চাই তোমার থেকে, দেবে তো?’
‘যে দুজন আছে তাদের মানুষ করো।’
‘তোমার বাবুটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে। তিন বছর পার করতে পারলেই তো বড় হয়ে গেল। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে যাবে। না কোরো না, কেমন?’
‘না।’
‘কেন? আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমার থেকে একটা বাবু নিতে।’
‘তুমি একটা বোকা।’
‘কাউকে বলব না। শুধু তুমি আর আমি ছাড়া।’
‘বাজে বোকো না তো!’
‘তোমার কাছে অন্য কিছু দাবি করব না। না কোরো না গো।’
‘তুমি একটা বোকার চেয়েও বোকা ইলিশ মাছ, আমড়াগাছ।’
‘আমার খুব ইচ্ছে। অনেক ভেবেছি। গত রাতেও ভেবেছি। মাসের সঠিক সময়ে আমি বলব। একটি বাবু আমি চাই-ই চাই।’
‘না।’
‘হ্যাঁ। তুমি কিছুতেই না করতে পারো না।’
‘পাগলামো কোরো না।’
‘তুমি এত কিপেট কেন গো!’
‘যে দুজন আছে তাদের মানুষ করো। এখন ওদের কলেজে পড়ার সময় হচ্ছে, ওদের তৈরি করো। বুঝবে ভালো কলেজে ভর্তি করা কাকে বলে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়, হোস্টেলে নাকি কোথায় থাকবে ভেবে দেখেছ।’
‘তুমি শুধু ভয় দেখাচ্ছ। একটুও স্বপ্ন দেখাচ্ছ না।’ ‘আমার স্বপ্ন!’
‘স্বপ্ন হলো বসন্তের কোকিলের ডাকের মতো, বসন্ত গেলেই শেষ।’
‘আমি আগে এক বসন্তের স্বপ্ন দেখতে চাই নতুন করে। দেখাও সেই একটি বসন্তের একটি স্বপ্ন। তারপর কোথাও কোকিলের ডাক থাকুক কি না থাকুক সেটা পরের বিষয়, পরে দেখা যাবে। আমি আগে স্বপ্ন দেখতে চাই। স্বপ্ন থেকে নির্মাণ, সৃষ্টি, উল্লাস। স্বপ্নকে নিয়ে আসব বাস্তবে, বাস্তবকে স্বপ্ন ভাবব সৃষ্টির পর। হে আমার স্বপ্ন, ও আমার স্বপ্ন…ও আমার ভালোবাসা…!’
এ সময় আকাশ ডেকে উঠল অসময়ে। পাখিরা চিত্কার করে উঠে আবার থেমে গেল। পাহাড়ি ছড়ার কুলুকুলু সুস্বর চুপ হয়ে গেল। সবেমাত্র স্কুল থেকে আসা দুই বোন কিছু ভেবে বা না বুঝে নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় শুরু করল ইঙ্গিতে-ইশারায়। এই অভিজ্ঞতা ওদের নতুন। আর কী আশ্চর্য, পরপরই গেল থেমে…। কিন্তু ওদের মাকে বাইরের থেকে খুব সন্তুষ্ট হতে পারল না, আবার খুব অখুশি বা ভয়াবহ মনে হলো না। ওদের জন্য এই নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া। নতুন সমস্যা।
স্বর্ণও কি প্রমাদ গুনল! ওর চোখে ঝরঝর অফোঁটা অশ্রুপ্রবাহ বাঁধ ভাঙার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল! এও স্বর্ণর জন্য কালবোশেখির মতো আসা আঘাত।
সে থামল!
ভাবল!
চঞ্চল হয়ে উঠল!
উঠেপড়ে লাগলাম। এ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলাম না। স্বর্ণও সন্তানের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বোধ করি দেখার চেয়ে মহত্তর আকাঙ্ক্ষায় ভাসতে শুরু করল…। জগৎ-সংসার তবে কি বাস্তবতার চেয়েও রূঢ় কঠিন, তেমনি কল্পনাময়…সুসুন্দর, সুখৈশ্বর্যময়…স্বপ্ন ভেসে চলল…ওর আকাঙ্ক্ষার জগৎ প্লাবিত হয়ে ছুটে চলেছে…বৃষ্টি হচ্ছে…বজ্রও এসে যুক্ত হয়েছে…বৃষ্টির সুস্বর…শিহরণ…বিমোক্ষণ…বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি…বৃষ্টিতে ভেসে চলল স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ…স্বপ্ন ও স্বপ্নের ঐশ্বর্য…