অনিকেতের ঘুম থেকে উঠতে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে আজ,এই হচ্ছে ওর এক বদ অভ্যেস,যেদিন তাড়া থাকবে ওঠার সেদিন ঘুম ভাঙতেই চায়না।কতো কাজ আজ ওর,প্রথমে মেসের কাকুকে মাসিক ভাড়াটা দেবে, তারপর যেতে হবে সেই কলেজ স্কোয়ার,সেখান থেকে শিয়ালদহ,বাড়ি যাবে আজ সে।কতোদিন পর যাবে ও ওর প্রিয়, ছোট্ট শহর শান্তিপুরে।
রাহী কোনোদিন খুব একটা সাজগোজ পছন্দ করে না, আর সাজগোজের দরকারও পড়ে না খুব বেশি।কারণ ওর বাদামি চোখে যে একটা অন্য মায়া আছে সেটা ওউ জানে খুব ভালো করে, তার ওপর মোমের মতো গায়ের রঙ এক অন্য আভা তৈরি করে রেখেছে ওকে জুড়ে।স্নান করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখছিল সে।আর হালকা হেসে উঠেছিল এসব ভেবেই।তবুও অহংকার নেই মেয়েটার একেবারেই, মিশতে ভালোবাসে সবার সাথে কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখেই।এসব ভাবতে ভাবতে বৈশাখী ডাকলো ওকে, দিদি চা,টোস্ট খেয়ে তারপর বেরোবে।হুম,পিজি থেকে রাহীও যাবে আজ ওর বাড়ি।
কলেজ স্কোয়ারে আজ অনি সুলগ্নার কাছ থেকে খাতাটা নিতে এসেছিল।খুব ভালো বন্ধু সুলগ্না ওর,তবে আজকাল বন্ধুমহলে অনি শুনেছে সুলগ্না নাকি বলেছে অনির সাথে ওর সম্পর্ক আছে, এটা শুনে প্রথমে খুব রেগে গেলেও নিজেকে শান্ত করেছিল অনি।
সুলগ্না খুব একটা খারাপ মেয়ে না জানে ও,তবে সবাইকে ভালোবাসা যায় না, ভালো দেখতে হলেই তাকে ভালোবাসতে হবে এরকম ভাবনা কোনোদিনই আসেনা অনির।
আজ সুলগ্না এসেছিল একেবারে অন্যভাবে,স্লিভলেস ব্লাউজ, হালকা গোলাপি শাড়ি, লিপস্টিক, টিপ পড়ে, যেন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ডেটিং এ যাচ্ছে, গেট দিয়ে সুলগ্না যখন ঢুকছিল তখনই দেখেছিল ওকে অনি,তারপর ওকে না দেখার ভান করে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ও। ভেতরে ভেতরে নিজেই রেগে গেছিল, সাতসকালে এভাবে কেউ কাউকে স্যারের বাড়ির নোটের খাতা দিতে আসে??
যতসব অদ্ভুত লোকজন।
অকারণে কেউ উগ্র সাজুক অনির সেটা কোনোদিন ভালো লাগে না,আজও লাগলো না।
এসব ভাবছে হঠাৎ করে পেছন থেকে হালকা ভাবে দুটো নরম হাত জড়িয়ে ধরলো ওকে,তৎক্ষণাৎ ছিটকে এলো অনি,”কি করছিস এসব তুই??পাগল হয়ে গেছিস লগ্না?
সুলগ্না যেন হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলো অনির ওপর,”কেন,কেন শুনি??হুম পাগল হয়েছি,তোর জন্য পাগল হয়েছি,তুই কি কিছুই বুঝিসনা?
অনি হালকা করে হাসলো,বললো লগ্না মানুষের ভালোবাসাটা দুদিনের নয়,তুই আমার বন্ধু, জাস্ট বন্ধু, এর থেকে বেশি কিচ্ছু না, আর আমি তোকে সেই রূপে কোনোদিন মেনেও নিতে পারবো না, আর তারওপর অর্ঘ্যর সাথে তোর সম্পর্ক জাস্ট একমাস হলো শেষ হয়নি, আর তারপর থেকেই তুই আমাকে ভালোবাসতে শুরু করলি?এটা মেনে নিতে হবে বলছিস?যে মেয়েটা দুবছরের একটা সম্পর্ক এক মুহূর্তে ভেঙে ফেলতে পারে, সে এভাবে ভালোবাসতে পারেনা, আসলে তুই এখন আমাকে কাছে টেনে নিয়ে অর্ঘ্যকে জেলাস করাতে চাস,এর থেকে বেশি কিছু না, আর তোর হাতের পাপেট হতে অনিকেত বোস কোনোদিন রাজি হতো না সেটা হয়তো তোর বোঝা উচিৎ ছিল।
মনের কথাটা অনি বুঝে ফেলেছিল বলেই মনে হয় লগ্নার ওই দুধে আলতা মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাসে মেরে গেছিল।খাতাটা নিয়ে অনি বললো, ভালো থাকিস, অর্ঘ্য ভালো ছেলে, পারলে সম্পর্কটা ঠিক করে নিস,চললাম।
উফফ,একেতেই ট্রেন ধরার তাড়া, তার ওপর এই ছেলেটার ফোন, কতোবার বারণ করেছিলাম ফোন করবিনা, তাও বারবার ফোন করবে ছেলেটা।ফোনটা আজ ধরলো ও,ওপার থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,কিরে ফোন করলে ফোনটা কি ধরা যায় না??শান্ত গলায় সংযমী হয়ে উত্তর দিলো রাহী না, ধরা যায় না।ওপার থেকে যেন এক তীব্র খোঁচা এলো,আমি ভালোবাসি রে তোকে, ব্রেকআপ করে নিলি সোভনের সাথে,দেখলি তো কেমন খারাপ ছেলে ও,এরপরেও আমি দেখ বসে আছি তোর জন্য, আয় রাহী আয় আমার কাছে, ভালো রাখবো তোকে খুব।
মাথাটা এবার যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে যাবে রাহীর,এসব কি বলছে অঙ্কিত ওকে।টুয়েল্ভ পর্যন্ত পড়াকালীন ভালো বন্ধু ছিল অঙ্কিত, তারপর ভালোবাসার কথা বললে রাহী ওকে না করে দিয়েছিল, বন্ধুত্বটা ছিল তবুও, তারপর হঠাৎ মাঝ থেকে সোভনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল রাহী, যেটা ওর জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল,আজ বোঝে ও।দুমাস হয়তো একটা ইনফ্লাচুয়েশনে ভুগেছিল,ভালো কোনোদিনই বাসেনি সোভনকে।
ও মাথাটা ঠাণ্ডা করলো,অঙ্কিতকে খুব কাটা কাটা ভাবে বললো, লিসেন অঙ্কিত আমি রাহী চৌধুরী, কারো অপশনের ওপর ডিপেন্ড করতে হবে এটা ভাবিসনা,সোভন আমার লাইফের একটা ভুল ছিল, এরকম ভুল হয়তো সবার লাইফেই ঘটে, যেটা পরবর্তীতে মানুষ চিনতে সাহায্য করে, আর তোকে আগেও বলেছি আর এখনো বলছি জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না, আর সেটা কোনোদিন তুই পাবিনা, কারণ আমি তোকে ভালোবাসিনি এক মুহূর্তের জন্যও,অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম বন্ধুত্বটা নষ্ট না করার জন্য, কিন্তু আর পারলাম না, সরি টু সে,তোকে ব্লক করতে বাধ্য হলাম, ভালো থাকিস।
এতোগুলো কথা একসাথে রাহী কোনোদিন বলতে পারবে ভাবতেই পারেনি, কিছুক্ষণ চুপ করে নিজের খাটে বসে পড়লো রাহী।না, আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর,তাও অঙ্কিতকে ব্লক করে ওর যেন খুব একটা শান্তি অনুভব হচ্ছে, কেন হচ্ছে জানে না ও নিজেও।তবে এতো কিছুর পরেও ওর বিশ্বাস একজন ঠিক আছে এই পৃথিবীতে যে ওর সবটা বুঝে নিয়ে আগলে ধরবে ওকে, সামলে দেবে সবটা,এই কথাটা ভেবেই যেন মুখটা হাল্কা লাল হলো লজ্জায়।পুরোনো অঘটন গুলো বহুদিন আগেই পেছনে ফেলে এসেছে ও,আজ যেন তার সমাপ্তি হলো।
কলেজ স্কোয়ারে ওই ঘটনার পর থেকে মুখটা কেমন তেঁতো হয়ে উঠেছিল অনির,তখন খিদে পেলেও কিছু খায়নি ও,তবে শিয়ালদহ ঢুকতে ঢুকতে পেটে ছুঁচো দৌড়াতে শুরু করলো ওর,এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশেই আরামবাগ চিকেনের সামনে এসে দেখলো একটা সাদা কুর্তি পড়া মেয়ে টাইমটেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে, মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল অনির,ওর দিকে যখন মেয়েটা ফিরলো তখন অনি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেছিল মেয়েটার চোখদুটো দেখে,বাদামি দুটো নরম চোখ, ওর ভেতরে দ্বিধাহীন ভাবে হারিয়ে যাওয়া যায় কোনো কারণ ছাড়াই, কিন্তু কেন হচ্ছে ওর এরকম, হঠাৎ করে কেন একঝাঁক চড়ুই বুকের ভেতর ছটফট করে উঠছে, কেন মনে হচ্ছে যেন শিয়ালদহর মতো ব্যাস্ততম স্টেশনেও আজ কেউ নেই ওরা দুজন ছাড়া,অনেক মেয়ের সাথে তো অনি মিশেছে,আলাপ হয়েছে বিভিন্ন সুত্রে,সকলে ভালো বন্ধু হয়েছে অনির কিন্তু এরকম তো হয়নি কোনোদিন, তবে আজ কেন! কিছুতেই বুঝতে পারলো না ও,হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলো,ইসস,কতোক্ষণ ধরে ঢ্যাব ঢ্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটির দিকে, কি মনে করলো কে জানে! কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলো শান্তিপুর?
মেয়েটা অবাক করে বললো অনিকেতদা না? সর্বনাশ, একে রামে রক্ষে নেই সুগ্রিব দোসর! মেয়েটা যে আমার নাম পর্যন্ত জানে।আরও লজ্জায় পড়ে গেলো ও।
হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো পিৎজা খাওয়া হয় তো?মেয়েটা বললো হ্যাঁ,কিন্তু কেন বলো তো!!কথা না বাড়িয়ে দোকানটা থেকে দুটো ছোটো পিৎজা অর্ডার করলো অনিকেত,হঠাৎ মেয়েটা কেমন হাত টাত নাড়িয়ে বলতে গেল,”না মানে আমি তো খেয়ে, মানে….”
অনিকেতের খুব হাসি পেলো,বড্ডো ছেলেমানুষ তো মেয়েটা,বললো, মানে মানে না করে খেয়ে নাও,এইটুকু একটা ছোট্ট জিনিস খেলে কিচ্ছু হবে না।
মাথাটা হাল্কা উঁচু করে মেয়েটা শুধু বলেছিল আচ্ছা।
আবার দেখেছিল অনি সেই দুটো চোখ,তখনই মনের ভেতর থেকে একটা চড়ুই পাখি যেন বলে উঠেছিল ওই মেয়েটা তোর,একে ছাড়িসনা,এ তোর জন্যই এসেছে।অনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলো,একেই কি বলে লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট!!
রাহী যখন স্টেশন পৌঁছলো,তখন ট্রেনের বেশ কিছুক্ষণ দেরি, তাই ওই একনম্বর প্ল্যাটফর্মের ওখানে দাঁড়িয়েছিল,হঠাৎ একটা ছেলে ওর প্রায় পাশে এসে দাঁড়ালো,পড়নে নীল সার্ট,হাতে ঘড়ি, রিমলেস চশমা, হাল্কা দাড়ি,চেনা চেনা লাগলো,মনে পড়লো এটা তো অনিকেত দা,বেশ সুন্দর লেখে দাদাটা,অনেক মনের কথা খুব সহজে যেন লিখে ফেলে।নিজে থেকে কথা বলেনি ও,ছেলেটা নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল ওকে,”শান্তিপুর?”!
তারপর, তারপর তারা জেনেছিল কিভাবে তাদের একে ওপরকে চেনা লেগেছিল, একসাথে ফিরেছিল শান্তিপুর পর্যন্ত।
কি গল্প মনে হলো? মনে হতেই পারে,কিন্তু এ তো আমার, তোমার, আমাদের সবার গল্প সকলের গল্প
তবে বলি,নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে,সেই দিনের পর ছটা বছর পেরিয়ে গেছে,
সোভন ওর প্রথম ভালোবাসা তোশনার কাছে ফিরে গেছিল,ওরা এখন থাকে পুনেতে,অঙ্কিত খুব কম বয়সে বিয়ে করে বাবার ব্যাবসা দেখাশোনা করছে,ও এখন এক সন্তানের বাবা,অর্ঘ্য বিয়ে করেনি,ও এখন নিজেদের কোম্পানির কাজে আমেরিকা আছে, সুলগ্না ওদেরই আর এক বন্ধু সায়নের সাথে রিলেশনে,আর সেই শিয়ালদহ স্টেশন এ দেখা বাদামী দুটো চোখ আজও অনিকেতের চোখেই আছে।
সেই দিনের পর,বেশ কিছুমাস কেটে যায়, দুজনেই দুজনের দিকে প্রতিটা মুহূর্তে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, বুঝতে পেরেছিল নিজেরাই,যে এই হাত ছেড়ে দেওয়া যায় না,এই হাত সারাটা জীবন ধরে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছে।
ভালোবাসা হয়তো এভাবেই গড়ে ওঠে, ধিরে ধিরে,প্রতি কণা বিশ্বাসের মাধ্যমেই….
যাক,এবার মূল কথায় আসা যাক,আগামী ডিসেম্বর অনিকেত আর রাহীর বিয়ে, সেই শিয়ালদহ স্টেশনের লাভস্টোরি,ভাবা যায় মশাই।
বিয়েতে সকলের আমন্ত্রণ থাকলো কিন্তু। ওদের আশীর্বাদ করতে আসছেন তো?