বেতন

বেতন

আজ আমার টিউশনের বয়স, ১মাস 6দিন পূর্ণ হলো । আর ঠিক ২মাস ১৩দিন আগে ,এই দিনে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে । যেখানে মানুষ একবার গেলে কোনোদিন ফিরে আসে না ।

আজ সকালে টিউশনের বেতন পেয়েছি (৪,৫০০)টাকা ।বেতন পেয়েই মা এর কথাটা খুব মনে পড়ছে ।কারন ছোটকালে মা বলতো ,তুই যেদিন চাকরি করবি ,তোর প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে দিবি । তাই বেতন পেয়েই ভাবছি মা এর জন্য শাড়ি কিনতে যাবো । বাবা বেঁচে থাকতে টিউশন করার প্রয়োজন ছিল না ।বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন ।যা বেতন পেতেন আমাদের সংসার খুব ভালো ভাবে চলে যেতো । আসলে বাবা আমাকে টিউশন করতে দিতো না ।বলতো আমি বেঁচে থাকতে তোর টিউশন করার দরকার নাই ।তোর বাবা এতোটাও অপদার্থ না ,যে তার সন্তান কে পড়াতে পারবে না ।

টাকা হাতে পেয়েই নিউমার্কেট এ গেলাম ।মা এর জন্য একটা শাড়ি কিনবো বলে । অনেক দোকান ঘোরাঘুরি করে একটা শাড়ি কিনলাম । আর ছোট বোনের জন্য একটা জামা । মোট ৪০০০ টাকা লাগলো । এখন ও আমার কাছে ৫০০ টাকা আছে। অনেক খুশি লাগছে ,এই প্রথম মা আর বোনের জন্য কিছু কিনলাম। নিউমার্কেট থেকে বাইরে এসে, বাসের জন্য অপেক্ষা করছি । প্রায় ৩০মিনিট পরে একটি বাস আসলো ,বাসে প্রচন্ড ভিড় । হাতে দুইটা প্যাকেট নিয়ে ,খুব কষ্টে বাসে উঠলাম । বাসে ছিট পাওয়াতো দূরের কথা ,মানুষের ভিড়ে নিঃশ্বাসটাও নিতে পারছি না ।

প্যাকেট দুইটা নিজের বুকে আগলে রেখে ঝুলতে ঝুলতে চলে আসলাম আমার গন্তব্য স্থানে । মেসে এসে হঠাৎ মনে হলো ,কেবল তো মাসের শুরু ।যা টাকা পেয়েছিলাম সব শেষ হয়ে গেলো ।পুরোটা মাস চলবে কি করে । এখন খুব টেনশন হচ্ছে । আল্লাহ ভরসা ,পরের কথা পরে ভাবা যাবে ।খেয়ে নিই আগে ,সকাল থেকে শুধু এক কাপ চা ছাড়া কিছুই খায় নাই । খাওয়া শেষ করে যাবো ট্রেনের টিকিট কাটতে । বাড়ি যেতে হবে । মা আর বোন গ্রামে থাকে ।তাদের সাথে দেখা করতে যাবো। চলে গেলাম টিকিট কাউন্টারে ।

কিন্তু আমার কপাল খারাপ ,আগামী কাল এর জন্য কোনো টিকিট পেলাম না ।আর বাসে যাওয়ার সামর্থ আমার নাই।
তাই ঠিক করলাম আজকেই যাবো রাতের লোকাল ট্রেনে । তাড়াতাড়ি মেসে গিয়ে জামাকাপড় গুছিয়ে নিলাম । বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম স্টেশনে । রাত ১১টাই ট্রেন । স্টেশনে এসে দেখি ৯:৫৫ বাজে । অনেক খুশি লাগছে ।মা আর বোনের সাথে দেখা হবে তাই । ঈশ আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দুই এক ফোটা পানি বেড়িয়ে গেলো । স্টেশনে একটা বেঞ্চ দেখতে পেয়ে ওইখানে বসে পড়লাম । কিছুক্ষণ পড়ে আমার পাশে একটা লোক এসে বসলো ।

–ভাই কোথায় যাবেন ?(লোকটা)
–জি খুলনা ।আপনি ?(আমি)
–আমি কুষ্টিয়া ।(লোকটি)
–নাম কি আপনার ?(আমি)
–জয় ।(লোকটি)

এই ভাবে আমাদের কথার শুরু হয় । লোকটা খুব সুন্দর করে কথা বলে ।তার সাথে খুব তাড়াতাড়িই ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো।যাক গল্প করার একটা মানুষ পেলাম ।

রাত ১১:৩০ এখনও ট্রেন আসে নাই । আর ভালো লাগছে না ,বসে থাকতে । আজ যদি আমার টাকা থাকতো তাহলে এই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না । আমি মা আর বোন আজ একসাথে থাকিতে পারতাম । আমি খুব তাড়াতাড়িই একটা চাকরি খুজে নেবো ,আর সবাই কে আমার কাছে রাখবো ।কাও কে আর গ্রামে থাকতে দিবো না। ১১:৫৫ দিকে ট্রেন আসলো । ট্রেনে উঠে দেখি ট্রেনে তেমন একটা ভিড় নাই । দেখে খুব ভালো লাগলো ,যাক বসে যাওয়া যাবে ।

আমি আর জয়ভাই একসাথেই বসলাম । ট্রেন চলতে শুরু করেছে ,ঝিক ঝিক ঝিক । ট্রেনে উঠতে আমার অনেক ভালো লাগে ।আর সিট যদি হয় জানালার মুখে তাহলে তো কোন কথায় নাই । জানালার বাতাসটা মনটাকে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে থাকলাম । সারাদিনে অনেক ছোটাছুটি করেছি তাই খুব ক্লান্ত লাগছে । জানিনা কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ পরে কিছু মানুষের গুনগুন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম জয়ভাই ও কিছু মানুষ মুখে মুখোস পড়ছে  এবং সবার হাতে বন্দুক । হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়লো সাধারণ মানুষের উপর । ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো

–যার-যার কাছে যা আছে সব নিজে থেকেই দিয়ে দিন ।

আমাদের কে জোর করে নিতে বাধ্য করিবেন না ,তাহলে ফল ভালো হবে না । তারা যে কতোটা খারাপ নিজের চোখে না দেখলে বলে বুঝানো যাবে না । একটি মধ্যে বয়স্কা মহিলা ,তার কানের দুলটা নিতে না চাওয়াই কানটা ছিড়ে ফেললো ।মানুষ রূপে জানোয়ার গুলো ।
এক বৃদ্ধা তার চিকিৎসার জন্য ,কিছু টাকা জমিয়ে ,যাচ্ছিল ডাক্তার এর কাছে। বৃদ্ধার বউ আর ছেলে ওদের পা ধরে টাকাটা না নেওয়ার অনুরোধ করাতে ,বন্দুকের গুলিতে মাথাটা ফাটিয়ে দিলো ।

এই বার সবাই ভিতরে ভয়টা বাড়তে লাগলো ।যার-যার কাছে যা-যা ছিল সবাই সব কিছু দিয়ে দিলো। সেই দৃশ্য দেখে ,আমি আমার মা বোনের জন্য কেনা কাপড় গুলোর বেগটা নিজের বুকে আকরে ধরে রাখিলাম। ওদের একজন আমাকে দেখে ভাবলো বেগে হয়তো মহা মূল্যবান ধনসম্পদ রয়েছে । আমার হাত থেকে বেগটা জোড় করে নিতে চাইলো ,আমি দিতে রাজি না হওয়ায় ,বন্দুক দিয়ে মাথায় একটা জোড়ালো আঘাত করলো। মাথা দিয়ে রক্ত বাইর হচ্ছে । আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম।

–জয় ভাই ,জয় ভাই ,শুনছেন ?

আপনার বন্ধুদের বলেন না আমার বেগটা ফিরিয়ে দিতে ।বেগে কিছু নাই ভাই ,শুধু মা এর জন্য একটা শাড়ি আছে।
প্রথমে দিতে রাজি না হলেও আমার অনুরোধ এ ,ওদের একজন বললো বেগটা খুলে দেখতো বেগে কি আছে ? একজন বেগ খুলে দেখলো আমি সত্যি কথায় বলছি । তারপর বেগটা আমার হাতে দিয়ে বললো যা ।সাথে রহস্যময় একটা হাসি ।

বেগটা হাতে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়ে নিজের ছিটে বসতে আসছিলাম । তখনই বন্দুক এর গুলিতে মাথাটা ফাটিয়ে দিলো আমার । আমার অপরাধ আমি জয় নামক জানোয়ার টাকে চিনি ।ওরা ভেবেছিল আমি বেঁচে থাকিলে,আমার সাহায্যে জয় এর ছবি পুলিশ একে নিবে । শেষ হয়ে গেলো আমার স্বপ্ন । মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা আর মা এর হাতে দিতে পারিলাম না । বাবার মৃত্যুর ২মাস ১৩ দিনের মাথায় আমিও চলে গেলাম অজানা মৃত্যুপুরির দেশে ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত