ছাত্রীকে পড়িয়ে ওর বাসা থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ড্রয়িং রুমের সামনে এসেই থমকে গেলাম ছাত্রীর বাসায় আসা গেস্টদের কথা শুনে।শুনেছিলাম ওর বড় বোনকে নাকি আজ দেখে পাকাপাকি কথা বলবে ছেলেপক্ষ, কিন্তু ওর এক্সাম থাকার কারণে আজ আমাকে পড়াতে আসতে হলো।আন্টি অবশ্য দুপুরের খাবার খেয়ে যাবার জন্য বলেছেন, কিন্তু আমার কিছু জরুরী কাজ থাকায় থেকে যাওয়া সম্ভব ছিল না।তবে ছেলেপক্ষের কোনো মহিলার কথা শুনে থেমে গেলাম।উনি বলছেন,
—মেয়ে তো ঠিক আছে,তবে আমাদের ছেলেও কোনো দিক দিয়ে কম নয়।আর সেজন্য মেয়েকে তো আর খালি হাতে পাঠাতে পারেন না,একটু আদটু গিফট তো দিতেই হয়।কি বলেন?
সোজাসাপটা যৌতুকের কথা না বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল সেটা।কি বদ মহিলা!আর মেয়ে বাড়ি থেকে কেনো উপঢৌকন দিতে হবে?সেটা তো ছেলে দিবে মেয়েকে।কিছু বলা উচিত উনাদের তা না হলে যৌতুক দিয়ে এবং নিয়ে উভয়পক্ষই গুনাহের খাতায় নাম লিখাবে।ইতিমধ্যে উভয়পক্ষই এ নিয়ে কথা বলে ফেলেছেন। মেয়েপক্ষ দিতে নারাজ আর ছেলেপক্ষের লোকেরা তাদের এটা বুঝাচ্ছে যে গিফট তাদের দেওয়া হবে তা তো মেয়েই ভোগ করবে,এতে সমস্যার কি আছে?
সত্যি! এরা পারেও বটে।কিন্তু আমি কিভাবে উনাদের মাঝে কথা বলব,আমি তো উনাদের থেকে ছোট।কিন্তু অন্যায় দেখলে তা প্রতিহত করা আমার উপর অবশ্য কর্তব্য।তা না হলে আমিও গুনাহগার হবো।(এতসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি আমার ছাত্রী সেখানে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল)
—আপু!আপনি এখনো এখানে?ভিতরে যান, আপুর নিউ ফ্যামিলির সাথে দেখা করেন।
—(আমতা আমতা করে)না মানে আমি,কিভাবে!
—ওহ! বুঝেছি। আনইজি ফিল করছেন?দাঁড়ান আম্মুকে ডেকে দেই।(আন্টিকে ডেকে এনে আমার কথা বলাতে আন্টি এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেলেন,আমি যাওয়ার সাথে সাথেই পরিবেশ পুরো চেন্জ হয়ে গেলো)
আন্টি আমাকে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন,আমিও সালাম দিলাম সকলকে।উনারা সালামের উত্তর নিয়ে আন্টি আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—যা বললাম চিন্তা করে দেখবেন। এতে আপনাদের মেয়েই খুশিতে থাকবে,আর এতো কম উপহারে এখন কেউ ছেলে বিয়ে দেয় না। এবার রাগটা একেবারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।তাও নিজেকে কিছুটা শান্ত রেখে বললাম,
—কিছু মনে করবেন না।ছোট মুখে বড় কথা বলছি।যদিও এটা আপনাদের পারিবারিক কথা,তবে আমি কিছু বলতে চাই।(সেই মহিলাটা কিছুটা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন, পাশে বসা অর্ধবয়স্ক লোকটাও চোখ উল্টো করে তাকালেন)
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আড়ালে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা শুনেছি একারণে। (সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে) আন্টি! কিছু মনে করবেন না,আপনাদের ছেলে হয়তো খুব নামীদামী মানুষ।
—হুমম..মাস্টার্স শেষ করছে,ভালো বেতনের চাকরি করে। একেবারে সময় পায় না,এজন্যই তো আজকে বউ দেখতে আসতে পারে নাই।আমার পছন্দই পুলার পছন্দ। হিরার টুকরো ছেলে আমার।
—আলহামদুলিল্লাহ!খুব ভালো।তা আন্টি ছেলের ভালো বেতন হলে তো কোনো গিফটের প্রয়োজন দেখি না,সেই তো উল্টো সকলকে গিফট দিতে পারে,কি বলেন?
—(মুখ ভ্যাচকিয়ে)এত কষ্ট কইরা পুলারে বড় করছি,কতগুলো টাকা খরচ কইরা বড় মানুষ করছি।এখন এমনি এমনি পুলারে বিয়া করাই দিমু?আর আমরা তো যা চাইছি তা বউয়ের ভালার জন্যই চাইছি।আমার বিয়ার সময়ও তো আমার বাপের বাড়ি থেকে কতকিছু দিছিলো।
—আপনি ছেলেরে কষ্ট করে বড় করেছেন, আর উনারা তো গায়েবিভাবে মেয়েকে বড় করেছেন, তাই না?আর মেয়ের ভালো মানে?স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর উপর ফরজ, এখানে মেয়ের ভালো দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন? আর আপনার বাবার বাড়ি একটা গুনাহ করেছে বলে আপনিও সেটা করবেন,এটা কেমন মুমিনত্ব?
রাসূলের (সা.) একজন প্রিয় সাহাবী ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.)। তিনি তৎকালীন ইরানের রাজধানী মাদায়েনে ইরানী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের দিন শ্বশুড়বাড়ি গেলেন, দেখলেন ঘরের দেয়ালগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে সাজানো। তিনি এটা অপছন্দ করলেন। যেখানে গরীব মানুষ কাপড় না পেয়ে শীতে কষ্ট পায়, সেখানে কাপড় দিয়ে দেয়াল সাজানো, এটা অপচয় মনে করলেন। বললেন,’কি ব্যাপার! দেয়ালের কি জ্বর হয়েছে যে, এর দেয়ালগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে!’ হুকুম দিলেন কাপড়ের পর্দাগুলো সরাতে। কাপড় সরানো হলো। তারপর তিনি ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকে যৌতুকের অনেক মূল্যবান জিনিস দেখতে পেলেন, জিজ্ঞেস করলেন – এই জিনিসগুলো কার? বলা হলো
– আপনার বধূর।
তিনি বললেন, আমার প্রিয় রাসূল (সা.) এ ধরনের নির্দেশ দেননি। তিনি বলেছেন – দুনিয়ার জিনিস এতটুকু থাকা দরকার, যতটুকু এক মুসাফিরের কাছে পথের প্রয়োজনের জন্য আবশ্যক। শুধু সাহাবী নয় মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোহরকে হালাল করেছেন এবং যৌতূককে করেছে হারাম।তাই যদি দৃষ্টান্ত দেখাতে হয় তাহলে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টান্ত দেখান।কারণ তিনি হচ্ছেন আমাদের আদর্শ।একজন পিতা_মাতার জন্য নিজের কলিজার টুকরা মেয়েকে অন্যের কাছে তুলে দেওয়াটা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কষ্টের, তার উপর যদি আলাদা প্রেসার ফেলা হয় এই যৌতুকের তখন তাদের কি অবস্থা হয় একবারও ভেবে দেখেছেন? পান থেকে চুন খসতেই বাড়ির বউকে ছোটলোক বলতে কুন্ঠাবোধ করেন না, অথচ নিজেরা যে কতো বড় ছোটলোক তা একবারও চিন্তা করেছেন?
—হইছে হইছে।এত উপদেশ দিতে অইবো না।কি যুগ আইলো এহন!হাঁটুর বয়সী মাইয়াগো কাছে হাদিস শিখতে হইবো।চলো,চলো।পু লারে এহানে বিয়া দেওন লাগবো না।(বলেই হনহন করে চলে গেলেন) আঙ্কেল আন্টি হতভম্ব হয়ে গেলেন,আমি কাছে গিয়ে বললাম,আঙ্কেল যদি এখন উনাদের কথায় রাজি হয়ে যৌতুক দিয়েও দিতেন তাহলে গ্যারান্টি কি আছে যে উনারা পরে আর কোনো কিছু চাইবে না?এর থেকে ভালো যে এখানেই এসব শেষ হয়ে গেছে, আমি কি খারাপ কিছু করেছি? (আঙ্কেল মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন)
—মারে!অনেক বড় গুনাহ থেকে বাঁচিয়েছিস।এসব ছোট লোকেরা শুধু চাইতেই পারে,এদের আল্লাহ পাক হেদায়েত নসীব করুক। ইনশাআল্লাহ যৌতুক দিয়ে কখনো মেয়েদের বিয়ে দেবো না এবং ছেলেটার বিয়েতেও যৌতুক নিবো না।
—(মুচকি হেসে)আচ্ছা,আজ যাই।
—কিছু খেয়ে যা মা!(আন্টি)
—অন্য একদিন ইনশাআল্লাহ।
(চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। গল্পের ছেলের ফ্যামিলিও ঐ টাইপের। কিন্তু আপনি কি সেরকম?নিশ্চয়ই না।তাহলে নিজের বিয়েতে কিংবা নিজের ছেলের বিয়েতে যৌতুকের নামে কাউকে হয়রানি করবেন না এবং মেয়েরাও নিজের বিয়েতে কিংবা মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিবেন না আশা করি।কেননা হারাম কাজ অবশ্যই বর্জনীয়।)