ঝড়ের পরে

ঝড়ের পরে

বড় হয়ে যেদিন থেকে বুঝেছিলাম, মায়ের উপর একসময় অনেক অন্যায় করেছিল বাবা, ঠাকুমা, পিসিরা … সেদিন থেকেই মাকে কত বকেছি। অভিমানী গলা ফুলিয়ে নির্বিবাদে বলেছি বারংবার ‘কেন মুখ বুজে সব সয়ে গেছো? যার যার ভবিষ্যৎ তার নিজ কর্মেই গড়ে ওঠে। আমারও তাই হত। তার জন্য তুমি এই অবিশ্বাসী সম্পর্কগুলোর মাঝে থেকে এতোগুলো বছর ধরে বালিশ ভেজানো নোনাজলের সমুদ্রে সাঁতার কাটলে?’

আজ অবধি সেসব প্রশ্নের উত্তরে, মায়ের মুখে দূরস্থ দুচোখের চাউনিতেও কোনো ক্রোধের প্রকাশ দেখতে পাইনি। সে হয়তো তার অভিমানী মনকে কবেই গলা টিপে মেরে ফেলেছিল। মায়ের দৃষ্টির শীতল নির্বিকার নীরবতা আমায় প্রতিটাবার চুপিসারে বুঝিয়ে দিত মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে সমাজের ঠুনকো আত্মসম্মানবোধের লড়াইকে। মা বলত সবসময়, স্মরণ করবি মা সারদার বাণীকে
‘যে সয় সে রয়, যে না সয়, তার নাশ হয়’।

যে সমাজ একবেলা কোনো অসহায়কে পাত বিছিয়ে খাওয়াবে না, এক মুহূর্ত তার মাথায় আশ্বাসের হাত রাখবে না, সেই দুর্বোধ্য সমাজের অদৃশ্য রক্তচক্ষুর শাসনকে মেনে নিতে অনেক নারীকেই হয়তো এভাবে গলা টিপে মারতে হয় তার মন ও জীবনের অনেককিছুকেই। আর এই ‘অনেককিছু’ শব্দের মধ্যে মোটেই থাকে না তার মনে পোষমানা ইচ্ছাগুলো, বরং মাথা গুঁজে গিজগিজ করতে থাকে একজন মানুষ হয়ে কাছের মানুষগুলোর মধ্যে নিরাপদে বাঁচার সামান্য অধিকারবোধটুকু।

আজ বিবাহিত জীবনে নিজে সেই সমাজচক্ষুর সম্মুখীন হয়ে অনুভব করছি, সে সমাজ বনাম লড়াইটা নীরব খুনির মতো কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়ে যেকোনো মানুষের পরিচয়বোধের আবরণকে টেনে হিচড়ে উলঙ্গ করে দিতে পারে। কিছু ঘৃণ্য অসৎ মানুষের মশলামিশানো বুলির আঁচলে বাঁধা থাকে সেই সমাজের ঠিক ভুলের চাবিকাঠি। তারা সেই চাবির গোছাটাকে অলস সময়ে প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের মাঝে বসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিথ্যা শব্দের মনগড়া জাল বিছিয়ে তুলে ধরে প্রকাশ্যে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে, আজকাল সেসব মিথ্যাচারিণী চতুরদের গন্ধ কারো নাকে লাগে না। বরং উলটো যারা সঠিক পথে নির্বোধের মতো উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের প্রতিই উৎসুকভাবে উপচে পড়ে সমাজের সুযোগসন্ধানীদের ভিড়।

কথাগুলো ভাবতেই আমার মনের মধ্যে দড়ি কষাকষি করতে থাকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার রোষ আর সামাজিক অসহায়তার মিনতি। আজ কেন জানি হঠাৎ, এতো দিনে মায়ের চিন্তাভাবনার ছাঁচে অজান্তে গড়ে ওঠা সহনশীল আমিটা আমার মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বরং মনের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছে আমার প্রিয় নেতা নেতাজির বাণী ‘মিথ্যা আর অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করার মতো ঘৃণ্য কাজ আর নেই’। নার্ভের ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কলেজ বান্ধবী সুমিতার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ার পর থেকেই আমি খেয়াল করলাম, আমার মধ্যস্থ আমিটা কেমন যেন গুটি কেটে ফ্যাকাসে লার্ভা থেকে প্রতিবাদে রঙিন প্রজাপতি হয়ে উঠতে ডানা ঝাপটাতে চাইছে। ভাবতেই আঁৎকে উঠি আমি যে, একজন মা কিকরে আরেকটি মেয়েকে মা হওয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য এতোটা ডেস্পারেট হতে পারে? একনাগাড়ে নির্বিকারে তার নিজ পুত্রবধূকে ছয়মাস ধরে অ‍্যান্টিপ্রেগন্যান্সির ওষুধ দিয়ে যেতে পারে? সে কি আদৌ অনুভব করতে পারে যে, ‘মা’ শব্দের অর্থই ওলটপালট করে দিচ্ছে তার মধ্যস্থ পিশাচসুলভ মনের বিষ। সুমিতাতো ঠিকই বলছিল আমায় ‘বল অনু, এমন কাজের পর আমি আমার শাশুড়ির মধ্যে কোথায় খুঁজবো মাতৃত্বের শীতলতাকে?’

আমি খেয়াল করছিলাম, সুমিতা ওর শাশুড়ির এই আচরণ বলতে গিয়ে, যেন নিজের সঙ্গে নিজেই লড়ছিল। এক নারী হয়ে অপর নারীকে এরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করতে গিয়ে লজ্জা পাচ্ছিলো ওর শিক্ষা ও রুচিবোধ। আর ওর চোখের চাউনিগুলো আমায় যেন ধাক্কা দিয়ে বলছিল, তুইও ভেবে দেখ এবার। কি তোর করণীয়? আজ নিজের উপর হওয়া অন্যায়কে প্রমাণ করার ক্লান্তিতে ডাক্তারের কাছে একা আসছিস। কাল আরও একা হয়ে যাবে তোর যুক্তিগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আপোষগুলো। তখন কি তুইও নীরব চাউনিতেই চেয়ে থাকবি?

অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মনে মনে ভাবলাম, ঠিক করেছে সুমিতা। ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছে ওর বিবাহিত জীবনের পরিচয়কে। যে পরিচয়ে এমন ঘৃণ্য চক্রান্তের শিকার হতে হয়, সে পরিচয়ের খোলস ব্রাত্যই থাক জীবনে। কিন্তু আমি কি করব? আমার কাছে যে সুমিতার মতো ওষুধের স্ট্রিপ নেই, নেই কোনো বিশ্বাসযোগ্য স্পর্শক প্রমাণও। আমি কি করে সবাইকে বিশ্বাস করাবো যে আমি বন্ধ্যা নই। দিনের পর দিন আমার শাশুড়িমা মায়ের মন্দিরে পূজা দেওয়ার নাম করে বেড়িয়ে আমার জন্য কালা যাদু আশ্রিত কোনো এক তান্ত্রিক বাবার ওষুধ নিয়ে আসে। যাতে সন্তর্পণে আমার শরীর ও মানসজাত মাতৃত্ব আসতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আমি নিজে শাশুড়িকে সেই কাগজের মোড়কে রাখা গুঁড়োর মতো বিষটি আমার খাদ্যে মেশাতে দেখেছি। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে সে সত্যকে? কে বিশ্বাস করবে তিন তিনজন বড় ডাক্তারের পরামর্শে করা আমার সব টেস্টের রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও চার বছর ধরে আমি শূন্য কোলে শূন্য হৃদয়ে বসে আছি কোনো এক নীচ ঘৃণ্য চক্রান্তের শিকার হয়ে।

সবাই তো দূরস্থ, আমার স্বামীর সামনেই যে একথাগুলো তুললে চরম অবিশ্বাসী কপট চোখে চেয়ে রয় সে আমার দিকে। হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটির বিশ্বাসই যেখানে ঠুনকো, সেখানে অন্যকেউ কিকরে এক মায়ের এই রূপকে সত্যি বলে মেনে নিতে পারবে? ভাবতেই মাথাটা অস্থির হয়ে উঠল আমার। স্টেশনে উঠতে উঠতে শুনলাম গাড়ির এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে টিকিট কাটতে হবে। কিন্তু চারদিকটা কেমন যেন ঝাপসা লাগছে চোখে। মনের দোটানায় ভেসে উঠছে সিদ্ধান্তের দাঁড়িপাল্লা। তাতে একদিকে মা, আরেকদিকে সুমিতা বসে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমার স্বামী মৈনাক সেই দাঁড়িপাল্লার মূল হুকটি ধরে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলছে যেন ‘তোমার অবস্থান কোন দিকে?’ সেসময় ওর দিকে এক পলক চেয়ে ভালোবাসার প্রতি অসহায়তা আমায় দুর্বল করে দিচ্ছে মুহুর্মুহু।

এমন সময় কিছু একটা শক্ত জিনিষের আওয়াজে আমার চোখ পড়ল সামনে। দেখলাম এক অন্ধ ভিখারি ডানহাতে একটি খালি স্টিলের পুরানো গ্লাসে কটা কয়েনকে ঝাঁকিয়ে ভিক্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর আরেকহাতে একটি লাঠি নিয়ে আমার থেকে ঠিক চার পাঁচ পা আগে স্টেশনের দিকে উঠছে। তার লাঠিটি প্লাটফর্মের যেদিক দিয়ে ট্রেন আসে, সেই কোনা বরাবর ঠেকিয়ে ধরে সে সামনে এগিয়ে চলেছে। এ যেন তার কাছে বিপদ সঙ্কেত চেনানোর এক সহজ উপায়। বিপদ হতে সবাইকেই যে নিজের মতো করে পথ বাৎলে বেড়িয়ে আসতে হয়। আমি সে দৃশ্য দেখে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ, আর ভাবলাম এক অন্ধ তার অসহায়তাকে জয় করতে পারছে তার লাঠির স্পর্শ দিয়ে। তবে আমি চোখ থাকতে কেন নিজের বিপদকে দেখেও তার মধ্যে দিনের পর দিন চুপ করে শ্লথবেশ ধরে বসে আছি? ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গ যদি আমার কাছে সে বিপদের চেয়ে, সমাজের কটুক্তিকর গ্লানির চেয়েও বেশি মধুর লাগে, তবে বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটি কেন একটিবারও আমায় বিশ্বাস করে কোনো পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক নয়? আর সব বুঝেও কেন আমি এ সম্পর্ককে বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে একা লালনপালন করার দুর্বোধ্য প্রয়াস করে চলেছি? তবে কি সম্পর্কীয় মূল্যবোধটা আদৌ আমার ক্ষেত্রে সামাজিক ভীতি নাকি শুধুই অভ্যাসের দায়?

ভাবনার মাঝেই ট্রেনটা জোরে হর্ণ বাজিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিল। চমকে উঠে দেখলাম আমি সেই শারীরিকভাবে অন্ধ মানুষটির চেয়েও গভীরভাবে মানসিক অন্ধ হয়ে প্লাটফর্মের বিপজ্জনক প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশের রে-রে করে ওঠা আওয়াজে আমার সলজ্জ জ্ঞান ফিরলো তখন। ট্রেনে উঠে একটা খালি জানলা খুঁজে বসলাম একটু খোলা বাতাসের ছিটেতে নিজেকে ভেজাবো বলে। এমন সময় হঠাৎ ফোনের রিংটোনে চিন্তার টানাপোড়ন ছিঁড়ে বেড়িয়ে এলো আমার মানস জগৎ। স্ক্রিনে দেখলাম শ্বশুরবাড়ির কাজের মেয়ে মালতীর ফোন।

“হ্যালো, কি হয়েছে গো মালতী? তোমার ছেলের জ্বর বাড়ল নাকি? এমন সময় কল করলে যে?” আমার মাতৃত্বসুলভ স্বতঃস্ফূর্তভাব বেড়িয়ে এলো হুড়মুড়িয়ে।

ফোনের ওপারে তখন মালতীর আনন্দঘন কণ্ঠ “আরে নাগো বৌদিমণি। সেসব কিছু হয় নি। তোমায় একখান দারুণ খবর দেব বলে ফোন করলাম। আমি আর না দিয়ে থাকতেই পারছিলামই না।”
আমি শীতল নীরব অন্যপ্রান্তে।

“তোমায় বলেছিলাম না বৌদিমণি, একদিন ঠাকুর তোমার ডাক ঠিক শুনবে। দেখো, আজ আমার কথাটা কেমন লেগে গেল।”

মালতীর এ কথাটাতে কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলাম আমি মুহূর্তে। মনে হল বলি, মালতী থামলে কেন? বলো কি বলবে? কিন্তু সাহস করে বলতে পারলাম না … বারংবার মনের আশাগুলোর ভাঙ্গনের ভয়ে।

মালতী খিলখিলিয়ে বলে গেল “দাদাবাবু দু সপ্তাহ আগে তোমাদের বাড়িতে যে লাইটের লোক লাগিয়ে সব ঠিক করালো না, তা আসলে ক্যামেরা বসানোর জন্য গো।”

“কি?” আমার বিষ্ময়সূচক প্রশ্ন।
“হ্যাঁ গো বৌদিমণি। সেই ক্যামেরায় সব উঠেছে। তোমার শাশুড়ি তোমার খাবারে কিসব লুকিয়ে লুকিয়ে মেশাচ্ছে। কী কাণ্ড! এবার আর মিথ্যে বলবে কি? এক্কেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে। আমি বলেছিলাম না বৌদি, আমি তোমার শাশুড়িকে ওই বুড়ো বটতলার জটাজুট বাবার কাছে যেতে দেখেছিলাম। দাদাবাবু খুব রেগে গেছে। খালি মুখে বলছে, এসবে বিশ্বাস আমি কোনোদিনই করতাম না। আমায় অনু বলতো, আমি উড়িয়ে দিতাম। সেটা এই জন্য নয় যে, এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। বরং এ কারনে যে, আমার বিশ্বাস ছিল আমার মা নিজ পুত্রবধূ দূরস্থ অন্যকোরো প্রতি কখনোই এমন চিন্তা করতে পারে না। স্বপ্নেও ভাবিনি কখনো যে, তোমার এই মানসিকতাকে আমায় একদিন বিশ্বাস করতে হবে।” বলে মালতী ফোনটাকে নীরবে কিছুক্ষণ ধরে রেখে বোধ হয় স্থান পরিবর্তন করল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল “এই যে নিজেই কানেই শোনো বৌদি …।”

আমি ফোনের ওপার থেকে নিচু ভলিউমে শুনতে পেলাম আমার হৃদয় স্পন্দনের জীবন্ত কণ্ঠ। মৈনাকের কণ্ঠে ক্রোধী অভিমানী সুর … ‘ আমি জানতাম জীবনে কখনো এমন কাজ করা উচিৎ নয়, যে তাতে সে ভগবান বা নিজের সন্তানের কাছে ছোটো হয়ে যায়। আজ তুমিতো দুটোই হয়ে গেলে মা।’

তৎক্ষণাৎ ফোনটাকে বুকের মধ্যে মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। এক আকাশ হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস যেন আমায় ফিরে এসে ছেঁকে ধরলো অতর্কিতে। আমি মনে মনে প্রতিশ্রুতিশীল হলাম … যে আমার হৃদয়ের মধ্যের যন্ত্রণার বোঝা লাঘব করতে আজ একাই প্রয়াসী হয়েছিল, আমার সেই ভালোবাসা মানুষটির আজকের দিনে প্রাপ্ত এ যন্ত্রণার বোঝাকে হাল্কা করাতে আমি আপ্রাণ সচেষ্ট হব। ফোনের ওপারে শুনতে পেলাম মালতীর ভেজা কণ্ঠের শুভেচ্ছা “কেঁদোনি বৌদি। তোমায় তো বলেছিলাম, সব পাপই একদিন শেষ হয়। তাই হয়েছে। আজ তোমার জয়ের দিন।”

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত