স্বপ্ন নাকি সত্যি

স্বপ্ন নাকি সত্যি

অনেক রাতে বাড়ি ফিরছি। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলাম। এক জায়গায় এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো ওরা। এদিক থেকে বাড়ি যেতে সুবিধা হয় বলে এই ব্যবস্থা।  তো হাটছি, পথ শেষ হওয়ার নামই নেই! রাস্তাঘাটে একটা গাড়িঘোড়াও নেই। হঠাৎ এক ট্রাক এলো, এলোপাথারি চালিয়ে আরেকটু হলেই আমার উপর উঠিয়ে দিয়েছিল প্রায়। কোনোমতে সামলিয়ে রাস্তার পাশে দাড়ালাম। আবার হাটছি। বাড়ি যেয়ে দেখি দরজা লক করা নেই, তাই সাবধানে খুলে ঢুকে পড়লাম।  মাথা ঘুরছে। খাটে শরীরটা এলিয়ে দিতেই, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।  ঘুমুতে না ঘুমুতেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে! ঈশ! আর পারা যায়! এতো জার্নি করে আসলাম, তারপরও ডাকাডাকি! মাত্রই তো শুইছিলাম।

– এই ত্রয়ীর আব্বু উঠো! কয়টা বাজে হিসাব আছে? আরেহ উঠো তো!

কণ্ঠটা তো পরিচিত নয়! এ কার কণ্ঠ! আবার আমাকে ত্রয়ীর আব্বু বলছে! ত্রয়ী কে? ঘুমটা ঝটকা লাগার মতো ভেঙে গেলো। তাই মাথাটা সেই ধরেছে!

– উফফ! প্রাচী! থামবে! একটু আগেই তো ঘুমাইছি!
– একটু আগে না, কাল রাতে ঘুমাইছো। কি হইছে কি তোমার! এই কয়দিন যাবৎ এতো ঘুমাচ্ছো কেন! নেশাটেশা করো নাকি! আর প্রাচী কে হুম? নিজের বউ এর নামটাও শেষ পর্যন্ত গুলিয়ে খেয়েছো!

আমার বউ! আমি বিয়ে করলাম কবে! হায় আল্লাহ! কই আমি! প্রাচী! প্রাচী কে? আর আমি ওকে প্রাচী নামেই বা কেন ডাকলাম? এতো প্রশ্ন ঘুরতেছে কেন মাথায়! না! মাথাটা ফেটে যাচ্ছে।  চোখ কচলিয়ে ভালোভাবে তাকালাম, অপরিচিত এক মহিলা দাড়িয়ে আছে। চিনি না জানি না! সে নিজেকে আমার বউ দাবী করতেছে? আমার বয়সই বা কত! এই জানুয়ারীতে ১৯ পরবে!

– আচ্ছা তোমার নামটা যেনো কি?
– নাম তো ভুলবাই এখন! আল্লাহ! এখন আমার কি হবে! সুস্থ সবল মানুষটা এমন পাগলামি করতেছে কেন! এই সত্যি করে বলোতো, তুমি কি এদানিং কিছু খাচ্ছো টাচ্ছো নাকি!

এসব বলেই সে কি কান্না। ধুর! নামটাও জানা হলো না। হয়তো আমিই পাগল হয়ে গেছি, নাহয় স্বপ্ন দেখতেছি। ২৬ বছরের এক “খাসা” তরুনী আমার বউ হয় কি করে! হাতে একটা সেই জোড়ে চিমটি কাটলাম। না! স্বপ্নে তো না।  কখন যে বাথরুমে এসে পরেছি নিজেও জানি না। দরজা আটকিয়ে দাঁত ব্রাশ করে মুখে পানি দিচ্ছি। হঠাৎই আয়নায় একটা অপরিচিত মুখ দেখলাম! এ কে! আমি নড়ছি এ ও নড়ছে! তবে কি এটা আমার মুখ! চেহারায় কোনো মিল নেই? বয়সও আমার থেকে ৮-১০ বছর বড়!  তবে কি আমি অন্য ব্যক্তির দেহে ঢুকে গেছি! কই জানি পড়েছিলাম এমন গল্প!  বাথরুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আমার মানে বর্তমানে আমি যে, তার বউকে ডাকলাম।

– এদিকে শুনো তো।

রান্না ঘর থেকে আচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হলো আমার বউ! আরেহ মানে এই লোকটার বউ! আমার সামনে এসে আচলটা কোমড়ে গুছে নিলো। কি অপূর্ব লাগছে! ঈশ! সে যদি সত্যিই আমার বউ হতো!

– কি এমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছো কেন! কি বলবা তাড়াতাড়ি বলো, রান্না বসাইছি, পুড়ে যাবে নাহয়।
– না কিছুনা, এমনি।
– গেছে মাথাটা সিউর। এই ডাক্তার টাক্তার দেখাও তো। আর চেহারার এই অবস্থা কেন! গাঞ্জা-টাঞ্জা ধরছো নাকি! আর এখনও রেডি হও নাই? ত্রয়ীকে স্কুলে কি আমি নিয়ে যাবো? তোমার অফিস নাই?
– আস্তে আস্তে। উফফ! মায়ের মতো বকতেছো দেখি!
– হইছে। দেখো তো ত্রয়ীর কি খবর? রেডি-টেডি কিছু হইছে নাকি? তোমার মেয়েটা তোমার মতোই আইলসা হইছে।

হায় আল্লাহ! বউরা কি এমন হয়! সাক্ষাৎ দাজ্জাল! আমার লোকটার কথা ভেবে মায়া হচ্ছে, কি সবই না সহ্য করে বেচারা! ঈশ! নামটাই তো জানা হলো না। দেখি কি করা যায়। এখন আপাতত আমার মেয়ে থুক্কু ঐ লোকটার মেয়েকে খোজা যাক। ” ত্রয়ী, ত্রয়ী মামণি, মা টা কোথায় রে আমার?” ওভার অ্যাকটিং হয়ে যাচ্ছে না তো! ধুর! জানবোই বা কেমনে নিজের মেয়েকে কেমনে ডাকে! আমি তো এখনো বাচ্চা! গতকালও মা এর ডাকে ঘুম ভাঙছে, আর আজ বউয়ের ঝাড়িতে! ভাবা যায়!  যাই হোক। ত্রয়ীকে ওর মা রেডি করিয়ে দিলো। আমি আর ত্রয়ী খেতে বসলাম। মহিলাটি খেতে দিচ্ছে। মহিলাই তো! আমার থেকে নিম্নে হইলেও তো ৭ বছরের বড়! সে না কি আমার বউ! যত্তসব!

– তোমার অফিস নাই?
– আছে তো। (কিছুটা ইতস্তত করে বললাম)
– তাহলে এমন ছেলে ছোকড়ার মতো জামা কাপড় পরেছো কেন? ফর্মাল ড্রেস-আপ ছাড়া তোমাকে অফিসে না ঢুকতে দেয় না!
– ও হ্যাঁ। একদমই ভুলে গেছিলাম। আসলে হয়েছে কি, জানো তো! আজ সকাল থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না!
– সে কি! তাহলে আজ অফিসে না যাও? ত্রয়ীকে আমিই স্কুলে দিয়ে আসি। তুমি শুয়ে থাকো।
– আরেহ না না। এতোটাও খারাপ নায় অফিসে না গেলে বকবে আই মিন প্রবলেম আছে। আর সময়ও বেশি নেই , ত্রয়ীর দেড়ি হয়ে যাবে। ( এহ! দরদ উতলাইয়া আসতেছে)

খাওয়া শেষে, ফরমাল ড্রেস-আপ করে ত্রয়ীকে নিয়ে বাসার বাইরে আসলাম। ত্রয়ীর মা গেটে দাড়িয়ে আছে। বাব্বা! এতো বড় বাসা আমাদের! মাথাই নষ্ট!

– এই রিক্সা!
– বাবা, ড্রাইভার কাকুকে বলো না, তাড়াতাড়ি বের হতে। স্কুলের টাইম হয়ে গেছে।
– ড্রাইভার! আমার গাড়িও আছে নাকি! তাহলে তো সেই পিনিক মামা! গাড়ি, বাড়ি, বউ বাচ্চা। আইস শালা! একদিনেই জীবন চেঞ্জ!
– বিরবির করে কি বলছো বাবা?
– কিছু না মামণি। চলো। ড্রাইভার গাড়ি বের করো তো।(গাড়িতে)
– মামণি, তুমি কোন ক্লাশে পড়ছো এখন বলতো?
– নার্সারী।
– তোমার নাম কি বলোতো?
– তিলোত্তমা হোসেন ত্রয়ী।
– তোমার মায়ের নাম?
– নুসরাত হোসেন নিটোল।
– আর আমার নাম?
– বাবা।
– ভালো নাম?
– তানভীর হোসেন তরফদার!
– কিহ্!
– কি হলো বাবা?
– কিছু না মা। এই ড্রাইভার স্কুলের সামনে দাড়িও তো।

মেয়েটাকে স্কুলে নামিয়ে দিলাম। গেট দিয়ে ঢোকার সময় মেয়েটা পেছন ফিরে টাটা দেখিয়ে চলে গেলো। কেমন একটা বাবা বাবা অনুভূতি কাজ করছে! ধুর! এসব কি চিন্তা করছি! যাই হোক! কেমন একটা প্রাউড ফিল হচ্ছে। কেমন বুদ্ধি খাটিয়ে নামগুলো জেনে নিলাম। (আসলেই বাচ্চা আমি!)

– বাইয়া, অফিসো যাইতান ন?
– যাবো যাবো। বসে আছো কেন। গাড়ি স্টার্ট দাও।

গাড়িটা বিশাল এক বিল্ডিং এর সামনে দাড় করালো। দেখে তো মনে হচ্ছে এখানেই আমার অফিস। ভাগ্য ভালো ড্রাইভার আমার অফিস চেনে, না হয় কি বিপত্তিটাই না হতো!  গাড়ি থেকে নেমে দরজার দিকে হাটা ধরলাম। দারোয়ান উঠে দাড়িয়ে সালাম দিলো। আমিও অভ্যাসবশত সালামের উত্তর দিলাম। বিল্ডিং এর ভেতরে এমনিই ঘুরপাক খাচ্ছি! কয়তলায় আমার থুক্কু মানে এই লোকটার অফিস কে জানে! পেছনে থেকে ডাক, ” আরেহ তানভীর সাহেব যে, কতদিন পর দেখা!”

আমি তো তাকে চিনিই না! তাই হ্যাঁ হুম বলে চালিয়ে যাচ্ছি। একসময় বললো, ” চলুন অফিসে যেতে যেতে কথা বলি”
লিফ্টে উঠলাম। এতো কথা কেন বলে এ লোক! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ৯ তলায় এসে নেমে পড়লাম। অফিসে ঢুকতেই দেখি সবাই যন্ত্রের মতো কাজ করছে। আমিও খুজতে লাগলাম আমার ডেস্ক কোনটা। একটু এগুতেই দেখি আমার নামে একটা আলাদা রুমই আছে! আমি নাকি ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার! যাই হোক, শুয়ে বসে অনেকক্ষন কাটালাম। বিকালে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম ধানমন্ডি লেকে। একবার এসেছিলাম প্রাচী’র সাথে। আমার কি আর কখনো প্রাচী’র সাথে দেখা হবে? আমি কি আমার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবো! লেকে ধারে বসে এক প্যাকেট বেনসন শেষ করলাম, শেষটা খাওয়ার সময় নিটোলের ফোন। “কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, একটা খুশির খবর দেবো”  এহ! খুশিতে একদম গজগজ করছে! কি না কি বলবে! ড্রাইভারকে বললাম চলো বাসার দিকে যাই।

বাসায় কলিংবেল চাপতেই ত্রয়ী দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলেই নিজের রুমে যেয়ে পড়ার টেবিলে বসে পরলো! বাহ! খুবই ক্লান্ত লাগছে। রুমে যেয়ে খাটে বসলাম। নিটোল এসে ব্লেজারটা খুলে দিচ্ছে, আমার কেমন যেনো লজ্জা লাগছে! বললাম, কি যেন খুশির খবর বলবে? সে বলে, “তুমি কি সিগারেট খেয়ে এসেছো! তুমি না কখনো সিগারেট খাও না!”  এই সেড়েছে! আমি মানে এই লোকটা সিগারেট খায় না! কি বলে এসব।  বললাম, ” কাজের প্রেসার অনেক ছিলো, তাই একটু খেয়ে আসছি!”

– একটা খুশির খবর বলতে চাইছিলাম। তুমি তো মনটাই খারাপ করে দিলা। বলবোই না।
– আরেহ বলো না। সরি তো।
– আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসছে।
– তোমার মা তাহলে আমাদের সাথেই থাকবে এখন থেকে?
– আরেহ বোকা! তুমি আবারো বাবা হতে চলেছো।
– মানে কি!

বড় রকম একটা ধাক্কা খেলাম। আমি তো কিছু করি নি! আমি নাকি বাবা হতে চলেছি! কি বলে এসব!
তো যাই হোক, এখন আমি অনেক সিনসিয়ার হয়ে গেছি, বউকে সময় দেই, মেয়েকে কেয়ার করি, বউয়ের শখ-আহ্লাদ পূরণ করি। বলতে গেলে একদম এই মানুষটা হয়ে গেছি। আমার পুরনো জীবনটাকে এখন আর খুব বেশি মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে আমাদের একটা ছোট্ট ছেলেও চলে এলো। নাম রাখলাম মেঘ। কেনো রাখলাম জানি না। ছেলেটা একদম এই লোকটার মতো হয়েছে।

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভারও কেমন যেন উল্টাপাল্টা গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে পড়ে রইলাম। তারপর আর কিছুই মনে নেই। চোখটা খুলতে কেমন জ্বালাপোড়া করছে। তাই চোখটা বন্ধ করেই শুয়ে রইলাম। পাশে অনেক গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি। একজন বলছে, “আজ চারমাস পর আপনার ছেলে কোমা থেকে উঠছে, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন” আরেকটা কন্ঠ আমি চিনি, মায়ে কন্ঠ, ” বাবা তূর্য্য, উঠ বাবা, শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?” আরো কয়েকটা কথার মধ্যে বন্ধুদের কথাও শুনতে পেলাম। ” ঈশ! ঐদিন রাতে যদি ওকে রাস্তায় না নামিয়ে, বাসায় নামিয়ে দিয়ে যেতাম! তাহলে আজ আক এমন অবস্থা হতো না।”

এতোক্ষনে বুঝলাম আমি আমার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছি। আমি চারমাস কোমায় ছিলাম! তাহলে আমি যে আরেকজনের চরিত্রে বেঁচে আসলাম, সেটা কি ছিল? স্বপ্ন নাকি সত্যি! আমার বারবার শুধু নিটোল, ত্রয়ী আর মেঘের কথা মনে পড়ছিলো। কেমন আছে ওরা? ঐ তানভীর নামের লোকটা কি ওদের ভালো রাখবে? কয়েকদিনেই কেমন ওদের উপর মায়া পড়ে গেছে। হ্যাঁ, ঐদিন রাতে ট্যুর থেকে ফেরার পথে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করেছিলাম। আর সেই সুবাদেই আজ নাকি ৪ মাস যাবৎ হসপিটালে, কোমায় ছিলাম।

(১২ বছর পরের কথা) আমি এখন ঢাকায় থাকি। একটা প্রাইভেট ভার্সিটির প্রফেসর। এই কয় বছরে অনেক কিছু বদলেছে। আমি বদলেছি, প্রাচী আমার প্রেমিকা ছিলো এখন সে আমার বউ হয়েছে। সুখেই কাটছে। শপিং মলের বাইরে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি। এমন সময় এক পিচ্চি মেয়ে এসে, ” বাবা বাবা” বলে জামা টানতেছে। মুখটা কেমন চেনে চেনে লাগলো। পেছন পেছন ওর মা ও এসে ওকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে, ” ছাড়ো ত্রয়ী, ইনি তোমার বাবা নন।” মহিলাটিকে দেখে আর ত্রয়ী নামটা শুনে আমার কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো। আরেহ এ যে নিটোল! নিটোল বললো, “কিছু মনে করবেন না। ছোট মানুষ তো। আসলে আপনাকে অনেকটা ওর বাবার মতোই দেখায়।”
আমি বললাম, ” কোথায় আছেন উনি?”

– সে গত মাসে একটা ট্রাক এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
– অহ আই সি।
– হুম।
– মেঘ কেমন আছে?
– ভালো। কিন্তু আপনি মেঘকে চিনেন কিভাবে?

আমি আর কিছু বললাম না। চলে আসলাম সেখান থেকে। কিছু জিনিস রহস্য থাকাই ভালো। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। তবে আজও আমি ভেবে চলি, যেটা আমার সাথে ঘটেছে, সেটা আসলে কি! “স্বপ্ন নাকি সত্যি?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত