বাড়ায়ে দুই হাত

বাড়ায়ে দুই হাত

রোদের পারার পরিমাপ দেখাচ্ছে- ৪০ডিগ্রি। ধোঁয়া ওঠা রাস্তার ব্যাখ্যা এতদিন বইতে পড়েছিলাম-আজ চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল। পথচারীরা চোখ- মুখ বেঁধে তালিবানি কায়দায় যাতায়াত করছেন দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু’ ফুলঝোরের’ এই বেসরকারি কলেজের সামনে উদগ্রীব মুখে অপেক্ষারত অভিভাবকবৃন্দ যেন ভয়ঙ্কর দাবদাহে দগ্ধ করে দেবার জন্য বদ্ধপরিকর প্রকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ! আকুল নয়নে তারা কলেজ গেটের সামনে অপেক্ষমান। সর্বভারতীয় স্তরের ‘মেডিকেল- এন্ট্রান্স’ পরীক্ষা চলছে ভেতরে। ‌

শেষ হতে আরও মিনিট দশেক বাকি।
প্রতিটি অপেক্ষমান মুখ উদ্বেগে ব্যাকুল। গাড়ি -বাড়ি -ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স- সামাজিক কৌলিন্য -অথবা অসহায় দৈনতা- সব মিলেমিশে একাকার! প্রত্যেকের এখন একটাই ‘স্ট্যাটাস’ এ মুহূর্তে! সন্তানের সামগ্রিক মঙ্গল কামনার প্রার্থনার পুঁজি নিয়ে প্রত্যেক অভিভাবক বাড়িয়ে রেখেছেন তাদের সহমর্মিতার, স্নেহের আর ভরসা যোগানো দুটি হাত। এই মুহূর্তে প্রত্যেকেরই একটাই পরিচয়। তারা উদ্বিগ্ন বাবা মা।

পরীক্ষা যেমনই হোক, সুযোগ পাওয়ার সম্ভবনা থাকুক বা না থাকুক, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চাবিকাঠির সুলুক-সন্ধান আজকের মেধা অন্বেষণ পরীক্ষাটি এনে দিক বা না দিক – সন্তানের জন্য উদগ্রীব, ব্যাকুল হয়ে বাবা মায়েদের অপেক্ষার এহেন সুরটুকু নিখাদ, অকৃত্রিম!

বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে আজ এক ছাত্রের আত্মহত্যা ও তার নিগূঢ় কারণ নিয়ে উত্তেজক প্রতিবেদনটি বেরিয়েছে। এই তিন ঘন্টা ধরে অপেক্ষমান বাবা-মায়েরা চেনা -অচেনার গণ্ডি অতিক্রম করে নিজেদের মধ্যে বারে বারে লিপ্ত হয়েছেন ‘ঐ’ ঘটনাটি নিয়ে আলোচনায়! শিহরিত হয়েছেন, শংকিত হয়েছেন,আনমনা হয়েছেন!ঐ তো ফাইনাল বেল্ পরার আওয়াজ হলো! একে একে বেরিয়ে আসছে ‘ওরা!’এপাশ থেকে ওপাশ থেকে নানা নাম ধরে নানা ডাক ছিটকে আসছে। কত রকম যে স্নেহের সুর শোনা যাচ্ছে!

-“কোন সকালে দুটো বিস্কুট জল খেয়ে এসেছিস বাবা। গোপাল আমার এখনই মিষ্টি দুটো খেয়ে জলটা খাও। তারপর বাস ধরব।”

-“মুখটা মুছে ফেল সোনা। কত ঘেমেছিস! আইসক্রিম খাবি? না ,না আমি খাব না। তুমি খাও মামন, এতক্ষণ পরীক্ষা দিয়ে এসেছো কষ্ট করে।” কথাগুলো বলতে বলতে আড়চোখে দেখা হয়ে যায় আইসক্রিমের গাড়িটা। এই গরমে খেলে হত একটা! থাক মেয়েটাই খাক। নিজে খেলে আবার অতিরিক্ত খরচা!

ক্রমশ পাতলা হয়ে যেতে থাকে ভিড়। বাবি, বাবু, সোনা , মামণি – আদরের ডাকনামেরা তাদের আদর করার মানুষদের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের স্পর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে ‘গন্তব্যের’ দিকে!

বাইরের এবং ভেতরের প্রকৃতি আর মানুষের উষ্ণতা আর ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে…! সূর্যদেব ও যেন খানিক অবাক হয়ে ভাবতে বসেন – ‘কোনটা বেশি উষ্ণ? আমার প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন – নাকি সন্তান স্নেহে ব্যাকুল, সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিজেকে ভুলে গিয়ে আকুল হয়ে দুটো পরম আশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এইসব অভিভাবকদের নিখাদ ভালোবাসার উষ্ণ উত্তাপ…!

বাবা মায়েদের সমস্ত সত্তায় – ভিতর- বাহিরে, অন্তরে- অন্তরে সমগ্র জীবন জুড়ে এভাবেই তো থাকে সন্তানের প্রতি তাদের স্বার্থহীন অপত্য স্নেহ। নিজেদের সবটুকু দিয়ে সন্তানের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা, সন্তানকে ভালো রাখা আর জীবনের নানান ওঠাপড়া সন্তানকে আগলে রাখাই তো মা- বাবার ঐকান্তিক প্রয়াস…!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত