বেশ ক’বছর আগে আমি ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’ নামে একটা গল্প লিখি। তবে ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’ লেখার আগে আমি যে গল্পটা লিখেছিলাম, তার নাম ‘সুকুমারের লজ্জা’ এ গল্পটার কথাও বলতে হবে। সুকুমারের লজ্জার যে মূল চরিত্র, মূল চরিত্র বলে আমার অনেক গল্পে যেহেতু কিছু থাকে না, কাউকে মূল চরিত্র আখ্যা দেওয়া উচিত না, কারণ আশপাশে অন্যান যে চরিত্রগুলো আছে, সেগুলো কোনো না কোনো ভাবে মূলের দায়িত্ব পালন করে। এই যেমন আবদুল হক, তার স্ত্রী রেবা, তাদের সন্তান রেবা, আবদুল হকের বন্ধু গোলাম হায়দার, সবাই হযবরল গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শান্তাকে এখানে অসুস্থ দেখানো হয়েছে, মানসিকভাবে অসুস্থ, সে ক্লাস টেনে পড়ে, ক্লাস টেনে পড়লে তার মানসিক বিকাশ সে অনুযায়ী নয়ই, বরং দেখা যায় ছোট বাচ্চাদের মতো তার মাথার পাশে বসে তাকে গল্পের বই পড়ে শোনালে তার ঘুম আসে না। এই কাজটি করে আবদুল হক।
‘আবদুল হকের যে ঘনিষ্ট বন্ধু, কিংবা একমাত্র বন্ধুও বলা যায়, যার কথা আমরা বলেছি, গোলাম হায়দার, তার এক অদ্ভুত বাতিক আছে। সে প্রতিদিন পত্রিকায় পাতা থেকে নানা নিউজ কেটে তার মোটা খাতায় পেস্ট করে। মোটা খাতা তার অনেকগুলো। একেক পাতায় একক ধরনের নিউজ। কোনোটায় আছে ধর্ষন ও গণধর্ষনের কথা, কোনোটায় টেন্ডার বাজির কথা, কোনোটায় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের কথা (আমার ঠিক মনে পড়ছে ‘নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষ’দের নিয়ে কোনো কিছু গোলাম হায়দার বানিয়েছিল কি না। সম্ভবত তখন ছিল না, তবে এখন থাকতেই পারে। একদিন গিয়ে দেখে আসতে হবে)। যাক, যা বলছিলাম, কোনোটায় হয়তো ব্যাংক লুটপাটের কথা, কোনোটায় হয়তো নানা নৈরাজ্য আর অবক্ষয়ের কথা, এমন তরো না। এই কাজটি গোলাম হায়দার গভীর মনোযোগের সঙ্গে করে যাচ্ছে। খাতাগুলো সে মাঝে মাঝে আবদুল হককে পড়তে দেয়। এ নিয়ে আবদুল হকের আপত্তি আছে, না উৎসাহ, অনেক দিন আগে লেখা গল্প– বলেছি, ঠিক মনে নেই, আমরা আপাতত কেবল এরকম অনুমান করতে পারি, আবদুল হক ঠিক বিরক্ত হয় না, ঠিক খুশিও না। সে হয়তো বলল–আহা, গোলাম হায়দার, আমার!
কে নয়! কতদূর এগোলাম, দেখবে না!
দেখছি তো!
কোথায়! খাতাই খোলোনি।
চারপাশে দেখছি না?
অবশ্য দেখছ।
আমিও কি, তুমি যা দেখছ, তার মধ্যে নেই?
আছ।
তা হলে… মন খারাপ করো না, দেখব।
না, মন খারাপ করি না। মন আমার এমনিই খারাপ হয়ে থাকে।
কারই-বা থাকে না।
আমার কেন যেন মনে হয়, উপন্যাসটা লিখে শেষ করতে পারলে কিছুটা হালকা হবো। এখনো বলা হয়নি, এই যে গোলাম হায়দার প্রতিদিন খাতায বিভিন্ন নিউজ কাটপেস্ট করে রাখছে, এসব সামনে রেখে সে একদিন এক উপন্যাস লেখা শুরু করবে। তার উপন্যাসের নাম এরকম–আবদুল হকের তাৎপর্য ভ্রমন।
এ নিয়ে আবদুল হকের প্রবল আপত্তি- তুমি কেন আমার নামে উপন্যাস লিখবে। তোমার নামে না আবদুল হক, তোমার নামে না। ধরে নাও এ হচ্ছে যে কোনো এক আবদুল হক। এক সাধারণ মানুষ। তার চারপাশে যে কালো, তার মাঝখানে সে বেরোবার পথ খুঁজছে।
নেই।
কী?
বেরুবার পথ। অন্তত আমি দেখি না।… আচ্ছা, তুমি ‘আজব দেশে অমলা’ পেয়েছ?
‘আজব দেশে অমলা’র কতা গোলাম হায়দারই বলেছিল আবদুল হককে। শান্তাকে প্রায় রাতে গল্পের বই পড়ে শোনাতে হয়। তবে যেমন তেমন বই হলে চলবে না। বই হতে হবে মজার। কিছুটা ভুতের হলেও চলবে যদিও, শান্তার পক্ষপাত মজার বইয়ের দিকে। সমস্যা হলো, বাংলা সাহিত্যে মজার বইয়ের সংখ্যা কম। দু চারটা বই অবশ্য পাওয়া গেল, তারপর আবদুল হক যখন বই-সমস্যায় ভুগছে, গোলাম হায়দার তাকে বলল তুমি কেন হযবরল-র কথা ভাবছ না।
আবদুল হক বলল কী আশ্চর্য।
এখানে আশ্চর্যের কী দেখছ তুমি, আবদুল হক।
না, সে কথা নয়, এ বইটার কথা আমার কেন মনে পড়েনি, এটা ভাবছি।
তুমি আরেকটা বইয়ের কথাও ভাববে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘আজব দেশে অমলা’। একটা ব্যাপার কী তুমি খেয়াল করেছ?
‘আজব দেশে অমলা’ পড়েছি ছোট বেলায়। মনে আছে।
সেকথা বলছি না, দুটোই ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ থেকে নেওয়া, এটা কখনো খেয়াল করেছে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবদুল হক গোলাম হায়দারের দিকে তাকিয়ে থাকল।
সুকুমার রায় আইডিয়াটা নিয়েছেন। এটা নতুন কিছু নয়। আইডিয়া সব সময়ই নেওয়া যায়। নিয়ে, নিজের মতো করে যে তৈরি করতে পারে, সে-ই বড় লেখক। যেমন সুকুমার রায়। হেমেন্দ্র কুমার রায় অবশ্য সরাসরি নেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ ছিলেন। আর, তার আজব দেশে অমলাকে আমি আইডিয়া নেওয়া না বলে অনুবাদ বলতেই পছন্দ করব। অবশ্য তেমন বরাও আছে বইয়ে।
গোলাম হায়দার, এত কঠিন আলোচনায় আমি যাব না। শুধু দুটা দারুণ বইয়ের নাম দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
নিলাম ধন্যবাদ।… শান্তা খুশি হবে?
খুউব।
আমারও একটা উপকার হলো। অনেক বড় উপকার।
আবদুল হক এবার জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তোমার কীসের উপকার।
যেই হযবরল-র কথা মনে হলো তখন।… উপন্যাসটা যে লিখব আবদুল হক, কীভাবে লিখব সেই কতদিন হলো ভাবছি, এখন হুট করে মাথায খেলে গেল– ‘আবদুল হকের আশ্চর্য ভ্রমন’ লেখা হবে অনেকটা হযবরল ঢঙে। … কেমন হবে।
কেমন হবে?
হযবরল’, এ এক আষাড়ে গল্প। আর আমরা এখন যে সময়ে আছি, চারপাশে যা দেখছি ও শুনছি, তা-ও এক অর্থে আষাঢ়ে। আমরা যদি চারপাশের রোজকার ঘটনা না শুনতাম, না জানতাম, না দেখতাম– বলো, আমরাও কি ভাবতাম না– আরে, এসবও হয় নাকি, এ সবই দেখছি আষাঢ়ে। ভাবতাম না?
ভাবতাম।
তা হলে ‘ হযবরল-র ফর্মটাই সবচেয়ে উপযোগী হবে, তাই না?
আমি এ গল্পটা শুরু করেছিলাম দুই ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’-এর উল্লেখ করে। বছর ১০-১১ আগের কথা সেটা, অর্থাৎ ও সময়ে আমি ঐ নামের গল্পটা লিখেছিলাম। এখানে ব্যাপারটা ছিল এরকম, গোলাম হায়দারের এক বন্ধু সামুদুর রহমান বিলাস বড়লোক হয়ে গেছে, এতটাই যে টাকা কোথায় রাখবে, এটাই তার জন্য এক বিশাল সমস্যা। আর, ভালো দিক হচ্ছে, এত টাকা হওয়ার পরও তার আরো টাকা বানানোর ইচ্ছা নষ্ট হয়নি। সে সম্প্রতি বিদেশিদের সঙ্গে এক জয়েন্ট ভেঞ্চারের যাওয়ার চেষ্টায় আছে। ইতিমধ্যে বিশাল জায়গা দেখা হয়েছে। ওখানে তারা ফ্যান্টাসি পার্ক করবে। নাম দেবে ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’।
গোলাম হায়দার বলল-এ আর নতুন কী।
আছে আছে, নতুন আছে। মাসুদুর রহমানের উত্তর।
বিদেশে ফ্যান্টাসি পার্ক সেই বহুদিন হলো আছে। আমাদের দেশেও আছে।
কিন্তু দোস্ত, এইটার কনসেপ্ট ভিন্ন। আমাদের আইটেম থাকবে এই দেশের সঙ্গে মানানসই। আমাদের যে কালচার, তার সঙ্গে মানানসই।
উদাহরণ দাও।
ধরো, আমাদের দেশে ন্যাংটা পাগল দেখা যায়। ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’ আমরা ধরো ন্যাংটা পাগল রাখলাম। সে থাকবে তার মতো, কিংবা সে থান ইট হাতে তাড়া করল দর্শককে, একটা থ্রিলিং গেমের মতো হবে ব্যাপারটা।
বেশ। আর কিছু?
আবার ধরো, এ দেশে কখনো আমরা মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলি, কিংবা দোষী, বিশেষত হাইজ্যাকার সাব্যস্ত করে গায়ে করোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরে ফেলি, সেরকম কিছুও থাকবে ওখানে।
মেরেই ফেলবে?
না না, তা হয় নাকি। আমরা আসলে আমাদের চারপাশ থেকে কনসেপ্ট নেব, তারপর সেগুলো ঢেলে সাজাব।
তা, আমার এখানে করণীয় কী? তুমি বলছিলে আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে।
… ভালো পেমেন্ট।
অবশ্যই ভালো পেমেন্ট। তার আগে তোমাকে তোমার কাজের ধরনটা বোঝাই। বিদেশ থেকে একটা টিম আসবে। যারা ইনভেস্ট করছে প্রজেক্টে, তাদের টিম। ধরো ৩-৪ জন। তারা পায়ে হেঁটে এই পুরো শহরটা ঘুরবে। হতদরিদ্রদের বস্তি থেকে অতি ধনীদের বসতি পর্যন্ত, সব দেখবে, দরকার হলে ঢাকার বাইরেও যাবে। সব দেখবে। এ দেশের মানুষ, তাদের ধরণ, তাদের আচার, তাদের আচরণ, তাদের দুঃখ তাদের বিনোদন, তাদের ক্রিয়া তাদের প্রতিক্রিয়া–তারা সব দেখবে। তারপর দেশে ফিরে তাদের পর্যবেক্ষণের ওপর ওয়াল্ডারল্যান্ডের ওপর আইটেম তৈরি করবে। অর্থাৎ এ দেশের মানুষের মনোজগত মাথায় রেখে আইটেমগুলো তৈরি হবে… ক্লিয়ার?
গোলাম হায়দার আবদুল হককে জানাল- এরা যে, যে যার ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভ তা আমার জানা ছিল। ওদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সেটা এখন আরো স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি। তুমি দেখো…।
গোলাম হায়দার বিদেশি টিমটার সঙ্গে কাজ শুরু করেছে দিন পাঁচেক হলো। সারাদিনের কাজ কখনো কখনো রাত ও হয়ে যায়, তখন তারা সারাদিনের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করতে বসে।
এরমধ্যে সে অবশ্য আবদুল হকের সঙ্গে দেখা করেছে। সে নিজে অকৃতদার হলেও হক পরিবারটির সঙ্গে তার সম্পর্ক এতটা কাছের, দুদিনের বেশি দেখা না হলে সে তো বটেই, আবদুল হক, রেখা, এমনকি শান্তাও অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করে। গোলাম হায়দার শান্তার জন্য ‘অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড’ কিনে এনেছে।
হঠাৎ ‘অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড’ কেন? আবুদল হক তার কাছে জানতে চেয়েছিল। আমি কিন্তু ওকে হযবরল’ পড়ে শোনাচ্ছি।
কেমন লাগছে ওর।
খুবই মজা পাচ্ছে। আমি একটু পড়ি, আর ও খিকখিক করে হাসে। মাঝে মাঝেই আমাকে বলে বরং একটা কতা শুনবে– হাতে কী থাকল, জানো? পেন্সিল। আবার কখনো বলে বাবা, এখন তোমার বয়স বাড়তি না কমতি?
আমার মাথার আধখানা কুমীরে খেল, তাই বাকী আধখানা মরে গেল– এ পর্যন্ত কি তোমরা এসেছ?
নাহ্ ওকে একটানা বেশি শোনাই না। ধৈর্য্য রাখতে পারে না, তুমি জানো।
হু। একটু একটু করে শোনাও। তা ছাড়া অমন অসাধারণ একটা খুব তাড়াতাড়ি ফুৃরিয়ে যাবে, তাও হওয়া উচিত না।… কী অসাধারণ একটা লেখা, তাই না আবদুল হক, আবার ভয়ংকরও।
আবদুল হক মাথা দোলাল- ভয়ংকর।… আচ্ছা, ‘অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড’ কেন এনেছ, সেটা বললে না?
হযবরল’ শেষ হলে তুমি এটা ওকে পড়ে শোনাবে।
শান্তাকে?
আর কাকে?
কিন্তু ওকি বুঝবে? এমনিতেই পিছিয়ে আছে, ইংরেজিতে দখলও কম, তার ওপর সেই তখনকার যুগের ইংরেজি…।
তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, আমি একটা রিটোল্ড ভার্সন এনেছি।
ওহ! আবদুল হক বইটা দেখতে আরম্ভ করল।
শোনো, একদম অল্প অল্প করে পড়ে শোনাবে, তারপর দরকার হলে বাংলা করে দেবে। আমার ধারণা এক পর্যায়ে গিয়ে আর বাংরা করার প্রয়োজন পড়বে না। ওর ইংরেজি জ্ঞান কিছুটা বাড়বে। এটা গেল একটা দিক।
আরো আছে? বলো।
‘হযবরল’ ও ‘অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড’ দুটোই যখন ওর শোনা হয়ে যাবে। তুমি একটু খেয়াল করে দেখবে, কিছু জিজ্ঞেস করবে না ওকে, শুধু খেয়াল করবে– দুটোর মধ্যে কোনো সাযুজ্য সে পাচ্ছে কিনা।
কঠিন হবে ওর জন্য।
কিন্তু তুমি কোনো পরীক্ষা নিচ্ছ না। ও যদি নিজে থেকে পারে, পারবে।
গোলাম হায়দার হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা ‘অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড’ বইটা তুলে নিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে বইটির প্রচ্ছদের দিকে, তার মুখে সামান্য হাসি দেখা দিল– মজা হয়েছে একটা। বইটা আমি খুঁজছিলাম। পাচ্ছিলাম না। সেদিন ছিলাম ঐ গ্রুপটার সঙ্গে। হাঁটছিলাম আমরা। ওরা হেঁটেই কাজ করে। সঙ্গে গাড়ি থাকে। কিন্তু ওরা হাঁটে, ওভাবে পর্যবেক্ষণটা ভালো হয়। তো, হাঁটতে হাঁটতে সবাইই হঠাৎ এক জায়গায় থামল। গ্রুপে একজন আছে, চার্লস ডজসন, একটু গম্ভীর প্রকৃতির, গ্রুপে ওই সবচেয়ে কম কথা বলে, কিন্তু যখন বলে- এমন সব তীর্যক মন্তব্য। ওখানে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল, অনেকটা নিজের মনেই, বলল, যেন নিজেকে বলছে সেÑ আমাদের কাজটা কঠিন। পুরো দেশটাই যখন ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’ তখন আলাদা করে ‘ওয়াল্ডারল্যান্ড’…।
গ্লিমারম্যান শুনে ফেলল তার কথা– কিন্তু ডজসন, এটাই আমাদের কাজ।
অস্বীকার করছি না। কাজটা কঠিন, আমি শুধু এটুকু বলছি।
আমার অবশ্য বেশ লাগছে। ওদের কালচার ওদের খাওয়ানো, চ্যালেঞ্জিং, তাই না?
ডজসন বিড়বিড় করে কী বলল, বোঝা গেল না।
তুমি একটু আগের ব্যাপারটা খেয়াল করো। রাস্তা দিয়ে ন্যাংটা পাগল হেঁটে যাচ্ছে। কারো কোনো সমস্যা নেই, সবাই স্বাভাবিক, যেন দৃশ্যটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই ঐ ন্যাংটা পাগল এক মহিলাকে বিব্রত করতে আরম্ভ করল, লোকজন সব দাঁড়িয়ে গেল, হাসিমুখে ঘটনা দেখতে লাগল, আর কী সব মন্তব্য, হায়দার আমাদের অনুবাদ করে শোনাচ্ছিল, কাউকে কাউকে দেখলাম মহিলার দুর্দমা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন পেট্রোল পুলিশও ছিল ভাব একবার এ দেশের মানুষ মহিলাকে বিনা দোষে বিব্রত হতে দেখলে উল্লসিত হয়।… তোমরা যে যাই বলো, এই আইটেমটা রাখব।
আবদুল হকের মুখে সামান্য হাসি, লজ্জা ও অস্বস্তি মেশানো- কী যে আমরা।… আর, ওরা খুঁজে খুঁজে এসবই দেখছে, না?
স্বাভাবিক। শুধু দেখছে না, লাইব্রেরি ওয়ার্কও করছে, গত কয়েক মাসের নিউজপেপার দেখল ওরা, বলছে, মেয়েদের বিরক্ত করার ওপর একটা আইটেম রাখবে।
দেখো, মেয়েদের বিরক্ত করা, আমরা এই কিছুদিন আগেও যাকে ইভটিজিং বলতাম, সেসব কিন্তু, ওসব দেশেও আছে।
আছে। কিন্তু দলবেধে ছেলেদের মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নেই। ওরা ব্যাপারটাকে সম্ভবত তিনটা ভাগে ভাগ করবে। প্রথমে ইভটিজিং ও বিয়ে বা শারিরীক মিলনের আহবান। দুই, রাজি না হলে মেয়েটাকে উঠিয়ে নিজে গিয়ে গণধর্ষন বা দা কুড়াল দিয়ে কোপানো। তিন, মেয়ের বাবা বা ভাই প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলা বা হাঁটুর নীচ থেকে দুপা কেটে ফেলা।
যত্তসব। আবদুল হকের মুখে কিছুটা বিরক্তি দেখা গেল।
বিরক্ত হচ্ছ?
হচ্ছি। খুবই।
আর আমি পাচ্ছি আমার লেখার উপাদান।… আবদুল হক …।
বলো।
এই সবকিছু আমার খাতাগুলো আর এদের সঙ্গে আরো কয়েকটা দিন থেকে যা দেখল, তা যদি ঠিক ঠিক গুছিয়ে লিখতে পারি, তবে আমার লেখাটা দারুন হবে। সেটা একটা ভালো খবর গোলাম হায়দার কিন্তু…
কিন্তু কী?
অস্বস্তি লাগে। কেন লাগে, জিজ্ঞেস করোনা, বলতে পারব না।
গোলাম হায়দার হাসতে আরম্ভ করল তোমাকে সবটা বলিইনি।
বলতে হবে না। এমনিতেই তোমার খাতার কাটিংসগুলো পড়ে মাঝেমাঝে নিজেকে এলামেলো লাগে।
আরো আছে।…. উঁহু, জুনেই দেখো। ঐ যে সুড়ঙ্গ কেটে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরির ব্যাপার আছে না, ওরা ওটাও রাখবে। তবে ওদের বেশি টেনেছে, ব্যাংকের তহবিল তসরুফ। লোনের নামে, এই নামে ঐ নামে হাজার হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে, কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটা তো ওরা রাখবেই আইটেমের একদম শেষে কেউ একজন বলে উঠবে, ধরো যত টাকা উধাও হয়েছে, তার পরিমান উল্লেখ করে রাবিশ এটা কোনো টাকা হলো।
তুমিও রাখবে?
কী?
তোমার বইয়ে, এইসব?
আরে, এসব নিয়েই আমার বই।
সে বহুবার বলেছে। কিন্তু এসব গপ্পের মতো করে আনা কঠিন।
হ্যাঁ, জানি সেটা। তা, লেখার আঙ্গিকটা হয়তো নতুন ধরনের হবে, কিন্তু আবদুল হকের আশ্চর্য ভ্রমন আমি লিখবই।
তুমি এটার নাম ওয়ান্ডারল্যান্ডও দিতে পার।
নাহ। তোমার নামে। শুনতে ভালো লাগে। তাছাড়া চারপাশের নৈরাজ্য নিয়ে তুমিই আমার চেয়ে বেশি কথা বলতে।
এখন আর বলি না।
বলে না। জানি তোমার বিরক্ত লাগে, তাই বলে তুমি সবকিছুর বাইরে চলে এসেছ, তাও কিন্তু নয়।
আব্দুল হক কিছু না বলে চুপ করে থাকল।
কী বললে? বাইরে কি আর যাওয়া যায় একথা বললে?
আবদুল হক সামান্য হাসল।
শোনো আবদুল হক, খুব তাড়াতাড়িই কিন্তু আমি আরম্ভ করছি।
করো। আবদুল হক ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল।
একটু করে লিখব আর তোমাকে ও রেবাকে পড়তে দেব। তোমাদের মতামতটা আমার জন্য জরুরি।
কীসের মধ্যে যে আমাকে নেবে।
ভ্রমন, আব্দুল হক। তোমাকে এক আশ্চর্য ভ্রমনের সত্য দিয়ে নেব।
আশ্চর্য কেন, অদ্ভুতুরে কি ভালো শোনায় না? আবদুল হকের অদ্ভুতুরে এমন?
গোলাম হায়দারকে চিন্তিত দেখাল কথাটা তুমি ভালো বলেছ।
নামটা কি তবে বদলে নেবে? আবদুল হকের অদ্ভুতুরে ভ্রমন? কিংবা শুধু অদ্ভুতুরে ভ্রমন।
গোলাম হায়দার একবার তাকাল আবদুল হকের দিকে। চুপ করে থাকল।
কী হলো?
আমি ভাবছি।… শোনো, যে কোনো তিনটার একটা হলে নাম। এর বাইরে সত্য কোনো নাম হবে না।
কিন্তু তুমি লিখবেই?
হ্যাঁ। আর ওটাই ফাইনাল হযবরল ঢঙে। হাসির পেছনে থাকবে করুন কাহিনি।
তা হলে বইয়ের নাম দিও দি নিউ হযবরল।
আবদুল হক ভেবেছিল গোলাম হায়দার খেপবে। কিন্তু গোলাম হায়দার খেপল না, সে বলল মন্দ চলোনি, এটাও মন্দ বলেনি। নতুন ধরনের নাম।
এটাই রেখে দাও তবে। আমার নামটা বাদ পড়ক।
তুমি আমার সব এলোমেলো করে দিচ্ছ। এত এত নামের কথা কে বলতে বলেছে তোমাকে।
চলে আসে। সবগুলোই মানানসই তাই না।
নাম একটা জরুরি ব্যাপার বটে। তবে আমি এখন নাম নিয়ে ভাবব না। আমি কী করব জানো? আমি প্রথমে লেখাটা শেষ করব। তারপর ভাবব নাম নিয়ে। দরকার হলে নাম দেব, হযবরল- দুই।
তুমি আমার ওপর খেপেছ মনে হচ্ছে?
না আমি সত্যিই ঐ নাম দিতে পারি। আমি এখনো জানি না।
আবদুল হক মুদু হেসে চুপ করে থাকল।
গোলাম হায়দার বলল বইটা কীভাবে পেলাম বলা হলো না। কথা অন্যদিকে চলে গেল। আমি ওদের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে ছিলাম, তারপর হাটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে এক জায়গায় থামলাম। ওরাও তাকাচ্ছিল, আমিও তাকাচ্ছিলাম ওদিক-এদিক। আমাদের নিয়ে উৎসাহী মানুষের ভিড় জমতে শুরু করেছে। তখন হঠাৎই আমার বইয়ের দোকানটা চোখে পড়ল। তেমন আহামরি কিছু না, সাধারণ একটা বইয়ের দোকান। তবে আমার অবাক লাগল এই ভেবে, এ রাস্তা আমার পরিচিত, এ রাস্তায় আমার যাওয়া আসা আছে, তুমি জানো আমি হেঁটেই যাই বা রিকসায় দুপাশে তাকাতে তাকাতে যাই আমি কতবার গেছি আসছি এই রাস্তায়, কখনো আমার বইয়ের দোকানটি চোখে পড়েনি। আবার এমনও নয়, দোকানটি নতুন। পুরনো দোকান, রাস্তার ধুলোবালিতে মলিন, বইপত্রের পাশাপাশি স্ট্রেশনারিজ বিক্রি করে, এমন। এমন দোকানে আমার ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। খোঁজার কথা না, কিন্তু কী হলো আমার আমি ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলাম ঐ দোকানে। ভেতরে ঢুকে নিরাশ হচ্ছি এই ভেবে এখানে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তবু জিজ্ঞেস করলাম ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ আছে? দোকানী, আমাদের চেয়ে বয়স্ক মানুষ সামান্য– হ্যাঁ-সূচক কাউন্টার থেকে উঠে এসে, আমি যে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সেখান থেকেই দুটো ঝকঝকে বই বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দেখলাম একটা মূল লেখকের লেখা, সেই ১৮৬৫ সালের ইংরেজি, আমি তাই বছর কয়েক আগে বের হওয়া রিটোল্ডটা কিনলাম। পয়সা মিটিয়ে বের হয়ে বাইরে, বইটা খামের ভেতর, ওদের কাছে বইটা বের করলাম। ওদের দেখাবার জন্য যে তুমি একটা ইংরেজি বই কিনলে আবদুল হকের মুখে হাসি। হাসিটা ফিরিয়ে দিল ভাবলাম হায়দার তা বলতে পার। হলো কী, বইটা উলটে পালটে দেখছি, ওরাও তাকিয়েছে, ওদের উৎসাহ নেই, শুধু ডজসন, ডজসনকে খুবই বিস্মিত দেখাল তুমি ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ কিনেছ। আমি ওর বিস্ময়ের কারণ বুঝলাম না, হাসলাম, বললাম ছোটবেলায় এটা আমার খুবই প্রিয় বই ছিল, অনেক বার পড়েছি মূল ভার্সনটা।
ডজসন বিড়বিড় করে কী বলল বুঝলাম না, ও হাত বাড়িয়ে বইটা নিল, দেখল কতক্ষণ, বলল হায়ডার, তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।
আমি বললাম বলো।
এখন না, বলব, পড়ে বলব।… কিন্তু তুমি রিটোল্ড ভার্সন কিনলে যে।
এটা আমার জন্য না। আমার লাইব্রেরিতে সম্ভবত এখনে। অরিজিনাল ভার্সনটা আছে। আমি এটা কিনেছি আমি তারপর ওকে শান্তার কথা, রেবার কথা খুলে বললাম। তোমার কথা বললাম। সুকুমার রায়ের কথাও বললাম। খুব মন দিয়ে শুনল। তারপর বলব, একদিন সময় বের করে সে তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে আসবে। আবদুল হক বলল সমস্যা, ইংরেজি বলতে হবে।
তিন
এর পরের ঘটনা নানাভাবে ঘটতে পারে। হতে পারে, গোলাম হায়দার তার উপন্যাস লেখা শুরু করে দিল। উপন্যাসের নামের ব্যাপারটা ঝুলে থাকল। আবদুল হকের আশ্চর্য ভ্রমন হতে পারে অদ্ভুতুরে ভ্রমণ হতে পারে কিংবা শুধু অদ্ভুতুরে অথবা দি নিউ হযবরল। গোলাম হায়দারের মনে হয়েছে দি নিউ হযবরল নামটা সুন্দর বটে তবে একটু নরম হয়ে যায়। এখনকার অবস্থাটা কিংবা উপন্যাসে যা থাকবে, তা ধরার জন্য এই নাম যথেষ্ট পোক্ত নয়। তবে, এমনই ভেবেছ সে নাম উপন্যাসের নাম পরে ভাবা যাবে, তার আগে দরকার উপন্যাসটা লিখে ফেলা। লিখতে সময় লাগবে, সে জানে, এই উপন্যাস খসখস করে লিখে যাওয়ার মতো না। এই উপন্যাস তাকে ভোগাবে। তবে সে রাজি আছে। সে সময় দিতে প্রচুর পরিশ্রম করতে রাজি। আমরা গোলাম হায়দারের লেখা শুরু করার কথা বললাম বটে, তবে আমরা নিশ্চিত করে জানি না, এই এখনই সে শুরু করবে কি না। আমরা জানি, একটি গল্পের একটি বা দুটো চরিত্র অবাধ্য হতেই পারে। যেন লেখকের কথা না শুনেই তাদের আনন্দ। লেখক যতই তাদের নির্দিষ্ট ট্রেইনের ওপর রাখতে চাইবে, ততই তারা এদিক যাবে ওদিক যাবে। সুতরাং এই গল্পের চরিত্র গোলাম হায়দার কী করবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। লেখক হিসাবে আমি হয়তো চাইলাম, গোলাম হায়দার ভাবল না? আগে হাতের কাজগুলো সেরে নেই। ভাবল এখনো কত কী দেখা বাকি।
তা ছাড়া ওয়ান্ডার ল্যান্ডের এই টিমটা চলে যাক। ওরা থাকলে কাজে মন দিতে পারব না। তখন আমি হয়তো ভাবলাম তবে তাই হোক, হাতের কাজ শেস করে নিক ও আরো কিছু দেখে নিক। তারপর গুছিয়ে….। ওদিকে গোলাম হায়দা হেসে ভাবল গুছিয়ে আবার শুরু হয় নাকি! এই উপন্যাস তৈরি হয়ে আছে, এখন বাকী শুধু তা লিখে ফেলা। সুতরাং শুরু হোক এই এখনই। দেখা গেল গোলাম হায়দার লিখতে শুরু করে দিল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ব্যাঙপার্টির ব্যবসা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। এদের অনেকেই সাতপুরুষের বাজনা বাজানো ছেড়ে অন্য নানা পেষায় চলে দিয়েছিল। এখন খুজে খুঁজে তাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের মধ্যে ফিরে আবার আসবে কি আসবে না এই নিয়ে বেশ দ্বিধা ছিল। কিন্তু তারা দেখল, টাকার পরিমান যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের দ্বিধা কেটে গেল। তারা ভাবল, চাহিদা যদি আবার একসময় চলেও যায়, একদিনে যা কামিয়ে নেব, তা দিয়ে বছর কয়েক চালিয়ে নেওয়া যাবে।
জুলহাস এক ব্যাঙপার্টির মালিক কাম ম্যানেজার। তার দলের হাতে এখন বেশ কিছু কাজ। জুলহাস তারিখ অনুযায়ী তালিকা তৈরি করে নিয়েছে। এক মেয়ে তুলে আনা কেইস। (হাকিম বাবুর্চির ছেলে রাজনীতি করে। এই ওয়ার্ডে তার ব্যাপক দাপট। সে এলাকার রুকসানাকে পছন্দ করেছে বিয়ের জন্য। রুকসানা ডাক্তারি পড়ে। দেখতেও সুন্দরী বলে বেশ কিছু বিয়ের প্রস্তাব বাবা-মার কাছে জমা হয়ে আছে। এরমধ্যেহাকিম বাবুর্চির ছেলে সুপারি পলাশের প্রস্বাব আছে। তবে সে কভর পেয়েছে তার প্রস্তাব পেয়ে ঐ পরিবারের সবাই, এ দেশের হলোটা কী’ জাতী অবাক হয়েছে। সুতরাং সুপারি ঠিক করেছে, দেশের কী হলো তা সে দেখিয়ে দেবে। ব্যাস্তপার্টি নিয়ে সে রুকসানাকে বিয়ে করতে যাবে। তার বাবা-মা বিয়ে না দিলে সে রুকসানাকে তুলে আনবে। তখন রুকসানা যদি বাড়াবাড়ি করে তবে সুপারি তাকে রেপ করে ছেড়ে দেবে। জুলহাসের দলের কাজ হবে, এই পুরোটা সময় বাজনা বাজানো। যা যা ঘটবে, বাজনার তালে তালে ঘটবে। কোনো মেয়েকে তুলে বা রেপ করা এসব নিয়ে জুলহাসের কিছু দোনোমনো ভাব ছিল। কিন্তু পরে সে ভেবে দেখছে, তুলে এনে বিয়ে করা এমন খারাপ কিছু না, আর রেপের ঘটনা যদি ঘটে, কী আর, রেপ তো পুরুষরাই করে তাদের কাজ বাজনা বাজানো, তারা বাজাবে।
দুই, হাকিম সাহেব জমির দখল নিয়ে প্রতিপক্ষের দুজনকে খুন করবেন। এ দুজন একই পরিবারের। তারা বারবার হাকিম সাহেবের দখলদারিতে বাধা দিচ্ছে। তো, হাকিম সাহেব ঘোষনা দিয়েছেন। বলেছেন তারা যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে। এই বলে তিনি চার পেশাদার খুনি ভাড়া করেছেন। তারা দিনক্ষণ বুঝে খুন করতে যাবে। জুলহাস তার দল নিয়ে ঘটনাস্থলের আশেপাশেই থাকবে। ঘটনা ঘটে গেলেই উদ্দাম বাজনা শুরু করে দেয়। খুনোখুনি নিয়েও একটু ভেবেছিল জুলহাস। পরে সে বুঝেছে, কী আর এমন ভ্যাপার এটা। ঐ পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি ৬জন হয়, দুজন খুন হলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা হবে ৪ জন–এই তো। তিন, এলাকায় শাজাহান সাহেবের সংস্থানই আলাদা। হোরাও রাজপুত্রের মতে। নানা ব্যবসা ও দান খয়রাতে তিনি আছেন। এবার ঠিক করেছেন, ইয়াবার ব্যবসা করবেন। কারখানা খুলবেন। যেদিন উদ্বোধন হবে, ফিতা কাটার সময় ব্যস্ত বেজে উঠবে। আগে থেকে কিছু ইয়াবা মজুদ থাকবে। উদ্বোধনের পর মহল্লা জুরে তা যুবসমাজের মাঝে কমদামে বিতরন করা হবে। ব্যান্ডপার্টি এসময় সক্রিয় থাকবে।
তালিকা এখানে শেষ নয়। আরো আছে। জুলহাসের তা নতুন করে দেখার ইচ্ছা হলো না। এখন দরকার হবে, এখন আবার ােখ বুলিয়ে নিলেই হবে।
গোলাম হায়দারের বাসায় এসছিল আবদুল হক। বেরোতে বেরোতে তার রাত হয়ে গেল। হায়দারের বাসায় সচরাচর তার আসা হয় না। আজ স এসেইছিল এদিকে। ফেরার পথে হায়দারকে ফোন করে জানল সে বাসায়। আবদুল হক ভাবল, একবার তাহলে ঘুরে যাই। তারপর সঙ্গে গঙ্গে রাত বেশ। আবদুল হক বললÑ উচিত হয়নি। আরো আগে ওঠা উচিত ছিল মাথা ঝাঁকাল গোলাম হায়দার– আমি কি তোমাকে পৌঁছে দেব ?
তারপর তুমি ফিরবে কীভাবে ? রাত আরো বেশি হয়ে যাবে…।
আবার তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে।
বুঝলাম। তারপর আবার তুমি।
আবদুল হক বেরিযে দেখল রাস্তা ফাঁকা। এতটা ফাঁকা হবে, সে আশা করেনি। রাত হয়েছে ঠিক, এমন রাত হয়নি– শহরের এক অংশ এমন ফাঁকা হয়ে যাবে। রাস্তায় হঠাৎ একটা দুটো রিক্সা, সেসব ফাঁকা নয়। হঠাৎ একটা দুটো খালি পেলেও তারা যাবে না। রাস্তায় মানুষ অবশ্য কিছু আছে। তবে এরকম অল্প দুচারজন মানুষ দেখলে অবশ্য স্বস্তির চেয়ে ভয় বেশি লাগে। আবদুল হক জোরে পা ফেলল। সামনে চৌরাস্তার মোড়, ওখানে রিকশা পাওয়া যাবে। চৌরাস্তায় পৌঁছানোর আগে ঘটনাটা ঘটল। আবদুল হক একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল, একটা আওয়াজ এসেছিল কানে, সে দেখল কিছুটা সামনে পুলিশের একটা ট্রাক, তিন-চারজন পুলিশ কাকে যেন ধরেছে, মৃদু হল্লা আর ধস্তাধস্তি। ছিনতাইকারী ? ভেবেই আবদুল হক স্বস্তি বোধ করল। এমন হতে পারত, পুলিশের টহল ওখানে থাকল না, আর সে আগোতে এগোতে ছিনতাইকারীর হাতে গিয়ে পড়ল! সঙ্গে যা আছে, তা যে এই, হয়তো প্রাণটাও।
আবদুল হক একবার ভাবল পুলিশের ট্রাক বরাবর সে যাবে না। রাস্তার ওপাশে চলে যাবে। তবে, এই যে- সম্ভবত ছিনতাইকারী ধরা পড়ছে- এটা দেখার কৌতূহলও সে এড়াতে পারল না। ঠিক করল, সরাসরি তাকাবে না সে, আড়চোখে তাকাতে তাকাতে ঘটনাস্থল পার হয়ে যাবে। তারপর বাসায় ফিরে লিলি, আর, পর দিন গোলাম হায়দারকে বলা যাবে। গোলাম হায়দার হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল। এর মধ্যে পুলিশের ট্রাক ছেড়ে দিলে সে কিছুই দেখতে পাবে না। জোরে পা চালিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে তার অল্পসময়ই লাগল। তখনও ধস্তাধস্তি চলছে। বেশ হল্লাও আছে সঙ্গে। তিনজন পুলিশ অল্পবয়সী একটা ছেলেকে, ২৩-২৪ হবে হয়তো, ট্রাকে তোলার চেষ্টা করছে, পারছে না। ছেলেটার সুশ্রী, একটা =রিয়া ভাব তার মধ্যে কাজ করছে, চিৎকার করার চেষ্টা করছে সে- ছাড়েন, ছাড়েন আমাকে, এরকম অন্যায় আপনারা করতে পারেন না।
এক পুলিশ ঘুষি মারল–আই, শুদ্ধ ভাষায় কতা কস ক্যা। আরেক পুলিশ হাসলো-একটু আগে আবার ইংরেজি কইছে। যেন ইংরেজি কইলেই আরে আমরা ছাইড়া দিব। হালায ইয়াবাখোর।
পেছন দিকে একটা লাথি খেয়ে পড়ে গেল ছেলেটা, পড়ে গিয়ে উঠতে গিয়ে সে আবদুল হককে সে দেখতে পেল ভাই… স্যার, আমাকে বাঁচান।
পুলিশ তিনজনও দেখল আবদুল হককে, ট্রাকের ভেতর বসে সিগারেট টানছিল একজন, সেও উঠে এগিয়ে এল। একজন বিরক্ত গলায় বলল- আপনে কে ? আমি বাসায় যাচ্ছি।
তাইলে দাঁড়ায়া আছেন ক্যান! যান। নাকি এর লগে আছেন। না না, এসব কী বলেন…।
ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠতে নিল-স্যার, এরা জোর করে আমার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
এবার একটা বড় ধাক্কা খেল ছেলেটা- খানকীর পুত, পকেটে ইয়াবা লইয়া ঘোরস। চল, থানায় গিয়া সব কইবি।… অই। এবর অন্যজনকে ডেকে আবদুল হকের দিকে ফিরল পুলিশ- দেখ তো, এর লগেও ইয়াবা আছেনি…।
আবদুল হক হকচকিয়ে গেল- আমার! আমার।… আমি….।
অই, এরে সার্চ দে।
একজন পুলিশ এগোল, আবদুল হক তখন হঠাৎই দৌড়াতে আরম্ভ করল। কাজটা ভালো হলো না, তার একবার মনে হলো, আবার এমনও তার মনে হলো যদি সত্যিই তার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে তাকেও ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়, সুতরাং দৌড়ানো ছাড়া কীইবা করার আছে তার।
ভয় যেটা ছিল, সেটা ঘটল না। এক পুলিশও তার পেছনে দৌড়াল না, তারা অবশ্য হাসল– হালায়…। সেই হাসি ছাপিয়ে ছেলেটার কন্ঠও আবদুল হক শুনতে পেল- স্যার, আমাকে ছেড়ে যাবেন না স্যার।
আবদুল হক থামল না, দৌঁড়িয়ে অভ্যাস নেই, তাই কিছুদূর এগনোর পর গতি কিছু শ্লথ হলো, তবে মোড়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত সে দৌড় থামাল না। রিকশঅলা যে ভাড়া চাইল, তাতেই সে রাজি হয়ে গেল। রিকশাঅলা প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগোতে শুরু করলে সে কিছু স্বস্তিবোধ করল, বড় করে শ্বাস ফেলল, ঠিক তখনই সে কানের পেছনে শুনল- স্যার, আমাকে ছেড়ে যাবেন না স্যার। ঝট কর আবদুল হক পেছনে ফেলল। না নেই, কেউ নেই। থাকবে কীভাবে! এতক্ষনে নিশ্চয় ছেলেটাকে ট্রাকে তোলা হয়ে গেছে। গেছে না?- আবদুল হক নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করল, নিজের কাছেই উত্তর দিল- হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই। তখন আবার সে কানের পেছনে ছেলেটার কন্ঠস্বর শুনল। আবদুল হক ফিরল না। এক মুখ শক্ত করে বসে থাকল।
এটুকু লেখা শেষ হলে গোলাম হায়দার পরদিনই আবদুল হকের বাসায় ছুটে গেল- একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেছে।
তোমাকে উদভ্রাস্ত দেখাচ্ছে। ওয়ান্ডার ল্যান্ড টিমের সঙ্গে বেরিযে তেমন কিছু দেখেছ ? সে তো আছেই, আবদুল হক, সে তো আছেই, তবে এখন তেমন কিছু না।… আমি উপন্যাসটা শুরু করে দিয়েছি।
আবদুল হক কিচু বিস্ময় বোধ করল- কী বলো! এর মধ্যে ?
হ্যা, এর মধ্যেই। ওদের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরেফিরে বাসায় ফিরে খাতাগুলো উলটে পালটে দেখছি, হঠাৎই মনে হলো-লিখছি না কেন!
আলৌকিক তাগিদ নাকি ? আবদুল হকের মুখে মুচকি হাসি।
ওরকমই। এতদিন ভাবতাম হয় না। এখন মনে হচ্ছে- ককখনো কখনো হয়। আবদুল হক কিছুটা বিস্ময় কিছুটা কৌতুক কিছুটা- ব্যাপারটা বুঝতে না পারার হাসি নিয়ে গোলাম হায়দারের দিকে তাকিয়ে থাকল। গেলাম হায়দার বলল- তুমি আর ভাবি পড়বে বলে আমি ফটোকপি এনেছি।
দি নিউ হযবরল ?
ঠিক করিনি। এই নামে ফান আছে, কিন্তু অবস্থাটা কি পুরো বোঝা যায় ?
ভেতরে কী আছে? মানে স্টাইলটা ? স্যাটায়ারের স্টাইল?
নাহ। বহু আগে একবার ভেবেছিলাম ওরকম। পরে ঠিকক করে রেখেছিলাম-নাহ, আমি সরাসরি লিখব। স্যাটায়ারের কিছু কোচিং থাকবে হয়তো, কখনো কোনো ঘটনা হয়তো স্যাটাযার হয়েই আসবে… আসলে আবদুল হক…। এই পর্যন্ত বলে গোলাম হায়দার চুপ করে গেল।
গোলাম হায়দার চুপ করে গেলে আবদুল হক অপেক্ষা করল। হায়দার তার অনেক দিনের বন্ধু, হায়দার কখন চুপ করে কেন করে, তার ধারণা আছে। সুতরাং সে অপেক্ষা করল, তবে গোলাম হায়দারের থেমে থাকা দীর্ঘ মেয়াদী হতে নিলে সে জিজ্ঞেস করল- থেকে গেলে কেন! কী বলবে ?
যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষা ছিল গোলাম হায়দার। দেখো। সে বলল। এই যে আমরা স্টাইল নিয়ে আলোচনা করিছি, এর কী দরকার আছে। যা আমি শিখব, তা কি এমনিতেই স্যাটায়ার নয় ?
এমনিতেই।
তা হলে লিখে গেলেই হলো, তাই না ?
আবদুল হক মাথা ঝাঁকাল- লিখে গেলেই হলো।
আবদুল হক বলল ও গোলাম হায়দার, আমরা দেখব, তেমনই করল। সে লিখে গেল। তাকে অবশ্য ভাবতেও হলো অনেক। কারণ একটি একটি করে ঘটনা হিসাব করলে তার পরিমাণ অনেক। তার খাতায় অনেক অনেক ঘটনার কথা লেখা। এগুলো সে কোনটার পর কোনটা আনবে, কোনটার ট্রিটমেন্ট কীরকম হবে, এসব তাকে জ্বালাচ্ছে। তার এমনও একবার মনে হলো ওয়ান্ডার ল্যান্ডের টিমটা চলে গেলে তার শুরু করা উচিত ছিল। তখন মাথার ওপর একটা বোমার মতো টিমটা যাকত না, সে থাকত নির্ভার, আর, এই যে টিমটার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে অনেককিছু দেখছে, সেসব তার ভেতর থিতু হওয়ার সময় পেত। আবার সে এরকমও ভাবছে, এই ভেবে তার কাজ বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে না। লেখাটা তার মাথার ভেতর ঘুরছে, তাকে তাড়াচ্ছে, তাকে অন্য মনস্ক করছে। এসব যে সত্যি, লেখাটা তার মাথার ভেতর ঘুরছে, তাকে অন্য মনস্ক করছে, এসব, সেটা সে নিজেও আরো সহজে বুঝতে পারল, এরমধ্যে একদিন যখন, ওয়ান্ডার ল্যান্ড টিমের সঙ্গে সে আছে ডজসন তাকে জিজ্ঞেস করল- তোমাকে দুতিনদিন হলো বেশ অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে।
গোলাম হায়দার সেকথা শুনে সামান্য হাসলে ডজসন আবার জিজ্ঞেস করল- ব্যাপারটা বলা যাবে ? তোমার আমাদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগছে না ? না না, এটা কী বলছ! আমার দারুন লাগছে।
তা হলে ?
আমরা নিজেরা এসব নিয়মিতই দেখি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে মিলে যখন দেখছি, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছি, তখন আমার দেখাটাও ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে। তা হলে ? তুমি কি কোনো সমস্যায আছ ? ব্যক্তিগত হলে বলতে হবে না। না না, ব্যক্তিগত কিছু না।… আসলে কিছুই না।… আসলে ডজসন, আমি একটা নতুন লেখায় হাত দিয়েছি।
তাই! ফিকশন ?
হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ফিকশনই লিখি। এই আমাদের চারপাশ নিয়ে। কী ঘটেছে, মানে যা যা দেখছি চারপাশে…। এই যেমন ধরেন, একসময় বলাবলি হলো না যেন পুরো দেশটাই ওয়াল্ডারল্যান্ড….।
তুমি এটা লিখচ!
কেমন হবে বলো তো, যদি লিখতে পারি ?
কতদূর লিখেছ ?
মাত্র আরম্ভ করেছি। কয়েক পাতা। ঐ লেখাটাই মাথার মধ্যে ঘোরে। ডজসন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল তার দিকে, সামান্য মাথা ঝাঁকাল, তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেল সামনে। গোলাম হায়দার ভাবল, এই জাতটাই এমন, এক কাজের সময় অন্য কাজের কথা ভাবতেই চায় না। তা, না ভাবুক, সে নিশ্চয় এখনকার কাজে ফাঁকি দিচ্ছে না, সুতরাং লেখা চলবে।
দিন কয়েক পরে গোরাম হায়দার আবার আবদুল হকের বাসায় উপস্থিত হলো। ছুটির দিন, সে এসেছে সকালের দিকে, বলল- ভেবো না, সারাদিন থাকব। এসেছি, বাকি যেটুকু লিখেছি সেটুকু দেখাতে।… দেখাবও না। দিয়ে চলে যাব। আজ বিদেশিদের সঙ্গে জরুরি মিটিং আছে। ফাইনাল মিটিংও বলতে পার। পরশু তরশু ওরা চলে যাবে।
তারপর তুমি দুহাতে লিখতে শুরু করবে ?
না, একহাতেই লিখব।… আগের অংশটুকু পড়েছ ?
পড়েছি। না-পড়ার কিছু কি আছে ?
কেমন হয়েছে ?
তোমার লেখা, খারাপ হওযার কারণ দেখি না। তবে আমি এই এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। রেবা অবশ্য তোমাকে কিছু বলবে।
রেবার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। সে কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে নিজেই এলো। সে টেবিলের ওপর চা রাখতে রাখতে বলল- হাযদার ভাই, আপনার লেখাটা নিয়ে কিচু কথা বলব।
হুম। আবদুল হক বলেছে।… ওটা কি হচ্ছে কিছু ?
রেবা হেসে ফেলল- এত বিনয়ী হওয়ার দরকার নেই। আপনার লেখা ওটা।
কিন্তু একদম অন্যদম অন্য রকমের একটা লেখা লেখার চেষ্টা করছি।
যেটুকু পড়েছি, ভালো লেগেছে। হক বোধহয় কোথাও কোথাও আপত্তি করবে। ওকে আন্ডারলাইন করতে দেখেছি।
তবে আমার কথা ভিন্ন।
বলো।
আমার কথা দুটো।
দুটোই বলো।
আপনার এই লেখা কেউ ছাপবে ? কোনো পত্রিকা ?
তুমি তাদের সাহসের কথা বলছ ?
ধরেন, সাহসের কথাই বলছি। আপনি যা যা লিখেছেন, যা যা লিখবেন, তা তারা আপনার হয়ে ধারনা করবে ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গোরাম হায়দার বলল- ধরলাম, কেউ ছাপল না।
আপনি এমন বহু কথা লিখবেন, যা হজম করা কঠিন। আবার বহু গোষ্ঠিকে খেপাবেন আপনি। পত্রিকার তো তাদের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে খেতে হয়, নাকি ?
তা খেতে হয়।
তা হলে ?
পত্রিকায় চেষ্টা করব। না হলে সরাসরি বই করব।
কোনো প্রকাশক ছাপতে চাইবে এটা ?
না হয় তো।
তা হলে ?
গাঁটের পয়সা খরচ করে আমি ছাপব। গোলাম হায়দার গম্ভীর দেখার।
তারপর গুম হয়ে যাবেন ?
কী! ধাৎ।
ধাৎ ধাৎ করোন না। গুম কি খুব কঠিন কিছু ?
না, তা না। আমার পরের অধ্যায়েই একটা গুমের ঘটনা থাকবে।
আপনি লিখবেন অনেকের স্বার্থের বিরুদ্ধে, অনেকের সমালোচনা করে, তাদের কারো পক্ষে কি গুম করা কঠিন?
না, সহজ।… কিন্তু রেবা ভয় দেখিও না।
আপনি ভয় পাবেন না, আমি জানি। আমি জানি আপনি লিখে শেষ করবেন।
হ্যাঁ, লিখে শেষ করব।
কিছু শেষ করবেন কীভাবে ?
মানে ?
আপনার এই উপন্যাসের সমাপ্তিটা কীরকম হবে, হায়দার ভাই ?
সমাপ্তি? গোরাম হায়দার যেন ভাবল। হঠাৎ সমাপ্তির কথা কেন ?
কারণ আমার মনে হচ্ছে এ লেখাটার শেষ নিয়ে আপনি ভোগান্তিতে পড়বেন। আপনার বন্ধুও তাই বলেছে।
গোলাম হায়দার আবদুল হকের দিকে একপলক তাকিয়ে নিল, আবদুল হকের মুখে এক চিলতে হাসি, গোলাম হায়দার রেবার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল- সব লেখাই শেষ হয়ে যায়।
আবদুল হক বলল- কিনউত এ লেখার পরিসমাপ্তি তুমি কীভাবে টানবে ? এই যে কাহিনি চলছে, তার আপাত কোনো সমাপ্তি নেই। তুমি সেটা কীভাবে টানবে ?
লেখাটা চলুক না। গোলাম হাযদার বলল। হয়তো ওটাই আমাকে কোনো এক সমাপ্তির দিকে টেনে নিযে যাবে।
গোলাম হায়দার এরকম বলল বটে গল্পই তাকে পরিণতির দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে, আবদুল হক ও রেবার কথায় তার ভেতর যে এক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটাও সে অস্বীকার করতে পারল না। সে টের পেল, যতই সে এরকম ভাবছে- একটা কাহিনিই তো, সব কাহিনিই একসময় এক জায়গায় এসে শেষ হয়, এটাও হবে; ততই তার সে ভাবনা ছাপিয়ে এ ভাবনাটা প্রবল হয়ে উঠছে- এই গল্পের পরিণতি টানা হয়তো সত্যিই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এই ভাবনার পাশাপাশি রেবার আরেকটা কথা, তার ভেতর আলগোছে বিঁধে থাকল। এই উপন্যাস সে ছাপতে পারবে? পারবে, গোলাম হায়দারের মনে হলো। এখানে সমস্যা এই, সমস্যা এখানে- যারা যারা থাকবে এই উপন্যাসে, তারা সবাই কি এটা সহজে হজম করবে ? যদি তাদের কারো হজমশক্তি মজবুত না হয়, গুম সে হয়েই যেতে পারে। হ্যাঁ, হয়ে যেতেই পারে। ব্যাপারটা সহজ। এভাবেই হতে পারে- তার ঘরের দরজার টোকা পড়ল, সে দরজা খুলল, কয়েকজন তাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
গোলাম হায়দার দেখল দুটো ভাবনা তাকে পেযে বসেছে। এক গুমের চিন্তা, যদিও ব্যাপারটা সে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না, গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে সে ভীরুও নয়, দুই, এই উপন্যাসের পরিণতি কী হবে ? এই দুই চিন্তা তাকে এতই ব্যতিব্যস্ত করল মাঝে মাঝে, সে রেবার ওপর আবদুল হকের ওপর বিরক্ত হযে যেতে লাগল। তবে লেখা সে বন্ধ করল না। লেখা সে চালিয়ে যেতে লাগল।
হ্যাঁ, এটাই আসল কথা, লেখা সে চালিয়ে যেতে লাগল। এর মধ্যে দুটো নাম সে মোটামুটি চূড়ান্ত করেছে। লেখা যখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে, তার মনে হয়েছে, উপন্যাসের নাম, না, আবদুল হকের আশ্চর্য ভ্রমণ সে রাখবে না, বরং তার চেয়ে ‘দি নিউ হযবরল’ বা ‘আবদুল হক ইন ওযাল্ডাল্যান্ড’ অনেক মানানসই হবে। এটা অবশ্য আরেকটু পরে শেষ করা যাবে, উপন্যাস প্রায় শেষের পথে, তারপরে।
দেখতে দেখতে গোলাম হায়দারের উপন্যাস মেষ হয়ে এলো। শেষের দিকে এক সপ্তাহ সে আবদুল হকের বাসায় যায়নি। এই যে একটা ঘোর তৈরি হয়েছে, এটা সে নষ্ট করলে চাচ্ছিল না। এভাবে লেগে থেকে সে উপন্যাসটা শেষ করে ফেলল। আসলে, প্রায় শেষ করে ফেলল। শুধু বাকিক থাকল শেষ এক দুই বা তিন পৃষ্ঠা লেখা। সেটা খুব কঠিন হবে বলে গোলাম হায়দারের মনে হলো না। তার মনে হলো, যখন যখন বেশ রাত হয়ে গেছে, এখন সে প্রশান্তির এক ঘুম দেবে, উপন্যাস প্রায় শেষ করার প্রশান্তি, ঘুমিয়ে পড়ার পাশ পর্যন্ত সে অবশ্য উপন্যাসের সমাপ্তি নিযেই ভাববে, তারপর সকালে উঠে বাকি অংশটুকু শেষ করে ফেলবে।
হাত-মুখ ধুয়ে, কিছুক্ষণ পায়চারি করে শুয়ে পড়ল গোরাম হায়দার, তারপর একসময় ও ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রশান্তির ঘুম, উপন্যাস শেষ হয়ে এসেছে। প্রশান্তির এই গভীর ঘুম ভাঙল মূহর্মূহ কলিংবেলের আওয়াজে। প্রথমে গোলাম হায়দার বুঝতে পারল না কিসের শব্দ, যখন বুঝতে পারল, তখন সে ধরমড় করে বিছানায় উঠে বসল। এভাবে কেউ কলিংবেল বাজায়। এভাবে ধরে থাকে!
এখন কত রাত, এখন কে আসতে পারে, এসব কিছুই মনে এলো না গোলাম হায়দারের। সে বিছানা থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে দরজা খুলল। দরজার বাইরে দুজন দাঁড়িয়ে। তাদের কাউকে চিনলই না সে। একজনের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, আরেকজন প্যান্ট-শার্ট আর টাই পরা। গোলাম হায়দার তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
চিনতে পারছ না ? মুখে সামান্য হাসি নিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটা তাকে জিজ্ঞস করল। গোলাম হায়দার দুপাশে মাথা নাড়ল। সে চিনতে পারছে না।
আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারছ ? পাশের বিদেশি লোকটা জিজ্ঞেস করল।
গোলাম হায়দারের লোকটাকে চেনা চেনা লাগল, কিন্তু সে ঠিক চিনতে পারল না। তার মনে হচ্ছে লোকটাকে সে দেখেছে, এই ভেবে সে আরো মনোযোগ দিল, এবারও চিনতে না পারলে সে খেয়াল করল লোকটার পরনের পোশাক বেশ পুরনো ধাঁচের। এখন কোনো বিদেশি, লোকটা ইংরেজ সম্ভবত, এ ধরনের প্যান্ট-শার্ট-টাই পরে না। একই কথা কিন্তু ধূতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটার ক্ষেত্রেও। এমন পোশাক পরা কাউকে গোলাম হায়দার শেষ কবে দেখেছে, ভুলে গেছে।
তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন ? ইংরেজ জিজ্ঞেস করল। তোমার আমাকে চিনতে পারার কথা, কিছুদিন আগেই আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম ওয়ান্ডারল্যান্ড নিয়ে।
গোলাম হায়দার চমকাল, চমকে সে তীক্ষ্ম চোখে তাকাল- আরে-সে বলল, বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল- তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।
লোকটা হাসল- কারণ আমি তখনকার পোশাকে এসেছি।
কখন কার ?
যখন আমি ‘অ্যালিস ইন ওযান্ডারল্যান্ড’ লিখেছিলাম তখনকার পোশাকে।
আপনি লিখেছেন। গোলাম হায়দারের ভুরু কুঁচকে গেল। আপনি লিখেছেন মানে!
আমার নাম তোমার মনে আছে ?
সে আছে। ডজসন।
পুরো নাম ? লুটউইগ
চার্লস লুটউইগ ডজসন, না ?
অ্যালিস ইন ওযান্ডারল্যান্ড কে লিখেছিল ?
ক্যারল। লুই…।
আহা, সে তো ছদ্মনাম। আসল নাম মনে নেই তোমার।
গোলাম হায়দার বিড়বিড় করে বলল- আছে। তুমি অংকের মাস্টার ছিলে।
আর আমি ? ধুতি পাঞ্জাবি-পরা লোকটা জিজ্ঞেস করল।
গোলাম হায়দার আবারও তাকাল, এবারও চিনতে পারল না- ওর নাম সুকুমার রায়। এবার চিনতে পারছ ?
কোন সুকুমার রায় ?
সুকুমার রায় কতজন আছে হে ? ছোটবেলায হযবরল কতবার পড়েছ ?
আপনি!… কী আশ্চর্য, আপনি ! আমি চিনতে পারছি, এখন চিনতে পারছি। কিন্তু আপনি ?
তোমার ‘দি নিউ হযবরল’-র পান্ডুলিপি কোথায় ?
গোলাম হায়দার মুখ খোলার আগে ডজসন বলল- হুঁম, বলো, কোথায় তোমার ‘আবদুল হক ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর পান্ডুলিপি?
গোলাম হায়দার একবার সুকুমার একবার ডজসনের মুখের দিকে তাকাল-কিন্তু আপনারা, আপনারা জানেন এই পান্ডুলিপির কথা!
এ এমন কোনো কঠিন কাজ না। ডজসন বলল। হলো কী-অ্যালিস একদিন আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। আমি ভেবে পাই না কোন আজব রাজ্যে সে গেল! শেষে খোঁজখবর নেওয়ার পর শুনলাম সে এসেছে বাংলাদেশে।
আশ্চর্য।
শোনার পর আমি কৌশলে মিশে গেলাম ওয়ান্ডাল্যান্ড টিমটার সঙ্গে। অ্যালিসকে খুঁজে পেলাম। জোর করে হয়তো নিযেও যেতে পারতাম। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, অ্যালিস এখানে থাকলে আমি আরেকটা কাজ সারতে পারব।
গোলাম হায়দর জিজ্ঞাসু চোখে ডজসনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিন্তু তোমার কারণে আমার সেই পরিকল্পনা নস্যাত হতে বসেছে।
কী আশ্চর্য, আমি আবার কী করলাম!
কী করোনি! সুকুমার বললেন। কে তোমাকে ‘দি নিউ হযবরল’ লিখতে বলেছে!
আমি নিজেই আমি নিজেই লিখেছি। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন!
হায়! তুমি কি জানো না হযবরল এখনো কেমন পঠিত হচ্ছে, তা দেখার জন্য বাংলার ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়াই। দেখলাম, তুমি আবদুল হকের সঙ্গে কথা বলছ, এটা নিয়ে। আবদুল হক তার মেয়েকে পড়ে শোনাচ্ছে। তোমার উপন্যাস লেখার কথাও শুনলাম। তারপর আমি আর তোমার পিছু ছাড়লাম না। এখন পান্ডুলিপি দাও, গোলাম হাযদার।
হ্যাঁ, হায়দার। তুমি পান্ডুলিপি দাও। ডজসনও হাত বাড়াল।
কেন ? আপনারা পড়বেন ?
না, আমরা নিয়ে যাব। তুমি কী লিখেছ, সে আমরা জানিই।
আপনারা নিয়ে যাবেন মানে! কী ধরনের কথা! আপনারা কেন নিয়ে যাবেন!
সুকুমার রায় হাসলেন- তুমি কি ভেবেছ তোমার ‘দি নিউ হযবরল’ লেখা হলে আমার হযবরল কেউ পড়বে! আমার চেয়ে বেশি আজব কাহিনি আমি কেন তোমাকে লিখতে দেব ?
সে আপনার ব্যাপার। আপনি আরেকটা লিখুন না।
আর লিখব না। ঐ একটাই টিকে থাকবে।
গোলাম হায়দার সুকুমারের রায়ের দিক থেকে চোখ সরিযে ডজসনের দিকে তাকাল- আর তোমার কী ব্যাপার?
প্রায় একই। তুমি ‘আবদুল হক ইন ওযান্ডারল্যান্ড’ লিখতে পার না। কারণ বাংলাদেশে আসার পরই আমি ঠিক করেছি আমি অ্যালিসের সেকেন্ড পার্ট লিখব।
লিখুন। যান। আপনার মতো করে লিখুন।
কিন্তু তোমারটা যদি বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায় ? সেই রিস্ক আমি নিতে পারি না।
তো আমাকে কী করতে হবে ?
পান্ডুলিপিটা দাও। ওটা পুড়িয়ে ফেলব আমরা।
গোলাম হায়দার হাসতে আরম্ভ করল, হাসতে হাসতেই সে বলল-যান আপনারা, এত রাতে এসব ফাজলামো ভালো লাগে না।
দেবে না ?
না। প্রশ্নই ওঠে না।
দেবে না ?
আপনারা যান প্লিজ। আমি ঘুমাব।
গোলাম হায়দার, না দিয়ে তুমি পারবে না।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। কারণ আমরা নিয়মমাফিক এসেছি।
সেটা আবার কী!
আমরা মাইক্রোবাসে এসেছি।
তো?
মাইক্রোবাসে আরো লোক আছে। ডাকব ?
এসব আপনারা কী বলছেন!
ওরা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে গোলাম হায়দার। তারপর তোমাকে আর পাওয়া যাবে না।
না না, এটা আপনারা করতে পারেন না।
পারি। এটা আমরা শিখেছি। পান্ডুলিপি দাও তুমি।
না। ওটা আমার লেখা।
ডজসন ও সুকুমার হাসল। তারপর তারা পেছন ফিরে মাইক্রোবাসের দিকে তাকিয়ে হাত তুলল।