পাখি

পাখি

দেউলটিতে পৌঁছে পিসির হাতের রান্না পাঁঠার মাংস আর ভাত খেয়ে , মকবুলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । উদ্দেশ্য পাখি কেনা । বৌ বলে দিয়েছে ,একটা ময়না আর একটা টিয়া কিনবে । ওদের বৌ কথা বলা শেখাবে ।আমার বৌ পাখি ভালবাসে । ওর নাম চন্দনা ।

আমার বাড়ির ছাদে ,অনেক পায়রা । তারা সারাদিন বকবকম্ করে । ওতে খুশি নয় আমার বৌ । সে ভালবাসে টিয়া আর ময়না ।

চন্দনা খুব সুন্দরী । কিন্তু ওর নিজের বলতে কেউ নেই । কেবল এক পিসতুতো দিদি আছে । সেই মেয়ে দেখিয়েছে । সেই দিদির বর আমার অফিসের কলিগের বন্ধু ।
চন্দনাকে দেখে ,আমার মাথা ঘুরে গেল । মনে হল ওর আর কোন পরিচয় না থাকুক । কি দরকার ?

আমার বিধবা মা আপত্তি তুললেন, সে আবার কি ? তিনকুলে কেউ নেই মেয়ের ? অনাথ নাকি ?
পিসতুতো দিদি কমলা নথ নাড়ল , তা কেন ? আমরা তো আছি । বন্যায় ভেসে গেছে বাড়িঘর । বরিশালের বনেদি পরিবারের মেয়ে ।চেহারা দেখেছেন ? ঠিক যেন রাজকন্যা ।
মা তো চটে লাল , তা বাপু বাবা রাজা হলে, তবেই বলে রাজকন্যা ।কোথা থেকে জোটালেন একে ?
কি বলছেন মাসিমা ? মেয়ে খুব ভাল ।
জামাইবাবু ফোড়ন কাটল ।
আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে ঘাড়ে গচাতে চাও । তা হবে না ।
আমি বললাম , এভাবে বলছ কেন মা ? কারুর জন্মের জন্য, সে তো আর দায়ী নয় ?

তপু ,মেয়ে দেখতে এসেই , ওদের হয়ে কথা বলতে শুরু করেছিস ? বলি, সুন্দরী মেয়ের কিছু অভাব নেই ।আমি এই মেয়ের সঙ্গে আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে দেব না ।কিছুতেই না ।
মেয়েটির অপূর্ব সুন্দর মুখ , বিষণ্ণতায় ঢেকে গেল ।আমার মনে হল , এই চাঁদ মুখে এই করুণার কলঙ্ক , মানায় না ।
মা আর কোন কথা না বলে, উঠে পড়লেন । আমি অগত্যা তার পিছু নিলাম । কিন্তু মা পেছনে ফিরেও ,তাকালেন না।

বাড়ি ফিরে মা ,পিসিকে ডেকে পাঠালেন , যেখান থেকে পার সুন্দরী মেয়ে জোগার কর । ছেলের বিয়ে দেব ।

কিন্তু পিসি কিছুই করতে পারেননি । আমি নিজেই ব্যবস্থা করে, নিজের খরচে মন্দিরে বিয়ে করলাম ,চন্দনাকে । একেবারে সিঁদুর পরিয়ে ,বাড়িতে নিয়ে এলাম ।
মা রাগ করে ,দরজায় খিল দিলেন । কিন্তু আমি তার একমাত্র ছেলে । আমার ওপর রাগ করে কতদিন থাকবেন ? তাই চন্দনাকে মেনেও নিলেন । বৌভাত , ফুলশয্যা সব হল ।সবাই বলল , রাণীর মত বৌ হয়েছে ।

কন্যাপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ।

বিয়ের পর চন্দনার বায়না , পাখি চাই । খাঁচায় পুরে বারান্দায় ঝোলাব । নইলে আড়ি ।
নতুন বৌ, নতুন বিয়ে । তার সঙ্গে আড়ি ?
অসম্ভব ।

পিসির বাড়ি দেউলটি আসতে হল তাই । কারণ মকবুল আমাদের অফিসের পিয়ন , ওর শালার বাড়ি গোসাবাতে । দেউলটির পাশে । গোসাবাতে নাকি একটা লোক থাকে ,যার কাছে বিনামূল্যে পাখি পাওয়া যায় । খুব ভাল পাখি । কিন্তু লোকটা দাম চায়না ।
আমি বললাম , তা বললে হয় ? আমি দাম দেব ।
বিকেলের দিকে মকবুলের সঙ্গে এলাম পক্ষীনিবাসে । বেশ বড় মাটির বাড়ি । চারপাশে অনেক গাছপালা । আম,জাম ,সজনে , শিমূল, বট ,পেয়ারা ইত্যাদি ।
একটা লোক বেরিয়ে এল । তিরিশ ,বত্রিশ বছর বয়স । খুব রোগা , মুখে দাঁড়ি আছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল । পরনে পাজামা । খালি গা ।
মকবুল আমাকে বলল , ইনার কথাই বলেছিলাম । ইনি হলেন তাপসবাবু ।

তাপসকে বলল , ইনি কলকাতা থেকে এসেছেন । ইনি টিয়া আর ময়না নেবেন ।

আমি বললাম , আমি কিন্তু পয়সা দিয়ে কিনব ।

তাপস বললেন , তার দরকার হবে না । আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াই । একলা মানুষ । বেশি পয়সার দরকার নেই। তাছাড়া আমি পয়সা দিয়ে পাখি বেচি না ।

আমি বললাম , আপনি শিক্ষক ?

আজ্ঞে হ্যাঁ ।

তবে এই কাজ করেন কেন ?

যারা পাখি ভালবাসে ,তাদের দিই । ভাল লাগে ।

কিন্তু তারা তো খাঁচায় পাখিকে পুরে রাখে । পাখিদের তাতে কষ্ট হয় না ?

তাপস চুপ করে রইল কিছুক্ষণ । তারপর বলল , আজকের দিনে গাছপালা কমছে । নীল আকাশ ,ধোঁয়ায় ঘোলাটে ।পাখিরা ফল পায় না । উড়তে পায় না । ওরা খুব কষ্টে আছে ।

আপনি পাখিদের নিয়ে খুব ভাবেন ?

আমি পড়াবার পর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরি । পাখি ধরি । আমার ঘরে নিয়ে আসি । ফল দিই , ছোলা দিই , লঙ্কা দিই । আবার ডিম ফুটে বাচ্চা হলে ,যত্ন করি । ওদের নিয়েই আছি । ওদের মধ্যেই বাঁচি । ওদের জন্যও ।

কেন বাঁচবার জন্য ,তরতাজা যুবকের পাখির দরকার হল ?
তাপস হাসল । ওর চোখ তিরতির করে কেঁপে উঠল ।

বলল , সে কথা আজ থাক ।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, তাপসের দিকে । এমন মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি ।

পরদিন সকালে একাই পাখি আনতে গেলাম, খাঁচা কিনে । মকবুল কি একটা কাজে ,তাহেরপুর গেল । তাপস ছোট বাঁশেরছোট ছোট ঘর তৈরি করে, তাতে পাখি রাখেন । ওর কাছে খাঁচা নেই । পাখির বিষয়ে কিছু বইও কিনেছেন দেখলাম ।

আমি বললাম , একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব ?

করুন । তাপস সম্মতি দিলেন।

কাউকে ভালবেসে আঘাত পেয়েছেন ?

কি করে বোঝা গেল ?

আপনার চোখ আর, মুখের বিষণ্ণতা দেখে ।

সে বুঝি পাখি ভালবাসত?

তারপর মনে মনে , গুন গুন করলাম । আকাশে উড়িছে বকপাঁতি , বেদনা আমার তারি সাথি ।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা । কাছের ডালে একটা ঘুঘু ডাকছিল ।তাপসের পক্ষীপ্রেমের অতলে ডুব দিতে চাইলাম ।
তাপস বললেন , তার নামই ছিল পাখি ।
কথাটা বলেই মাথা নীচু করলেন ।

আমিও ছাড়বার পাত্র নই । লেখক হলে এ নিয়ে একটা সুন্দর প্রেমের উপন্যাস লিখে ফেলতাম , নির্ঘাৎ ।

বিয়েটা হল না কেন ?

মেয়েটিকে আমার খুব ভাল লাগত । কিন্তু ও অনাথ ।আমার মা কিছুতেই , এ বিয়েতে রাজি হলেন না ।মা বললেন ,এই বিয়ে হলে, তিনি আত্মহত্যা করবেন । ওরা কত অনুনয় বিনয় করল । কিন্তু মার মন গলল না ।

তাই নিজের ভালবাসাকে বলি দিলেন ?

এছাড়া উপায় ছিল না । আমি আমার প্রেমকে সেদিন প্রকাশ করতে পারিনি ।মাকে দুঃখ দিতে পারিনি ।

আপনার মা এখন নেই ?

না । মারা গেছেন ।

আর সেই মেয়েটি ?

ওর বিয়ে হয়ে গেছে ।

তাপস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন ।

এবার যেন রহস্যের জটিলতা কাটছে । কুয়াশার ধূসর পর্দা অপসৃত হল ।

আচ্ছা , মেয়েটির বাড়ি কি বরিশালে ?

আমি জানি ,আমার অনুমান মিথ্যা হবে না ।তাই কথাটা বললাম ।

আশ্চর্য । আপনি কি করে জানলেন ? বরিশালে আমাদের কলেজের পাশে ওর বাড়ি ছিল । আসা যাওয়ার পথে , ওকে দেখতাম । অত সুন্দর মেয়ে কম দেখা যায়।আপনি পাখিকে চেনেন নাকি?

হ্যাঁ । ভাল করেই চিনি ।

তবে তো ভাল করেই জানেন যে , ওকে একবার দেখলে , ভোলা যায় না ।

বললাম ,বিলক্ষণ ।একথা আমার চেয়ে ভাল ,আর কে জানবে বলুন ?

তার মানে ?

আপনার মতো দশা যে, আমারও হয়েছিল একদিন । শেষে বিয়ে করে তবে, সে ভূত নামল ।

ঠিক বুঝলাম না । বিয়ে আর ভূত নামানোর ব্যাপারটা কি ?
সত্যটা তহলে বলেই ফেলি । আমিই পাখির স্বামী ।
স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন তাপস ।

আমি জানি ,চন্দনা পাখি এখন আমার মমতায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন । সে অন্য কোথাও উড়ে যাবে না ।কিছুতেই না ।এক হিসেবে আমি আজ জয়ী ।

অন্যদিকে এই ভীতু লোকটার কি করুণ হাল । আজ হন্যে হয়ে , সে পাখির জন্যে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছে। আর নিজের সঙ্গে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত । ওকে তো হিংসা করার প্রশ্নই ওঠে না ।

আমি বললাম , পাখির ভাল নাম চন্দনা ।সে এখন আমার স্ত্রী । আসলে কি জানেন তাপসবাবু ,শুধু ভালবাসলেই হয় না , তাকে প্রকাশ করার মত সাহস থাকা চাই । নইলে সারাজীবন আফশোস করতে হয় ।

তাপস বললেন , আমাকে ক্ষমা করবেন । রাগ করবেন না । কি বলতে কি বলেছি ।আমার কথাগুলো ধরবেন না , প্লিজ ।

পাগল ? আপনার ওপর কেউ রাগ করে নাকি ?

আসবার সময় বললাম , আর একটা কথা ।আজকের কথাগুলো ,আর কেউ যেন না জানে , আপনি আর আমি ছাড়া। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়াইফ । তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন , পাখি ভাল থাকবে । টেক কেয়ার অফ ইওরসেলফ। চললাম ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত