–রূম্পা!
–জ্বি আম্মা?
–তোর আপার হাবভাব তো আমার ঠিক সুবিধার ঠেকছেনা।
–মানে ঠিক বোঝলাম না আম্মা।
–আমার ধারনা তোর আপা প্রেম করছে।
সকালবেলা রূম্পা একা একা ব্রেকফাস্ট করছে। সবেমাত্র মুখে একটা ব্রেড দিয়েছিল। সেটা গেল গলায় আটকে। পানি খেয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,,
–তুমি কি করে বোঝলে আম্মা?
–এখন কয়টা বাজে?
–সাড়ে নয়টা।
–টুম্পা কই?
–ঘুমাচ্ছে।
–এত বেলা করে ও কখনো ঘুমায়? নিশ্চই সারারাত কারো সাথে ফোনে গুজুরগুজুর করে।
বেশ ক’দিন ধরেই আমি ব্যাপারটা লক্ষ করছি। এছাড়া ইদানীং ওর আরো অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি। পরিবর্ন এর কারনও আমি ধরতে পেরেছি। কারনটা শিওর হওয়ার জন্যে তোকে একটা কাজ দিচ্ছি। মন দিয়ে শোন। রুম্পার মা রুম্পাকে যে কাজটা দিয়েছেন সেটা হলো, টুম্পা কোথায় যায়, না যায়, সেসব ব্যাপারে মাকে খবর দিতে হবে। মোট কথা টুম্পার পিছনে গোয়েন্দা হিসেবে রুম্পাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রূম্পা নিজের ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। আম্মা তো ডেঞ্জারাস মহিলা! টুম্পার হাবভাব আম্মা ঠিকই ধরে ফেললেন। কিন্তু রুম্পার হাবভাব যে ভাল হবে সেটাই বা উনি ভাবলেন কি করে? বিকেলে টুম্পার পিছন পিছন রূম্পাও ইকো পার্কে চলে এল। নিতান্তই কৌতুহলের বশে এসেছে। আপা সত্যি সত্যি প্রেম করছে কিনা সেটা দেখার জন্যে। কিন্তু একা একা পার্কে হাটতে ভাল লাগছেনা। মনে হচ্ছে কেউ একজন সাথে থাকলে ভাল হয়। রূম্পা আরিফকে ফোন দিল,,,
–তুমি কোথায়? ( রূম্পা)
–এই সময়তো অফিসেই থাকবো তাইনা?? (আরিফ)
–ওহ, তাইতো। আচ্ছা তুমি এক্ষুনি ইকো পার্কে চলে আস।
–তুমি ওখানে কি করছো।
–একটা কেসের তদন্ত করতে এসেছি। একা একা অসুবিধা হচ্ছে। একজন অ্যাসিসট্যান্ট এর খুব দরকার। তুমি চলে এসেতো।
–দেখো রূম্পা অফিস থেকে তো হুটহাট করে চলে আসা যায় না।
–তুমি আসতে পারবে কি-না সেটা বল।
–এখন কি করে? একটু বোঝাআ।
কথা শেষ হওয়ার আগেই রূম্পা খট করে ফোন কেটে দিল। ফোন রাখার পর মেজাজটা গেল আরো খারাপ হয়ে। টুম্পা আপা গেল কই? এখানেই তো ছিল! অনেক খোজাখোজির পর টুম্পাকে পাওয়া গেল। হুম, আম্মার ধারনাই ঠিক। একটা ছেলের সাথে টুম্পাকে দেখা যাচ্ছে। রূম্পা একটা গাছের আড়াল থেকে টুম্পাকে দেখছে। “”কার তদন্ত হচ্ছে ম্যাডাম? চমকে উঠে রূম্পা পিছন ফিরে তাকাল। আরিফ চলে এসেছে। ওকে দেখে মূহুর্তেই রুম্পার সব রাগ পানি হয়ে গেল। কিন্তু ভাবটা এমন করে রাখলো যেন এখনো রেগে আছে। থমথমে গলায় বলল,,
–টুম্পা আপার।
–কেন, উনি আবার কি করছেন?
–প্রেম করছেন। ঐযে দেখছো একটা হ্যাবলা মার্কা ছেলের পাশে বসে আছে, ঐ ছেলেটার সাথে।”” আরিফ ছেলেটার দিকে তাকাল এবং রুম্পার কথা শুনে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। আরিফ আহত গলায় বলল,,
–ছেলেটা মোটেও হ্যাবলা মার্কা না রূম্পা।”” আরিফের কথায় রুম্পা একটু অবাকই হল। ওর দিকে তাকাতেই দেখল বাচ্চাদের মতঅভিমানী চেহারা বানিয়ে রেখেছে। রূম্পা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,,
–হঠাৎ ঐ ছেলেটার প্রতি তোমার এত মায়া হচ্ছে কেন বলতো? কেউ হয় নাকি তোমার? আরিফ বলল,
–হুম,,আমার ভাই হয়।”” রূম্পা নিজের অজান্তেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেলল। সাথে সাথেই আবার বলল,,
–আল্লাহ! আমার দুলাভাই এত্তো কিউট কেন!!কিন্তু আরিফ কিছু বলছেনা। ও একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রূম্পা আবার বলল,,
–সত্যি তোমার ভাই হয়??
–হুম। এটা পাবলিক প্লেস না হলে রূম্পা এক্ষুনি আরিফকে জড়িয়ে ধরতো। খুশি খুশি গলায় বলল,,
–আমরা দুই বোন সারাজীবন একসাথে থাকব! ভাবতেই কি যে ভাল লাগছে! আমার তো খুশিতে চোখে পানি চলে আসবে মনে হচ্ছে!”” আরিফ হতাশ কন্ঠে বলল,
–এক্ষুনি পানি চলে আসবে। চিন্তা করোনা।
–তাই? কিভাবে?
–ঐ ছেলেটা আমার ছোট ভাই। মারুফ।
–হ্যা জানিতো তোমার ছোট ভাই, তো?
–তুমি এখনো বোঝতে পারছো না সমস্যাটা কি?
–নাতো, তুমি বুঝিয়ে বলো।
–টুম্পা আপা মারুফকে ভালবাসে, ওকে বিয়ে করতে চায়।
কিন্তু মারুফ ততদিন বিয়ে করতে পারবেনা, যতদিন না আমার বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে। কিন্তু তুমি আবার বিয়ে করতে পারবেনা যতদিন না তোমার আপার বিয়ে হচ্ছে। সমস্যাটা বোঝতে পারছো এবার?””রূম্পা টিস্যু দিয়ে কপাল মুছে যাচ্ছে। কিছু বলছেনা। কিছুক্ষন চুপ থেকে রূম্পা বলল,,
–ভাল সমস্যায় পড়েছি, এখন কি করা যায়।
–আপাতত চলো ওদের সাথে কথা বলি।
সমস্যা তো আমাদের একার না। ওদেরও। চল ওদের সুখবরটা দিয়ে আসি। আরিফ আর রূম্পা চুপিচুপি ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে যেতে ওরা একটু সময় নিচ্ছে। টুম্পা মোবাইলে একটার পর একটা মেয়ের ছবি মারুফকে দেখাচ্ছে আর বলছে,,
–এখান থেকে যেকোন একটা মেয়ে পছন্দ কর আর তোমার ভাইয়াকে বিয়ে দিয়ে নিজের পথটা ক্লিয়ার করো প্লিজ! নাহলে হঠাৎ একদিন আমার বিয়ে হয়ে যাবে আর তুমি ছাড়ো।এই দেখো, এই মেয়েকে তোমার ভাইয়ার পাশে দারুন মানাবে।রূম্পা কথাগুলো শুনে মনের দুঃখে আরিফের পিঠে মাথা ঠেকাচ্ছে আর ফিসফিস করে বলছে,,
–কিছু একটা করো আরিফ! না হলে আমার নিজের বোনই আমাদের বারোটা বাজিয়ে ফেলবে।””আরিফ খুক খুক করে কাশতে কাশতে টুম্পা আর মারুফের সামনে এসে দাড়াল। আরিফকে দেখে ওরা ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। টুম্পা অবাক হয়ে রুম্পাকে জিজ্ঞেস করল,,
–তুই এখানে কি করছিস?
রূম্পা কিছু বলার আগেই ওর ফোনটা বেজেউঠলো। আম্মা ফোন করেছেন। রূম্পা ফোন দেখিয়ে বলল,,””আম্মা পাঠিয়েছেন। তোমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে””—টুম্পার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেদে ফেলবে। ও কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,,,””আম্মা বলল আর তুইও আমার পেছন পেছন চলে এলি?””রূম্পা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফোনটা রিসিভ করে মাকে আশ্বস্ত করল যে টুম্পাকিছুই করছেনা। সব কিছু শোনার পর টুম্পা আর মারুফ একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। অনেক্ষন যাবৎ ওদের এই তাকানোর পর্ব চলছে। শেষে আরিফ বিরক্ত হয়ে বলল,,
–এভাবে তাকালেই তো আর সমস্যার সমাধান হবেনা। মাথায় কোন বুদ্ধি আসলে বল।”” মারুফ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষন হাটল। ভ্রু কুচকে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলে উঠলো,,””শরীফ মামা ছাড়া আর কোন পথ দেখছিনা।””
রুম্পাদের বাবা নেই। আর আরিফদের মা নেই। একমাত্র শালা শরীফকে ওদের বাবা রহমান সাহেবের একটু বেশিই প্রিয়। শরীফের কোন কথাই উনি ফেলতে পারেন না। কিন্তু আরিফের বাবার প্রধান সমস্যা হচ্ছে উনিপ্রেমঘটিত কোন ব্যাপার দু চোখে দেখতে পারেন না। যাই হোক, এই মূহুর্তে দুই ভাইয়ের কাছে শরীফ মামাই একমাত্র ভরসা। ওরা মামাকে ফোন দিয়ে সব বুঝিয়ে বলল। মামা বলেছেন উনি এক্ষুনি রওয়ানা দিচ্ছেন এবং ভাগ্নেদের বিয়ে দিয়ে তবেই উনি বিদেয় হবেন। শরীফ মামা বাসায় ঢুকলেন বিশাল হৈ চৈ করে। রহমান সাহেব আতংকিত অবস্থায় নিজের রুম থেকে বের হলেন। উনাকে দেখামাত্র “”দুলাভাইই”” বলে চিৎকার দিয়েশরীফ মামা রহমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক্ষন কোলাকোলি করা হল। একে ওপরের বাড়ির খবর নেওয়া হল। একসময় শরীফ মামার মনে হল যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে। এবার কাজের কথায় আসা যাক। উনি বললেন,,,
–ছেলেদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছো দুলাভাই? আপা থাকলে তো এতদিনে বিয়ে দিয়েই তো।
–ভাবছি। কিন্তু ভাল পাত্রী পাচ্ছিনা বুঝলে।
–জানিতো। তুমি সারাজীবনেও ভাল পাত্রী খুজে পাবেনা। আমার কাছে দুজন পাত্রী আছে। দুই বোন। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ্। তোমার পছন্দ হবেই। ছেলেদের একসাথে বিয়ে দিয়ে দাও। ভাল হবে।
–দুই বোন?
–হ্যা। বোনে বোনে মিল থাকবে। সংসারে ঝগড়া-ঝাটি কম হবে। এই দেখো,, মেয়েদের ছবিও এনেছি।”” রহমান সাহেব মেয়েদের ছবি দেখলেন। উনার পছন্দ হয়েছে কি-না সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। অনেক্ষন পর উনি বললেন,,
–তোমার যখন পছন্দ হয়েছে তখন ভালই হবে। তবে ছেলেদের সাথে একবার কথা বলা দরকার। ওদেরও মতের প্রয়োজন আছে।”” শরীফ মামা খুশি খুশি গলায় বললেন,,,
–ওদের সাথে আমার আগেই কথা হয়েছে। ওরা কি মামার কথা ফেলতে পারে? তবে ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।
–কি সমস্যা? শরীফ মামা হাসিমুখে বললেন,,
–আরিফের পছন্দ হয়েছে ছোট মেয়েকে। আর মারুফের পছন্দ হয়েছে বড় মেয়েকে।”” রহমান সাহেব হতাশ দৃষ্টিতে শরীফ মামার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অবশেষে ওদের চারজনের বিয়েটা হয়েই গেল। রহমান সাহেব এরপর আর তেমন আপত্তি করতেপারেন নি। উনি এটা ভেবেই খুশিতে আত্মহারা যে উনার ছেলেরা কখনো প্রেম করেনি। আজকালকার ছেলেরা তো বাবা মায়ের বিরুদ্ধে যেয়ে প্রেম করছে। সেখানে উনার ছেলেরা তেমন কিছুই করেনি। হ্যা মেয়ে পছন্দে একটু উল্টা-পাল্টা করে ফেলেছে। কিন্তু একসাথে বিয়ে হলে সেই প্রব্লেম আর থাকছেনা। রাত বাজে এগারোটা। রূম্পা আর টুম্পা সব কাজ শেষ করে মনের আনন্দে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। ওদের গল্প করার ভঙ্গী দেখে মনে হয় আর জীবনেও ওদের দেখা হবেনা। এটাইওদের শেষ গল্প। রোজই ওরা একই কান্ড করে। হঠাৎ করেই মারুফ হাপাতে হাপাতে এসেবলল,,,
–ভাবি! ভাবি!…ভাইয়া কেমন জানি করছে! শুধু তোমাকেই ডাকছে!”” রূম্পা সোফায় পা তুলে বেশ আরাম করে গল্পকরছিল। মারুফের কথা শুনে ওর বুক ধক করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দিল এক দৌড়। রুমে গিয়ে দেখে আরিফ শুয়ে আছে। ফ্যাকাসে গলায় বলল,
–এই কি হয়েছে তোমার?? আরিফ ক্ষীণ স্বরে বলল,,,
–বোঝতে পারছিনা। হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্টের মতো হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছিনা।””
–বল কি! আমিতো কিছু বোঝতে পারছিনা। দাড়াও আপাকে ডেকে আনি।”””আরিফ ঝট করে ওর হাতটা ধরে ফেলল,,,স্পষ্ট স্বরে বলল,,
–সবকিছুতেই আপা লাগবে তোমার?? রূম্পা বলল,,””এই তোমার না শ্বাসকষ্ট? শ্বাস নিতে পারছনা। এখনতো দেখছি দিব্যি ভাল মানুষের মতোই কথা বলছ। ব্যাপার কি?””– আরিফ হেসে ফেলল। রূম্পা বলল,
–ইশশ!তুমি জান কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপারে আমরা কথা বলছিলাম?””
— আপাতো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছেন না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কাল কথা বলতে পারবে।
–আমিওতো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিনা।””
–পালিয়ে বেড়াচ্ছো তো। সারাক্ষণ শুধু আপা আর আপা।
–তাই?
–হ্যা তাই। আচ্ছা এখন বল তো সকালবেলা ফুপু আসার কথা। উনি এসেছিলেন?বিয়েতে তো আসতে পারেন নি।
–হ্যা এসেছিলেন। ফুপু আসামাত্র আপা অতিমাত্রায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।”‘ আরিফ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,,,
–আপাকে একটু সাইডে রাখা যায়না??
–আরে শোননা। আপা ব্যাস্ত হলেও আমি ততটা ব্যাস্ত হচ্ছিলাম না। আপা আমাকে প্রায় ধমকের সুরে বলল,,,
–খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ফুপুজানকে সালাম কর!”” ফুপুজান বড় বড় চোখ করে আপাকে বললেন,,
–এ কি বউমা! বড় বোনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? ছিঃ ছিঃ””বোঝলাম উনি আমাকে বড় ভাবছেন। আমি কি বললাম জানো?””আরিফ ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,,,
–কি বললে??
–আমি দুঃখি দুঃখি কন্ঠে বললাম,,””থাক
ফুপুজান, ওসব আমার অভ্যাস আছে।”” হি হি হি…..আপার চেহারাটা যদি দেখতে তখন।””কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে রূম্পা আরিফের দিকে তাকাল। দেখে বেচারা চিৎপটাং হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রূম্পা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। কি সুন্দর জোছনা হয়েছে! ঠিক এমনই এক জোছনা রাতে ওর মোবাইলে অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। সেই থেকেই ওদের গল্পের শুরু। রূম্পা আরিফকে জাগিয়ে তুলল,,
–চলো, ছাদে যাই! আরিফ হাই তুলে বলল,
–আপা গেলে আমি নাই””
রূম্পা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে হেসে বলল,,””চলো তো’…